মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৯
নিরু ঝিটকা স্কুল থেকে পাশ করে বের হলো। এখন ধানমন্ডিতে বড় বোনের কাছে
থেকে লালমাটিয়া কলেজে পড়বে। বাড়ি থেকে এই
সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিরুর বাবা, বড় বোন আর নিশাতের
দাদি আর মা একসাথে ঢাকা আসছিল। গাড়িতে
নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন পরে এই প্রথম নিশাত একটু অবাক হলো। এইতো এই চোখ
আমি খুঁজছিলাম এতদিন! নিরু বড় হবার পর এত কাছে থেকে নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি
এতদিনেও। আজ কাছে পেয়ে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এতদিন এই চোখ কোথায় ছিল?
যে চোখে প্রশান্ত মহা সাগরের গভীরতা! যে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেয়া যায়
সারাটা জীবন! অবাক হয়ে চেয়ে ছিল পলক হীন। মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে মানুষের
ঋতু পরিবর্তনের সাথে তার মনের অনেক পরিবর্তন হয়। নিশাত এতদিন যেমন ছিল আজ আর
তেমনটি নেই। আজ সে চাকরী নিয়ে লন্ডনের যাত্রী। নিরুকে এতদিন মনে মনে ভাল লাগলেও তা
কেমন করে যেন কিসে চাপা পড়ে ছিল কিন্তু আজ সে লন্ডনের যাত্রী বলে তার দৃষ্টি ভঙ্গি
বদলে গেছে। সে নিরুর চোখের চাওনি বা চোখের গভীরতা নিরূপণ করতে পারছে। মানিকগঞ্জে
এসে গাড়ি থামিয়ে কিছু খাবার আর বীণা আপার ছোট বাচ্চার জন্য কি যেন কিনতে হবে বলে
বীণা আপা গাড়ি থামতে বলল। নিশাতের মা নিশাতকে পাঠাল, বীণা আপাও বলল নিরু তুই যা ওর
সাথে ও চিনতে পারবে না। এমন কি আনবে যে
নিশাত চিনে আনতে পারবে না! যে কিনা মাত্র কয়েকদিন পরে একা একা লন্ডন যাচ্ছে সেই
ছেলে আনতে পারবে না? নিশাতও নিষেধ করল না। সাথে নিরু আসছে
বলে কোন প্রতিবাদ করেনি। নবীন সিনেমা হলের পাশে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আর গাড়ির সবাই
নেমে একটু হাত পায়ের জড়তা ছাড়াচ্ছিল। ওরা রাস্তা পার হয়ে গড়পাড়া মিষ্টান্ন
ভাণ্ডারের কাছে যেতেই একটা মোটর সাইকেল হুট করে নিশাতের পাশে এসে ব্রেক করল। আরোহী
পিছন থেকে নিশাতের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল
এই বাঙালি, কোথায় যাচ্ছিস?
নিশাত দাঁড়িয়ে পড়ল, নিশাতকে দেখে নিরুও দাঁড়াল। নিরুকে দেখে মটর বাইকের
আরোহী নোমান বলল
কিরে তুই বিয়ে করলি কবে?
বিয়ে! কি বলছিস?
ফিসফিস করে বলল তাহলে এ কে?
এই চুপ! আস্তে করে বলল, সর্বনাশ করে ফেলেছিস! এ হলো শিহাবের ছোট বোন নিরু, ও লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবার জন্য ঢাকা যাচ্ছে, ঐযে গাড়িতে সবাই আছে, আমরা কিছু কেনার জন্য নেমেছি
নোমান ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল সরি দোস্ত, কিছু মনে করিস না
না কি মনে করব! মনে মনে ভাবল তোর কথা
যেন সত্যি হয়!
নোমানকে দেখিয়ে বলল নিরু এ আমাদের বন্ধু
নোমান, শিহাব চেনে
নিরু নোমানকে সালাম দিয়ে বলল ভাই আপনার
বাড়ি গোপীনাথপুর না?
হ্যাঁ, তুমি আমাকে চেন?
খুব ভাল করেই চিনি, আপনি ঊর্মির ভাই না? আমি ঊর্মির সাথেই পড়েছি, ও কোথায়
ভর্তি হবে ভাইয়া?
ও এখানেই দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে
ও আচ্ছা, আমার কথা বলবেন,
আমি ঢাকা যাচ্ছি, বড় আপার কাছে থাকব
নিশাতের লন্ডন যাবার ঘটনা নিয়ে নোমান
আরও কিছু আলাপ করে নিশাতের লন্ডন যাত্রা আর জাহাজে চাকরীর কথা জেনে খুশী হয়ে বিদায়
নিল।
নোমানকে বিদায় দিয়ে নিশাত বলল শুনেছ ও
কি বলেছে?
নিরুর মুখ লাল হয়ে গেল, মাথা নিচু করে দাড়িয়েই রইল
মনে মনে ভাবল এ আবার কেমন মানুষ! এমন
কথা কাউকে বলা যায়? না জেনে সে না হয় ভুল করেই ফেলেছ তাই
বলে............।
আচ্ছা দাড়াতে হবে না চলো
এইতো নোমানের এই কথায় মনে হয় এতদিনে ওরা
দুই জনে মন দেয়া নেয়ার চিরাচরিত মহান কাজটা ওদের অজান্তে একান্ত নীরবে সেরেই ফেলল
তবে নিরু এখনও বুঝতে পেরেছে কি না সে একটা সংশয় হয়ে রইল। সেদিন একটা বেকারিতে
খাবার কিনতে কিনতে নিরুই প্রথম কথা বলল,
তাহলে আপনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ
আবার কবে ফিরবেন?
নয় মাস পরে, ফিরে আসলে আমাকে চিনতে পারবে?
পারব, আপনাকে এত দিন ধরে চিনি, এই কয় দিনেই
ভুলে যাব? কি যে বলেন না!
আর সাধারণ কিছু টুকিটাকি কথাবার্তা
হয়েছিল। সেদিন বেশি কিছু বলার সময় পায়নি বা সুযোগও হয়নি। সময় পেয়েছিল ঢাকায় যাবার
পরে।
৫।
ঢাকায় পৌঁছে নিশাতদের বাড়ির পাশে ওদের
নামিয়ে দিয়ে বীণা আপা নিরু আর চাচাকে নিয়ে চলে গেল। রাস্তায় চাচা নানা কথা জিজ্ঞেস
করছিল কি চাকরী কেমন করে কোথায় থাকবে ইত্যাদি নানা কিছু। চাচা বেশ খুশি হয়েই
বলেছিল যাক বাবা আমাদের গ্রামের মধ্যে তুমিই প্রথম লন্ডন যাচ্ছ কাজেই বাবার মান
সম্মানের দিকে খেয়াল রেখো। ও ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্টে বড় হয়েছে, বাবা মায়ের সুখ শান্তির দিকেও লক্ষ রেখ।
বাড়িতে পৌছার একটু পরেই হাবিব এলো।
কিরে তোকে এমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না কি
ভুল দেখছি?
না চিন্তার কি আছে, কিছু চিন্তা করছি না। বল তোর কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছিস?
হ্যাঁ আমার মোটা মুটি কমপ্লিট, তোর কত দূর?
এই তো পরশু দর্জির কাছে কাপড়ের মাপ দিয়ে
গ্রামে গিয়েছিলাম। দাদুর সাথে দেখা করে তাকে নিয়ে এইমাত্র আসলাম তবে এবার গ্রামে
যেয়ে............
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেল, মুখে আর কোন সারা নেই।
কি, গ্রামে যেয়ে কি?
না কিছু না।
না, কিছু একটা আছে তুই বলতে গিয়েও থেমে গেলি কেন?
না হাবিব কিছু না। আচ্ছা, তুই কবিতার সাথে দেখা করেছিস?
ও! বুঝেছি, তোরও এমন কেউ আছে,
এত দিন কিছু বলিসনি কেন?
আমি কি বলি আর তুই কি বলিস?
হ্যাঁ গত কাল দেখা হয়েছে, কিন্তু তোর কথা কি বল।
নারে আমার তেমন কোন কিছু নেই।
আলাপ আর তেমন এগোয়নি। মা এসে গেল।
কি হাবিব, তোমার কি অবস্থা,
সব কিছু গুছিয়েছ?
হ্যাঁ খালাম্মা।
সামনে আর মাত্র দুএক দিন বাকি। বাড়িতে
ছোট ভাই বোনেরা আনন্দে বিভোর। দাদা বিদেশে যাবে। মা এটা সেটা যা নিশাতের পছন্দ তাই
রান্না করছেন। সূর্য তার নিয়ম মত ডুবছে উঠছে। নিশাতের মনের বিষণ্ণ ভাব যাচ্ছে না।
মা দেখে ভাবলেন কোন দিন বাড়ির বাইরে থাকেনি এখন হয়ত সবাইকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে মন
খারাপ তাই এক দিন সন্ধ্যায় নিশাতকে ডেকে বোঝালেন।
কি করবে বাবা যে বয়সে আর দশটা ছেলে
বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে সেই বয়সে তোমাকে রুজির সন্ধানে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে
বলে মন খারাপ করে থেকো না। ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। মন দিয়ে কাজ
করবে, সবার সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করবে,
ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সব কথা
নিশাতের কানে কিছু ঢুকছে আর বেশির ভাগই পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। মা জানে না নিশাতের
কিসের ভাবনা।
পরদিন বিকেলে বীণা আপার বাড়িতে এলো।
যাবার আগে দেখা করে যাবার উছিলায়। নোমানের ওই কথা বারবার মনে পরছে। আবার নিরু কি
ভাবল জানা হলো না। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নিরুই দরজা খুলে দিয়েছিল।
আপনি!
হ্যাঁ আমি! চাচা কোথায়?
আমাকে ভর্তি করে দিয়ে তখনই বাবা বাড়ি
চলে গেছে
ও আচ্ছ তুমি তাহলে ভর্তি হয়েছ?
হ্যাঁ
সেদিন, এত দিন পরে নিরুর সাথে দেখা হলো কিন্তু তেমন কিছুই আলাপ হলো না।
নোমানের ওই কথার পর থেকেই মনে হতে শুরু করেছে যেন নিরু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। চোখে
মুখে কোন এক অচেনা মায়াবী ছাপ পড়েছে দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে। এত দিনের চেনা সেই
নিরু আর নেই এখন নিরুর চোখ কথা বলতে শিখেছে। চোখে ফুটে উঠেছে প্রশান্ত মহাসাগরের
অতল গভীরতার ছায়া। এত দিনের নিরু আর আজকের নিরুর মধ্যে অনেক তফাত। আজকের নিরু
পরিপূর্ণ এক নারী। তার স্বত্বায় জেগে উঠেছে নারী হৃদয়ের মমতা, প্রেম। এই নিরু কি নিশাতের জন্য অপেক্ষা করবে?
কি হলো! ভিতরে যেতে দিবে না? বলেই ঘরে ঢুকে নিরুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সোফায়
বসল। ভিতর থেকে বীণা আপা জিজ্ঞেস করল কে রে নিরু? অপ্রত্যাশিত প্রথম স্পর্শের ঘোর কাটিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ভিতরে যেতে যেতে
বলেছিল আপা নিশাত ভাই। মেয়েদের যে ষষ্ট
ইন্দ্রিয় থাকে তাই দিয়ে অনুভব করে মনে মনে ভাবছিল হঠাৎ করে এই মানুষ এমন হলো কেন? তবে যাই হোক, এই আকর্ষণে কোন ইতর ইঙ্গিত নেই, কোন লালসা নেই,
বরঞ্চ একটু কেমন যেন
নির্ভরতার ছোঁয়া আছে। দেখা যাক সামনে কি হয়!
ওকে ভিতরে নিয়ে আয়
বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে
ইশারায় বলল আপা ডাকছে
নিশাত উঠে ওর পিছে পিছে আপার সামনে
হাজির হলো। আমি কাল চিটাগাং চলে যাচ্ছি ওখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাব হয়ত
ঢাকায় আসা নাও হতে পারে আপা,
দুলাভাই কোথায়? তোর দুলাভাই এখনও আসেনি
নিরু পাশেই ছিল, সব শুনল।
তাহলে আমি ওই ঘরে বসি?
যা বয় আমি আসছি
নিরু, ওকে চা নাস্তা দে। একটু পরে কাঁপা হাতে ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে নিরু যখন
ট্রে নিয়ে বসার ঘরে এলো তখন নিরুর হাত কাপতে দেখে নিশাত উঠে ট্রেটা নামিয়ে নিচ্ছিল
কিন্তু নিরু ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাড়াতেই অন্য হাতে ওকে টেনে দাড় করিয়ে হাতের
ট্রে নামিয়ে আবার ওকে নিয়ে পাশে বসল।
পালাচ্ছিলে কেন? কাল নোমান কি বলেছিল শুননি?
আমার ভয় করছে, ছেড়ে দেন আপা দেখে ফেলবে
নিরুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবার মোটামুটি
নিশ্চিত হলো এই আকর্ষণে নিরাপত্তার অভাব নেই, নির্ভরযোগ্য। এতদিন যার অপেক্ষা করেছে এ সেই হাত।
আপা দেখল তো কি হলো? আপারও এমন দিন গেছে, সে জানে
আজই এর একটা সমাধানে পৌছাতে হবে! এ ঘরে
নিরুকে একা পেয়ে নিশাত জোর করে পাশে বসিয়ে সেই কথা কানে কানে বলছে। নিরু কি ভাবছে
সে কথা বোঝার মত ধৈর্য বা জ্ঞ্যান কোনটাই নিশাতের ছিল না। নিশাতের হাতে বাধা পড়ে
নিরু শুধু ভাবছিল এই মানুষটা হঠাৎ করে এমন পাগল হয়ে গেল কেন? যাকে সেই ছোট বেলা দেখে আসছি সেতো কোনদিন এমন ছিল
না! শান্ত সৌম্য সহজ সরল একজন সুপুরুষ কিন্তু আজ কি হলো? কাল চলে যাচ্ছে বলে?
যতক্ষণ নিশাত নিরুর হাত
ধরে রেখেছিল ততক্ষণ বারবার উঠি উঠি করছিল।
আহ! ছাড়ুনতো! আপা এসে দেখে ফেলবে!
না, তুমি বল তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না!
ছাড়ুন না! আপা দেখে ফেললে কি হবে
ভেবেছেন?
কিচ্ছু হবে না তুমি বল তুমি অপেক্ষা
করবে!
ছাড়া পাবার জন্য মুখে যা আসে নিরু তাই
বলে ফেলল,
দরকার হলে সারা জীবন আমি আপনার জন্য
অপেক্ষা করব! এবার ছাড়ুন!
আস্বস্ত হয়ে নিশাত এবার নিরুকে ছেড়ে
দিল। কোন রকম নিজেকে ছাড়িয়ে নিরু বলল
আজ কি হয়েছে আপনার, এমন ডাকাতের মত করলেন কেন? অমনিই পিছনে আপার পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে দেখে আপা পর্দা সরিয়ে
ভিতরে আসছে।
আপা, দুলাভাইয়ের আসতে দেরি হবে আমার আবার অনেক জায়গায় যেতে হবে আমি বরং উঠি
আপনি দুলাভাইকে বলবেন আমার জন্য দোয়া করতে।
আর একটু বসে দেখ
দুলাভাইকে বলা তেমন জরুরী না। নিশাতের
যা জানার তা জেনে ফেলেছে কাজেই
না আপা, আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হবে, বলেই উঠে পরল।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।