মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৯
কি ব্যাপার নিশাত ভাই খেতে এসেছেন? জাহাজের নিয়ম কিন্তু এই ডিউটির
সময়ের সাথে খাওয়া, এক দল ডিউটিতে যাবার আগে খেয়ে যায় আবার
তার পরে আর এক দল ডিউটি শেষ করে খেয়ে ঘুমাতে যায়।
ঠিক আছে সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এই এত
তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেলে রাতে ক্ষুধা লাগবে না তখন কি হবে?
কেন এই যে দেখেন এখানে ব্রেড, বাটার, জ্যাম, ডিম, দুধ সব কিছু
রয়েছে ব্রিজেও থাকে। ক্ষুধা লাগলে যা ইচ্ছা খেয়ে নিবেন, স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিতে পারেন এই যে এই ফ্রিজে টমাটো, শসা, লেটুস সব
কিছু আছে কোন নিষেধ নেই, কেউ কিচ্ছু বলবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, খাবার ব্যাপারে জাহাজে যথেষ্ট সাবধানতার সাথে খুব হিসেব করে মেনু তৈরি
করে। চিটাগাঙে আর্টিক্যাল সই করেছেন তাতে দেখেননি এক জন মানুষের দৈনিক কি পরিমাণ
এবং কোন ধরনের খাবার দিবে তা ওখানে লেখা আছে, দেখবেন এখানে এক খাবার পর পর দুই বার হবে না। প্রতি দিন ভিন্ন ভিন্ন
মেনু থাকবে। এটার দায়িত্ব সেকেন্ড অফিসারের। মুকিত ভাই কিছু বলেনি?
না, বলার সময় পেল কোথায়, অন্যান্য কথায় সময় চলে গেল।
দেখবেন আরও অনেক নিয়ম আছে জাহাজে, নেন খেয়ে নেন আপনার আবার ডিউটির সময় হয়ে গেছে।
কি রান্না হয়েছে?
এখন সবজী, মুরগী আর ডাল
আচ্ছা ওই ফিলিপিনোরা কি খাবে? ওরাও কি এই খাবে? তারপর ক্যাপ্টেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওরা?
হ্যাঁ ওরাও এই খাবে, এখানে এমন ভাবে রান্না হয় যা সবাই খেতে পারে তবে
ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য আলাদা রান্না হয়।
আচ্ছা বেশ ভালোই তো এই নিয়ম, দেন দেখি কি দিবেন, তবে এনাম ভাই আমার কাছে এই বিকেল বেলা রাতের খাবার খেতে একটু কেমন অবাক
লাগছে।
তা প্রথম প্রথম একটু লাগবেই, পরে অভ্যাস হয়ে গেলে তখন আর অসুবিধা হবে না।
খাবার খেয়ে নিশাত কেবিনে গিয়ে চিটাগাং
থেকে দেয়া ডিউটির পোশাক পড়ে ডেকে মুকিত ভাইর কাছে গেল। মুকিত ভাই ওকে দেখে বলল কি
ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি এলে?
তাড়াতাড়িই এলাম দেখি কি হচ্ছে।
বেশ ভালো কথা, হ্যাঁ সব সময় এই ভাবে পাঁচ সাত মিনিট আগে আসবে এতে অফিসাররা তোমাকে সুদৃষ্টিতে
দেখবে।
ওদের কথা বলতে বলতে চীফ অফিসার অরুণ এসে
হাজির।
কি ব্যাপার নিশাত, বল দেশের খবর কি, তখন একটু কাজ করছিলাম বলে কথা বলতে পারিনি, তোমার শরীরে বাংলাদেশের গন্ধ পাচ্ছি।
না, অরুণ’দা বাংলা দেশের গন্ধ দুবাইতে দামী
হোটেলের দামী সাবান দিয়ে গোছল করে ধুয়ে ফেলেছি।
আরে ধুর কি বল! আমি এখনও গন্ধ পাচ্ছি,
সাবান দিয়ে কি দেশের গন্ধ
ধোয়া যায়? আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশটা বুঝি এসে
পরেছে। তা বল দেখি কোন কোন ঘাট ধরে এসেছ?
নিশাত এক এক করে বলছে আর মুকিত, অরুণ ডেকের আর দুই জন শাহিন এবং জয়নুল এটা ওটা জিজ্ঞেস
করছে।
একটু পরে কথা শেষ করে মুকিত বলল তাহলে
অরুণ’দা আমি যাই? মুকিত ভাই চলে যাবার পর নিশাত অরুণ’দার সাথে ব্রিজে ঢুকল। অরুণ’দা প্রথমেই সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে,
ব্রিজ দেখেই নিশাতের খুব ভালো লেগে গেল। মন দিয়ে সব শুনছে। প্রাথমিক ভাবে দেখে যা
বোঝা যায় এক নজরে দেখে নিয়েছে। রাডার, স্টিয়ারিং
হুইল, কম্পাস, জাইরো কম্পাস, হেল্মস ইন্ডিকেটর, ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাম, ব্যারো মিটার, হাইগ্রো মিটার, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর,
ইকো সাউন্ডার, স্যাটালাইট ন্যাভিগেটর, ডেকা ন্যাভিগেটর আরও কত কি!
অরুণ’দা ব্রিজের টেবিলের পাশে কফি বার
থেকে কফি বানিয়ে কাপ হাতে নিয়ে এলো চার্ট টেবিলের কাছে। অরুণ’দা চার্ট টেবিলে একটা ম্যাপের মত মেলে কি যেন করছে
ভূগোল, ম্যাপ কেমন বুঝ?
একে বারে খারাপ না, ভূগোল আমার প্রিয় সাবজেক্ট,
তাই নাকি! বেশ ভালো হয়েছে, তাহলে ম্যাপ বুঝতে তোমার সুবিধা হবে।
টেবিলের উপর একটা ম্যাপের মত বিছানো
রয়েছে। তার পাশে কাটা কম্পাস,
দুইটা বড় স্কেলের মত এক
সাথে জোড়া লাগান রয়েছে এগুলি দেখিয়ে আবার বলল
দেখ তো এগুলি চিনতে পার কি না?
হ্যাঁ এটা একটা ম্যাপ বুঝতে পারছি এই যে
এই হচ্ছে সাগর, আর এই যে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেই
এলাকা, এই হচ্ছে ল্যাটিচুড মার্ক আর এটা
লঙ্গিচুড, আর এই পেন্সিলের লাইনটা মনে হচ্ছে
আমাদের রাস্তা, তাই না?
বাহ বেশ!, তুমি তো অনেক জান দেখছি!
তবে এই স্কেলটা এমন কেন?
এটাকে প্যারালাল রোলার বলে, দেখ এটা দিয়ে কি করি
এবার চার্ট টেবিলের পাশে উপরে দেয়ালের
সাথে লাগান ডেকা ন্যাভিগেটর কেমন যেন একটা ক্লিক ক্লিক শব্দ করছিল ওটায় কি রিডিং
দেখে রোলার দিয়ে মেপে চার্টে একটা দাগ দিয়ে বলল
এই যে আমরা এখানে আছি এখন
ও বুঝেছি এর নাম নেভিগেশন?
হ্যাঁ।
কফি শেষ হয়ে গেছে কাপ ধুয়ে রেখে দিল।
রাডার দেখে বলল
আচ্ছা এই যে সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে এগুলি
কি?
ওগুলি জাহাজ বা অন্য কিছু হতে পারে, সে তুমি লক্ষ্য করে দেখবে এই দাগ মুভ করছে কি না, যদি মুভ করে তা হলে বুঝবে এটা জাহাজ, আর যদি মুভ না করে স্থির থাকে তা হলে বুঝবে ওটা
সাগরের কোন বয়া বা কোন স্থির কিছু হবে, ওয়েল রিগও
হতে পারে, দেখ আমাদের পিছনে এই স্থল ভাগ কেমন
দেখাচ্ছে, আর সাগরের পানি কেমন দেখাচ্ছে। এখানে এই
যে এই রাডার এটার রেঞ্জ আরও বেশি। এই ইংলিশ চ্যানেলে আমরা এটা চালাই না। এখানে এই
৫০ মাইল রেঞ্জ যথেষ্ট। আর একটু কফি খাবে?
না আর না আপনি খেলে খান আমি বানিয়ে দিই?
না না আমিই বানিয়ে নিচ্ছি
কি শাহিন তুমি খাবে?
না দাদা।
ওকে আজ এই পর্যন্তই, তুমি স্টিয়ারিং করতে পারবে?
চেষ্টা করে দেখি
শাহিন ওকে একটু দাও তো।
শাহিন স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে টুল থেকে
নেমে এলো, নিশাত ওখানে বসে স্টিয়ারিং হাতে নিলো।
শাহিন বলে দিল এটা হচ্ছে হেল্মস
ইন্ডিকেটর মানে আপনার স্টিয়ারিং সোজা আছে না কোন দিকে ঘুরছে তা বুঝতে পারবেন আর এই
হচ্ছে আপনার কম্পাস। দেখেন আমাদের জাহাজের হেড এখন কত ডিগ্রিতে আছে দেখছেন?
হ্যাঁ দেখলাম,
তাহলে ঠিক এই কোর্সে রেখে চালান।
নিশাত স্টিয়ারিং করছে। অরুণ ব্রিজের
বাইরে বের হয়ে পিছনে দেখে এসে বলল তোমার স্টিয়ারিং ঠিক হচ্ছে না।
কি ভাবে বুঝলেন?
কি ভাবে বুঝলাম দেখবে এসো আমার সাথে।
ব্রিজের বাইরে এসে পিছনে প্রপেলারের
ঘূর্ণির ফলে পানিতে ফেনা উঠেছে সেদিকে দেখিয়ে বলল
দেখ কেমন জিগ জাগ দেখাচ্ছে না? কারেক্ট স্টিয়ারিং হলে এই লাইনটা সোজা হবে। এই দেখে
মিটার না দেখে যে কেউ বলতে পারবে স্টিয়ারিং কেমন হচ্ছে। তবে সে যা হোক তুমি যে
সাহস করে হাতে নিয়েছ এতেই আমি খুশি, আস্তে আস্তে
শিখে নিও।
দাদা ফরিদা কোথায় আছে একটু দেখবেন?
হ্যাঁ দেখছি,
ফরিদাকে ডেকে পেল না।
আমার মনে হয় ওরা ইউরোপে নেই। কেন, ফরিদাকে কেন?
আমার সাথে আমার এক বন্ধু এসেছে ওকে
ফরিদায় দিয়েছে তাই জানতে চাচ্ছিলাম ওরা কোথায় আছে
ও আচ্ছা! তোমার বন্ধু কে?
হাবিব!
হাবিব?
আমি আর হাবিব এক সাথে এসেছি, আমরা এক সাথে একই কলেজে পড়া শুনা করেছি এবং আমাদের
বাড়িও এক জায়গায়।
ও, তাই নাকি?
১১।
আজ নিশাত ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ করল
জাহাজের ইঞ্জিন চলছে না থেমে আছে।
কি ব্যাপার জানালা দিয়ে
বাইরে তাকিয়ে দেখে জাহাজ চলছে না এবং কোন রোলিং হচ্ছে না, নোঙর করে রয়েছে। কাছা কাছি আরও অনেক জাহাজ এমনি নোঙ্গরে রয়েছে। সউদি
আরবের সবুজ সাদা পতাকা উড়ছে। কেবিন থেকে বের হয়ে ওই ডেক থেকে নেমে মেইন ডেকে এসে
বাইরে দেখে এটা এক নতুন দেশ। সুয়েজ খালের
পাশে যেমন দেখেছে অনেকটা ওই রকম। সামনে একটা ডকইয়ার্ড দেখা যাচ্ছে আশে পাশে বেশ
কয়েকটা বিশাল বিশাল জাহাজ নোঙ্গর করে আছে। ওইতো দূরে কিনারা দেখা যাচ্ছ। একটু একটু
ওগুলি কি মাটির ঘর, না কী ওগুলি? সুয়েজের দুই পাড়ে আরব দেশগুলিতে এমন দেখেছে। অন্যান্য সমুদ্র বন্দর
যেমন হয় ছোট ছোট অনেক বোট এবং পালের বোট এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। ওইতো সমুদ্রের
মাঝখানে জেটি দেখা যাচ্ছে,
অনেকগুলি জাহাজ ভিড়ে
রয়েছে। মনে হয় সবগুলি ট্যাংকার হবে, একটারও
মাস্তুল বা ক্রেন নেই। নিশাত অবাক হয়ে শুধু দেখছে। নাস্তা খাবার কথা ভুলে গেছে।
মিডল ইস্টের প্রচণ্ড গরমেও ওর খেয়াল নেই। লন্ডন থেকে এখানে আসার পথে এ পর্যন্ত
কতগুলি দেশ এবং সাগর দেখে নিয়েছে। মনে মনে শুধু ভাবছে, এ কোথায় এসেছি! কত কি দেখছি! কি আনন্দের চাকরী! তন্ময় হয়ে যখন দেখছে আর
ভাবছে তখন ব্রিজ থেকে অরুণ’দা ডাকল ‘এই
নিশাত ওখানে কি করছ?’ নিশাতের সম্বিত ফিরে এলো। পিছনে ফিরে
উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল অরুণ’দা ডাকছে! দেখছি অরুণ’দা! কাপড় বদলে ব্রিজে চলে আস!
আচ্ছা আসছি!
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।