মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৪
নিশাত ভিতর বাড়ি গিয়ে দাদিকে সামনে পেয়ে বলল দাদু আমরা কাল চলে যাচ্ছি।
আবার কবে আসবে?
জানি না, আব্বার ছুটি না হলে আসা হবে না,
আচ্ছা ঠিক আছে ভালো ভাবে থাকবে, মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
চাচীরা কোথায়?
দেখ তো রান্না ঘরে না কি?
নিশাত এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় নিরু ওর
ঘরে থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিল। নিশাত ডাকল
নিরু চাচীরা কোথায়?
সবাই রান্না ঘরে। আপনারা তাহলে কালই
যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, কালই যাচ্ছি, চল চাচীদের একটু বলে যাই।
আসেন। মা, নিশাত ভাই এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে, উনারা কাল চলে যাবে।
নিরুর চাচী রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে
নিশাতকে ডাকল,
এই যে বাবা আমরা এখানে।
চাচী আমরা কাল যাচ্ছি।
আচ্ছা বাবা ভালো ভাবে থাকবে মন দিয়ে পড়া
শুনা করবে।
ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে নিরু জিজ্ঞেস
করল
সত্যিই আপনারা কাল যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, আমি যেগুলি দেখিয়ে গেলাম সেগুলি মন দিয়ে পড়বে, না বুঝলে যুঁইকে জিজ্ঞেস করবে। আচ্ছা যুঁই কোথায় ওকে দেখছি না।
আপা পুকুরে।
পুকুরে কি করে একটু ডাকবে ?আমি ওকে তোমার পড়া দেখার জন্য বলে যাব।
আপনি যান মেঝ ভাইয়ের কাছে বসুন আমি ডেকে
আনছি।
একটু পরেই যুঁই এসে বলল কি রে নিশাত
তোরা তা হলে কাল যাচ্ছিস?
হ্যাঁ তাই বলতে এলাম। শোন তুই কিন্তু
নিরুর পড়াটা একটু দেখবি, ও তো ভাল ছাত্রী মনে হলো, তা তুই একটু দেখলেই ওর অনেক সাহায্য হবে। দেখবি।
হ্যাঁ তোর বৌকে তো দেখে রাখতেই হবে, আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। এই নিরু এখন থেকে আমার
কাছে নিয়ম করে বসবি। একা পড়বি না,
আমার সাথে বসবি। মনে থাকে
যেন।
নিশাতের দিকে তাকিয়ে, দেখলি তোর সামনেই কেমন অর্ডার দিয়ে দিলাম?
৭।
এর পরের দিন নিশাতরা ওই অত টুক নিরুর
মনে গভীর একটা দাগ দিয়ে চলে গেল। নিরুর মনে যে দাগ কেটে গেল, নিরুর মনের যে জানালা খুলে দিয়ে গেল সে আর কিছুতে
বন্ধ হবার নয়। সে তো ভিন্ন জগতের অনুভূতি, ভিন্ন সে ধ্যান,
ভিন্ন জ্যোতি, ভিন্ন আকুতি। এত দিন যা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। এ যে
কি এমন এক ব্যথা, এমন এক যাতনা যা কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখান যায় না। নিজের বুকের ভিতর তুষের আগুনের
মত জ্বলতেই থাকে। নিতান্ত চেপে রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। শুধু চোখের জলেই যার
সমাধান। আশা পথ চেয়ে দিন যায়,
রাত আসে। এক দিন ফিরে আসবে
সে আজ হোক বা কাল। ফিরে যে তাকে আসতেই হবে, এই এক সান্ত্বনা বুকের গভীরে পুষে রেখে নিরু নিজেকে নিশাতের জন্য
প্রস্তুত করছে।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও চলে যায়। নিরুর কাছে মনে হয় যেন
একটা যুগ যাচ্ছে। ক্লাসে নিয়মিত হাজিরা, যুঁইয়ের কাছে
পড়া, সংসারের কিছু তদারকি এতেই দিন চলে যায়।
ভাবে এমন হয় কেন, ও আমার কে? ওর জন্য এমন লাগে কেন?
এক জন পুরুষ মানুষের প্রতি
এমন টান কেন হয় কিছুতেই এর কোন জবাব খুঁজে পায় না। এই টান কোথা থেকে আসে, এই কি নিয়ম, যদি তাই হয় তা হলে ও কিছু বলে গেল না কেন? আবার ভাবে সেদিন তো বলেছেই “আমি থাকলে তোমার ভালো লাগবে?”এর চেয়ে কি আরও একটু খুলে বলতে পারত না? না, আমিই তো ওকে
নিয়ে গেলাম না ও তো পুকুর পাড়ে যেতে চেয়েছিল। ওখানে গেলে কি বলত? না কি আমি যা ভাবছি ও তেমন করে ভাবছে না। তাই বা কি
করে হয়, যুঁই আপা যখন অমন করে বলত তখন এত লজ্জা
কি জন্! এই নানা ধরনের বিচিত্র প্রশ্ন তার মাথায় ঘুর ঘুর করে কোন ফাঁকে যেন চোখ
দুইটা বন্ধ করে দেয়।
দেখতে দেখতে প্রায় দুই বৎসর চলে গেল
নিশাতদের আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুর মনে যখন নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা শাখা
প্রশাখা ছড়িয়ে তার ছোট্ট হৃদয়ের মাঝে নিশাতের জন্য একটা গভীর সাগর বানিয়ে ফেলেছে
তখন দেশে শুরু হলো স্বাধীনতার আন্দোলন। তারপর মুক্তি যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন এক
দিন সত্যিই নিশাতরা কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশে এসে হাজির।
এক দিন সকালে নিরু বাড়ির দক্ষিণ পাশে
কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য কুয়ায় মাত্র বালতি ফেলেছে এমন সময় সামনে তাকাতেই দূরে
নিশাতদের বাড়ির ওদিক থেকে দুই পাশে ধান ক্ষেতের মাঝে বাধানো উঁচু রাস্তা দিয়ে
শার্ট প্যান্ট পরা কে এক জনকে আসতে দেখে একটু থেমে গেল। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু!
হ্যাঁ তাই তো, বুকটা কেপে উঠল। হ্যাঁ সেই, যার জন্য এতো দিন অপেক্ষা, যার জন্য পথ চেয়ে কল্পনার জাল বুনে, দিন রাত যন্ত্রণা সয়ে এক উত্তাল সাগরের উন্মত্ত ঢেউ বুকে নিয়ে এতো গুলো
দিন কেটেছে এ সেই। মানুষটা কেমন! একটা খবরও কি দিতে নেই? এমন কেন? আনমনা হয়ে কত কি এলো মেলো ভাবনা এসে
জড়িয়ে গেল। হাত পা সব যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে এলো। বালতির রশি হাতেই ধরা রইল।
কি নিরু, কেমন আছ?
কণ্ঠ শুনে নিরুর ভাবনা থেমে গেল। বুকে
এক অজানা কাঁপন অনুভব করল,
গলা জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে
গেছে।
কি নিরু কথা বলছ না কেন?
কোন রকম একটু ঢোক গিলে বলল
কবে এলেন?
কই আমি যে বললাম, কেমন আছ তার কিছু বললে না?
হ্যাঁ ভালোই আছি, আপনি?
হ্যাঁ আমিও ভালো আছি, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ, প্রায় চেনাই যায় না।
নিরু এতো দিন যার পথ চেয়ে দিন রাত একটা
ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে, নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু
যার জন্য তৈরি করেছে আজ এই তাকে এমন হঠাৎ দেখে হত বিহ্বল হয়ে গেছে। মনে মনে বলল
আমি কেমন আছি সে তুমি বুঝ না?
তোমার পথ চেয়ে আমার দিন
গুলি কি ভাবে গেছে সে বোঝার শক্তি তোমার কবে হবে, না কি কোন দিন হবে না?
একটু স্থির হয়ে বলল
যান, ওই যে বাড়ির পিছনে মেঝ ভাই বাঁশ কাটছে ওখানে যান।
আমি এসেই তোমাকে দেখতে পাব ভাবতেই
পারিনি। তোমাদের কি সৌভাগ্য কি সুন্দর পরিবেশে তোমরা থাক। তোমাদের এই কুয়ার পাড়টা
কি সুন্দর, ও পাশে পুকুর পাড়ে ঝোপে পাখি ডাকছে, সামনে ধান ক্ষেতের বিশাল সবুজ প্রান্তরে বাতাসে ঢেউ
তুলছে। আচ্ছা ওই যে ওটা কি পাখি?
নিরু নিশাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে
তাকিয়ে বলল ওটা মাছ রাঙ্গা।
কি চমৎকার পরিবেশে থাক তোমরা, চারি দিকে উঁচু নিচু ঝোপ ঝাঁর, তাতে নানা রঙের পাতা ফুল কত সুন্দর এ দেশ আর আমরা
যেখানে থাকি শহরে সেখানে শুধু ইট লোহা কাঠ পাথরের দালান কোঠা আর তার সাথে মানুষের
মনও তেমন হয়ে যায়!
এখানে আসার সময় তাই দেখলাম রাস্তার পাশে
কি সুন্দর পানিতে ধানের ক্ষেত গুলি মনে হচ্ছে যেন ভাসছে। এই সবুজের মধ্যে থেকে
থেকে তোমার মন কত সরল।
আমার সাথে কখনো ভালো করে কথাই বলেননি কি
করে জানলেন আমার মন সরল, এ সব আপনার বানানো কথা।
না নিরু, আমি বানিয়ে কথা বলতে পারি না, যা সত্যি মনে
হয় তাই বলি, বানানো কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না। এই
যদি এখন বলি এ বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগে তোমাকে, এটাও সত্যি এবং মোটেই বানানো নয়। তোমার দুরন্তপনা, তোমার চঞ্চলতা আর তোমার এই হাসি ভরা মুখটা আমি এক
দিনের জন্যেও ভুলতে পারিনি,
তা কি তুমি জান?
তাই যদি হবে তবে এতদিন পরে আসলেন কেন
নাকি যুদ্ধ শুরু না হলে আর আসতেন না?
কি যে বল তুমি!
নিরুর চোখ কুয়োর নিচে একেবারে গহীনে
পানির উপরে স্থির হয়ে আছে। ও পাশে রাখালরা আসা যাওয়া করছে এদের মধ্যে যারা নিশাতকে
চিনে তারা এসে একটু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কবে এসেছে।
ফাঁকে ফাঁকে ওদের কথার জবাব দিচ্ছে। নিরুর কানে কে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে, এই টুকু শোনার জন্যই এতো দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ
আমার সাধনা যেন পূর্ণ হতে চলেছে,
আমার মনের কথা শুনতে
পেয়েছে। নিরু ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে গেছে, তন্ময় হয়ে
শুধু শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের মনে হলো নিরু ওর কথা শুনছে না কি! কি হলো তুমি আমার কথা শুনছ না?
লজ্জায় নিরুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল।
কোন রকম পিছনে ফিরে
ওই যে মা ডাকছে আমি যাই।
বলেই কুয়োয় বালতির রশি ছেড়ে এক দৌড়ে
ভিতর বাড়ি। নিরুর যাবার পর নিশাতের মনে হলো তাইতো এটা গ্রাম, এভাবে একটা ছেলে একটা মেয়র সাথে খোলা কুয়োর পাড়ে
দাঁড়িয়ে কথা বলা কারো নজরে এলে ফলাফল নিশ্চয় খুব একটা সুখের হবে না। নেহায়েত তারা
গ্রামে থাকে না বলে হয়তো আপাত কেউ কিছু বলবে না তবে এর আগের বারে নিরুর মুখেই এই
কথা সে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু নিরু? মুনি ঋষিরাই যেখানে ব্যর্থ সেখানে নিশাত আর কি!
নারী হৃদয় বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তবুও নিশাত হতভম্বের মত কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়েই
রইল। নিরুর এই হঠাৎ চলে যাওয়া কি শুধুই লোক লজ্জা না কি ভিন্ন কিছু? এমন করে কিছু না বলেই চলে যাবে? কিছুটা বোকার মতই দাঁড়িয়ে রইল। এ কথা কাউকে জিজ্ঞেস
করা যাবে না। কেন, সরাসরি কিছু বলে গেলে কি হতো? কেন এমন হয়? লজ্জা, নাকি অন্য কিছু?
তা হলে সে অন্য কিছু কি? আর কি হতে পারে? কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে আস্তে আস্তে নিরুর দেখানো বাড়ির পিছন দিকে
যেখান থেকে বাঁশ কাটার শব্দ আসছে সে দিকে চলে গেল।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।