১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে আমার সপ্তম ভয়েজে
যাত্রার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে দুবাই তারপর দুবাই থেকে গালফ এয়ারে
বাহরাইন এসে পৌঁছলাম। ব্রিটিশ পতাকা বাহি ট্যাংকার জাহাজ ইলেক্ট্রা কুয়েত থেকে লোড
করে শারজাহ
যাবার পথে আমাকে বাহরাইন থেকে নিয়ে যাবে এবং সেকেন্ড অফিসার জাকিরকে
নামিয়ে দিয়ে যাবে। জাকির সাইন অফ করে দেশে যাবে, ওর জায়গায় আমি এসেছি। জাহাজ আসতে
আরও দুই বা তিন দিন দেরি হবে এ কয় দিন কোম্পানির খরচে বাহরাইনের মানামায় একটা
হোটেলে থাকি, খাই দাই ঘুরি ফিরি আর কোন কাজ নেই।
দুই দিন পর রাতে বাইরে থেকে হোটেলে ফিরে এলে
রিসিপসনস্ট জানাল যে তোমার অফিস থেকে ফোন করে বলেছে তুমি আগামী কাল সকাল আটটায়
রেডি হয়ে থাকবে এজেন্ট এসে জাহাজে নিয়ে যাবে। বেশ, পর দিন সকালে উঠে যথারীতি রেডি
হয়ে রইলাম। একটু পরেই এজেন্ট এসে তার গাড়িতে করে নিয়ে গেল। পোর্টে ঢুকে
ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি সেরে জাহাজে উঠে পরলাম জাকির সাইন অফ করে নেমে গেল। আগেই
জানতাম এই জাহাজে আমার কয়েক জন বন্ধু আছে। আমি ওঠার পরে পরেই জাহাজ ছেড়ে দিল। আমার
ডিউটি দুপুর বারোটা থেকে। চীফ অফিসার সুধাংশু’দা আমার কেবিন দেখিয়ে দিল, উনার কাছেই জাহাজের মাপ জোক স্বভাব চরিত্র জেনে নিলাম এটার ধারণ ক্ষমতা
প্রায় ১৫,০০০ টন, গ্রস টনেজ প্রায় ৭,০০০ টন, ঘণ্টায় বার নটের বেশি ক্রুজ করতে পারে না এবং এরাবিয়ান গালফের মধ্যে ক্রুড
ওয়েল বাদে নানা গ্রেডের তেল নিয়ে এর চলাচল সীমিত।
দিন গুলি বেশ কেটে যাচ্ছিল। এখান থেকে
ওখানে। রাতের ন্যাভিগেশনের সময় ব্রিজের রেডিওতে কাছাকাছি যে সব জাহাজে অন্যান্য
বন্ধুরা আছে তাদের সাথে ইয়ার্কি ফাজলামি, গল্প গুজবের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে
নভেম্বরের শেষ দিকের কোন এক সময়ে ইরানের আবাদান রিফাইনারি থেকে Jet A1 বা জেট কেরাসিন এনে আবুধাবির এডনক কোম্পানির অফ শোর বয়াতে মুরিং করে
ডিসচার্জ করা হয়ে গেছে। পাইপ লাইন ডিস কানেক্ট করে পাইপের মুখ বন্ধ করে সাগরে ছেড়ে
দিয়েছি।
খালি ট্যাংকার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে যাত্রা
সম্ভব নয় বলে সি ভাল্ভ খুলে পাম্পিং করে পুরো জাহাজ আবার সমুদ্রের পানি দিয়ে বোঝাই
হচ্ছে। এবার পানীয় জল নেবার জন্য হারবারের ভিতরে ঢুকতে হবে।
আবুধাবির এজেন্ট গ্রে আবুধাবিকে ডাকলাম,
গ্রে আবুধাবি গ্রে আবুধাবি দিস ইস ইলেক্ট্রা
কলিং।
গ্রে আবুধাবি সাথে সাথেই উত্তর দিল।
ইয়েস ইলেক্ট্রা, দিস ইস গ্রে আবুধাবি, ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার।
আমাদের
আনলোড হয়ে গেছে, পাইপ লাইন ছেড়ে দিয়েছি, পানির কি করেছ?
এখানে ফ্রেস ওয়াটার নেই তোমরা দুবাই চলে যাও
ওখান থেকে পানি নিয়ে বাহরাইনের সিতরা
ট্যাংকার বার্থ থেকে হাই স্পিড ডিজেল লোড করে মাস্কাট যাবে।
আমরা আগের ধারনা অনুযায়ী আবুধাবি থেকে
বাহরাইন যাবার চার্ট রেডি করে রেখেছি, এখন আবার
দুবাইর পথ বের করতে হবে আবার দুবাই থেকে বাহরাইনের পথ বের করতে হবে, ঝামেলার ব্যাপার। যথারীতি চীফ
অফিসার এবং জাহাজের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনকে
জানালাম। ক্যাপ্টেন তার রুম থেকে ভিতরের সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে এসে কালচে আকাশ দেখে
থমকে গেল। আমরাও যে লক্ষ করিনি তা কিন্তু নয়। ব্যারো মিটারে বাতাসের চাপ অসম্ভব
কমে গেছে। নিম্ন চাপের পূর্বাভাস। আরব্য উপসাগরের স্বভাব আমাদের বঙ্গোপসাগর বা
ভারত মহা সাগরের মত নয়। ওখানে শীত কালে সাগর অশান্ত থাকে আবার গরমের সময় শান্ত
থাকে, আমাদের উলটো।
এর মধ্যে সাগরের পানি একেবারে থমথমে ভাব ধারণ
করেছে, ঠিক যেন মনে
হচ্ছে বড় কোন সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরের কাচের মত। যেন কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু পারে না, একে বারে
সুবোধ বালক।
ক্যাপ্টেন নিজেই রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে
গ্রে আবুধাবি কে ডেকে বলল তোমরা ওয়েদার রিপোর্ট নিয়েছ?
হ্যাঁ দেখেছি, ওয়েদার ভাল।
আমি দেখছি ওয়েদার খারাপ তোমরা ভাল রিপোর্ট
পেলে কোথায়?
না না ওয়েদার ভাল তুমি তারা তারি সেইল কর।
ঠিক আছে আমি সেইল করছি তবে আমার মনে হচ্ছে
আবার ফিরে আসতে হতে পারে।
ক্যাপ্টেন এক রকম নিরুপায় হয়ে নোঙ্গর তোলার
অর্ডার দিল। পিছনের রশি খুলে নোঙ্গর তোলা হয়ে গেলে জাহাজ ঘুড়িয়ে দুবাইর উদ্দেশ্যে
ফুল এহেড ইঞ্জিন চালাবার নির্দেশ দিয়ে
দিলাম। কে যেন স্টিয়ারিং করছিল মনে নেই। ক্যাপ্টেন আমাকে চার্ট চেঞ্জ করার কথা বলে
আর কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে নিচে চলে গেল। সুধাংশু’দা ও তার সাথে সাথে চলে গেল। বেশি
না, আবুধাবি থেকে দুবাই মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পথ। জাহাজ চালিয়ে দিয়ে গ্রে দুবাইকে
বললাম আমরা সকাল এগারোটায় পৌঁছব, আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা কর।
ওরা বলল হ্যাঁ আমরা জানি, গ্রে আবুধাবি বলেছে। তোমরা এসে দুবাই পোর্ট কন্ট্রোলের সাথে কথা বলে সরাসরি
হারবারের ভিতর ঢুকে যেও। এক সময় দুবাই এসে পানি নিয়ে দুপুর দুইটায় গ্রে দুবাই এবং
দুবাই পোর্ট কন্ট্রোল কে জানিয়ে জেটি ছেড়ে হারবারের বাইরে চলে এলাম। গ্রে
বাহরাইনকে ডেকে আমাদের ETA জানালাম আগামী কাল সন্ধ্যা ৭টা। কোর্স ঠিক করে আবার ফুল এহেড, গন্তব্য বাহরাইনের সিতরা পোর্ট। দুবাই আসার পথেই চার্ট রেডি করে রেখেছিলাম।
আকাশ তখন ওই রকম, সাগর জলও
নিস্তরঙ্গ। গুমোট থমথমে ভাব। ক্যাপ্টেন আকাশের অবস্থা, ব্যারোমিটারের রিডিং দেখে ভুরু
কুচকে এবার মিডল ইস্টে আমাদের প্রধান অফিস গ্রে বাহরাইনের সাথে নিজে কথা বলে
যাত্রা বিরতির কথা জানাল। কিন্তু গ্রে বাহরাইনেরও সেই একই কথা, না না, যত তারা তারি সম্ভব এসে লোড নিয়ে যাও।
ঘণ্টা তিনেক এর মধ্যে ডিউ ওয়েস্ট অর্থাৎ ২৭০
ডিগ্রিতে হেডিং করে আমরা ঘণ্টায় ১২ মাইল
বেগে দুবাই পিছনে ফেলে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছি। পিছনে ৩২ তলা দুবাই হিলটন হোটেল
ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে, দুবাই শহরের অন্যান্য দালান কোঠা আজ আর দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে সাধারণত
৩৫/৪০ মাইল পর্যন্ত দিগন্ত রেখা বেশ স্পষ্টই দেখা যায়। আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে।
আমার ডিউটি শেষের পথে। আমার জায়গায় থার্ড অফিসার পর্তুগীজ কার্লো আসবে। মানসিক
প্রস্তুতি নিচ্ছি কার্লোকে কি কি বুঝিয়ে দিতে হবে তার একটা তালিকা বানাচ্ছি মনে
মনে। এমন সময় হঠাৎ উত্তরের দিকে দৃষ্টি গেলে এক অস্বাভাবিক দৃশ্য নজরে এলো, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম সাথে একটু ভয়।
নীল সাগরের জল অনেকক্ষণ ধরেই রঙ বদলে ফেলেছে, দুবাই
হারবার থেকে বের হয়েই লক্ষ্য করেছি। এখন দেখলাম সেটা কাল হয়ে গেছে, উত্তর থেকে
একটা বিশাল কাল পাহার আকাশ বেয়ে রকেটের গতিতে যেন আমাদের দিকে উড়ে আসছে। আবার ঠিক
সাগরের ঢেউ এর মত যেন ইরানের আস্ত কুহে তুর পাহার মাথায় সাদা মুকুট পরে শত সহস্র
মাইল বেগে ধেয়ে আসছে। সাগরে এবং আকাশে দুই পাহাড় দেখে ভয় পেলাম। যদিও এই অবস্থায়
ভয়ে অস্থির হলে চলবে না। শীতের বেলা একটু তারা তারি বিদায় নিয়েছে, অন্ধকার হয়ে
আসছে। ন্যাভিগেশন লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছি। কি আসছে এমন করে?মেঘ?ঢেউ?না, মেঘের রঙ কি
এমন কাল হয়?নীল সাগরের নীল জল কি এমন কাল হয়?দেখতে দেখতে
কার্লো এসে পরেছে। ওকে বুঝিয়ে দিয়ে আমার চলে যাবার কথা। ওকে দেখালাম, কার্লো দেখ, কিছু বুঝতে
পারছ?ওর চেহারা দেখে ওকে বিস্মিত মনে হোল, হা করে চেয়ে
আছে। উভয়েই হতবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই এলাকায় সমুদ্রের গভীরতা একটু কম তাও প্রায়
২০০০ ফুটের মত হবে।
ডিউ নর্থ থেকে ওই ঢেউ আর আকাশের কাল পাহাড় এগিয়ে আসছে, আসছে একে বারে কাছে এসে পরেছে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার কাল ঢেউ আর তার
পিছনে আরও ঢেউ আর ঢেউ, সবার মাথায় সাদা হিরের মুকুট জ্বল জ্বল
করছে প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার
দেখতে পাচ্ছি। আকাশে যে মেঘের পাহাড় ছিল সেও এই ঢেউ এর সাথে জাহাজের ডান দিকে
এগুচ্ছে। এই ঢেউ জাহাজকে পাশ থেকে ধাক্কা দিলে নির্ঘাত আজ এই শেষ নিশ্বাস নেয়া।
জাহাজে থাকা এত লাইফ সেভিং ইকুইপমেন্ট কোন কাজে লাগাবার সুযোগ কেউ পাবে না। কোন
ভাবেই জাহাজের পাশে এই আঘাত লাগতে দেয়া যাবে না। সামনে বিপদ দেখে মানুষ দিশা
হারিয়ে আবোল তাবোল কিছু করে বসে যাতে বিপদ আরও বেশি সুযোগ পায়। এই মুহূর্তে মাথা
গুলিয়ে ফেললে হবে না, কিছু একটা করতেই হবে। সমুদ্রে যাদের বসবাস তাদের
ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলে একটা ইন্দ্রিয় থাকে যা দিয়ে বাতাসের গন্ধই বলে দেয় কি করতে হবে
তা বুঝতে পারে। এই ক্রান্তি কালের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হলে বা উলটা
পালটা সিদ্ধান্ত নিলে জীবন নিয়ে আর কোন দিন মাটিতে হেটে চলার উপায় থাকবে না একে
বারে সলিল সমাধি বা হাঙ্গরের পেটে স্থায়ী নিবাস হয়ে যাবে। আজকের এই লেখা আর কেউ
কোন দিন লিখতে পারত না।
ক্যাপ্টেন বা চীফ অফিসারকে ডাকা তো দূরের কথা যে স্টিয়ারিং করছে তাকেও
কমান্ড দেবার সময় নেই। চট করে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে স্টিয়ারিং নিজের হাতে নিয়ে
জাহাজের হেড ঢেউ এর দিকে করে দেয়ার জন্য হার্ড স্টার বোর্ডে (ডান দিকে) টার্ন করে
দিলাম। চেয়েছিলাম ৯০ ডিগ্রী টার্ন নিয়ে ঢেউ এর মুখোমুখি হতে কিন্তু এত বড় জাহাজটা
ঘুরতে কিছু সময় নিবেই, সম্পূর্ণ টার্ন নেবার আগেই প্রায় ৬০ ডিগ্রী
ঘুরেছে এমন সময় প্রথম ঢেউ জাহাজের মাথায় কোণা কুনি ভাবে আছড়ে পড়লো, জাহাজের
মাথা ঢেউ এর সাথে উপরে উঠেই প্রায় সাথে সাথেই দ্বিতীয় ঢেউ এর ফাকে নিচে চলে গেছে
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, প্রথম ঢেউ এগিয়ে আসছে ব্রিজের দিকে, পুরো জাহাজ
পানির তলে, তার সাথে প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা না কি বলি বুঝতে পারছি না, ঝড়ের বেগে
এসে জাহাজ কে পোর্ট সাইডে (বাম দিকে) প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কাত করে ফেলল। ব্রিজে কেউ
দাঁড়িয়ে নেই যে স্টিয়ারিং করছিল সে ছিটকে পরল পোর্ট সাইডের দরজায়, কার্লো পড়লো রাডারের উপর আমি স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখেছিলাম বলে আমাকে
ফেলতে পারেনি।
কয়েক
সেকেন্ডের মধ্যেই জাহাজের ট্রিমিং ঠিক হোল কিন্তু নোনা জলের ঢেউ একের পর এক
ব্রিজের ওপর দিয়ে পিছনে যাচ্ছে। কোন একটা জানালা যদি খোলা থাকত তা হলে ব্রিজের
ভিতর পানি ঢুকে যেত। শীত কাল বলে সব জানালা বন্ধ ছিল। গাড়িতে যেমন সামনের কাচ
মোছার ওয়াইপার থাকে জাহাজে থাকে ঘুরন্ত কাচ, ওটা এমন তীব্র গতিতে ঘুরে যে পানি
বা কিছু জমার সুযোগ পায় না কিন্তু ওটা অন করবে কে?আর অন করেই বা কি হবে সম্পূর্ণ
জাহাজটা পানির নিচে ডুবছে আবার ঢেউ এর সাথে একটু ক্ষণের জন্য ভেসে উঠছে। আমি
স্টিয়ারিং হুইল ধরে ব্যালেন্স রাখার জন্য দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছি এর মধ্যে
স্টিয়ারিং হুইল হাত থেকে ছুটে গেলে কি যে হবে কে জানে কাজেই কোন অবস্থাতেই হুইল
ছাড়া যাবে না। কত টুক ঘুরাতে পেরেছিলাম জানি না হুইল ইন্ডিকেটর বা কম্পাসের দিকে
তাকাবার মত মানসিক ভারসাম্য নেই। তবে ঢেউ যা আসছে এখন সামনে থেকে আসছে। অন্তত পাশে
থেকে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে না। ওরা কে কি করছে কিছুই দেখার মত শক্তি বা সুযোগ
কিছুই নেই। মনে হচ্ছিল যেন পুরো জাহাজ সহ ডুব সাতার দিচ্ছি। সামনে দিয়ে ঢেউ
এসে ব্রিজের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কয়েকবার
এমনি করে চুবানি দিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাণ্ডব লীলা কমে গেল। যা হবার এই পাঁচ
মিনিটই যথেষ্ট। সমুদ্র তখনও গর্জাচ্ছে, জাহাজ প্রতিটি ঢেউ এর আঘাতে থর থর করে কাঁপছে। ভাগ্য ভাল
আবুধাবি থেকে ফুল লোড করে পানি নিয়েছিলাম। এমনি সাধারণত বাহরাইন যাবার পথে অর্ধেক
লোড নেই আজ আকাশের অবস্থা দেখে ফুল লোড করেছিলাম ওদিকে খাবার পানির ট্যাঙ্ক ও
ভর্তি। জাহাজ সম্পূর্ণ বোঝাই ছিল বলে রক্ষা না হলে যে কি হতো কে জানে।
স্টিয়ারিং
ওর হাতে দিয়ে দিলাম এর মধ্যে কার্লো রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে গ্রে দুবাইকে ডাকছে।
আরে বুদ্ধু,
কাকে
ডাকছ, রেডিওতে কোন শব্দ
পাচ্ছ? বলে বাইরে এলাম। সামনের মাস্তুলের উপরের অর্ধেক ভেঙ্গে কোথায়
গেছে কে জানে,
ব্রিজের
ছাদে দেখলাম রেডিও, জিপিএস, ডেকা ন্যাভিগেটর এবং
রাডার এর এরিয়েল কিছুই নেই। মনকে প্রবোধ দেবার জন্য রাডার স্ক্রিনে দেখলাম, কমলা রঙের একটা গোল চাকতি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, জিপিএস কথা বলছে না, ডেকা মিটার শুধু ক্লিক ক্লিক শব্দ করছে কিন্তু কোন
স্টেশনের সিগন্যাল দেখাতে পারছে না।
প্রকৃতি
যে এত ভয়াবহ কঠিন হতে পারে তা আমার এর আগের ছয়টি সমুদ্র যাত্রায় কখনো দেখিনি বা
পুরনোদের কাছে শুনিনি। বিশাল ঢেউ হয়, সমুদ্র অশান্ত হয়ে নানা রকম দুর্যোগ ঘটায় জানতাম, কিছু দেখেছি ও কিন্তু
এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে কল্পনাও করিনি। ক্যাপ্টেন বলল আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।
কোথায় আছি কিছু বুঝতে পারছ?চার্ট টেবিলে এসে দেখালাম সর্ব শেষ পজিশন ছিল এখানে। এর পর
এখন কোথায় বুঝতে পারছি না।
আমাদের
কোর্স কত ছিল?
২৭০
ওই
কোর্স রাখার চেষ্টা কর তবে অবস্থা বুঝে ঢেউ এর সাথে হেডিং রেখে যেও যেখানে যায় যাক, জাহাজ তো বাচাতে হবে।
জাহাজ না বাঁচলে আমরা বাঁচব কি করে।
চাঁদ
তারা দেখে সাবেক কায়দায় ন্যাভিগেশন করার উপায় নেই, আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া
আমরা যন্ত্র নির্ভর হয়ে পরেছি বলে সে চর্চাও নেই। আমার ডিউটি শেষ হলেও কার্লোর
সাথে কিছুক্ষণ রইলাম। বিপদ তো সবার, ৫টা দেশের ১৭ জন নাবিক। ক্যাপ্টেন বলল তুমি যাও শুয়ে পর, রাতে আবার আসতে হবে।
কার্লোর
সাথে
আমি থাকি। চলে এলাম। এসে কাপড় বদলে বিছানায় শুয়ে আর ঘুম আসে না। বার বার ওই
জ্যান্ত বিভীষিকা কাল দুই পাহাড় শুধু তেড়ে আসছিল। ভোর চারটায় ডেকে দিল। ব্রিজে এসে
দেখি সাগরের মাতলামি অনেকটা কমেছে তবে এখনো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ অশান্ত।
সুধাংশু’দা কে জিজ্ঞেস করলাম
কিছু বুঝতে পারছেন কোথায় আছি?
না।
তা হলে
কি কানার মত চালাচ্ছেন?
এ ছাড়া
আর উপায় কি?
কোন
জাহাজ দেখেছেন?
না।
কোর্স
কত?
ওই, তখন যা ছিল তাই রাখার
চেষ্টা করছি কিন্তু মাঝে মাঝেই ঢেউ এর সাথে হেডিং করতে হচ্ছে।
ড্রিফট
হয়েছে বলে কিছু বুঝতে পারছেন?
ড্রিফট
হচ্ছে বুঝতে পারছি কিন্তু কোথায় কোন দিকে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না শুধু সামনে
যাচ্ছি।
ক্যাপ্টেন
কিছু বলেছে?
কি আর
বলবে, কোন জাহাজ দেখতে পেলে ডাকতে বলেছে।
আচ্ছা
ঠিক আছে দেখা যাক, কাল
দিনের আলো না হলে কিছু বোঝা যাবে না। আচ্ছা আপনি যান ঘুমান দেখি আমি কত দূর নিতে
পারি।
ভোর
হবার একটু আগে ডান দিকে দূরে একটা সুপার ট্যাংকারের ন্যাভিগেশন লাইট দেখে বুঝলাম
ওরা লোড নিয়ে এরাবিয়ান গালফ ছেড়ে ইন্ডিয়ান ওসেনের দিকে যাচ্ছে। একটু আশার আলো
দেখতে পেলাম। খুব বেশি হলে ওই জাহাজ আমাদের থেকে ৫ মাইল দূর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু
ওর যে স্পিড তাতে দৌড়ে ওকে ধরা সম্ভব নয়। কি করা যায়?রেডিও বা ওয়ারলেস কোথায় পাই, ভাবতে ভাবতে মনে হোল, লাইফ রেফটে (life raft) যে ছোট ওয়ারলেস থাকে
সেটা বের করে ওকে ডাকতে হবে। তারা তারি ক্যাপ্টেনকে ডেকে দেখালাম ওই জাহাজ। বললাম
আমি একটা রেফট খুলে ওয়ারলেস বের করে ওদের ডেকে দেখি।
ক্যাপ্টেন
স্টিয়ারিং করছে। আমি আর হেল্মস ম্যান দুই জনে একটা রেফট খুলে ওয়ারলেস বের করে ওই
নাম না জানা জাহাজকে ডাকলাম। ভাগ্য ভাল। ওরা আমাদের ডাক শুনে জবাব দিয়েছে। ওরা
কুয়েত থেকে ক্রুড অয়েল লোড করে কোথায় যাচ্ছে। আমাদের বিপদের কথা খুলে বললাম, এমনকি আমরা কোথায় আছি
তাও জানি না। ওরা আমাদের দেখেছে, ওদের রাডারে বিয়ারিং নিয়ে আমাদের পজিশন বলে দিল। আমাদের
গ্রে বাহরাইনকে জানাবার অনুরোধ করলাম। বললাম বল যে তোমাদের ইলেক্ট্রা ওই পজিশনে
আছে, আমাদের ইঞ্জিন সব ঠিক
আছে কিন্তু কম্যুনিকেশন এবং ন্যাভিগেশন ইকুইপমেন্ট কোন টাই কাজ করছে না তাকে রেস
কিউ কর। গত কাল দুবাই থেকে সেইল করার পর থেকে গ্রে বাহরাইন বা গ্রে দুবাইর সাথে
যোগাযোগ না হওয়ায় ওরা চিন্তিত ছিল। এখন খবর পেয়ে গ্রে বাহরাইন জানাল যে
ইলেক্ট্রাকে বলে দাও ওরা যেখানে আছে ওই খানেই যেন ভেসে থাকে আমরা গ্রে সুইফটকে পাঠাচ্ছি, গ্রে সুইফট ওদের
পাইলটিং করে নিয়ে আসবে। ওরা আমাদের খবর পৌঁছে দিলে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
চার্টে
ওই জাহাজের দেয়া লঙ্গিচুড/ল্যাটিচুড মিলিয়ে দেখি আমরা বাহরাইন বামে রেখে কুয়েত
যাবার পথে চলে গেছি।
এবার
গ্রে সুইফটের আসার অপেক্ষা। গ্রে সুইফট আমাদের সাপ্লাই বোট। ঘণ্টায় ১৮ নট স্পিডে
চালিয়ে প্রায় বিকেল চারটা নাগাদ এসে আমাদের পাশে ভিড়ল।
তারপর?তারপর আর কি, গ্রে সুইফট আমাদের
স্পিডের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের আগে আগে আর আমরা ওদের পিছনে ওদের ফলো করে বাহরাইন
এসে পৌঁছলাম তার পর দিন সকালে। সারা পথেই সাগরের উন্মত্ততা কমে নি। কার উপর যে এই
ক্রোধ কিছু বুঝলাম না। এখানে ডকে তুলে জাহাজের কীল, বটম প্লেট, প্রপেলার, রেডার সব কিছু চেক করে কিছু প্রয়োজনীয় মেরামত করে
এন্টেনা লাগিয়ে আবার জলে ভাসিয়ে দিল। আমরাও আবার সমুদ্রের পরবর্তী কোন আক্রোশের পথ
চেয়ে তা মোকাবিলা করে নাবিক জীবনের অ্যাডভেঞ্চার সংগ্রহের আশায় জাহাজ লোড করে আবার
যাত্রা করলাম মাস্কাটের পথে।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।