মরীচিকা [২]-১
১।
বাচ্চু
মিয়ার দিন খুব একটা ভাল যায় না। একদিন কাজ করতে পারলে দুই দিন বিছানায় পড়ে থাকতে
হয়। ঝাঁর ফুক, গাছ গাছন্ত দিয়ে অনেক দিন চিকিৎসা করান হয়েছে কিন্তু কাজ
হয়নি তাই ও
পাড়ার মফিজের পরামর্শে কিছু পয়সা জমিয়ে মানিকগঞ্জে বড় ডাক্তার
দেখিয়েছে। সে ই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছে লিভারে সমস্যা দেখা দিয়েছে নিয়মিত ওষুধ
খাবেন আর বিশ্রামে থাকবেন। কিন্তু যার দিন আনতে পানতা ফুরায় সে কি করে বিশ্রামে
থাকবে আর কি করেই বা নিয়মিত ওষুধ খাবে! হযরত আলির লাকড়ির দোকানে কাঠুরিয়ার কাজ করে
কি আর বিশ্রামে থাকা যায়? চার পাঁচজন ছেলে পুলে তার পরে আবার
ঘরে অবিবাহিত ছোট এক বোন নিয়ে বড় কষ্টে দিন যায়।
ভাগ্য ভাল যে বড় মেয়েটা ঢাকায় ওসমান সাহেবের বাসায় কাজ করে। মাস গেলে কিছু
টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় নয়তো সে নিজে বাড়ি এলে বাচ্চু মিয়ার হাতেই দিয়ে যায়। ঢাকা
আরিচা রোডের তরা ব্রিজ পাড় হয়ে এসে বায়ে হরিরামপুরের রাস্তায় দক্ষিণে একটু ভিতরে
নবগ্রাম খালের পাড়েই বাড়ি।
২।
বোনটা
দেখতে শুনতে ভাল অন্তত কাঠুরিয়ার বোন বলে মনে হয় না। কি জানি, কোথায়
বিয়ে হয় কে জানে! বোনটার যদি একটি বিয়ে দিতে পারে তাহলে অন্তত একজনের বোঝা কমে যায়
কিন্তু চাইলেইতো আর বিয়ে দেয়া যায় না। তবে বাচ্চু মিয়ার ভাগ্য ভাল বলতেই হবে।
যেদিন মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে আসছিল তখন বাসে গিলন্ডের ঘটক রমিজ মুন্সির সাথে দেখা।
কি
খবর বাচ্চু মিয়া কেমন আছ?
ভাল
আর কেমনে থাকি? এইতো মানিকগঞ্জ থিকা পরীক্ষা করাইয়া আসলাম, লিভারে
গণ্ডগোল দেখা দিছে।
ও, তাইলেতো
চিন্তার কথা, দেখ যতটা পার চিকিৎসা কর। আইচ্ছা ভাল কথা, তোমার
একটা বইন আছে না?
হ
ভাই আছেতো, ওরে নিয়েই যত চিন্তা, কি
যে করি!
একটা
ভাল পোলার খোজ আছে, দেখবা?
কনে?
এইতো, আমাগো
গেরামেই। খুব ভাল পোলা, মা বাপ ভাই বইন কেও নাই ভাল জমিজমা
আছে আবার রাস্তার মোড়ে একটা দোকানও আছে।
এই
পোলা কি আমার মত গরীব মাইনসের বইন বিয়া করব? আমার
কি দেওনের কিছু আছে? বাড়ির ভিটা আর ২/৩ পাকি জমি এ ছাড়া আর কিছুই নাই হে কথা
তুমরা সব জান
না
না কিচ্ছু লাগব না। হে খালি একটা ভাল মাইয়া চায়। ঘর সংসার সামাল দিতে পারব এই রকম
একটা মাইয়া, তুমার বইনতো দেখতে শুনতে ভালই
কি
জানি রমিজ ভাই, যদি তার পছন্দ হয় তাইলে তুমি দেহ
কাইল
বাড়ি থাকবা?
হ
থাকুম, আর কনে যামু? শরীলডা ভাল না কামে যাইতে
পারতেছি না কয় দিন ধইরা
আইচ্ছা
তাইলে কাইল আসরের পর আমি পোলারে নিয়া আসুম তুমি থাইকো
৩।
বাচ্চু
মিয়ার বোন দেখতে শুনতে বেশ রূপবতী, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, কোমর
পর্যন্ত চুল, পটলের মত চোখ, ধারালো নাক আর কি চাই? তারপরে
আবার কাজে কর্মেও তেমনি চোখা। গরীবের ঘর থেকে বের হলে জেল্লা আরও বাড়বে বই কমবে
না। রূপ যৌবন ভরা এই মেয়ে দেখে মজে গিয়ে ফজর আলির মনে ধরে গেল আর সাথে সাথে মোল্লা
ডেকে বিয়ে পড়িয়ে বৌ বাড়ি নিয়ে এলো। পণ যৌতুকতো দূরের কথা বাচ্চু মিয়ার অবস্থা দেখে
চিকিৎসা করাবার জন্য তার হাতে হাজার দুই টাকা দিয়ে এলো।
আম্বিয়া
শ্বশুর বাড়ি এসে দেখে তার বাড়িতে দুই একজন কাছের আত্মীয় ছাড়া আর কেও নেই। তারাই
বাড়ি ঘর ফসলাদি দেখা শোনা করে, রান্না বান্না করে। বাড়িতে পা দিয়েই
আম্বিয়াকে তার স্বামী সব বুঝিয়ে দিল। আম্বিয়াও সব বুঝে শুনে নিল। আত্মীয়রা যারা
ছিল তারা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। এতদিন ইচ্ছে মত চলাফেরা করেছে এখন আর সে উপায়
থাকবে না। বাড়ির বৌ এসেছে তাহলে সেই গিন্নী হবে এটাই নিয়ম নিশ্চয়ই সে সব কিছু তার
হাতের মুঠোয় নিয়ে নিবে! ফজর আলি এত দিন তার নিজের কেও ছিলনা বলে এদের আশ্রয়
দিয়েছিল কিন্তু এখন নিজের বৌ এসেছে কাজেই সংসারের চাবি কাঠি তার কাছেই থাকবে এমন
ব্যবস্থাই করে দিল। উঠতি সংসার। কয়েকদিনের মধ্যে আম্বিয়া সব কিছু মোটা মুটি দেখে
শুনে বুঝে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। রান্না বান্না এখন সে নিজেই করে। স্বামী কি খায়
কি খায়না জেনে নিয়েছে।
সকালে
উঠে ফজর আলি ঘুরে জমি জমা দেখে এসে নাশতা খেয়ে দোকানে চলে যায়। দোকানের কর্মচারী
কুদ্দুস সকালেই দোকান খুলে। ফজর আলি দুপুরে দোকান থেকে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে
বিকেলের দিকে দোকানে চলে যায় আবার রাতে বেচাকেনা করে হিসাব নিকাশ সেরে আসে। সকালে
বা রাতে পুরনো রাখাল বেলালকে বুঝিয়ে দেয় কোথায় কি করতে হবে।
নানা
রকম ফসলাদি কোনটা রোদে শুকিয়ে কোন ঘরে তুলতে হবে কোনটা বাজারে নিতে হবে এগুলিও এক
সময় আম্বিয়ার হাতেই চলে আসে। ফসল বিক্রির টাকা পয়সাও আম্বিয়ার হাতেই আসে। এত দিন
গরীব ভাইয়ের সংসারে থেকে নিজেকে চেপে রাখতে হয়েছিল। মনের কোন সাধ আহ্লাদ কিছুই
করার সুযোগ পায়নি। আজ তার দু হাত ভরা, যা চায় তাই পায় দরকার হলে
ফজর আলিকে দিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে এনে নেয়। নিজের ইচ্ছে মত সংসার করার সুযোগ পায়নি।
ভাইয়ের বৌয়ের অধীনে থাকতে হয়েছে। এখন সে স্বাধীন।
আজীবন অভাবের মধ্যে থাকা আম্বিয়া বেগম হঠাৎ করে হাতে হিসেব ছাড়া টাকা পয়সা
পেয়ে অনেক বদলে গেছে আগের মত নেই। স্বামীর জোরে আজ তার আঁচলের চাবি দিয়ে তালা দেয়া
লোহার আলমারিতে টাকার বান্ডিল রেখে দিয়েছে তার হিসেব নেয়া বা দেয়ার মত কেও নেও, সেই
সব,
সবই
তার। ফজর আলি এদিকে কোন নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
৪।
রাতের
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আম্বিয়া বেগম পান বানিয়ে স্বামীর হাতে এনে দেয়। ফজর আলি পান
চিবায় আর স্ত্রীর সাথে দিনের ফিরিস্তি নিয়ে আলাপ পরামর্শ করে। পান চিবাতে চিবাতে
ফজর আলি বলল
কাইল
কিছু টাকা দিও, আমার একটু নবগ্রাম যাওয়া লাগব
টাকা
নিয়া নবগ্রামে কি করবা?
ভাইজানরে
কিছু টাকা দিয়া আসি
ও, আইচ্ছা
যাইও, কত টাকা দিবা?
অন্তত
হাজার খানিক দিও, না কি কও?
তুমার
যা খুশি দিবা, আমি কি কমু?
এভাবে
উদার বোন জামাই বাচ্চু মিয়ার দেখা শুনা থেকে শুরু করে তার সংসারের অনেক দায়িত্ব
নিয়ে নিয়েছে তবে সে কোনদিন এ কথা বলতে পারবে না যে তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম তাকে এ
কাজে অনুরোধ করেছে বা তাগিদ দিয়েছে। যা দেবার ফজর আলি নিজেই দিয়েছে। ইচ্ছা করলে
আম্বিয়া বেগম আরও কিছু বেশিই দিতে পারত কিন্তু স্বামী নিজেই যা করছে তাতেই সে
সন্তুষ্ট। বাচ্চু মিয়ার অসুখের চিকিৎসা, তার সংসার চলার ব্যবস্থা
সবই বোন জামাই চালাচ্ছে। আম্বিয়া বেগম ভীষণ খুশি। মাস বছর যাবার সাথে সাথে সংসারের
যাবতীয় কর্তৃত্ব আম্বিয়া বেগমের হাতে চলে এসেছে। ফজর আলির এত দিকে তাকাবার সময়
নেই।
বাচ্চু
মিয়া আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আবার ওসমান সাহেবের বাড়ি থেকে
মেয়েটাকেও ছাড়িয়ে এনে বিয়ে দিয়েছে। এখন তার ঘরে সচ্ছলতা না এলেও আগের মত অভাব নেই।
বড় লোক বোন জামাইর কৃপায় তার দিন ফিরেছে। ছোট দুই ছেলেকে স্কুলে দিয়েছে।
৫।
মানুষ
শুধু নিজের স্বার্থই চায়, নিজের সুবিধার জন্য অন্যের অসুবিধার
কথা বিচার করতে রাজী নয়। এত দিন অভাবের মধ্যে থেকে বাচ্চু মিয়াও এর বাইরে যেতে
পারেনি। বাচ্চু মিয়ার এত কষ্টের দিন কি ভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আর সে জায়গায় নতুন
করে সুখ পাখি এসে কেমন করে ডালে বসল সে হিসাব করার কি দরকার? এগুলি
যে কোন যাদু মন্ত্র দিয়ে হয়নি সে কথা বোঝার মত ইচ্ছা বা মনোবৃত্তি বাচ্চু মিয়ার
হাতে নেই। বাচ্চু মিয়া পরের ধন পেয়ে ফেলে আসা পিছনের হিসেব মিলিয়ে দেখার ইচ্ছা করে
না। হঠাৎ করে জেগে ওঠা সচ্ছলতার স্রোতের বান কোথা থেকে আসল কি ভাবে আসল তার কিছু
জানার দরকার নেই। শুধু আরও চাই আরও দাও।
এটা নেই ওটা নেই, নেই নেই অনেক কিছুই নেই। নেই কথাটা
কখনও শেষ হতে চায় না। এত নেই এত দিন কোথায় ছিল? কে
জানে এই কাহিনী? কেও জানে না! শুধু জানে ফজর আলি! ফজর আলি তার সুন্দরী
স্ত্রীর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হলে বাচ্চু মিয়ার দিকে তার
খেয়াল রাখতেই হবে।
এত
দিনে তার বাড়ি ঘরের চেহারাও কিছু বদলে গেছে। ফজর আলি যখন আম্বিয়া কে বিয়ে করে
তখনকার মত গমের ডাটার চালা দেয়া বাঁশের বেড়ার ঘর আর নেই সেখানে এখন টিনের দোচালা
ঘর উঠেছে। ফজর আলি যা দরকার মনে করেছে তা দিয়েছে। ভাই এর যখন যা প্রয়োজন হয়েছে
আম্বিয়া বেগমও তার হাতে যা ছিল, তা দিতে কৃপণতা করেনি। করবেই বা কার
জন্য? তার কি ছেলে মেয়ে কেও আছে?
এদিকে
বাচ্চু মিয়ার মাথায় নতুন ফন্দি এসেছে। ইদানীং বোন এবং বোন জামাইকে ভাল করে খাতির
আপ্যায়ন করতে শুরু করেছে। শীতের পিঠা, অঘ্রাণ মাসে হাসের মাংস
দিয়ে ফজর আলির প্রিয় চাউলের রুটি, আম কাঁঠালের দিনে আম দুধের
নিমন্ত্রণ, এমনি যখন যা আসে সম্বন্ধীর বাড়িতে ফজর আলির নেমন্তন্ন
লেগেই থাকে। এ ভাবেই কয়েক বছর চলে গেল
ওদিকে
দিন চলে যায় কিন্তু আম্বিয়ার গর্ভে কোন সন্তান সম্ভাবনার দেখা নেই। ফজর আলি কি আর
কম চিকিৎসা করিয়েছে, নিজের এবং স্ত্রীর। কিন্তু কোন সুফল পায়নি। আশে পাশে নানা
জনে নানা আলাপ করলেও বাচ্চু মিয়ার এতে কোন বিকার নেই, তার মনে হয় আম্বিয়ার বাচ্চা
না হলেই ভাল!।
[
বাচ্চু মিয়া হুঁকা টেনে কি বোনের কথা ভাবছে? তাহলে? সে কি সিদ্ধান্তে পৌঁছাল সে
কথা জানতে একটু অপেক্ষা করতে হবে। ]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।