১০৭।
এই হলো
এই দেশের অবস্থা, অধিকাংশই
এইরকম, এতো তবুও ইউনিভার্সিটি
পর্যন্ত গেছে,
বেশির
ভাগ স্কুল পর্যন্তই শেষ, তারপর বাবার ব্যবসা কিংবা সরকারি ভাতা, এই হলো এখানকার জীবন।
আবার অনেক আছে যারা স্কুলও শেষ
করেনা। এদের কথা হলো, লেখাপড়া করে কি হবে? আমি লেখা পড়া না করেই
জাগুয়ার,
মার্সিডিজ
কিংবা বিএমডব্লিউ গাড়ি চালাচ্ছি, তো লেখা পড়া করা এমন কি প্রয়োজন? বাংলাদেশে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে কয়জন
লোক গাড়ি চালায়?
তারা
দেখি বাস নয়তো রিকশায় চলাফেরা করে, আমাদের এখানে এসে আমাদের রেস্টুরেন্টে কাজ করে। এখন বলেন
তার দাম বেশি নাকি আমার দাম বেশি? লেখাপড়া করা মানে বেহুদা সময় নষ্ট করা। শুনে রাশেদ সাহেব
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, এই
কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? আমরা যাদের দিকে তাকিয়ে আছি, এরাই কি তারা? ধীরে ধীরে পৃথিবী বদলে
যাচ্ছে। না ভুল হলো, পৃথিবী বদলাচ্ছে না। বদলাচ্ছে মান মর্যাদা, সম্মান, ন্যায় নিতি, লজ্জা, মূল্যবোধের সংজ্ঞার
ধরন প্রকৃতি,
কৃতিত্বের
সুখ বোধ,
সৃষ্টিসুখের
আনন্দ এবং নির্ভেজালের প্রকৃত স্বাদ।
আধুনিক
হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করে মানুষ উন্নত হচ্ছে না কি হচ্ছে? কোন আধুনিক কি
চিরস্থায়ী?
আজ যেটা
আধুনিক কিছু দিন পরেই তো সেটা সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। আবার তখন যারা নিজেকে আধুনিক
ভাবছে সেই তো আবার তার সন্তানের কাছে সেকেলে হচ্ছে। আমি যখন আমার মা বাবার কাছে
আধুনিক ছিলাম বাড়িতে যখন কোন নতুন যন্ত্রপাতি কেনা হোত বাবা আমাকে দেখাতেন দেখত
এটা কি ভাবে চালাতে হবে। আর আজ সেই আমাকে ক্লাস ফাইভে পড়া আমার নিজের মেয়ের কাছে
কম্পিউটার শিখতে হয়েছে। কি দাঁড়াচ্ছে শেষ পর্যন্ত? কোথায় চলেছি আমরা? বাবা যেমন বলেছেন আমরা
তোমাদেরকে যেভাবে মানুষ করেছি তোমরা তোমাদের সন্তানদের সে ভাবে মানুষ করতে
পারবেনা। তাই বলে মানুষের বোধ শক্তি গুলি এভাবে পরিবর্তন হচ্ছে কেন? কই, শীত গরম, স্পর্শ আঘাত এগুলির
বোধের তো কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। তবে যা দিয়ে আমরা সৃষ্টির সেরা বলে দাবি করি, নিজেকে পশু নয় মানুষ
বলে দাবি করি সেই অনুভূতি গুলি পরিবর্তন হচ্ছে। হতে পারে, মানুষের চাহিদা রুচির পরিবর্তন হতে পারে।
কিন্তু, ধ্যান ধারনা, মানসিকতা, প্রবৃত্তি কেন
পরিবর্তন হচ্ছে?
শহরের
কথা না হয় নাই বা ধরলাম মানুষের প্রয়োজনে শহর খুব দ্রুত রূপ বদলায়। আমার গ্রামে
যেখানে ইছামতী নদী বয়ে যাচ্ছে, নয়াবাড়ির তালগাছটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, গ্রাম গুলি সেই ভাবে
ছড়িয়ে আছে,
গ্রামের হালট বা সড়ক গুলি সেই
ভাবে বিছানো রয়েছে যে ভাবে আমার দাদা দেখেছেন, আমার বাবা দেখেছেন, আমি দেখছি আমার
সন্তানেরা দেখবে। যে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে আমার দাদা পাঠশালায় গেছেন আমিও সেই নদীর
পাড় দিয়ে হেঁটে স্কুলে গেছি। যে গাছের তাল কুড়িয়ে এনে আমার দাদা আমার দাদির হাতে
দিয়েছে আমিও সেই গাছের তাল কুড়িয়ে এনে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে পিঠা বানাতে বলেছি। আমার
দাদা কিংবা তার দাদা গ্রামের যে হালট দিয়ে হেঁটে ঝিটকা হাট থেকে ইলিশ মাছ কিনে এনেছেন আমার
বাবাও তাই করেছেন আমিও তাই করছি। সেই গ্রাম সেই নদী সেই হালট তেমনই আছে। বৈশাখের হিজল বকুলের
গন্ধ, ঝড়ে আম কুড়ানো, জ্যৈষ্ঠের আম পাকা
ভ্যাপসা গরম,
আষাঢ়ের
ঢল, শ্রাবণের ধারা, কার্তিকের জলজ উদ্ভিদ
পচা গন্ধ,
অঘ্রানের
নতুন ধানের গন্ধ, মাঘের
হাড় কাঁপানো শীতের রাতে পিঠা, ফাল্গুনের আম বাগান তলার দখিনা সমীরণ, গাছে গাছে নতুন পাতার
কুড়ি, নতুন ফুলের ঘ্রাণ, চৈত্রের সেই কাঠ ফাটা
রোদে বুকের ছাতি ফাটা তেষ্টা এর তো কিছুই বদলায়নি।
আমরা
বদলে গেছি। আমার সন্তানেরা আজ তালের পিঠা চায় না, নারকেলের লাড়ু চায় না। তারা
ক্যাডবেরি,
বার্গার, পিজা, ইগলু আর ম্যাকডোনাল
খুঁজে। ডাব কিংবা ঘোলের পরিবর্তে চায় কোক। দশ
টাকা দিয়ে আড়াইশ এমএল দুধ না খেয়ে দশ টাকায় এক বোতল কোক বা পেপসি খাবে। এটা
হতে পারে,
অভ্যাস
গত রুচির কারণে। পরিবর্তন এটুকের মধ্যেই সীমিত থাকলে যথেষ্ট হতে পারতো। তা না হয়ে
এসব কি হচ্ছে?
১০৮।
চারিদিকে
আতশ বাজির ধুম,
কান ফেটে
যাবার অবস্থা। এদিকে কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শহর সাজানো হচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে রঙ
বেরঙ্গের নক্সা,
ফুল, ছবি এইসব দিয়ে। রাতের
জন্য আলোক সজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে। দিনে কিংবা রাতে সারা শহর ঝলমল করছে। সকল দোকান, অফিস, ব্যাংক সবাই নিজ নিজ
প্রতিষ্ঠান সাজাবার প্রস্তুতি নিয়েছে। কার চেয়ে কে বেশি সুন্দর করবে প্রতিযোগিতা
চলছে। বাড়ি ঘরের মালিকেরাও বসে নেই, নিজ নিজ বাড়ি নানা ডিজাইনের আলো জ্বেলে সাজিয়েছে। বন্ধু
বান্ধবী,
প্রেমিক
প্রেমিকা,
স্বামী
স্ত্রী সন্তান সন্ততি নিয়ে পুরো পরিবার সহ উৎসব উপলক্ষে রেস্টুরেন্টে পার্টির
আয়োজন করছে। কয়েক দিন আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছে, যদি সময় মতো জায়গা না পায় তাই।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বা অফিসের মালিক তার কর্মচারীদের নিয়ে পার্টি দিচ্ছে। প্রতি
দিন চার,
আট, দশ বারো জনের পার্টি
লেগেই আছে। সবাই ব্যস্ত, দোকানে বেচা কেনার ধুম। যার যা প্রয়োজন কিনে নিচ্ছে। প্রিয়
জন কাকে কি উপহার দিতে হবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে। বিশেষ করে যারা দূরে থাকে
তাদের উপহার ডাকে পাঠাতে হবে তাই ডাক বিভাগ রয়াল মেইল ভীষণ ব্যস্ত।
সেই
সাথে রাশেদ সাহেবের কাজের ব্যস্ততাও বেড়েছে। কাজ বুঝে উঠেছে, এখন তেমন কষ্ট হয়না, আগের মত ত্রাসের মধ্যে
থাকতে হয়না,
বস্তা
টানার কাজ করতে হয়না। রেস্টুরেন্টে ব্যবসা হচ্ছে। মালিক খুশি, প্রতিদিনই টেক এওয়ে বা
ভিতরে বসে খাবার সংখ্যা বাড়ছে। কিচেনে একজন লোক নেয়া হয়েছে, সামনেও পার্ট টাইম
একজন নেয়া হয়েছে। এখন কাজের মধ্যে কোন ভুল ভ্রান্তি তেমন হয়না। কাস্টমার সব বিদায়
হবার পর ইস্ত্রি করা সার্ট প্যান্ট টাই পরে জমে থাকা মদের গ্লাস, ছুরি কাটা চামচ ধুয়ে
মুছে, টেবিল চেয়ার গুছিয়ে
সেটিং করে রেখে,
ফ্লোর
হুভার করে খেয়ে দেয়ে বাসায় চলে যায়।
ডিউটিতে
যাবার আগে গায়ে স্প্রে করা পারফিউমের গন্ধ মুছে গিয়ে ফেরার পথে শরীরে মদের গন্ধ
নিয়ে ফিরে। হোক না মদের গন্ধ, তাতে ক্ষতি নেই। সেদিন দেলু বলছিলো উহ! ভাই সাহেবের শরীর
দিয়ে গন্ধ হয়ে গেছে, খেয়েছেন
নাকি একটু?
দেলু ভাই
যে কি বলেন,
আমি
খাবার সুযোগ পেলাম কোথায়? আজ পুরো এক ব্যারেল মানে প্রায় নব্বই পাইন্ট ইন্ডিয়ান
কোবরা গেছে,
রেড
ওয়াইন খেয়েছে সাত বোতল, শ্যাম্পেন দিয়েছি দুই বোতল অন্যগুলি তো আছেই। ওই যে সাত
জনের এক টেবিল ছিলো, সেই
টেবিলে একজন খেয়েছে নয় পাইন্ট কোবরা। দেলু যাই বলুক এতে কি আসে যায়? সারা রাত মদের মধ্যে
ডুবে থাকি গন্ধ তো হবেই।
ময়না
ভাই বলেছে ক্রিস্টমাসের এই কয় দিন ছুটি পাবে না, তার পরিবর্তে নগদ নিয়ে নিবেন।
রাশেদ সাহেব ভেবেছেন ভালোই হবে, ছুটির এমন কি দরকার? তার চেয়ে যদি কিছু বেশি আয় হয়
মন্দ হবে না। ছুটির চেয়ে তার রানীর মাথার ছবি ছাপানো স্টার্লিং পাউন্ডের প্রয়োজন
বেশি। অনেক বড় টাকা! অনেক মূল্য! যা দিয়ে অনেক অভাব দূর করতে পারবে। যে জন্য দেশ, সন্তান এবং স্ত্রী
ছেড়ে এই দেশে এসেছেন সেই প্রয়োজন কিছুটা হলেও মেটাতে পারবেন। আর মাত্র এক সপ্তাহ
বাকি আছে তারপর ক্রিস্টমাস।
ময়না
ভাই বললো-
-এবার
আমাদের রেস্টুরেন্ট ডেকোরেশন করতে হবে।
-করেন, কি ভাবে করেন আমাকে
বলেন কাল দুপুরেই করে ফেলি।
ঝাঁর
বাতি, আলোক সজ্জার লাইট আগেই
তোলা ছিলো সেখান থেকে বের করে সেট করা হলো। দোকান থেকে একটা প্লাস্টিকের
ক্রিস্টমাস ট্রি আনা হলো। কিছু রঙ বেরঙ্গের ঝিলিমিলি কাগজে নক্সা করা সাজাবার
জিনিষপত্র সব কিছু এনে লাঞ্চ টাইমের মধ্যেই সব করা হয়ে গেলো। রাতে ডেকোরেশন লাইট
জ্বালানো হয়েছে। ক্রিস্টমাস ট্রিটাও লাইটিং করা হয়েছিলো সেটা জ্বলছে নিভছে, বেশ সুন্দর একটা
পরিবেশ। কাস্টমার আসছে, খাচ্ছে পান করছে, নিজেদের মধ্যে গল্প হাসাহাসি হৈচৈ করছে যাবার সময় বিলের
সাথে টিপস দিয়ে যাচ্ছে। ময়না ভাইকে জিজ্ঞেস করলো এই টিপস কি হবে? ওগুলি এই যে এই লাল
বাক্সে রেখে দেন। রাতের হিসাবের পরে টিপস গুনে নিয়ে বিক্রির টাকার সাথে মিশিয়ে ময়না
ভাই পকেটে ভরে নিয়ে গেলো।
ব্যবসায়
যতই লাভ হোক না কেন মালিকেরা সাধারণত অনেক টাকা ব্যয় করে ব্যবসা পরিচালনা করে, তাদের সবসময়ই টাকার
প্রয়োজন থাকে। টাকার চাহিদা তাদের ছেড়ে কখনো দূরে যেতে পারে না। ব্যবসায় যে যত
বেশি টাকা চালান খাটায় তার তত বেশি টাকার প্রয়োজন। টিপসের ঐ টাকা দিয়ে কাল হয়ত
লন্ড্রি বিল নয়তো গ্যাস বিল দেয়া যাবে। বিলের হিসাবের বাইরে কাস্টমার যদি খুশি হয়ে
কিছু দিয়ে যায় তাহলে এতে তারই অধিকার। সে এত টাকা খরচ করে দোকান সাজিয়ে বসেছে এই
জন্যেই তো টিপস দিয়েছে। কর্মচারীরা ভালো সার্ভিস দিয়েছে সেটা তাদের ডিউটি, সেজন্য টিপস পেতে
পারেনা। তাদেরকে তো বেতন দেয়া হচ্ছে। বোকা কাস্টমার হয়ত মনে করেছে আহা বেচারা
কর্মচারীরা বেতন টেতন পায়না এদের কিছু টিপস দিয়ে যাই।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।