অঘ্রাণ মাসের প্রথম দিকে জামালের বোনের বিয়ে হল ঘিওর বাজার
থেকে পশ্চিমে জাফর গঞ্জ গ্রামে। খুব আদরের বোন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পর সেই যে গেল আজ একমাস
হয়ে গেল আর আসছে না। জামাই ঘিওর
বাজারে দোকান করে, খুব ব্যস্ত মানুষ তাই নতুন বৌ নিয়ে
শ্বশুর বাড়ি বেড়াবার মত যথেষ্ট সময় হাতে নেই। শেষ পর্যন্ত জামালকেই বোনের বাড়ি যেতে
হচ্ছে বোনকে আনার জন্য। মা খুবই চাপাচাপি করছিল।
ঠিক আছে মা, আইজ সন্ধ্যায় গরু বাছুর বাইন্ধা রাইখা যামু আর
কাইল দুফুরের আগে তোমার মেয়ে আইনা দিমুনি চিন্তা কইর না
সত্যি সত্যি সন্ধ্যার একটু আগেই ধুপ দিয়ে, মশারী টানিয়ে গরু
বাছুর সব গোয়াল ঘরে বেধে রেখে মুখহাত ধুয়ে পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে কাঁধে একটা চাদর ঝুলিয়ে
মাথা আঁচড়িয়ে মায়ের সামনে এসে বলল
মা আমি চললাম।
ঢাকি জোড়া থেকে জাফর গঞ্জ পাঁচ ছয় মাইল পথ যেতে আর কতক্ষনইবা
লাগবে! তার মধ্যে চাঁদনি রাইতে যাইতে কোন অসুবিধা নাই। জামাল হেটে চলেছে। একটু একটু
জোসনা যা ছিল বেশ ভালই ছিল কিন্তু হঠাৎ কি হলো আকাশ আস্তে আস্তে মেঘে ঢেকে গেল। তবুও চাঁদনী রাত বলে
বেশ ভালই আলো আছে। কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে। অঘ্রাণ মাসের গ্রামীণ রূপ সাধারণত যেমন হয় তেমনি।
মেঠো পথে লোকজন চলাচল কমে এসেছে। এর মধ্যেই মহাদেব পুর পৌঁছল। এক চায়ের দোকানে বসে একটু লাল চা খেয়ে সড়ক
থেকে নেমে ক্ষেতের আইল দিয়ে আবার হাটা। না, এই মেঘ কেটেও যাবে না বা বৃষ্টিও নামবে
না। থাক যেমন আছে তেমনই থাক। আইলের পাশে খেসারী কলই, গম সরষে সহ নানান চৈতালি ফসল।
ধনে পাতা সহ নানা ফসলের গন্ধে
বেশ লাগে
পথ চলতে। তারপরে যদি বোনকে
এতদিন পরে দেখার আগ্রহটা মনের মধ্যে জমে থাকে তাহলে সবকিছুই ভাল লাগে। ঘিওর বাজারে
এসে দেখে বোন জামাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে গেছে। থাকলে ভালই হতো, কথায় কথায় যাওয়া
যেত।
বাজার ছেড়ে অনেকটা পথ চলে এসেছে প্রায়। যমুনার পাড় দিয়ে চলছে।
দুই পাশে কি সুন্দর সরষে ক্ষেত। আমাদের ওদিকে এত সুন্দর সরষে হয় না, এদিকে নদীর পাড়ে
তাই এত সুন্দর সরষে হয়। এই এলাকায় শুধু সরষে কেন সব ফসলই ভাল হয়! এইতো সামনের এই গম
ক্ষেতে কত সুন্দর গম হয়েছে বিঘাতে অন্তত আট দশ মনতো হবেই! হঠাৎ ওইতো গম ক্ষেতের ওপাশে
থেকে ফত ফত শব্দ আসছে না! কান পেতে শুনল কিছুক্ষণ। হ্যাঁ তাইতো ফত ফত শব্দ! কিসের শব্দ?
একটু দাঁড়াল!
না, ঠিকই
শুনছি, কোন ভুল নেই! কি ব্যাপার এই শব্দ আসছে কোথা থেকে? আশে পাশে কোন মানুষ বা প্রাণী
দেখা যাচ্ছে না। কিসের শব্দ? জামাল একটু দাঁড়াল। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে আকিজ বিড়ি বের
করে একটা জ্বালাল। আকিজ বিড়ি টানছে আর এদিক ওদিক দেখছে। না, কোন জনমুনিষ্যির সারা তো
দূরের কথা কারও কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না! আশ্চর্য! খুব বেশি রাত হয়েছে নাকি? আকাশের
দিকে তাকিয়ে দেখল চাঁদ খুব বেশি উপরে ওঠেনি। মেঘলা আকাশ। কিছু কিছু মেঘ তার মত মুসাফির
হয়ে দ্রুত চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলতে
খেলতে উড়ে আসছে আবার দ্রুত চলেও যাচ্ছে।
একটু ভয় পেল তবে ভূতের ভয় না, ডাকাতের ভয়! কয়েকদিন আগে এই এলাকায়
বিরাট এক ডাকাতি হয়েছে! কিন্তু এই খোলা মাঠে ডাকাত কোথায়? কাওকেই যে দেখা যাচ্ছে না!
অবাক লাগছে আবার সাথে ভয়ও করছে কিন্তু কাওকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতও পাচ্ছে না। কি করা
যায়? এদিকে হাতের বিড়ি শেষ হয়ে এসেছে। এক সময় জ্বলন্ত বিড়ির শেষ অংশ ফেলে দিয়ে আবার
অনেকক্ষণ ভরে খুব মনোযোগ দিয়ে চারিদিকে ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিন্তু ফলাফল
ওই একই। এইবার সমস্ত শরীর শির শির করে উঠল। গা ছম ছম করে ভয়ের একটা চিনচিন ভাব
পায়ের বুড়া আঙ্গুল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল।
না: কোন অবস্থাতেই ভয় পেলে চলবে না এটা নিজের এলাকা না। বোনের বাড়ির এলাকা। জানাজানি
হলে মান সম্মানের ব্যাপার আছে। কাজেই ভয় ডর কিছুই হতে পারবে না! আরও একটু এগিয়ে যেতে
চাইল কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। পিছিয়ে যাবে? না, তাই বা কি করে করি! মাকে
বলে এসেছি কাল দুপুরের মধ্যে তার মেয়েকে এনে দিব! এখন কি করি? না: এগুতেই হবে। এক পা
দুই পা করে এগিয়ে যায় আবার দুই পা পিছিয়ে আসে। বেসামাল কিছু থাকলে বিপদ হবে। আবার একটা
বিড়ি জ্বালাল। এবার বিড়ি হাতে একটু একটু করে এগিয়ে গেল। গম ক্ষেত পর্যন্ত এগিয়েই থেমে
গেল। এখনও শব্দের কোন উৎস খুঁজে পাচ্ছে না অথচ এখনও শব্দ হচ্ছে। গম ক্ষেতের ওপাশে সরষে
ক্ষেত, বেশ লম্বা হয়েছে গাছগুলি। হঠাৎ হাঁচি এলো। হাঁচি দিয়ে দেখে সরষে ক্ষেতের ওপাশ থেকে কি যেন
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। চাঁদের নিচে থেকে মেঘের টুকরা সরে যাবার পর দেখল গরুর ছোট এক বাছুর।
কিন্তু এটা গরুর বাছুর দেখার পরেও নিশ্চিত হতে পারছিল না! এখানে এই বাছুর একা আসবে
কোথা থেকে? হতে পারে কোন গৃহস্থের বাড়ি থেকে চলে এসেছে অথচ কারো চোখে পড়েনি। গরু ভাবছে
গেরস্ত বাছুর সরিয়ে রেখেছে তাই ডাকছে না। হ্যাঁ তাই হবে। এমনি এক দ্বিধার মধ্যে পড়ে
গেল এটা কি আসলেই বাছুর নাকি বাছুরের বেশে আর কিছু? এমন সময় বাছুরটা হাম্বা করে ডেকে
উঠল। সাহস নিয়ে একটু একটু করে কাছে যেয়ে বাছুরের গলায় হাত দিয়ে আদর করে বলল কি রে এখানে
আমারে ডর দেখাইবার জন্য একলা একলা কেমনে আইলি?
বাছুর যখন সরষে ক্ষেতের বেড়ে ওঠা মজার ঘাস টেনে টেনে খাচ্ছিল
তখন ফত ফত শব্দ হচ্ছিল।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।