গত
প্রায় একটা বৎসর বার্মিংহামেই কাটালাম। বার্মিংহাম শহরের উত্তরে এক নিভৃত পল্লীর
ছোট্ট একটা রাস্তার পাশে ছোট্ট ঘরে। বেশ কেটে যাচ্ছিল। কোন হৈ চৈ নেই, পাশেই একটা পাব কিন্তু
কোন সারা শব্দ পাইনি কোন দিন, অবশ্য
পাবই বা কি ভাবে, যখন পাবের বাজনার তালে উত্তাল
উচ্ছল মদিরার আবেশে জীবনের শূন্যতা কাটাতে আসা টলমল নর নারীর গানের নামে বেসুরো
চিৎকার আর হাত পা ছুড়ে নাচের ঝঙ্কারে উন্মত্ততা চলতে থাকে সে সময় তো আর আমি এখানে
থাকি না,
প্রায়
ত্রিশ মিনিট হেটে চলে যাই আমার রুটি রুজির তল্লাশে ডাডলি রোড ইস্টে। হেটেই যাই, ডায়াবেটিসের রুগী বলে
হাটার উছিলায় শরীরের অহেতুক কেলরি ঝেড়ে ফেলাও হয় আবার তার সাথে বাস ভাড়া নামে পকেট
থেকে বেড় হয়ে যেতে চাওয়া পাউন্ড গুলিও পকেটেই থেকে যায়। কত সুবিধা।
এক রাতে
ডাডলি রোড ইস্টে এদেশের নির্মাণ কাজে পারদর্শী এক কোম্পানির নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ
কক্ষে সিসি টিভির সামনে বসে ডিউটি করছিলাম তখন আমার কোম্পানির মুল নিয়ন্ত্রণ দফতর
থেকে ফোন এলো। মুল কথা জানিয়ে দিল যে এখানকার পাট শেষ, তুমি পরশু রাতে ডিউটি করে সকালে
রওয়ানা হয়ে নিউক্যাসেলে চলে আস তোমার জন্য এখানে স্টেশনের কাছেই একটা বাসা দেখে
রাখা হয়েছে।
এ আবার
কি আচরণ। আর ক দিন পরেই ঈদ, ভেবে রেখেছি পাশের শহর গ্লস্টার আর স্ট্রাউডে ছোট দুই ভাই
থাকে বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে, তাদের সাথে ঈদ করবো, আর এই মুহূর্তে বলছে নিউক্যাসেলে
যেতে! বলে দিলাম এ সময় আমি ঈদ না করে যেতে পারবো না। ঈদ করে দুই সপ্তাহ ছুটি
কাটিয়ে তারপর যাব। এদেশে আবার ছুটির কথা বললে ভিন্ন চোখে বিচার করে। বৎসর ভরে
মেশিনের মত কাজের পর মাথার নিয়ন্ত্রণ ভার যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে চায়, ভাব আদান প্রদানের
পথের সংযোগ তার গুলি জায়গায় জায়গায় ঝলসে যায় সেগুলি ঝালাই করে নেয়ার জন্য ছুটির যে
কত প্রয়োজন তা এরা হারে হারে বুঝে। কাজেই কেও যখন ছুটির কথা বলে তখন আর নিষেধ করে
না। আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুমি আগামী ৩০ তারিখেই আস।
সেদিন
সকালে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পরলাম। বিকেলে ঘুম ভাঙ্গার পর বার্মিংহামের স্মলহীথে অফিস
করতে আসা মেঝ ভাই অপুকে ফোন করে বলে দিলাম যেন শুক্র বারে অফিস করে যাবার পথে
আমাকে নিয়ে যায়,
আমার
এখানকার পাট শেষ। আর আসার সময় যেন কিছু মাংস নিয়ে আসে। সেঝ ভাই নিপুর বৌ ঈদের দিন সকালে আমাদের বাড়ির প্রথানুযায়ী সকালে
খিচুড়ি আর মাংস রান্না করবে, রাতে মাংসের সাথে চালের রুটি। গাটঠি বোচকা ঝোলা ঝুলি বেধে
ছেদে রেডি হয়ে বসে রইলাম। অফিস শেষ করে স্ট্রাউডের বাসার ঈদের কেনা কাটা করে দুপুর
তিনটায় অপু এসে বাসার নিচে গাড়ি পার্ক করে উপরে উঠে এলো। মালামাল নামিয়ে গাড়িতে
উঠিয়ে রওয়ানা হলাম গ্লস্টারের পথে। গাড়িতে বসে দুই ভাই নানা রকম আলাপ পরামর্শ করতে
করতে এলাম। ঈদের দিন কখন কোথায় যাব সব ঠিক হলো। অপু বলেছিল নিপুর সাথে আলাপ হল না
ও কি প্রোগ্রাম করে রেখেছে তাতো জানিনা। আমার সাথে নীলিমার যা আলাপ হয়েছে তাতে ওরা
তেমন কিছু প্রোগ্রাম করেনি, রায়নার সাথেই ওরা যা করার করবে।
গাড়িতে
বসেই নীলিমাকে ফোন করলাম, নীলিমা কি করছ?
দাদা
আপনি কখন আসছেন?
হ্যাঁ
আমারা মটর ওয়েতে আছি একটু পরেই আসছি।
আসেন
দাদা আমি আপনার জন্য ইফতার বানাচ্ছি।
বিলাতে বাঙ্গালি উৎসব
কি
বানাচ্ছ?
দাদা, বাড়িতে ভাবি যা যা
বানাত, আপনি যা পছন্দ করেন
তার প্রায় সবই বানাচ্ছি, সাথে হালিমও আছে।
বল কি
হালিম বানাচ্ছ?
হ্যাঁ
দাদা।
বেশ।
ইফতারির
প্রায় ঘণ্টা খানিক আগেই এসে পৌঁছলাম গ্লস্টারে নিপুর বাসায়। আমাকে নামিয়ে দিয়ে
নীলিমা আর নিপুকে আগামী কালের প্রোগ্রাম জানিয়ে অপু চলে গেল। নীলিমা বলল ভাইজান
এখানে ইফতার করে যান বলে যা যা বানিয়েছে তার একটা ছোট্ট ফিরিস্তি পেশ করলো।
হালিমের কথা জানাতেও ভুল করেনি।
শুনে
অপু বলল না আমাকে বাসায় যেতে হবে, ইফতারির পর তোমার ভাবিকে নিয়ে আবার এখানে আসতে হবে কিছু
কেনা কাটার বাকী আছে।
নীলিমা
সব কিছু করেছে। কতদিন পর বাড়ির ইফতারির আবহ। ভাবতেই কেমন যেন এক অতীত চারণের
বেলাভূমিতে হারিয়ে গেলাম। ইফতার শেষে ছোলা, পিয়াজু, বেগুনি দিয়ে টমাটো পুদিনা পাতা আর
সরষের তেল সহ নিপুর মাখানো মুড়ি, আজ সাত বৎসর পর ফিরে পেলাম।
দাদা
হালিম খাবেন কখন?
ও
হালিম! হ্যাঁ আমিতো ভুলেই গেছিলাম, না এখন আর কিচ্ছু পারবোনা।
তাহলে
একটু পরে খান।
হ্যাঁ
তাই দিও।
রাত নটার
দিকে বাড়ির বাইরে গাড়ি থামার শব্দ পেয়ে ভাতিজা তাদি বলে উঠলো ওই যে মেঝ কাকুর গাড়ি, দৌড়ে দরজা খুলেই দেখে
ছোট আপু,
মেঝ চাচী
এগিয়ে আসছে। ওরা ভিতরে এলো। অপুর বৌ রায়না হাতের ব্যাগ খুলে একটা একটা করে প্যাকেট
সবার হাতে দিয়ে বলল এটা তোমার জন্য, আমার হাতেও একটা ধরিয়ে দিয়ে বলল ভাইয়া এটা আপনার জন্য, একটু দেখে নেন সাইজ
ঠিক আছে কিনা। অবাক হয়ে আপত্তি করলাম,
আমার
জন্য কেন আনতে গেছ?
এই দেশে
এই প্রথম সব ভাই এক সাথে ঈদ করছি এতো দিন এক এক জন এক এক শহরে থেকে ঈদ করেছি। কোন
ঈদেই নতুন কাপড় তো দুরের কথা সব ঈদে নামাজও পড়া হয়নি। এই প্রথম সবাই এক সাথে ঈদ
করছি। এর আগে দুই বার ঈদ করেছি, খুকু মানে আমার বড় মেয়ের সাথে লন্ডনে। খুকু একবার সিল্কের
ফতুয়া কিনে দিয়েছিলো, মেয়েরা
সবাই ফোনে বলে বাবা তুমি যা হোক কিছু কিনে গায়ে দিও আমাদের ভালো লাগবে, তুমি নতুন কাপর গায়ে
না দিলে আমরা যে শান্তির সাথে কিছু পরতে পারবো না। তবুও কেন যেন হয়ে উঠেনি, মন থেকে কোন সায় পায়
নি। শুধু খুকু যে ঈদে ফতুয়া কিনে দিয়েছিলো সেটা হাতে নিয়েই চোখটা ভিজে উঠেছিলো, পাছে তা দেখে খুকু মনে
কষ্ট পাবে তাই আর বাড়তে দেইনি অনেক কষ্ট করে চেপে রেখেছিলাম।
বসার পর
নীলিমা হালিম এগিয়ে দিল সবাইকে। হাতের প্যাকেটটা খুলে দেখি পাঞ্জাবী পায়জামা, খুলে গায়ের সাথে
মিলিয়ে ধরে দেখে বলল হ্যাঁ ঠিকমতো আছে। আলাপ হোল। এখানকার মসজিদে সকাল সাতটায়
জামাত
বিলাতে বাঙ্গালি উৎসব
এখানেই
নামাজ পড়বো। সকাল সাড়ে ছটায় অপু স্ট্রাউড থেকে এখানে এসে আমাদের দুইজনকে নিয়ে যাবে।
নামাজ পরে এসে নীলিমার রান্না গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে সবাই এক সাথে স্ট্রাউডে
যাব।
সকালে
কাজল, আমাদের ভাগ্নের বড়
গাড়িতে ওকে নিয়ে অপু ঠিক কাটা ধরে এসে হাজির। নিপু তার চির কালের অভ্যাস মত দেরি
করেই রেডি হোল। ওর জন্য কোন দিন আমরা সময় মতো এক সাথে বের হতে পারিনি। ঈদের দিনে
সকাল বেলাই যে কারণে যার কারণে মেজাজটা বিগড়ে যেত সে এই নিপু, ওর দেরি করে বের হওয়াই
এর জন্য দায়ী। দেশের বাড়িতে চারটা বাথরুম থেকেও ওর জন্য দেরি হবেই এটা একটা নিয়ম
ছিল আর এদেশে তো চারটা বাথরুম ওয়ালা বাড়ি কল্পনাই করা যায় না।
যাই হোক
দেরি হিলেও নিপু শেষ পর্যন্ত রেডি হবার সাথে সাথেই মসজিদে চলে গেলাম। নামাজ পরে
বাসায় এসে পাঁচ ভাই ভাতিজা ভাগ্নে মিলে খিচুড়ি খেয়ে অপুর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা
হলাম। গ্লস্টার থেকে স্ট্রাউড বেশি দূরে না, ঘণ্টা খানিকের মধ্যেই এসে গেলাম।
কাছেই কাজলের বাড়ি, নেমে
কাজলকে বলে দিলাম মুন্নিকে মানে কাজলের বৌকে নিয়ে চলে আস। আপনারা যান মামা, আমি ওকে নিয়ে আসছি।
ঘরে ঢুকেই ঢাকার বাসায় ফোন করে বলে দিলাম তোমরা জি টকে বা স্কাইপিতে আস এপারের আর
ওপাড়ের গুষ্ঠি মিলে ঈদের ফিরিস্তি বয়ান হবে। কম্পিউটারে জি টকে লাইন সংযোগ হোল, একে একে এখানে ওখানে
সবাই সবার সাথে কথা হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুন্নি তার ছেলেকে কোলে নিয়ে এসে পরল।
তার কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের শহর সাইরেনসিস্টারে থাকে রায়নার বোন, দুলাভাই তাদের
বাচ্চাদের নিয়ে আসলো লন্ডন থেকে মেঝ বোনের আসার কথা ছিল কিন্তু তারা আসতে পারেনি।
বাচ্চারা হৈচৈ করে স্বাধীন ভাবে ঈদ করছিল তাকিয়ে দেখতে দেখতে অনেক দিন আগের ঘটে
যাওয়া পুরনো ঈদের দিন গুলি ঘুরে দেখে এলাম। দেখলাম তেমনি আছে, হারিয়েও যায়নি বা
মুছেও যায়নি। ভাতিজী সারার এক ইংরেজ বান্ধবী এলো বান্ধবীর বাংলাদেশি উৎসব ভোগ করার
জন্য।
রায়না
অনেক কিছু করেছিলো। পোলাও, বিরিয়ানি, শামি কাবাব, ছাগলের রোস্ট, মুরগীর গ্রিল, ছাগলের কোর্মা, মুরগীর কারি, আরও কি কি যেন, কালই খেয়ে এসে আজই ভুলে গেছি বলে লিখতে পারলাম না, লজ্জায় নীলিমাকেও
জিগ্যেস করতে পারলাম না।
দুপুরে
ড্রইং রুমে ফ্লোরে কার্পেটের উপরে কম্বল বিছিয়ে সবাই একসাথে বসে খাওয়া হোল। খেতে
খেতে কাজল প্রস্তাব দিলো, মামা চলেন স্ট্রাউড গলফ মাঠে যাই। কেন? ঘুড্ডি ওড়াবো। ঘুড্ডি!
হ্যাঁ, এবার দেশ থেকে নিয়ে
এসেছি, ঘুড্ডি, নাটাই, সুতা সব। বাহ! চল যেতে
পারি। খাবার শেষে রায়নার বোন তার বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেল।
ওরা
যাবার পর মুন্নি বায়না ধরল মামা আমার বাড়িতে যাবেন না? হ্যাঁ মা তাতো যেতেই হবে, চলো। গেলাম। মুন্নির
সবজী বাগান দেখলাম, বাংলাদেশি
লাউ, পালং শাক, কচুর মুখি, বিট, মিষ্টি কুমড়া কত কি
করেছে। মামা দুধ কদু খান, আমার এই বাগানের কদু দিয়ে রান্না করেছি। দুধ কদু! এতো আমার
খুব প্রিয় খাবার ছিল এক সময়, আমিতো ভুলেই গেছিলাম এই নাম, দাও। ডায়াবেটিকের রুগী হয়েও
বিদেশের বুকে ভাগনা বৌয়ের রান্না এক বাটি দুধকদু খেলাম, আহ!
বিলাতে বাঙ্গালি উৎসব
বিকেলে
দুই গাড়ি নিয়ে সবাই গেলাম গলফ মাঠে। সত্যিই সুন্দর জায়গা। বাচ্চারা দৌড়া দৌড়ী করলো, পাটি বিছিয়ে বসলাম। হটাত
মনে হোল আবার এই জায়গায় এই ভাবে একত্র হওয়া হয়তো আর হবেনা। নীলিমা চলো একটা ইতিহাস
নিয়ে যাই,
চলো সবাই
মিলে একটা ছবি তুলি। হ্যাঁ দাদা চলেন। নিপুর ১২ মেগাপিক্সেল কেমেরা দিয়ে ক্লিক
ক্লিক করে পটাপট কয়েকটা ছবি তোলা হোল। আনন্দ হৈচৈ করে ক্লান্ত হয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচটায়
ফিরে এলাম,
আবার
সাইরেনসিস্টার যেতে হবে। অপুর বাসায় এসে দেরি করলাম না। সাথে সাথেই আবার গেলাম
সাইরেনসিস্টারে রায়নার বোনের বাড়ি। সেখানে রাতের খাবার খেতে বসলাম একই ভাবে সবাই
এক সাথে বসে। এখানেও অনেক কিছু করেছিলো, এর মধ্যে নাগা মরিচ দিয়ে রান্না করা মুরগীর মাংসটা ঝাল
হওয়াতে বেশ ভালোই লেগেছে।
রায়নার
বোন মানে আমাদের বেয়াইনের সাথে এই প্রথম পরিচয়, খাবার পর কিছুক্ষণ গল্প গুজব হোল।
এবার ফেরার পালা। অপুরা সারার বান্ধবীকে নিয়ে স্ট্রাউড চলে গেল আর নিপুর গাড়ি না
থাকায় কাজল তার গাড়িতে করে আমাদের দিয়ে গেল নিপুর বাসায়।
সারা
দিনে অর্জিত বিলাতের এক নতুন ঈদের অভিজ্ঞতা নিয়ে মনে সুখের একটা শিখা জ্বালিয়ে
ক্লান্ত দেহে শুয়ে পরলাম। মনে মনে দিনের ফিরিস্তি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি
বুঝিনি। বেলা ১১টায় নীলিমার ডাকে ঘুম ভাঙল, উঠে গরুর মাংসের ঝোল দিয়ে চাউলের
রুটি খেতে খেতে ভাবলাম বিলাতের বুকে বসে বাঙ্গালির চেনা এই ঈদ কি কখনো ভুলতে পারব?
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।