৫৮।
হাতের
কাপটা নিয়ে বাইরে থেকে শব্দ আসা জানালার পাশে দাঁড়ালেন। তখন দিনের বেলা যে পাব
দেখেছিলেন সেই পাবের সামনে মহিলা পুরুষ মিলে দশ বারোজন। এর মধ্যে আবার কেও ভিতরে
যাচ্ছে কেও বাইরে আসছে। এদেরই
হৈ চৈ। পাবের ভিতর উচ্চ শব্দের বাজনাও শোনা যাচ্ছে।
কাল পরশু ছুটি তাই আজ কাজের শেষে পানের উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। এই জন্যই তাহলে
এখানে শুক্র শনি বারে এতো ব্যস্ত! এই হলো এদের আনন্দ ফুর্তি। এরা তাহলে আনন্দের
জন্য ভিড় করে পাব আর নাইট ক্লাবে? আর আমাদের দেশে এমন দুই দিন ছুটি পেলে ভিড় দেখা যায় বাস আর
লঞ্চে। সবাই ছুটে যায় নিজ নিজ আপন জনের কাছে। এরা আনন্দ ভোগ করে নিজে নিজে, একা একা আর আমরা করি
সবাইকে নিয়ে অন্তত আপনজনকে নিয়ে। এই জন্যেই আমাদের এতো কষ্ট। এদের আঘাত করার কেও
থাকেনা আর আমরা আঘাত পাই পায়ে পায়ে। মানে আপন জনের কাছে যেমন করে যা আশা করি ঠিক
তেমন করে তা পাওয়া হয়ে উঠে না একটু হয়তোবা এদিক সেদিক হয়ে যায় হয়তো আমি ঠিক যেভাবে
যা চাইছি সেভাবে পাইনি তাই বলে একেবারে যে পাইনি তা নয় হয়তো বা বেশিই পেয়েছি তখন
ব্যবধানটা হয়ে দাঁড়ায় শুধু অভিমানের। আর এদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন এদের তো
কারো কাছ থেকে কিছুই পাবার নেই যা করছে তা নিজেই করছে নিজের কাছ থেকেই আনন্দ বা
দুঃখ যাই হোক পাচ্ছে। সারা রাত পান করে নিজের অনুভব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে ভাবছে সব
পেয়েছি, কিছুই অবশিষ্ট নেই।
৫৯।
নিচে
থেকে ডাকছে,
দুইটা
বেজে গেছে! হ্যাঁ
তাইতো, ওদিকে পাবের সামনের জটলা কমে গেছে ভিতরের বাজনাও থেমে
গেছে। দুই এক জন করে পাব থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব নিচে নেমে এলেন সেহেরি
খাবার জন্যে। দুই এক জন করে সবাই নেমে এলো। সবাই যা করছে সেফ এর পিছনের লম্বা
টেবিলের মত তার নিচের সেলফে ভাত তরকারির ডেকচি ওখান থেকে যার যার মত ভাত তরকারি
নিয়ে পিছনের মাইক্রোওয়েভে গরম করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। পানি খাবার কোন গ্লাস
নেই। যে কন্টেইনারে করে টেক এওয়ে নিয়ে যাবার ভাত দেয় সেটাতে করে পানি নিয়েছে সবাই।
রাশেদ সাহেব গত রাতে যে গ্লাসে কোক খেয়েছিলেন সেখান থেকে একটা গ্লাস ধুয়ে তাতে
পানি নিয়ে এক পাশে টেবিলের উপর ভাতের প্লেট নামিয়ে আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলেন।
কবির বললো -
-কি
ভাই বাড়ির কথা মনে হইতেছে? খান না কেন?
-খাচ্ছি
তো। আমি এতো তাড়াতাড়ি খেতে পারিনা একটু আস্তে আস্তেই খাই।
-ও
আচ্ছা ঠিক আছে খান খাওয়া হলে এগুলি ঢেকে রেখে লাইট নিভিয়ে আসবেন। আমরা তাহলে যাই।
সেহেরি
শেষ করে কবির যেভাবে বলেছে সেই ভাবে সব রেখে এক কাপ চা নিয়ে উপরে এসে বিছানার উপর
বসে ওষুধের প্যাকেট বের করলেন। ওহ! পানি তো আনা হয়নি! আবার নিচে গিয়ে এক
গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। একটা জগ বা অন্তত একটা বোতল হলে পানি এনে রাখা যায়। দেখি
কাল সকালে কবির বা নুরুল ইসলামকে বলে ব্যবস্থা করা যাবে। এখন এ ভাবেই চলুক। ওষুধ
খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। বালিশের নিচে থেকে তামাকের প্যাকেট বের করে একটা
সিগারেট বানিয়ে জ্বালালেন।
বাড়িতে
খুকু তার দুই বোনকে নিয়ে কি করছে? না খুকুকে নিয়ে এতো ভাবার কিছু নেই মনে হয়। খুকুর ছোট খালা
আর নানুকে রেখে এসেছে তারা ভালই আছে। রাত
প্রায় তিনটা বাজে।
না এখন ভাবার সময় নেই। চা শেষ, সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে শুয়ে
পরলেন। কম্বলটা টেনে নিয়ে স্বভাব মত ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পরলেন। এমন
সময় নুরুল ইসলাম এসে বললো -
-কি
ভাই ঘুমিয়ে পরেছেন?
-না এখনও
ঘুমাইনি।
নুরুল
ইসলাম কি যেন বলছিলো কানে ঢুকেছিলো কিন্তু জবাব দেয়া হয়নি। সারা দিনের ক্লান্তি আর
অবসাদে কখন যে শ্রান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পরেছে তা আর বুঝতে পারেনি।
৬০।
সকালে
নয়টার দিকে ঘুম ভাঙলেও উঠি উঠি করে আবার ঘুমিয়ে পরেছেন। প্রায় ঘণ্টা খানিক পর ঘড়ির
দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে উঠে পরলেন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ পড়ে মনে হলো এখন দেশে
কয়টা বাজে?
হ্যাঁ
এখন দুপুর একটা। ফোন করা দরকার। কার্ডটা নিয়ে ফোনের কাছে গিয়ে নাম্বার ঘুরাতেই ওপাশ থেকে
খুকুর কণ্ঠ কানে এলো।
-হ্যালো, আব্বু কি খবর তোমাদের?
-হ্যাঁ
আব্বু আম্মু এসেছে। সেঝ কাকু এয়ারপোর্টে গিয়েছিলো কিন্তু আম্মু জানে না। আম্মু
কায়সার চাচার সাথে বেরিয়ে পড়েছিলো। পরে উনার সাথে উনার বাসায় আজিমপুর পর্যন্ত যায়
সেখানে উনি নেমে গেলে আম্মু ওই ট্যাক্সিতেই চলে এসেছে।
-ও
আচ্ছা, যাক নিশ্চিন্ত হলাম।
তোমার মা কোথায় আব্বু?
-আম্মু
খুব টায়ার্ড,
এসেই
গোসল করে খেয়ে দেয়ে একটু শুয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরেছে। তুমি কেমন আছ
আব্বু?
-হ্যাঁ
আব্বু আমি ভাল আছি।
-কাজ
করতে পারছ?
-হ্যাঁ
আব্বু করতে হবে তাই পারছি।
-তোমার
ঠিকানা কি আব্বু?
-আব্বু
আমি ঠিকানা আর সব জানিয়ে মেইল পাঠাব। দেখি
ইন্টারনেট কোথায় আছে পাই নাকি, ফোনে তো এতো কথা বলা যাবেনা। এখন রাখি আব্বু?
-ঠিক
আছে তবে তুমি সাবধানে থেকো আর খাবার ওষুধ এসব সময়মত খেয়ো মনে করে। দেখো ডায়াবেটিস
যেন ঠিক থাকে।
-আচ্ছা
আব্বু তোমার মা উঠলে বলবে যেন চিন্তা না করে আর তোমরা সাবধানে থাকবে, রাখি আব্বু আল্লাহ হাফেজ।
৬১।
যাক, আল্লাহর রহমতে মনি
ঠিকভাবে পৌঁছেছে। আলহামদুলিল্লাহ! এসে জানালার পাশে
দাঁড়ালো। কাল রাতে যেখানে এতো হৈ চৈ ছিলো এখন সেখানে নীরব। কেও নেই। রাস্তা দিয়ে
দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে এই শুধু। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশ মেঘে ঢাকা। কিন্তু
বৃষ্টি নেই রাস্তায় লোকজন নেই এ আবার কেমন দেশ? ভাবছিলো রাশেদ সাহেব। এখন কি করবে
কোথাও যাবার জায়গা নেই কিছু চেনা নেই। এই ভাবেই চলবে আস্তে আস্তে চেনা জানা হবে
হয়তো। কত দিন এখানে থাকতে হবে বা থাকা যাবে তা সে জানে না। তবে এটা জানে যে এদেশের
রানী তার জন্য দরজা খুলে বসে নেই। ভিসার মেয়াদ যতদিন আছে ততদিন নিশ্চিন্ত। তারপর
কি হবে? কখনো ধরতে পারলে
পাঠিয়ে দিবে এইত? তা যদি দেয়ই দিবে। জোড় করে তো থাকা যাবেনা। ভাগ্যকে মেনে
নিতেই হবে। কতক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো খেয়াল নেই। নুরুল ইসলাম উঠে পড়েছে।
-কি
ভাই সাব কি দেখেন?
-না
কি আর দেখব এই দাঁড়িয়ে থাকা আর কি, এছাড়া কি করব সবাই ঘুমে।
-হ্যাঁ
সবাই সাধারণত সারে এগারোটা পর্যন্ত ঘুমবে। এখন এগারোটা বাজে। আজকে তো আপনাদের সারে
এগারোটায় নামতে হবে, সব
কিছু আটাইয়ে নিতে হয়তো তাই।
-প্রতিদিন
সারে এগারোটায়?
-না
শুধু শুক্র শনি বারে, অন্যদিন
বারোটার দশ মিনিট আগে নামলেই হয়। আজও কিন্তু কালকের মত
কিংবা কালকের চাইতে বেশি বিজি হবে।
৬২।
রাশেদ
সাহেব একটু ভয় পেলেন কি ভাবে কুলাবেন বুঝতে পারছেন না। দেখা যাক যা হোক একটা কিছু
হবে। এতো ভয়ের কি আছে? এবারে
বিছানায় এসে একটু কাত হয়ে শুয়ে পরলেন। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে সামনের দেয়াল ঘড়িতে
এগারোটা পঁচিশ দেখে উঠে প্যান্ট সার্ট বদলে নিচে নেমে একটা এপ্রণ গায়ে কিচেনে ঘুরে
দেখে বুঝার চেষ্টা করে দেখলেন কি কি করতে হবে। রাতের আর সেহেরির তরকারির ডেকচি
গুলি ধুয়ে রাখলেন। ছেলা পিঁয়াজের ড্রামটা অর্ধেক খালি হয়েছে। ভাবলেন এক বস্তা এনে
রাখি। স্টোর থেকে বের হতেই ঠাণ্ডার একটা ধাক্কা লাগলো গায়ে। মনে হলো সমস্ত শরীরে
সুই বিঁধিয়ে দিয়েছে কেও। ঝট পট এক বস্তা পিঁয়াজ এনে রাখলেন
কিচেনের সাথের স্টোরে। এসে দেখে মারুফ পিঁয়াজ কাটছে। পিঁয়াজ কাটার ধরনটা তার কাছে বেশ
ভাল লাগল। একটা চপিং বোর্ডের নিচে ভেজা কাপর বিছান, তার পাশে টেবিলের উপর প্রায় এক
বালতি ছেলা পিঁয়াজ। একটা একটা করে নিয়ে কাটছে আর টেবিলের নিচে বোর্ড বরাবর একটা
বালতিতে ছেড়ে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেবকে দেখে বললো -
-ভাইছাব
এক বস্তা পিঁয়াজ আনতে পারবেন?
হ্যাঁ
এইতো নিয়ে এলাম ওপাশে রেখেছি।
-আচ্ছা
বেশ, এখন এই যে এ ড্রয়ারের
ভিতরে ছুরি ওখান থেকে একটা নিয়ে যান ওগুলি ছিলতে থাকেন। আপনে দুইটা পিঁয়াজ নিয়ে
আসেন আমি দেখিয়ে দেই কিভাবে ছিলবেন।
দুই তিন
টা পিঁয়াজ নিয়ে এসে মারুফের সামনে রাখতেই এপাশে ওপাশে কেটে দেখিয়ে দিল আবার বললো ওই যে বিন ওইটা নিয়ে যান খোসাগুলি
এতে ফেলবেন আর ছেলা গুলি রাখার জন্যে একটা বালতি নিয়ে নেন বালতি ভরলে আমাকে দিয়ে
যাবেন। এদেশের পিঁয়াজগুলি বেশ বড় বড়।
রাশেদ
সাহেব মারুফ কে বললেন-
-এই
এতদিনে ওসি ডিসির মানে বুঝলাম।
মারুফ বললো-
-কি রকম।
-শোনেন
তাহলে, ছেলে বিদেশে লাখ টাকা
কামাচ্ছে শুনে বাবা খুব খুশী। একবার জানতে চাইলেন বাবা তুমি কি কর, কি কাজ তোমার? তখন ছেলে লিখে পাঠাল
বাবা আমি এখানে ওসি ডিসির কাজ করি। তা মারুফ ভাই আপনি আমাকে সেই ওসি ডিসি বানালেন? মানে অনিওন কাটার এন্ড
ডিশ ক্লিনার!
-ও
আচ্ছা আচ্ছা,
হ্যাঁ
ভাই কি আর করা যাবে দেখেন না আমরাও তাই করি। আপনি কি মনে করেছেন আমি এসেই সেফ বা
তন্দুরি সেফ হয়ে গেছি? না
আমিও ওই কিচেন পোর্টার থেকে শুরু করেছি এবং শুধু আমি না এদেশে যত সেফ দেখবেন তা
সেফই হোক আর মালিকই হোক সবাই এই একই কাজ থেকে শুরু করেছে। নয়তো কুমি ওয়েটার থেকে।
কুমি ওয়েটার কি জানেন?
-না।
-শুধু
কুমি ওয়েটার বলি কেন সব ওয়েটারকেই টয়লেট পরিষ্কার করতে হয়।
-বলেন
কি সুইপার নেই?
-আরে
না সুইপার রাখলে বেতন কত হবে জানেন? তার বেতন দিতে গেলে মালিকের লাভ শেষ আর ব্যবসা চলেনা।
মালিক নিজেও করে আপনি যদি সামনের কাজ নেন আপনাকেও করতে হবে। কিচেনের কাজে বেতন
বেশি তবে কষ্টও বেশি আপনি কুলাতে পারবেন না। আপনি দেশে কি করেছেন তা না বললেও আমরা
বুঝতে পারছি। আমরা কাল রাতে আপনাকে নিয়ে আলাপ করেছি। আপনি এ কাজ
পারবেন না আপনার জন্য এ কাজ না। দেখি আমিও দেখছি আপনিও
দেখেন সামনে একটা কাজ জোগাড় করে নেন। ওখানে আরামে থাকতে পারবেন নয়তো শেষ হয়ে
যাবেন। সামনেও পরিশ্রম আছে তবে কিচেনের মত না। ওখানে সুট টাই পরে সেন্ট মেখে কাজ
করবেন সাহেবের মত। সাহেব মেম সাহেবদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলবেন।
এমন সময়
কবির আর দেলোয়ার কথা বলতে বলতে কিচেনে ঢুকে বললো-
-রাশেদ
কার নাম?
ভাই সাহেব
আপনার নাম রাশেদ নাকি?
-হ্যাঁ
আমিই রাশেদ,
কেন?
-আপনার
ফোন।
-কোথায়?
-ভিতরে
যান, না না এভাবে না এপ্রণ
খুলে রাখে যান।
-ও
আচ্ছা।
এপ্রণটা
খুলে দরজার বাইরে হুকে ঝুলিয়ে রেখে ভিতরে গিয়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ফিরোজের কণ্ঠ-
-কি
রাশেদ কি খবর?
-ভাল।
-কাজ
শুরু করেছ?
-হ্যাঁ
সে তো কাল এখানে আসার সাথে সাথেই শুরু।
-আচ্ছা
ঠিক আছে, আমি কাল ফোন করিনি কারণ আমি জানি অবস্থা। যাক কেমন লাগছে
কষ্ট হচ্ছে?
-হ্যাঁ
তা তো বুঝতেই পার। ডেকচি মাজতে মাজতে হাতের আঙ্গুলে বেশ কেটে কুটে গেছে।
-কেন
গ্লোভস নেই?
তুমি বল
গ্লোভস দিতে,
গ্লোভস
পরে করবে এসব। এখন কি আর করবে, আপাতত করতে থাক সাবধানে কর কষ্ট
তো একটু হবেই।
আচ্ছা আমি মাঝে মাঝে ফোন করব। তোমাকে যেদিন অফ দিবে সেদিন ঘরে বসে থাকবে না মন খারাপ
হবে। কাপর চোপর ধুবে, বিছানা
পত্র ঘর গুছাবে,
বাইরে
বের হবে,
ঘুরবে
দেখবে সময়মত এসে খেয়ে যাবে। মন ভাল থাকবে আর দেখবে আসে পাশে লাইবেরি কোথায় যে কোন
লোককে বললেই দেখিয়ে দিবে। সেখানে যাবে। তোমার পাসপোর্ট দিয়েই হবে, বলবে আমি ভিজিটর।
ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারবে, বাসায় মেইল পাঠাবে। ভাল কথা, বাসায় ফোন করেছ? ভাবীর খবর কি?
-ও
পৌঁছেছে অসুবিধা হয়নি।
-তো
ঠিক আছে আজকে রাখি তাহলে। ফোন করবে মাঝে মাঝে। দরকার মনে করলে আসে পাশেই দেখবে
কয়েন ফোন বক্স আছে সেখান থেকে তুমিও ফোন করতে পার আমাকে। আমি বাসায় না থাকলে তোমার
ভাবী তো থাকবে কি দরকার বলে দিও।
-আচ্ছা।
-ফোন
টা রেখে আবার পিঁয়াজ ছেলা শুরু করতেই কুইক করেন ভাইছাব। দেলোয়ারের
তাগিদ। পনের মিনিটে এক বস্তা পিঁয়াজ ছিলতে হবে, বুঝলেন? কুইক, কুইক করেন।
-হবে
ভাই হবে একটু সময় তো দিবেন।
-কথা
বাদ দেন কুইক করেন, হাত চালান।
মারুফের
পিঁয়াজ কাটা শেষ।
এখানে যে কয়টা ছেলা হয়েছে সেগুলিও শেষ। এবারে মারুফও ছেলার কাজে হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি বস্তা
শেষ করে আবার কাটা কাটিতে লেগে গেলো।
এবার
কবিরের হুকুম-
-ভাইছাব
করে থেকে একটা ডেকচিতে করে আট পট চাউল এনে ধুয়ে দেন।
-করে
মানে?
-ও! করে মানে পিছনে।
-আচ্ছা।
চাউল
এনে ধুয়ে দেয়ার আগেই-
-এই
যে ভাই এই কিমা গুলি মাখান তো।
শুধু
রাশেদ সাহেব নয় সবাই বিজি কারো নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
মারুফ বললো
-
-ভাই
এক ফাঁকে রাতে আর সেহেরির জন্যে ওই ফ্রিজ থেকে এক পোটলা মাছ আর এক পোটলা চিকেন বের
করে পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন আর এখন আমাকে কয়েকটা টমাটো আর দুই তিন টা লাল পিঁয়াজ
দেন।
এর
মধ্যে বিরাট এক ডেকচিতে সদ্য কাটা সব পিঁয়াজ বিভিন্ন মশলা, লবণ, টমাটো আরও কি কি সব দিয়ে চুলায়
দিয়ে দিল।
-এটা
কি হবে ভাই?
-এটা
হচ্ছে গ্রেভি,
এগুলি
দিয়েই কারি রান্না হবে।
রাশেদ
সাহেব বুঝলেন ফ্রাইংপ্যানে চামচ দিয়ে যে জিনিস দেয়া হয় তাহলে এই সেই। এটা হলো
কারির ঝোল। ওদিকে একজন বড় এক গামলায় করে মুরগির মাংস মশলা দিয়ে মাখাচ্ছে। একজন
আবার একটা সিংক এর ভিতর দিকটা পরিষ্কার করে তার মধ্যে ময়দা ছেড়ে দিল বস্তা থেকে।
তার মধ্যে ডিম,
লবণ, চিনি, কালিজিরা, বেকিং পাউডার এসব দিয়ে
মাখাচ্ছে।
এই যে
ভাই এই গুলি ধুয়ে দেনতো, আরে ভাই দেখে আসেন তো ওই ওখানে কড়াইতে ফুলকপি কত গুলি আছে
দেখেন। কুইক করেন। আচ্ছা ভাইছাব এই যে দেখেন এইরকম তিনটা কৌটা নিয়ে আসেন স্টোর
থেকে। হ্যাঁ ঠিক আছে। আচ্ছা উপরের টয়লেটের পাশে যে রুম ওখানে দেখবেন এই যে ভিম
পাউডার এই গুলি আছে এরকম দুইটা নিয়ে আসেন। ভাইছাব এইগুলি একটু কুইক ধুয়ে দেন।
শ্বাস ফেলার সময় নেই। হুলস্থূল ব্যাপার। যাক মোটামুটি দুইটার মধ্যে একটু হালকা হলো। মারুফ বললো-
-ভাই
সাহেব রান্না করতে পারেন?
-আসলে
রান্না করার তো কখনও প্রয়োজন হয়নি তাই চেষ্টা করা হয়ে উঠেনি।
-আচ্ছা
ঠিক আছে শিখিয়ে নিব।
-হ্যাঁ
তাতে আপত্তি নেই।
-ঠিক
আছে কাল দেখিয়ে দিব আপনে রান্না করবেন। এখন কিচেন টা একটু ব্রাশ করে শেষ করে উপরে
চলে যান।
কয়েকটা
চুলা সমানে জ্বলছে। কোনটায় গ্রেভি, কোনটায় মুরগী, কোনটায় ভেড়া আরও কি কি যেন। রাশেদ সাহেব বললেন-
-আপনি
যাবেন না?
-না
আমার যেতে একটু দেরি হবে আপনে যান।
-না
কি দরকার চলেন এক সাথে যাই।
-না
আপনি টায়ার্ড,
নতুন তো
রেস্ট নেন।
-না
চলেন একসাথে যাই।
এই বলে
টেবিলের উপর উঠে বসল।
বাড়ি
কোথায়, কবে এসেছে মানে তাকে
যা যা বলেছে সবাই সেও তাই জানতে চাইল। মারুফ সুনামগঞ্জ থেকে এসেছে। ওখানে
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বেকার ঘুরছিলো এদেশের এক মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে
আসে বাবা। আর দেরি না করে লন্ডনি মেয়ে বিয়ে করে তার আঁচল ধরে চলে এসেছি চার বৎসর
আগে, আমরা তো আর অন্য কোন
কাজ পারি না লেখাপড়াও তেমন নেই তাই এই কাজই করি। তবে ভালই আছি বাড়ি কিনেছি। না
না এক বারে না। মাসে মাসে কিস্তি দেই। গাড়ি কিনেছি।
-ও
আচ্ছা, ওই যে পিছনের গাড়িটা?
-হ্যাঁ
হ্যাঁ ওইটাই আমার। আমি এইতো সোম বারে রাতে ডিউটি শেষ করে আমার অফ আমি গাড়ি নিয়ে
লন্ডন চলে যাব। সেফ আসবে মঙ্গলবারে। আবার বৃহস্পতিবার বিকেলে এসে ডিউটি করব।
-আচ্ছা, আপনার ওয়াইফ তাহলে
লন্ডন থাকে,
কতক্ষণ
লাগে লন্ডন যেতে?
-বেশি
না, দেড় ঘণ্টার মত। ওই যে কবির, ওকে দেখছেন ও এসেছে তিন বৎসর
আপনার মত টুরিস্ট হয়ে এসেছিলো এখন বেআইনি।
-উনি
বেআইনি কেন থাকবে? দেখে
টেখে একটা বিয়ে করিয়ে দেন আপনাদের সবাই এদেশে অনেক জানাশোনা। ওর একটা গতি হোক। ওর
বাড়ি কি আপনার এলাকায়?
-হ্যাঁ
সেই জন্যেই একটু মাথা ব্যথা। খুঁজছি কিন্তু পাইনা সেরকম।
-আর
দেলোয়ার?
-না
ও টেম্পোরারি। সেফ নেই তাই ওকে আনা হয়েছে। সেফ এলেই ওকে বিদায় দেয়া হবে দেখবেন ওকে
কিন্তু আবার একথা বলবেন না। দেখেন না আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করে তবুও আমরা কিছু
বলি না।
-না
আমি আর কি বলতে যাব? আচ্ছা, দুপুরে মালিকেরা কেও
আসেনা?
-আসে
তো, দেখেন নাই? ও! তখন আপনে স্টোরে
ছিলেন। ওরা সামনে কাজ সেরে চলে যায়। সেফ না থাকলে এদিকে খুব একটা আসেনা। দেখি আমার
গ্রেভির কি অবস্থা!
টেবিল
থেকে নেমে যা যা জ্বাল হচ্ছিল সব কিছু দেখে একটা একটা করে চুলা নিভিয়ে দিয়ে বললো-
-চলেন
যাই।
এক
সাথেই উপরে চলে এলো দুই জনে।
-আসেন
একটু বসেন।
আমতা
আমতা করে বললো-
-নামাজ
পড়া হয়নি।
-ও
না না ঠিক আছে নামাজ পড়েন গিয়ে পরে আলাপ করা যাবে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।