২৭।
আজও
মানুষটা সংসারী হতে পারল না। আজ ছাব্বিশটা বছর ধরে দেখে আসছে সংসার সম্পর্কে কি
উদাসীন। নিজের কথা আর কোন দিন ভাবতে পারবে না। এমনি কি আর বলে, তুমি না হলে আমি কবে
বাতাসে উড়ে যেতাম। যদি মনি
নিজে যদি শক্ত করে হাল না ধরত তাহলে কি যে হোত কে জানে!
মানুষটার মনে সারাক্ষণ শুধু দেশ, সমাজ, প্রতিবেশী, বাবা মা ভাই বোন। কোন সময় একবার ভুলেও নিজের কথা ভাবতে
দেখেনি। বাজারে গেলে দুটার বেশি তিনটা জিনিসের কথা বলে দিলে আর মনে রাখতে পারে না, লিখে দিতে হয়। টাকা, ব্যাগ আর লিস্ট লিখে
বাজারে পাঠালে কখনো দেখা যায় যে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। কি হলো, বাজারে যাওনি? না, ওই ভ্যান ওয়ালাটা বললো
ওর মেয়ের অসুখ তাই ওকে ওষুধ কেনার জন্য টাকা দিয়ে দিলাম। আমাদের তো আছে, চলবে না? এই মানুষকে আর কি
বলবে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই দেখে আসছে।
রাগা
রাগিও করা যাবে না, ওই
ড্রইং রুমে টিভির সামনে বসে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদর সোহাগ করে না আনা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত
কিচ্ছু খাবে না। এই পাগলকে বুকে নিয়েই মনি চলছে। মনটা শিশুর মত সরল আর সাগরের মত
বিশাল। থাকুক,
আমার
পাগল আমার বুকেই থাক এতেই আমার পরম শান্তি। কত বলেছে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ভাব, সে কথা কোন দিন কানে
নেয়নি। অফিসের বেতন তোলার সময় চেক লিখে তার পিওন সুনীলের হাতে দিয়ে দিত। সুনীল
আবার সেই টাকা এনে মনির কাছে দিয়ে যেত। কোন দিন জিজ্ঞেসও করেনি সুনীল কত টাকা
দিয়েছে। সেই জিজ্ঞেস করে নিত আজ কত টাকার চেক লিখেছিলে মনে আছে? না। চেকের মুড়ি দেখে
মনিকেই তা সামাল দিতে হতো। যদিও জানে সুনীল খুবই বিশ্বাসী তবুও। ওর
নিজের কখনো টাকার দরকার হলে মনির কাছে চেয়ে নিত। মনি আমাকে পঞ্চাশ টা টাকা দিতে
পারবে? তার নিজের রোজগারের
টাকা সে চাইছে বলে মনি কোন দিন জিজ্ঞেস করেনি টাকা দিয়ে কি করবে? মনি নিজেই এর মধ্যে
থেকে সংসার চালিয়ে যা কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছে তাই তার সম্বল।
-খুব
ক্ষুধা লেগেছে মনি।
মনি
ব্যাগ খুলে ঢাকা থেকে বড় মেয়ের দেয়া সেদ্ধ আটার রুটি আর শামী কাবাব বের করে দিয়ে
খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা ভরে এনে দিল।
-নাও
খাও।
-তুমি
খাবে না,
তোমারও
তো ক্ষুধা লেগেছে।
২৮।
একটু
পরেই দেখলো তারা যে গেট দিয়ে লন্ডন যাবার প্লেনে উঠবে সেখানে এক বিশাল ৭৪৭ বোইং
এসে দাঁড়ালো। দেখ, দেখ
মনি আমরা এই প্লেনে লন্ডন যাব। ঘণ্টা খানিক পর লন্ডনের যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য
C গেটে যাবার ঘোষণা
শুনে তারা এগিয়ে গেলো। ওদের বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট দেখে যথারীতি অন্যান্য
এয়ারপোর্টের মত এখানেও বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও রক্ষা যে ওদের বেশ মোটা এবং
পুরাতন পাসপোর্ট এবং রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টে ইতিপূর্বে ব্রিটেন ভ্রমণের ভিসা দেখে
তেমন কোন ঝামেলা করেনি। এক সময় সব ঝামেলা শেষ করে প্লেনে উঠে সিট খুঁজে বসে পরলেন।
এবারেও মনি জানালার পাশে।
অল্পক্ষণের
মধ্যেই প্লেন ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, সামনের জিপিএস এর স্ক্রিনে
দেখছে। জানালা দিয়ে নিচে নীল সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা আরও
বেশি সুন্দর ছবির মত দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ গুলির উপর দিয়ে যাচ্ছিল। সাগর পাড়ি
দেয়ার পর যে শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে রাশেদ সাহেব বলে যাচ্ছেন কবে এই শহরে এসেছিলেন, দেখ দেখ মনি আমি এই এই
শহরে এসেছিলাম দেখ উপর থেকে দেখ কেমন দেখাচ্ছে! ওইসব শহরের নানা গল্প বলছিলেন। তার
কোনটা মনিরার কানে যাচ্ছে কোনটা যাচ্ছে না। সে শুধু অবাক হয়ে রাশেদ সাহেবের মুখের
দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন তাকে এই প্রথম দেখছে।
কুয়ালালামপুর
থেকে লন্ডন দীর্ঘ চৌদ্দ ঘণ্টার পথ। কম না। মাঝে দুই বার খাবার দিয়েছে, দুই বার হালকা নাশতা
আর চা কফি বা পানীয় তো আছেই। যে যখন যা চাইছে। রাশেদ সাহেব মনিরা কে জোর করে বার
বার পানীয় দিচ্ছে যাতে ডি-হাইড্রেশন হয়ে এয়ার সিকনেস না ধরে। মাঝে
মাঝে উঠে এলি ওয়েতে হাঁটা হাটি করতে বলছে নিজেও করছে। রাশেদ সাহেবকে যেন আজ মনিরার
কাছে নতুন লাগছে। এর আগেও তো কত বার প্লেন জার্নি করেছে তখন তো এতো এমন করেনি, এ যেন অন্য কোন নতুন
রাশেদ সাহেব।
মনিরার
ভাবনা শুধু একটাই, যে
জন্য আসা তার কতটা কি হবে, কোন কাজকর্ম পাবে কি না, কি করবে, মনি যখন চলে যাবে তখন এই আত্মভোলা
মানুষটা কি ভাবে থাকবে, কি করবে এই সব সাত পাঁচ
ভেবে নানা আশঙ্কায় মনিরার মন বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে। না কি আবার দেশে ফিরে যেতে
হবে। এমন যদি হয় তাহলে কি উপায় হবে, নানা কিছু। আবার এটাও ভাবছে দেশ ছেড়ে যখন বের হয়ে এসেছে
নিশ্চয়ই একটা গতি হবে। এতো বড় এই ইংরেজদের রাজ্যে কি ওর
জন্য একটা কাজও জোগাড় হবে না? নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আশা নিরাশার অনিশ্চয়তা আর গতরাতের
অনিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে মনিরা ঘুমিয়ে পড়েছে।
২৯।
রাশেদ
সাহেব ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আর ডাকতে পারলো না। কাত হয়ে থাকা মনির মাথাটা
টেনে নিজের বুকে এনে নিলেন, মনি একটু কাত হয়ে রাশেদ সাহেবের বুকে ঘুমাচ্ছে। মনির মুখের
দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন সে কত সুখী। মনির মত স্ত্রী পেয়েছে। যে তার সমস্ত সত্তা দখল
করে রয়েছে,
ওকে ছাড়া
একটা দিন তো দূরের কথা একটা বেলাও চলে না। তার মনের কথা গুলি কেমন করে যেন সব ঠিক
ঠিক বুঝে ফেলে। অবাক লাগে। ভালবাসা কি এমনই গভীর? কত গভীরে গেলে এমন হতে পারে? কই আমি তো পারি না!
ভাবতে ভাবতে সেও এক সময় ঘুমিয়ে পরে। হঠাৎ মাইকে এয়ার হোস্টেস এর কণ্ঠে চমকে উঠলেন, প্লেন অল্প কিছুক্ষণের
মধ্যেই হিথরো এয়ারপোর্টে নামবে, সেখানকার তাপ মাত্রা দুই ডিগ্রী এবং আবহাওয়া সম্পর্কে
জানিয়ে যাত্রীদের সেই অনুযায়ী পোষাক পরে নেবার কথা জানিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নেবার
অনুরোধ জানালো। মনিরার ঘুম তখনও ভাঙ্গে নি। রাশেদ সাহেব আস্তে করে ডাকলেন, মনি ওঠ, লন্ডন এসে গেছে! মনির সিট
বেল্ট বেঁধে নিজেরটাও বেঁধে নিলেন।
আবার
ডাকলেন, মনি ওঠ!
মনি চোখ
মেলে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো
-কি
হয়েছে?
-লন্ডন
এসে পরেছি প্লেন নামছে।
মনি
জানালা দিয়ে দেখল। ছবির মত সাজান সুন্দর বাড়ি ঘর, টেমস নদী, আই অফ লন্ডন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনের চাকা মাটি ছুঁয়ে গেলো। একটু পরেই প্লেন হিথরো এয়ারপোর্টের
তিন নম্বর টার্মিনালের সামনে থেমে গেলো। রাশেদ সাহেব ব্যাগ থেকে মনির গরম কাপড় বের
করে মনিকে পরিয়ে দিলেন, পায়ে মুজা বদলে গরম মুজা পরিয়ে দিলেন, এছাড়া হ্যান্ড গ্লোভস
আর গলার মাফলার মনির হাত ব্যাগে ভরে দিলেন।
গ্যাং
ওয়ে টেনে প্লেনের দরজার সামনে আনতে দরজা খুলে দিল। যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে
গেলো। টার্মিনালের দোতলার উপর বেশ অনেকটা পথ হেঁটে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বেশ দীর্ঘ
কিউর পিছনে। তাদের পালা এলে কাল ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের পাসপোর্ট দেখে সিল দিয়ে
ফেরত দিয়ে দিল। রাশেদ সাহেব এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে মনিরার হাত ধরে লাগেজ
কনভেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালো। ওদের মালামাল কোন বেল্টে আসছে তা মনিটরে দেখে নিয়ে
সেখানে যেয়ে দাঁড়ালেন। ওদের মাল আসতেই বেল্ট থেকে নামিয়ে কাস্টমের সবুজ গেট দিয়ে
বেরিয়ে এসে বাইরে যেখানে যাত্রীদেরকে রিসিভ করার জন্য সবাই এসে অপেক্ষা করে সেখানে
এসে ফিরোজকে খুঁজে না পেয়ে মনিরাকে বললো তুমি এখানে এগুলি নিয়ে বসে থাক আমি ফিরোজকে
খুঁজে বের করি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফিরোজকে না পেয়ে আবার মনির কাছে ফিরে এলেন।
মনি
জিজ্ঞেস করলো,
পেলে না?
-দেখছি
না।
-তাহলে
কি আসে নি?
-না
আসলেও আসবে।
-তুমি
কি ঠিক ভাবে জানিয়েছিলে?
-কি যে
বল, তারিখ, ফ্লাইট নম্বর, সময় সব জানিয়েছি। আমার
মনে হচ্ছে ওরা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে আটকে রয়েছে।
-এখানেও
ট্রাফিক জ্যাম আছে নাকি?
-থাকবে
না মানে,
এখন পুরো
পিক টাইম! দাঁড়াও আর একটু দেখি, তারপর ফোন করি।
বলেই
তিনি মনির পাশে বসলেন।
-আমার
কিন্তু ভয় করছে আসবে কি না, যদি না আসে তাহলে কি করবে এখন?
-কী যে
বল তুমি আসবে না কেন, অবশ্যই
আসবে। একটু অপেক্ষা কর।
প্রায়
আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলো এর মধ্যে ওকে না দেখে এবার রাশেদ সাহেবও একটু চিন্তিত
হলেন। উঠে গিয়ে দোকান থেকে সাথে থাকা পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে এনে ফিরোজের বাসায় ফোন
করলেন।
ফিরোজের
মেয়ে জানাল আব্বু আম্মু দুজনেই আপনাদের রিসিভ করতে চলে গেছে, আম্মু একটু বাইরে কাজে
গিয়েছিলো ফিরতে দেরি হওয়াতে দেরি হয়েছে।
-আচ্ছা
ঠিক আছে তা হলে আমি ওকে মোবাইলে ফোন করছি।
লাইন
কেটে দিয়ে আবার মোবাইলে ফোন করে সরাসরি ফিরোজের সাথে কথা হলো।
-হ্যাঁ
রাশেদ আমরা আসছি, তোমরা
কি তিন নম্বর টার্মিনালে আছ?
-হ্যাঁ।
-তাহলে
ওখানেই থাক আমাদের আরও আধা ঘণ্টা লাগবে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।