১১৪।
দুপুরে
খাবার সময় দেলু জিজ্ঞেস করল-
-লন্ডনে
আপনার থাকার কোন জায়গা নেই?
-একজন
আছে কিন্তু আমি সেখানে যেতে চাই না, দেখি আরও একজন আছে সে হলো আমার বন্ধুর বোন, এবার নাহয়
তার ওখানেই
দেখি কি হয়।
-ইতস্তত
করছেন মনে হচ্ছে, কেন
কি ব্যাপার,
সেরকম
সম্পর্ক নেই তাই?
-না
ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না, কখনো যাইনি তো তাই, তবে তার ছোট ভাই আমার খুবই ঘনিষ্ঠ
বন্ধু।
-তাহলে
আর এত ইতস্তত করছেন কেন? ভাইয়ের বন্ধুকে কি একটু জায়গা দিবে না? আপনি তাই করেন ওখানেই
চলে যান,
দুই চার
দিন যা লাগে থাকলেন তারপর কাজ খুঁজে চলে যাবেন। না হলে ব্রিকলেন বা ইস্ট লন্ডন
মসজিদে গিয়ে কাউকে বলে দেখবেন আমি শুনেছি ওখানে থকার ব্যবস্থা আছে, ওরা হয়তো কোন ব্যবস্থা
করতে পারে। বাংলাদেশ সেন্টারও আছে তবে ওখানে গিয়ে লাভ নেই কারণ ওখানে আপনি আমি
জায়গা পাব না।
-হ্যাঁ
তাই দেখি কি করা যায়, যদি
কোন ব্যবস্থা না হয় তাহলে তো বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট আছেই, কত আর লাগবে, না হয় চার দিনে দেড়
দুইশ পাউন্ডই খরচ হবে। দরকার হলে তো করতেই হবে না হলে শীতের মধ্যে কি করবো? না দেলু ভাই আমি
সেজন্যে ভাবছি না, ভাবছি
এই মাত্র সেদিন এলাম এত দূর, আবার সেই বিশাল জার্নি তাই।
দেখি আজ
মনির সাথে কথা বলতে হবে। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পাশের বক্স থেকে ফোন করলেন।
-মনি
শোন, এখানে এসে যত খুশি
হয়েছিলাম ব্যাপারটা তত খুশির না।
-কেন
কি হয়েছে?
-এইতো
ক্রিস্টমাস নিউ ইয়ার হয়ে গেছে এখন বিজি কম তাই না করে দিল, বললো বেতন দিতে পারব না।
-কবে
যেতে বলেছে?
-আগামী
সপ্তাহের পরে,
এখন কি
করবো কোথায় যাব কোথায় থাকবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না, আমার ভালো লাগছে না, কেমন যেন ভয় করছে, আমার শুধু কান্না
পাচ্ছে। মনি,
আমি চলে
আসি?
-তুমি
ভয় পেয়ো না। এত ঘাবড়ে যেয়ো না শান্ত হও, ভয়ের কিচ্ছু নেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আরে, এই জন্য কি কারো আটকে
থাকে নাকি?
আচ্ছা, তুমি আগে যেখান থেকে
কাজ নিয়েছিলে সেখানে এসে দেখ।
-হ্যাঁ
ওখানে যেতে হলে লন্ডন গিয়ে কয়েক দিন থাকতে হবে, সেই থাকা কোথায় থাকবো?
-আমি
যা বলি শোন,
ফিরোজ
ভাইয়ের সাথে আলাপ করেছ?
-না
ওকে আর কত বিরক্ত করবো?
-বিরক্ত
কিসের সে তোমার বন্ধু তাই না? তাহলে আর কি ওকে অন্তত একটু বলে দেখ, আর যদি ওখানে থাকতে
নাই চাও তাহলেও তুমি লন্ডন এসে পর। আসার আগে রিতা আপার সাথে কথা বল, ওনার এতো বড় বাড়ি
ওখানে না হয় থাকবে, তুমি
বলে দেখ কি বলে,
আমার মনে
হয় নিষেধ করবেনা।
-হ্যাঁ
ঠিক বলেছ মনি আমিও তাই ভাবছিলাম কিন্তু কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না।
-এইতো
এখন পেলে?
-হ্যাঁ
মনি পেয়েছি।
-এইতো
আমার পাগল সোনা তুমি এখন আমার এই কল রেখেই রিতা আপার কাছে ফোন কর, নম্বর আছে তো?
-হ্যাঁ
আছে।
-আপা
কি বলে আমাকে জানিও।
-আচ্ছা
মনি তাহলে রাখি,
তোমরা
সাবধানে থেকো।
মনিকে
রেখে ফোন করলো রিতা আপাকে।
-আপা
আমি রাশেদ বলছি,
-হ্যাঁ
রাশেদ বল কি অবস্থা তোমার।
-আপা
আমাকে তো লন্ডন চলে আসতে হচ্ছে, একটা কাজ খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত কয়েক দিন আপনার ওখানে থাকতে
হবে।
-কয়দিন
থাকবে?
-দুচার
দিনের বেশি লাগবে বলে মনে হয় না।
-আচ্ছা
আস।
আবার
মনিকে ফোন করে আপার কথা জানিয়ে দিল। এর পর ফিরোজকেও ফোন করে জানিয়ে দিল। ফোন রেখে
টিকেট কনফার্মেশনের জন্য যেখানে কোচ থেকে নেমেছিলো তার পাশে কলম্বাস ট্রাভেল
এজেন্টের অফিসে গিয়ে টিকেট কনফার্ম করে নিয়ে আসলো। আগামী কাল ময়না ভাই লন্ডন যাবে।
তাকে একাই সামনে সামাল দিতে হবে। এখানে তার মেয়াদ আছে আর মাত্র আট দিন। রবি বারে
ময়না ভাই আসবে আর রাশেদ সাহেব সোম বার লন্ডন যাবেন, কোচ সন্ধ্যা সাতটায়।
১১৫।
এই কয়দিনে এখানে যা দেখার
দেখে নিয়েছে। পাহাড়ের উপরে একটা অনেক পুরনো বাগান, ওখানে উঠলে চোখ অনেক দূর পর্যন্ত
যেতে পারে। চতুর্দিকে পাহাড় আর পাহাড়। কোথাও ধূসর রঙের, কোথাও সবুজ আবার কোথাও
কালচে এলোমেলো ভাবে নিশ্চল নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিম দিকে কিছু দূরেই
সাগর দেখা যায়। ক্রিকের জেটিতে যে জাহাজ ভিড়ে থাকে সেগুলি আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট
আর ওবানে যাতায়াত করে। ওই জাহাজ ক্রিকের ভিতর থেকে দুই পাড়ে পাহাড়ের মাঝে দিয়ে বেশ
অনেক দূর গিয়ে সাগরে পড়ে ওই সাগর দেখা যায় এখান থেকে। সাগরের সমতলের নীল আর
উঁচু পাহাড়ের নানান রঙের কারুকাজের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে অনেক কিছু আসে যায়। মন
যেন কোথায় চলে যায়। সব দিন যেতে পারেনা, যেদিন স্নো থাকে সেদিন ঘরে বসে
থাকতে হয় তাছাড়া কুয়াশাও দৃষ্টি পথে কম বাঁধা তৈরি করে না। তবুও, এই রকম খোলা প্রান্তরে
কুয়াশার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে যা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। দূর থেকে দূরে
স্তরে স্তরে সিঁড়ির মত ভাজে ভাজে যেন উড়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা রাজহাঁসের মত পাখা মেলে
কোথায় কোন দূর দেশে যে হারিয়ে যায় কিছুই বোঝা যায়না। কেমন যেন হিম মাখানো নিঝুম
ঘুম ঘুম ভাব। মনে হয় চোখ বুজে আসতে চায়। প্রকৃতি যেন আরও কাছে ডাকে। এসো, আমার কাছে এসো, ওখানে বসে আছ কেন আমার
বুকের মধ্যিখানে এসো। যেন দুবাহু বাড়িয়ে শুধু কাছে ডাকে।
মনি যেভাবে কাছে টেনে নেয় সেই ভাবে। মন কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। পৃথিবীর কোন
কথাই আর মনে থাকেনা। শুধু দিগন্ত, আকাশ, দূরের ওই পাহাড়। পাহাড় ঘেরা ক্রিক আর সাগর। মেঘলা দিনে নয়তো কুয়াশা
মাখানো ভেজা দিনে দূরের সাগর আর নীল থাকেনা আকাশের সাথে সেও তার রঙ বদলে ফেলে।
আকাশের সাথে সাগরের যে কি এক গভীর সম্পর্ক তা সাগরের একেবারে কাছে না গেলে দেখার
উপায় নেই,
বোঝার
উপায় নেই। সাগরের নীল রঙ বদলে ছায়া ছায়া ধুসর রঙ, ঠিক ইলিশ মাছের পিঠের রঙ যেমন
তেমন হয়ে যায়।
এখানে
এসেছে প্রায় এক মাস অথচ এর মধ্যে সূর্য দেখেছে মাত্র সাত আট দিনের বেশি হবেনা। আবহাওয়া
প্রায়ই খারাপ থাকে কখনো ইলশে গুড়ির চেয়েও কম থেকে থেকে বৃষ্টি নয়তো স্নো, নয়তো কুয়াশা লেগেই
আছে। সারাটা শীতকালই এই রকম। শুধু সামারের কিছু দিন ভালো থাকে। রাস্তায় প্রায়
মানুষই ছাতা,
ওভার কোট
নয়তো রেইন কোট গায়ে চলা ফেরা করে। সবার সাথে ছাতা নয়তো রেইন কোট থাকবেই।
এখানে
আসার কয়েক দিন পর লাইবেরিতে গিয়ে টুরিস্ট বই দেখে ভেবেছিলো ব্রিটেনের সবচেয়ে উঁচু
শহর ফোর্ট উইলিয়ামে যাবে। এখান থেকে কাছে, তারপর ইনভারনেস হয়ে ব্রিটেনের
একেবারে উত্তর প্রান্তে সাগর পারের শহর থারসো দেখে আসবে। মেয়েদের হাফ স্কার্টের মত বড় বড় চেক
কাপড়ের তৈরি পুরুষদের স্কটিশ পোশাক কার্ল পরনে পুরুষদের কেমন দেখায় দেখে আসবে। এতো
দিন ছবিতেই দেখেছে, অবশ্য
এখানেও দু’চার জনকে দেখেছে ওই পোষাকে।
সেদিন
থারসোর উত্তরের কি যেন একটা ছোট্ট দ্বিপ থেকে, দ্বিপটার নাম বলেছিলো ভুলে গেছে
গ্রে ক্যাম্পবেল এসেছিলো তার তিন মেয়ে, দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে। এখানে এক
হোটেলে উঠেছে। ওদের ওই ছোট্ট দ্বিপে কোন ভারতীয়ই নয় শুধু কোন বিদেশি রেস্টুরেন্টই
নেই তাই এখানে এসেছে সভ্যতার কাছে। কিছু অচেনা মানুষের কাছে, যাদের কখনো দেখেনি
তাদের কাছে, তাদের দেখতে। মানুষ দেখতে, মানুষের গড়া সভ্যতা দেখতে আর গাড়ি
ভরে কিছু সভ্যতা নিয়ে যেতে। তাদে্র ওই শহরে কিছুই নেই। তার নিজের একটা পাব আছে আর
সামান্য চলার যোগ্য কিছু যা না হলেই নয় এই ধরনের কয়েকটা দোকান পাট। সপ্তাহে দুই
দিন থারসো থেকে ফেরি চলাচল করে। তাদের যার যা দরকার কেনাকাটা করে গাড়ি ভড়ে নিয়ে
যায়। ক্যাম্পবেল সাহেবের সাথে রাশেদ সাহেবের বেশ আলাপ হলো। তার পরিবারের সবাই কেতা
দুরস্ত পোশাক পরনে, কথা
বার্তায় মার্জিত। খাটি স্কটিশ উচ্চারণ। বড় ছেলেটা লুঙ্গির মত করে স্কটিশ পোশাক লাল
সবুজ কাল বড় চেকের কার্ল পরেছে। ভারতীয় মশলাদার খাবার তাঁদের খুবই প্রিয় তাই এখানে
এলে খেয়ে যায়। এর আগে দুই বার এসেছে। এছাড়া যেখানেই যায় সেখানে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট
পেলে খেয়ে যায়। জীবনে কখনো লন্ডন যায়নি। তার দৌড় গ্লাসগো পর্যন্ত। তবে বেলফাস্ট আর
আমস্টারডাম গেছে কিন্তু লন্ডনে না।
আমাদের
দ্বিপে লোক সংখ্যা কত জান? মাত্র কয়েক শ, এক হাজারও না। আমরা এই কয়েক জন চেনা মানুষ দেখতে দেখতে
হাঁপিয়ে গেলেই বাইরে চলে আসি। কেনাকাটা করি, বিদেশি রেস্টুরেন্টে খাই, ভালো হুইস্কি নিয়ে যাই, ডান্স করি। এই
যে আমার সুইট হার্ট মরিন, খুব
ভালো ডান্স করে। জান আমাদের ওখানে মাত্র তিন চার পদের বিয়ার আর কয়েক পদের
ওয়াইন ছাড়া আর কিছু পাই না। তাই এখানে এলে আমরা গাড়ি ভরে সব কিছু নিয়ে যাই।
-তাহলে
ওখানে থাক কেন এদিকে কোথাও চলে এলেই পার ওখানে তো আমার মনে হয় বাচ্চাদের পড়া লেখাও
সমস্যা, শীতও বেশি।
-হ্যাঁ
এইতো আমার এই বড় তিন জনই ইনভারনেসে আমার যে বাড়ি আছে সেখানে থাকে, একজন গভর্নেস রেখে
দিয়েছি সেই দেখা শুনা করে। আমরা কেও হয়তো মরিন নয়তো আমি প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার
আসি। আর এইযে এই ছোট দুই জন ওখানে প্রাইমারিতে আছে তবে প্রাইমারি শেষ হলেই এরাও
চলে আসবে ইনভারনেস। ব্যাপারটা সুবিধা আর অসুবিধার না এটা হলো একটা মায়া। আমি ওই দ্বিপের মায়া
ছাড়তে পারিনা। তুমি সময় পেলে যাবে দেখবে কেমন সুন্দর দ্বিপ।
-দিন
রাত সাগরের ঢেউ কিনারে আছড়ে পরছে আর যখন বাতাস থাকে তখন যে ঢেউয়ের কি সুর তুমি
অবাক হবে এমন ছন্দময় সুর তুমি জীবনে শোননি, অসাধারণ মেলোডি। স্নো হলে তো আমরা
সাগরের সাথে মিশে যাই, কোন
মাটি দেখবে না। মনে হবে সাগরের মাঝে ভেসে থাকা কিছু বাড়ি ঘড়, বুঝলে, এই হলো প্রকৃতি। তুমি
চেষ্টা করলেও ওখানে কোন গাড়ির হর্ন শুনবেনা, কোন অজে বাজে মেশিনের বা কোন
ইঞ্জিনের শব্দ পাবেনা। পাহাড়, পাহাড়ের চূড়ায় স্নো বা স্নো জমা বরফ, ঝর্ণা, সাগরের ঢেউ সব কিছু
মিলিয়ে রিয়াল প্রকৃতি, একেবারে
হ্যাভেন লাইক।
-বুঝলাম
ক্যাম্পবেল তুমি আসল স্কটিশ, প্রকৃতি প্রেমী।
খাওয়া
দাওয়া সেরেও অনেকক্ষণ গল্প করেছিলো কিন্তু ছোট ছেলে আর মেয়েটা ঘুমে পড়ে যাচ্ছিল
বলে মরিনের তাগাদায় আর টিকতে পারেনি, যাবার সময় তার পাবের ঠিকানা লেখা একটা কার্ড দিয়ে বলেছিলো
সুযোগ
পেলে যাবে,
তুমি যদি
প্রকৃতি প্রেমী হও তা হলে ভালো লাগবে।
সাত
জনের বিল হয়েছিলো একশ চুয়াত্তর পাউন্ড, স্কটিশ বিশ পাউন্ডের দশটা নোট রাশেদ সাহেবের হাতে দিয়ে বললো
কিপ দা চেঞ্জ। রাশেদ সাহেব টিল থেকে ভাংতি ছাব্বিশ পাউন্ড গুনে টিপসের লাল বাক্সে
রেখে দিয়ে তাদেরকে দরজার বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। কোলের বাচ্চাটা সহ
সবাই একে একে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।