১২৩।
লাটিম
যেমন তার একটা ছোট বিন্দু পরিমাণ পায়ের উপর দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকে রিতা
আপার কথা শুনেও রাশেদ সাহেবের মাথা সেই ভাবে ঘোরা শুরু হলো। উন্মত্ত সাগরের বিশাল পাহাড়
সমান ঢেউ যেমন পাহাড়ের মত খাড়া
পাড়ে এসে প্রচণ্ড গর্জন করে আছড়ে পরে ভেঙ্গে খান
খান হয়ে ছিন্ন ভিন্ন টুকরো গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আবার সাগরে মিশে যায়, কিছু পাড়ের উপড়ে পড়ে
আর কিছু ক্ষুদ্র কণা হয়ে বাতাসে উড়ে কোথায় হারিয়ে যায় তার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না।
রাশেদ সাহেবের মনের অবস্থাও তেমনি হলো। রাশেদ সাহেব নিজেকে মুহূর্তের মধ্যে সামলে
নিয়ে নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন-
-তাহলে
আপা আমি আসি!
বলেই
টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা হাতে নিলেন।
-না
এখনই কেন যাবে সারা রাত জেগে এতো দূর থেকে এসেছ নাশতা খেয়ে যাও!
-না
আপা আমি এখন ব্রিকলেন যাব ওখানেই কোথাও খেয়ে নিব, যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি ততই ভাল।
বলে যে
দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দরজাটা খুলে বাইরে বের হলেন। পিছনে দরজায় দাঁড়িয়ে
আপা বললেন-
-তুমি
কিছু মনে করোনা রাশেদ।
-না
আপা আমি কিছুই মনে করিনি।
মনে মনে
ভাবলেন যার কোন সংস্থান নেই তার কিছু মনে করা সাজে না, সে কোন অধিকারে কিছু মনে করবে? রিতা আপার বাড়ির কাছে এজওয়ার
টিউব
স্টেশনে নেমেছিলেন, সেদিকেই
এগিয়ে গেলেন।
১২৪।
জানুয়ারি
মাসের লন্ডন শহরে -৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার শীতের মধ্যে রাশেদ সাহেব কাঁধে ব্যাগটা
ঝুলিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত হেঁটে যাচ্ছেন আর ভাবছেন। রিতা আপা! আপনার ভাই আমার বন্ধু
শাহিন যখন এডিক্টেড হয়ে গেলো আপনার আত্মীয় স্বজনেরা যখন সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করে
তাকে ভাল করতে পারেনি, তার
বৌকে তার ভাইয়েরা নিয়ে গেলো তখন তাকে ভালো করার জন্য আমি এনে আমার কাছে রাখলাম।
আমার স্ত্রী তাকে নিজের ভাইয়ের মত সেবা যত্ন করে তার জন্য সুপ এটা সেটা রান্না করে
সময় মতো খাওয়াত। নামাজের সময় হলে তাগিদ দিত ভাই যান আপনার বন্ধু এখন নামাজ পড়বে আপনি
ওজু করে আসেন ওর সাথে নামাজ পড়বেন। নিজে তদারকি করে কাপর চোপর
ধুয়ে ইস্ত্রি করিয়ে দিত। শাহিন ভাই আপনার সিগারেট আমি কিনে দিব তবে প্যাকেট আমার
কাছে থাকবে যখন ইচ্ছা হবে আমার কাছে চেয়ে নিবেন। আমি জিজ্ঞেস করবনা কতগুলি খেলেন
তবুও প্যাকেট আমার কাছেই থাকবে। তার জন্য আলাদা করে মনি বেনসন সিগারেট কিনে আনাত।
রাশেদ সাহেব যখন বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন তখন মনি তাকেও বলে পাঠিয়ে দিত।
শাহিন ভাই আপনার বন্ধু খেলতে যাচ্ছে আপনিও যান। খেলা শেষে ফিরে এলে দুই বন্ধুর
জন্যে নিজের গরুর দুধ কিংবা বাগানের তাজা সবজী দিয়ে বানান কাটলেট বা অন্যান্য
নাস্তা রেডি করে রাখত। এই ভাবে যখন সে মোটা মুটি ভাল হয়ে আপনাকে চিঠি লিখেছিলো সে
চিঠির সাথে আমিও দুই লাইন লিখেছিলাম। আপা, চিন্তা করবেন না মনির যত্নে আর
আমি ওকে সব সময় আমার সাথে রাখি তাই ও এখন ভালর দিকে, আশা করি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে
যাবে। এই কড়া শাসনে শাহিন ভাল হয়ে গেছে। সুস্থ হয়ে উঠেছিলো। প্রায় দুই মাস সিগারেট
ছাড়া আর কিছু নেয়নি। তবে এই ধরনের নেশার আসক্তি কি আর সহজে ছাড়ান যায়? প্রথম দিকে রাশেদ
সাহেবই নিজে কিনে এনে দিতেন, চেনা দোকানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো-
-এগুলি
দিয়ে আপনি কি করবেন?
-আছে
দরকার আছে।
দোকানের
চেনা ডাক্তারকে বলেছিলেন আসল ঘটনা।
-আমার
ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি নিয়ে এসেছি নেশা ছাড়াব বলে।
অনেক
টাকা খরচ হয়েছিলো। প্রায় ভালো হয়েই গিয়েছিলো, রাশেদের সাথে রাশেদের ব্যবসার
কাজকর্মে সাহায্য করছিলো। মনিই একদিন বললো-
-ভাই
এবার যান একদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসেন দেখেন রুমাকে নিয়ে আসতে পারেন কিনা। রুমা এলে
আপনারা, মনি আর রাশেদ যে রুমে
থাকে তার পাশের রুম দেখিয়ে বলেছিলো এই ঘড়ে থাকবেন। আপনি আপনার বন্ধুর সাথে ব্যবসা
দেখে শুনে শিখে নিবেন, আপনারা
বাইরে দেখবেন আর ভিতরে আমি আর রুমা দেখব, ওকেও আমি শিখিয়ে নিব। কিছু দিন গেলে এখানে কাছেই আপনাদেরও
জায়গা আছে সেখানে আপনিও এই ব্যবসা করবেন, আমি বলেন আর আপনার বন্ধু বলেন সব ধরনের সাহায্য তো পাবেনই।
মনির
কথা শুনে শাহিন বলেছিল-
-হ্যাঁ
বাড়ি যাওয়া যায়,
ভালই হবে
তবে তোমরাও চলো না আমার সাথে, ওরা খুশি হবে।
-আচ্ছা
চলেন।
মিতা
আপা মানে রিতা আপার বড় বোনকে ফোন করে রাশেদ সাহেব বলেছিলেন-
-আপা
আমরা আগামী কাল শাহিনকে নিয়ে আসছি আপনি রুমাকে আসার জন্য বলবেন রুমা যেন ওখানে
থাকে।
-তুমি
মনিরাকে নিয়ে এসো।
-হ্যাঁ
আপা ও আসবে।
সেদিন
মনিই রুমার জন্য একটা শাড়ি আর ওর ছেলের জন্য একটা টি সার্ট কিনে শাহিনের হাতে দিয়ে
বলেছিলো এগুলি নিয়ে চলেন রুমা খুশি হবে। সেদিন একসাথে সবাই গিয়েছিলো, ওদের বাড়ির সবাই ভীষণ
খুশি, বড় ভাবী তো বললোই-
-আমার
মনে হচ্ছে আজ যেন ঈদ, শাহিনকে
যে ভাল দেখব এ আশা তো আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
মিতা
আপা রাশেদকে আর মনিরাকে ধরে সে কি কান্না,
-আমরা
যা পারিনি তোমরা তাই করলে।
ভাল
রান্না বান্নার আয়োজন করেছিলো। সবই হয়েছিলো কিন্তু যার জন্য এতো আয়োজন সেই রুমা
তার ভাইদের বাড়ি থেকে আসেনি। দুপুরে খাবার পর মনিরা রাশেদ সাহেবকে বললো-
-তুমি
যাও রুমাকে বুঝিয়ে বল অন্তত যেন এসে একটু দেখা করে যায়।
-তুমিও
চলো না আমি একা গেলে কেমন দেখায়, চলো।
মিতা
আপা জিগ্যেস করলেন-
-কি
আলাপ করছ তোমরা?
মনি বললো
-আপা ওকে বলছি রুমাকে একটুক্ষণের জন্যে হলেও এসে শাহিন ভাইর সাথে দেখা করার জন্য
নিয়ে আসতে।
-ও
তাহলে চলো আমিও যাই।
-বেশ।
ওরা এক
সাথেই গিয়েছিলো। রাশেদ সাহেব রুমার হাতে ধরে অনুনয় করে বলেছিলো-
-দেখ
রুমা, আমি জানি তুমি বিশ্বাস
হারিয়ে ফেলেছ,
ও যেখানে
পৌঁছেছিলো সেখান থেকে ফেরান কঠিন ছিলো, তোমরা পারনি। আমি শুধু তোমার আর তোমার ছেলের জন্য ওকে আমার
কাছে নিয়ে গেছি,
এই ভেবে
যে দেখি শেষ চেষ্টা করে। আমি দেখছি ও ভাল হয়ে গেছে, আমার সাথে আজ প্রায় তিন মাস হয়ে
গেলো।
আমাদের
কষ্ট হয়েছে,
অনেক
টাকা খরচ হয়েছে। মনিও কম কষ্ট করেনি। কিন্তু সবার উপরে সুখ পেয়েছি যে তোমার জিনিষ
তোমার হাতে ফিরিয়ে দিতে পারছি বলে। তুমি যদি ওকে আনতে না যাও তাহলে কেমন হয়? তাহলে ও কার জন্য ভাল
হলো বলবে আমাকে?
তুমি চলো
ওর সাথে একটু দেখা করে আস, আমার বিশ্বাস ওকে তুমি দেখলেই ওর পরিবর্তন বুঝতে পারবে।
তুমি চলো,
ওকে একটু
নিজের চোখে দেখে অন্তত বলে আস যে রাশেদ ভাই মনিরা ভাবী যে ভাবে বলে সেভাবে থাক আমি
আসছি। তারপর মনি যেভাবে বলছে ওখানে গিয়ে কয়েক দিন ওর সাথে থেকে এসো, ওখানে যেতে না পারলে এ
বাড়িতেই থেক,
ওকে আমি
পাঠিয়ে দিব মাঝে মাঝে। তুমি যদি ওকে গ্রহণ না কর তাহলে আমি ওকে কার কাছে পাঠাব? শোন, পুরুষ মানুষের আশ্রয়
হলো তার স্ত্রীর বুকে। সমস্ত পৃথিবী তাকে ত্যাগ করতে পারে কিন্তু স্ত্রী তা পারে
না। যে স্ত্রীর বুকে তার স্বামীর জায়গা হয় না তার মত হতভাগা পুরুষের জায়গা আর
কোথায় হবে বল? তুমি চলো, দেখবে শাহিন একেবারে ভালো হয়ে গেছে। এখন মনি ওকে গুনে গুনে
সিগারেট দেয়,
ওর জন্য
দিনে মাত্র তিন কাপ চা বরাদ্দ। তুমি ওকে কাছে টেনে নাও, তুমি সাথে থাকলে আরও ভালো হবে না? আরও সহজ হবে। দেখবে
আগের মত সব ঠিক হয়ে গেছে। তোমার ভয় কি, মনিতো আছেই আমিও আছি, তোমার ভালো লাগবে।
তুমি তোমার হারান বিশ্বাস, হারান সম্পদ ফিরে পাবে। শাহিন ভাল হলে কে বেশি খুশি হবে
আমি না তুমি?
আমার মনে
হয় আমার চেষ্টা আমি করেছি এখন যা করার তা তোমার হাতে।
না, এতো অনুনয় বিনয়ে কোন
কাজ হয়নি।
রুমার একই কথা-
-যেদিন
আপনার বন্ধু নিজে রোজগার করে এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে সেদিনই আমি যাব তার আগে
নয়।
কারো
কোন কথাই সে মেনে নেয়নি। সেদিন ওখান থেকে ফিরে এসে সে রাতেই শাহিন গেট ডিঙ্গিয়ে
বেড় হয়ে কোথা থেকে যেন নেশার বস্তু এনে আবার শুরু করেছিলো। গেট ডিঙ্গিয়ে যেতে
দেখেছিলো রাশেদ সাহেবের নৈশ প্রহরী। সকালে সে রাশেদ সাহেবকে বললো-
-স্যার
গতরাতে আপনি শোবার পর শাহিন ভাই গেট ডিঙ্গিয়ে কোথায় যেন গেলো প্রায় দুই ঘণ্টা পরে
ফিরেছে।
কয়েক
দিনের মধ্যে রাশেদ সাহেবের নিজের চোখেও পড়ে যায়। দেরি না করে মিতা আপাকে ফোনে সব
জানিয়ে দুঃখ করে বললো সেদিন যদি রুমা আসত তাহলে হয়ত এমন হোত না, আমার সব চেষ্টা বৃথা
হয়ে গেলো। রুমা যদি এত কঠিন জেদ না করে একটু নমনীয় হোত তাহলে ওরই লাভ হোত। আপা
আমাকে মাফ করবেন, আমি
আর পারলাম না। আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এই হলো
শাহিন আর মিতা আপার বোন রিতা আপা। বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে রাশেদ সাহেব
কোন প্রতিদান আশা করেনি তবে দেশ থেকে প্রায় ছয় হাজার মাইল দূরে এই শীতের মধ্যে
সৌজন্যটা আশা করা নিছক অমূলক মনে করেনি। এরকমই হয়, অভাগার যা হবার তাহা রুধিবে কে? যাই হোক, আজ এখানে রিতা আপার
জায়গায় মিতা আপা হলে এমন হোত না।
১২৫।
টিউব
থেকে অল্ডগেট ইস্টে নেমে সোজা চলে গেলেন ব্রিকলেনে একটা জব সেন্টারে। ক্ষুধায়
রীতিমত পেট জ্বলছে ওদিকে তার সাথে আছে জানুয়ারির শীত। গায়ে যথেষ্ট শীতের কাপর থাকলে
কি হবে মনে যখন শক্তি থাকে না তখন হাজার গরম কাপরেও শীত দূরে যেতে চায় না। এমনিতেই সে ক্ষুধা
সইতে পারেনা তারপর আবার ডায়াবেটিসের রুগী। ক্ষুধা লাগলেই রীতিমত শরীর কাঁপে। না, আগে কাজের খোঁজ নিয়ে
নেই তার পর খাওয়া যাবে। এর আগে যেখানে গিয়েছিলেন তার কোনটায় না। এবারে অন্য আর এক
সেন্টারে। পরে জেনেছে এটা নাকি এখানকার বেশ পুরনো এবং নাম করা জব সেন্টার। নতুন
অফিস, এর আগে এখানে আসেনি
তাই একটু দ্বিধা সংকোচ নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে সামনের টেবিলের
এপাশে কোট গায়ে এক ভদ্রলোক বসে আছে। ওপাশে ভিতরের চেয়ারে কেও নেই। পাশে রিসিপশনের
মত লম্বা কাউন্টার টেবিলের ওপাশে একজন তার সামনে দাঁড়ানো লোক জনের সাথে কথা বলছে।
রাশেদ সাহেব দাঁড়িয়ে
কিছুক্ষণ তাদের কথাবার্তা শুনলেন। সে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে সেই ধরনের কথা হচ্ছে।
কাজকর্ম কেনা বেচা হচ্ছে। অপেক্ষায় রইলেন। একটু পরে তার ডাক এলো,
-কি
ভাই আপনি কি চান?
-আমি
সামনের একটা কাজ খুঁজছি, আছে?
-আপনার
অভিজ্ঞতা কত দিনের?
প্রবীণ
ছত্রির থিউরি আর বিয়ার দিয়ে গোসল করার অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বললেন-
-ছয়
মাস।
-আছে, আপনি একটু অপেক্ষা
করেন আমি ডাকবো।
ভাবল, তাহলে এই ফাঁকে কিছু
খেয়ে আসি, আচ্ছা
তাহলে আমি আধা ঘণ্টা পরে আসি?
-হ্যাঁ
ঠিক আছে আধা ঘণ্টা পরেই আসেন।
কাউন্টার
ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে ওই যে ঢুকে প্রথমেই কোট গায়ে যে লোককে চেয়ারে বসা দেখেছিলেন তার চোখে চোখ পড়ল। সে তাকেই দেখছিলো
আর অমনিই তাকে বাইরে আসার জন্য ইশারা করে বের হয়ে এলেন। বেরিয়ে
এসে পিছনে ঘুরে দেখে সেই লোক বেরিয়ে আসছে।
-আমি
কোট গায়ে আপনাকে দেখে বুঝেছি আপনি এখানকার স্থানীয় নন। এখানে কেও সাধারণত কোট গায়ে
দেয় না। জ্যাকেটই এখানে বেশি চলে তাই ভাবলাম দেখি একটু আলাপ করে। আমি রাশেদ, বাড়ি ঢাকা, গত অক্টোবরের শেষে
এসেছি বর্তমানে রেস্টুরেন্টে কামলা দিচ্ছি, আপনি?
-আমি
নাসির, আমার বাড়িও ঢাকা।
পরবর্তী
আলাপে জানা গেলো সে এখানে টুরিস্ট হিসেবে এসেছে, কিছু দিন কাজ কর্ম করে যাতায়াতের
টাকাটা যা পারে তুলে নিয়ে দেশে ফিরে যাবে। পেশায় গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ঢাকায় বাংলা বাজারে
নিজের ব্যবসা আছে। আপাতত ছোট ভাই সেটা দেখছে। এই জব সেন্টারে কাজের সন্ধানে এসেছে।
মালিকের সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে কম্পিউটার সম্পর্কে জানে এমন একজন লোক দরকার।
তাই অপেক্ষা করছে। গত কাল বিকেলে ঘণ্টা দুয়েক বাংলা কম্পোজ করিয়েছে আর ছোট একটা
ডিজাইন করিয়েছে।
রাশেদ
সাহেব বললেন-
-আরে
ভাই এরা আপনাকে দিয়ে শুধু কাজ করিয়ে নিবে পয়সা দিবেনা। এখানকার
মানুষদের আমার হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে। দেশে আপনার অবস্থা যাই থাকুক আমরা তৃতীয়
বিশ্ব বলেন আর গরীব দেশ বলেন সেখান থেকে মূলত অভাবের কারণে অসহায় হয়েই এখানে আসি
আর এরা আমাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। এই যে কাল আপনি যা করেছেন সেটা যদি
এখানকার স্থানীয় কাওকে দিয়ে করাত তাহলে তাকে অন্তত পঞ্চাশ পাউন্ড দিতে হোত। আপনাকে কত দিয়েছে?
-না, কিছুই দেয়নি এমনকি এক
কাপ চাও খাওয়ায় নি। আমি বাইরে গিয়ে চা খেয়ে এসেছি।
-তাহলে
আপনি কি করে ভাবছেন আপনাকে হাজার পাউন্ডের কাজ দিবে? এদেশে আমাদের মত মানুষদের একটাই
কাজ আর তা হলো রেস্টুরেন্টের কাজ। থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা নেই। সপ্তাহ শেষে কাজের
বিনিময়ে রানীর মাথার ছবি সহ নগদ কিছু পাউন্ড পাবেন, যা পাবেন তাই লাভ।
আমি তাই
করছি। আমি গত সন্ধ্যায় রওয়ানা হয়ে এই মাত্র স্কটল্যান্ড থেকে আসলাম। এখন এখানে
একটা কাজ খুঁজতে এসেছি। যা বলেছে মনে হয় শুনেছেন, বলেছে আধাঘণ্টা পরে আসতে। এই
ফাঁকে নাস্তা সেরে আসার জন্য বের হচ্ছিলাম আপনাকে দেখে মনে হলো এই দেশের বাঙ্গালি
নন তাই ইশারা দিয়ে এলাম আলাপ করার জন্য।
-আপনি
নাস্তা করার জন্য যাচ্ছেন, কিছু মনে না করলে আমার সঙ্গে বেশ অনেক খাবার আছে খেতে
পারেন!
-আপনার
সাথে খাবার আছে মানে কি?
-মানে
হলো আমার সাথে আমার স্ত্রী আর ছেলে এসেছিলো, ওরা আজ চলে গেলো আমি ওদের হিথরো
এয়ারপোর্টে উঠিয়ে দিয়ে এখানে এসেছি। ওদের খাবার জন্য যা নিয়ে বের হয়েছিলাম তা ওরা
সব খেতে পারেনি,
রয়ে
গেছে।
বলে হাতের
ব্যাগ দেখাল।
-এই
যে এখানে।
-চলেন
এক জায়গায় বসে কথা বলি আর আপনি খেয়ে নেন।
রাশেদ
সাহেব হঠাৎ এই রকম একজন সদ্য পরিচিত কারো খাবার খেতে একটু সংকোচ বোধ করছিলেন।
সম্ভবত নাসির সেটা বুঝতে পেরেছে।
-দেখুন
আলাপ যখন হলো আমরা একই পথের পথিক তাহলে আর আপনি এতো সংকোচ করছেন কেন?
চলুন
ওইতো এই বিল্ডিঙের পাশে ওই সিঁড়ির নিচের বেঞ্চে বসি। আপনি সারা রাত জার্নি করে
এসেছেন ক্ষুধা লেগেছে। খেয়ে নেন তারপর চলেন একটু চা খাই। এখানে এই শীতের মধ্যে
বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা।
-চলুন,
এগিয়ে
এসে কাঁধের ব্যাগটা বেঞ্চে নামিয়ে রেখে একটু আড়াল করে বসলেন। নাসিরও বসে হাতের
ব্যাগ খুলে একটা কন্টেইনার বের করে দিল তাতে মাখন মাখানো ব্রেড, ডিম ভাজি আর একটু আলু
ভাজি, এই পরিবেশে অপূর্ব
বাঙালি নাশতা। এগুলি দেখে অনেক কথা মনে হলো আবার তা ঝড়ের মত উড়েও গেলো। সব সময় সব
কিছু মনে করতে নেই, মনে রাখতেও নেই।
নাসির বললো-
-পানি
তো নেই যা ছিলো ফুরিয়ে গেছে।
-ভাবতে
হবেনা, আমার সাথে পানি আর জুস
আছে
ব্যাগ
খুলে জুসের প্যাকেট নাসিরের হাতে এগিয়ে দিলেন। নিজে পানির বোতল পাশে নামিয়ে রেখে
কন্টেইনারটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। খেতে খেতে কথা হচ্ছে।
-দেশে
আপনি যাই করেন না কেন এখানে তার কোন কদর নেই। হ্যাঁ থাকতো যদি আপনার ওয়ার্ক পারমিট
থাকত। এখন হয়ত খুঁজলে আপনার যোগ্য কাজ পাবেন কিন্তু থাকার জায়গা, খাওয়া দাওয়া এসব
কিভাবে চলবে?
আপনাকে
তো উপযুক্ত পয়সা দেবেনা! খুব বেশি হলে সপ্তাহে একশ পাউন্ড দিবে এ দিয়ে ঘর ভারা, যাতায়াত আর খাবার এসব
ম্যানেজ করবেন কিভাবে? কাজেই
ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে চলেন দেখি কোন রেস্টুরেন্টে কাজ পান কিনা। আমার মনে হয় এতেই
ভালো হবে।
-আমি
যে রেস্টুরেন্টের কাজ কিছুই জানিনা।
-আরে
আমিই কি জানতাম আমার ঘটনা শুনবেন?
-হ্যাঁ
বলেন শুনি।
রাশেদ
সাহেব মনিকে হিথরোতে বিদায় দেয়া থেকে আজ সকালে ভিক্টোরিয়া নামা পর্যন্ত সব খুলে বললো
।
-এখন
বুঝেছেন?
আপনি
প্রথমে কুমি ওয়েটারের কাজ নিবেন আগে থেকে কিচ্ছু জানার দরকার নেই কাজে গিয়ে শিখে
নিবেন। কথায় আছে না যেখানে ঠেকবেন সেখানে শিখবেন। কোথাও না ঠেকলে কিছু শেখা যায়না।
রাশেদ
সাহেবের খাওয়া শেষ। বোতল থেকে পানি খেয়ে তামাকের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট
বানিয়ে নাসিরের দিকে এগিয়ে দিলেন।
-না
ভাই আমার চলে না।
-ও
আচ্ছা বেশ ভাল।
নিজেই
জ্বালালেন। আয়েশ করে সিগারেট টানছিলেন আর ভাবছিলেন যাক অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও
একজন সঙ্গী পাওয়া গেলো, সিগারেট শেষ। উঠে দাঁড়ালেন,
-চলেন
দেখি একটু চা কোথায় পাই।
দুই জনে
হাঁটতে হাঁটতে ব্রিকলেনের সোনালি ব্যাংক ছাড়িয়ে সামনে হোয়াইট চ্যাপেলের দিকে এগিয়ে
ডান পাশে একটা দোকান থেকে কাগজের কাপে দুই কাপ চা নিয়ে আবার সেই জব সেন্টারের দিকে
ফিরে এলেন।
-কী
নাসির সাহেব কি সিদ্ধান্ত নিলেন?
-আমাকে
সাহেব বলার দরকার নেই আমি আপনার অনেক জুনিয়র আমাকে তুমি বলেন ভালো লাগবে।
-বেশ
তাই হবে,
তা কিছু
পেলে?
-হ্যাঁ
পেয়েছি।
-কি
পেলে?
-আপনি
আমার আগে এসেছেন এবং এসেই এর মধ্যে বেশ অনেক কিছু দেখে ফেলেছেন কাজেই আমার মনে হয়
আপনি যা বলছেন তাই ঠিক। চলেন দেখি আমার জন্য কোন কাজ পাই কিনা।
-হ্যাঁ
ঠিক বলেছেন চলেন।
আবার জব
সেন্টার। কাউন্টারের সেই ভদ্রলোকের সামনে যেতেই লোকটা বললো-
-আপনাকে
খুঁজছি আমি।
-আমি
একটু নাস্তা করে এলাম। স্কটল্যান্ড থেকে এসেছি ক্ষুধা লেগেছিলো, বলেন কি খবর।
-আপনার
একটা কাজ আছে একটু দাঁড়ান আমি ফোন করছি।
-হ্যালো, আপনারা একজন লোক
খুঁজছিলেন এই নেন ইনার সাথে কথা বলেন।
সালাম, ওয়ালাইকুম সালাম
ইত্যাদি সেরে গতানুগতিক যা যা এ পক্ষ ও পক্ষ বলা বলি করে তাই হলো। যা বললো তাতে
বুঝলেন ওবানের চেয়ে বেতন কিছু বেশিই দিবে।
-কবে
আসতে পারবেন?
-কবে
আসতে হবে?
-কাল
আসতে পারবেন?
-হ্যাঁ
পারা যাবে তবে আপনার ঠিকানা, ফোন নম্বর, কিভাবে কোথায় নামবো একটু বলবেন?
-হ্যাঁ
ঠিকানা ফোন নম্বর ওনার কাছেই পাবেন আর আমাদের রেস্টুরেন্ট হলো সাউথ ওয়েলসের
ব্রীজেন্ডে। আপনি ভিক্টোরিয়া থেকে ব্রীজেন্ডের টিকেট করে সোয়ান সির কোচে উঠবেন
কিংবা ট্রেনেও আসতে পারেন। আচ্ছা ভাই আমার নাম আসিয়াদ আলি আপনার
নামটা জানতে পারলাম না।
-ও
হ্যাঁ, আমার নাম রাশেদ, বাড়ি ঢাকা।
-তাহলে
রাশেদ ভাই কাল আসছেন?
-হ্যাঁ
আসিয়াদ ভাই আশা করছি কাল দেখা হবে।
এই
পর্যন্ত বলে রিসিভারটা কাউন্টারের ওপাশের লোকের হাতে ধরিয়ে দিলেন। সে তার প্রয়োজনীয়
কথা সেরে ওখানকার ফোন নম্বর ঠিকানা মালিকের নাম ইত্যাদি লিখে দিল। রাশেদ সাহেব
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে বিশ পাউন্ডের একটা নোট বের করে হাতে দিলেন। উনি নোটটা একটু দেখে বললো-
-ভাই
এটা তো স্কটিশ পাউন্ড! আর কোন নোট নেই?
-আমি
স্কটল্যান্ড থেকে আসছি আমার কাছে এটাই থাকবে। এই যে দেখেন সবই স্কটিশ নোট। অসুবিধা
কি ভাই, ওখানে দেখেছি ইংলিশ
আইরিশ সব নোটই চলে। কেও কিছু বলেনি। এগুলি সবই ব্রিটিশ পাউন্ড। আমি কোন সমস্যা
দেখছি না,
সকালে
টিউবে টিকেট করেছি কিছু বলেনি।
-না, আসলে এখানে এই নোট
বাজারে নিতে চায়না।
-নিতে
না চাইলে ব্যাংক থেকে চেঞ্জ করে নিবেন। আমি আর কিছু দিতে পারছিনা। আমার কাছে যা
আছে সবই স্কটিশ আর আইরিশ নোট। ইংলিশ নোট এই যে মাত্র দশ পাউন্ড আছে নিবেন, দশ পাউন্ডে হবে?
-আচ্ছা
থাক, যা আছে তাই দেন।
নোটটা
দিয়ে বললেন-
-আচ্ছা
ভাই, এই যে আমার এই বন্ধুর
জন্যে একটা কাজ হবে? উনি
কিন্তু একেবারে নতুন।
-হ্যাঁ
আছে, ডিড কোটে একটা কাজ আছে
তবে বৃহস্পতিবারে যেতে হবে। পারবেন?
নাসির
এগিয়ে বললো-
-আজ
মঙ্গলবার,
মানে
পরশু যেতে হবে?
হ্যাঁ
পারব।
-তাহলে
আপনি কাল সকালে আসেন।
নাসির
এবং রাশেদ সাহেব জব সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলেন।
-আচ্ছা, এখন বল কি দেখলে আর কি
বুঝলে?
-হ্যাঁ, ওই তো যা বলেছি তাই, আমি আপনার মতই করে
দেখি কি হয়।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।