১৭।
সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো বলে আর কিছু করার ছিলো না তবে রাশেদ সাহেব
বাবাকে বলে রাখলেন সে যেন কালই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। মনিকে বলে রাখলেন
কাল যেন সময় মত তাদের পাঠিয়ে দেয়। পর দিন
ডাক্তার দেখেই বলে দিল যে ‘ব্রেস্ট
ক্যান্সার’, বি লেভেলে চলে গেছে আপনি এতো দিন আসেননি কেন? এ তো এখনই
অপারেশন করতে হবে। আপনারা টাকা পয়সা আর সবার অনুমতি নিয়ে কালই চলে আসুন। বাড়িতে
ফিরে সবার সাথে আলাপ হলো।
রাশেদ আর তার ছোট ভাইয়ের বক্তব্য,
-না, অপারেশন করতে হলে কিছুতেই এখানে না, কোলকাতা
গিয়ে করাতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো সাথে কে যাবে? বাবা সিদ্ধান্ত দিলেন
সেঝ বৌ আর রাশেদ যাবে। মা বেঁকে বসলেন।
-না, যেতে হলে বড় বৌকে ছাড়া আমি যাবো না।
এ বাড়ির সবারই পাসপোর্ট আছে কাজেই দেরী করতে হয়নি। মার কথা মত পর দিনই
ভিসার জন্য সবার পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হলো। তার পরের দিন ছোট ভাই গিয়ে পাসপোর্ট
ভিসা সহ তিনটা টিকেট নিয়ে এলো। ওই দিনই রাতের কোচ। তার পর দিন কোলকাতার বেহালায়
ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে। ওরা সারা দিন এটা সেটা নানান টেস্ট ফেস্ট করে
জানাল আগামী দশ দিন পূজার বন্ধ আপনারা এর পরে আসুন। রাশেদ সাহেবের পিলে চমকে গেলো, বলে কি? এটা তো আর
নিজের দেশ না, এখানে কী করতে পারবে সে?
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পাশেই একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে গেলো। মা
আর মনিকে রেখে রাশেদ বের হয়ে গেলো বেহালা বাজারে। বাজার থেকে মায়ের পছন্দের বাজার
এনে দেখে এর মধ্যেই মনিরা ফ্ল্যাটের পাশের দোকান থেকে হাড়ি পাতিল কিনেছে আর গ্যাস
সিলিন্ডার সহ একটা সিঙ্গেল বার্নার চুলা ভাড়া করে এনে মৃত্যু পথ যাত্রী শাশুড়ির
জন্য রান্নার যোগাড় করে নিয়েছে।
রাশেদ বাজার নামিয়ে দিয়ে আবার বের হলো ফোন বুথ খোঁজার জন্য। বিলাতে মেঝ
ভাইকে জানাতে হবে। তাকে বিস্তারিত জানিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কোথায় আছে
খুঁজতে বের হলো। আশে পাশের দোকান, লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে সন্ধান পাচ্ছে
না এমন সময় একজনের সাথে আলাপ হলো যার পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষ শুনে নিজেই এগিয়ে এসেছেন, পেশায়
ডাক্তার। সব শুনে সে সল্ট লেকের এক ডাক্তারের ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে বলে দিলেন উনি
আমার শিক্ষক।
আপনি এখনি ফোন করে দেখুন উনি কি বলে। রাশেদ সাহেব দেরি না করে একটু আগে
যে বুথ থেকে ফোন করেছিলেন আবার সেখানে গিয়ে ফোন করলেন। ডাক্তার সাহেব নিজেই ধরেছেন, শুনে বললেন
হ্যাঁ ঠিক আছে আপনি সন্ধ্যা সাতটায় আসুন। ফোন রেখে মার ক্ষুধা লেগেছে ভেবে তার
প্রিয় দৈ চিড়া নিয়ে এসে দেখে মনিরার রান্না প্রায় শেষের দিকে। মা দৈ খেতে চাইল না, বললো এই তো রান্না প্রায় হয়ে গেছে। একটু পরেই মনি
খেতে দিল। রূপচান্দা মাছ ভাজা, ডাল আর ভাত। ভাত মুখে দিয়ে মা বৌকে কাছে
টেনে নিলেন। নিজের দেশ ছেড়ে এসে তার নিজের হাতে ছাব্বিশ বছর ধরে গড়া বৌয়ের হাতের
রান্না তার কাছে অমৃতের মত লাগছে তাই কান্না থামাতে পারেননি,
-তুমি তো আসতে চাইছিলে না, তুমি না এলে আমাকে কে
এই রান্না করে দিত?
-না মা, আমি তো নিষেধ করিনি, আব্বাই তো
রেখার নাম বলেছে।
খাবার শেষ করতেই বিকেল হয়ে গেলো। অচেনা জায়গা, এখান থেকে
সল্ট লেক যেতে কতক্ষণ লাগে জানা নেই বলে একটু আগেই বের হলো। একটা ট্যাক্সি নিয়ে
সোজা সল্ট লেক ডাক্তার ঘোষের চেম্বার। ডাক্তার ঢাকার প্রেসক্রিপশন দেখলেন, রুগী দেখে
রোগীকে পাশের ঘরে নিয়ে বসিয়ে আসতে বললেন। মনি মাকে নিয়ে পাশের ঘরে বসিয়ে এলো।
ডাক্তার জানতে চাইলেন,
-ইনি আপনার কি হয়?
-মা।
-তাহলে এতো দেরী করেছেন কেন, এখন বি স্টেজে চলে গেছে, এই লেভেলে
চলে গেলে মাস ছয়েকের বেশি রাখা যায় না। আপনারা চাইলে আমি অপারেশন করতে পারি এতে
আমার লাভ হলেও আপনাদের কোন লাভ হবে না
শুনে রাশেদ মনি দুই জনেরই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে মনি
জিজ্ঞেস করলো তাহলে এখন কি করা যায়? আপনি বলে দিন কোথায় গেলে ভাল হবে সে
যেখানেই হোক তা নিয়ে ভাববেন না, যত টাকা লাগে লাগবে।
-দেখুন কার কাছে পাঠাবো বলুন, যদি অন্য কারো কাছে কোন
ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সেটা আমার কাছেও থাকতো।
রাশেদ সাহেব কিছু বলতে পারছে না, শুধু একবার
মনির দিকে আবার ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখছে।
মনি আবার বললো, -তা হলে?
-তা হলে এখন ওই কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি এই সব
দিয়ে যত দিন থাকে। আর দেরী করবেন না। আপনারা একটু বসুন আমি কেমো থেরাপি দিয়ে নিই।
কেমো দেয়ার পর বললেন একটু বসুন দেখি কি অবস্থা হয়। আধা ঘণ্টা পর বললেন
এখন নিয়ে যান। তবে আপনারা কালই চলে যাবেন না। অন্তত তিন দিন এখানে থাকুন, কেমোর কোন
সাইড এফেক্ট দেখা দেয় কিনা সেটা দেখতে হবে। তিন দিন পর এখানে আসার দরকার নেই
যেখানে আছেন ওখান থেকে আমাকে ফোনে জানাবেন, যদি ঠিক
থাকে তাহলে চলে যেতে পারবেন। এর পরে আর রোগীকে কষ্ট দিয়ে এখানে আসতে হবে না
আপনাদের ঢাকাতেই আমার চেনা ডাক্তার আছে আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি তাকে আমার এই
প্রেসক্রিপশন দেখাবেন, আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি উনি সেভাবে ব্যবস্থা নিতে
পারবেন।
রাশেদ সাহেব ঠিকানা দেখল, -এতো আমাদের বাড়ির কাছেই।
দেশে ফিরে এসে কোলকাতার ডাক্তারের দেয়া ঠিকানা খুঁজে ডাক্তারের সাথে
দেখা করে প্রেসক্রিপশন আর তার চিঠি দেখালেন। ডাক্তার
হিসেব করে তারিখ দিয়ে বলে দিলেন সেদিন নিয়ে আসার জন্য, এখানেই
কেমোথেরাপি দেয়া যাবে। সব ভাই বোন, বৌ, জামাই, মেয়েদের
ডেকে একত্র করে সবাইকে কঠিন মর্মান্তিক সংবাদটা জানিয়ে বলে দিলেন তোমরা মানসিক
ভাবে প্রস্তুত থাকো। যে যে ভাবে পার তার সেবা করার চেষ্টা কর আর সে যেন ঘুণাক্ষরেও
কিছু বুঝতে না পারে এরকম অভিনয় করে যেও। বিলাতে ফোন করে ভাইকেও জানিয়ে দিল।
কয়েকদিন পর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এসে সেও শেষ দেখা দেখে গেলো।
কেমোথেরাপি শেষ হলে চলল রেডিও থেরাপি। এক সময় এটাও শেষ হবার পর কি যেন কি একটা
দামী ওষুধ দেয়া হলো। আত্মীয় স্বজনেরা নানা রকম খাবার এনে খাইয়ে দিয়ে শেষ দেখা করে
গেলো। বডি স্ক্যানের ছবিতে দেখেছে শরীরের প্রায় সব হাড় ঝাঁজরা হয়ে গেছে। মা তার
ব্যথা আর যন্ত্রণা যতটা সম্ভব চেপে রাখতে চাইতেন কিন্তু রাশেদ সাহেব তার মুখ দেখেই
বুঝতে পারতেন কি যন্ত্রণা মা সহ্য করছেন। সারাক্ষণ বাড়িতে মায়ের কাছেই থাকতেন আর
ভাবতেন হায়রে অর্থ! তুমি আমাকে ধরা দিলে না, আমি কি এতই
ঘৃণ্য? তোমার জন্যই আমার মায়ের এই যন্ত্রণা আমাকে নিরুপায় হয়ে দেখতে হচ্ছে।
বাড়িতে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই আছে।
স্থানীয় ডাক্তারের দেয়া সব ধরনের চিকিৎসা শেষ হবার পর কোলকাতার সেই
ডাক্তারের কাছে ফোন করে জানতে চাইলেন এখন কি করতে হবে। উনি সব শুনে বলে দিলেন সবই
তো হয়ে গেছে এখন দেবার মত আর কিছু নেই।
এর দিন দুয়েক পরেই মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। এই অবস্থায়ও নামাজ
ছাড়েননি। সেদিন মাগরিবের নামাজের পর থেকেই শ্বাস কষ্ট দেখা দিল, বড় মেয়ে প্রেশার
মেপে দেখল অসম্ভব রকম লো প্রেশার দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে মনির
শ্বাস কষ্টের ওষুধ নেয়ার মেশিন নেবুলাইজার দিয়ে ওষুধ দিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের
মধ্যেই শিয়রে বসা মনির কাছে পানি চাইলেন। কে যেন এক গ্লাস পানি মনির হাতে এগিয়ে
দিলে মনি এক হাতে মাথাটা একটু উঁচু করে ধরে পানি খাইয়ে দিল। পানি খেয়ে মনিকে জোরে
চেপে ধরে তার কোলে মাথা রেখে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। প্রাণ বায়ু উড়ে
গেলো, নির্বাক রাশেদ সাহেব পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখলেন।
১৮।
মনি রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাতের পাখা নামিয়ে নিশ্চল পাথরের মত মার
মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরে ফুল স্পিডে ফ্যান চলছিলো এ ফ্যানের বাতাস মায়ের
যন্ত্রণা মুছে দিয়ে বা উড়িয়ে না নিয়ে প্রাণ বায়ুটাই উড়িয়ে নিয়ে গেলো। বাবা, মনি সবাই
হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিলো। রাশেদ সাহেব বাবাকে বললেন ‘আব্বা হয়েছে
আর বাতাস করতে হবে না’ বলেই হাত থেকে পাখাটি নিয়ে পাশে রেখে মায়ের মুখ
চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন -কি করছিস?
মনি অনেক কষ্ট করে শুধু এটুকুই বলতে পারলো তার আর বাতাসের প্রয়োজন নেই
আব্বা।
ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজনদের কেও কেও ডুকরে কেঁদে ফেললেন।
রাশেদ সাহেব বাবাকে বললেন আমি একটা অন্যায় করেছি আব্বা আমাকে ক্ষমা
করবেন, সব কিছু আমি জানতাম, সবাইকে বলেছি কিন্তু আপনাকে বলতে পারিনি।
বাবা বললেন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেঝ ভাই অফিসে, ছোট ভাই
বাইরে গেছে। তাদের সবাইকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। বোনকে ফোনে জানালেন ওরা
সবাই যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে আসে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটরকে মৃত্যু
সংবাদ দেয়ার কথা বলে জরুরী ভাবে কল বুক করলেন, প্রায় সাথে
সাথেই লাইন পাওয়া গেলে বিলাতে মেঝ ভাইকে বললেন তোরা এখন কোথায় কি করছিস?
শুনে বললো -আম্মা তো আর নেই।
-কখন?
-এইতো চার মিনিট আগে।
-ও, আচ্ছা তাহলে আপনারা সব ব্যবস্থা করে ফেলেন, আমি এখনই
টিকেট বুকিং দিচ্ছি, পেলে সাথে সাথেই আসছি, তবে আমার
জন্য দেরী করবেন না।
আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিলেন। ছোট ভাইদের
বন্ধুরা সবাই এলো, তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেললো। সবাইকে ভাগাভাগি
করে কোরান খতম করার কথা বলে দিলেন। পরদিন মিরপুর বুদ্ধি জীবী গোরস্তানে রেখে আসার
আগ পর্যন্ত রাশেদ সাহেব অবিচল ছিলেন। যা যা করতে হবে তা যাকে দিয়ে যা করা যায় সবই
ঠিক ভাবে করেছেন। যাকে যাকে সংবাদ দেবার তা তিনি নিজেই দিয়েছেন। গোরস্তান থেকে
ফিরে এসে সবার অলক্ষ্যে গ্যারেজের এক কোণায় গিয়ে একা বসে পড়লেন। হঠাৎ করেই কান্না, সে কি
কান্না! কোন পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে এ এক বিস্ময়!
হঠাৎ ছোট মেয়ে দেখতে পেয়ে মাকে ডেকে নিয়ে এলো। মনি এসে মাথায় হাত রেখে
সান্ত্বনা দিয়ে কোন ভাবে ওখান থেকে ঘরে নিয়ে এলো। মায়ের মৃত্যুর পরেই শুরু হলো
রাশেদ সাহেবের অনন্ত পতন, একেবারে পৃথিবীর অতলে তলিয়ে যাবার যাত্রা
আরম্ভ হলো তার।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।