১৩১।
নাসিরও
তার জীবনের অনেক কথা বললো। ওর বিয়ের অনেক আগেই শ্বশুর শাশুড়ি বড়
মেয়েকে তার নানীর কাছে রেখে আমেরিকা চলে যেতে বাধ্য হয়। ভদ্র লোক এখানে ব্যবসা
করতেন ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতি দিয়ে অনেক দেনায়
জর্জরিত হয়ে যখন ঋণ শোধ করার আর কোন
উপায় নেই তখন কিভাবে যেন একটা পথ বের করে আমেরিকা পাড়ি দিয়ে পালিয়ে রক্ষা পায়। সেই
যে গেছে আর ফিরতে পারেনি এমনকি মেয়ের বিয়েতেও না। এ যাবত শ্বশুর শাশুড়ি, শালা শালি কাউকে
দেখেনি শুধু ফোনে কথা হয়েছে আর ছবিতে দেখেছে। তাদের ইচ্ছা ওরা দুই জনেই আমেরিকা
চলে আসুক ওখানেই থাকবে, ছেলেটার চিকিৎসা হবে। রাশেদ
সাহেব ছবি দেখে বুঝেছে এই ছেলে পোলিওতে আক্রান্ত। এটা ভালো হবার না। কিন্তু আশায়
বুক বেঁধে
যে বাবা ছেলের আরোগ্যের পথ চেয়ে বসে আছে তাকে কি ভাবে এ কথা বলে, তাই কিছু বলতে পারেনি।
এই জন্যেই ওরা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে পাসপোর্ট ভারী করছে।
মানুষ
আশা তরী বেয়ে কত কি করতে পারে, কোথায় কোথায় চলে যায় কত কি করে! সেই স্বপ্ন তরী গুলো
মানুষকে কত কি করতে আগ্রহ যোগায়, শক্তি যোগায়। এই স্বপ্ন তরী গুলিই নাসিরকে দিয়ে সারা
পৃথিবী ঘুরে ঘুরে আমেরিকা যাবার বীজ বুনে চলছে। ঢাকায় বাবার স্টিল ফার্নিচারের
ব্যবসা ছিলো বাবা মারা যাবার পর ছেলেরা কেও আর সে ব্যবসা ধরে রাখতে পারেনি, চায়নি। ওরা ওদের মত
করে নিজেরা আলাদা ব্যবসা করছে। বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা ভালো লাগেনি। এখন ভালোই
চলছে, ভালোই আছে।
১৩২।
-নাসির, তিনটা বেজে গেছে এবার
ঘুমাতে হয়। আমার গত রাতে একটুও চোখ বন্ধ হয়নি তবুও ঘুমাতে ইচ্ছা হচ্ছে না মনে
হচ্ছে আরও কথা বলি, কত
দিন কথা বলি না। মনি যাবার পর এই প্রথম এত কথা বললাম।
-ভাবীর
নাম বুঝি মনি? ছবি
নেই কোন?
-না
সাথে নেই,
মেইলে
আছে, তোমার মেইল এড্রেস দিও
আমি এটাচ করে দিব দেখে নিও। নাসির কাল যদি ওখানে যেতে না হোত তাহলে আরও গল্প করতাম, এখন মনে হচ্ছে কাল যাব
কথাটা বলা ভুল হয়ে গেছে। আমি কি জানি যে তোমার বাসা আছে, আগে জানলে কাল এখানে থেকে পরশু দুজনে
এক সাথে বের হতাম।
-হ্যাঁ
রাশেদ ভাই আমিই কি জানতাম যে আপনি এই ভাবে আছেন তা হলে তো কাল আমরা সারা দিন
বেড়াতে পারতাম।
-যাক
যা হবার হয়ে গেছে এখন শুয়ে পর দেখি ঘুম আসে কিনা। সকালে কখন উঠবে?
-এক
সময় উঠলেই হলো,
আপনার
কোচ তো বারটায় তাই না?
-হ্যাঁ।
-তাহলে
এখান থেকে এগারোটায় বের হলেই হবে। নয়টা বা দশটায় এক সময় উঠলেই হবে বিশেষ কোন তাড়া
নেই।
১৩৩।
সকালে
উঠে দুজনে এক সাথে নাস্তা খেয়ে বের হলেন। এক সাথেই টিউব স্টেশন পর্যন্ত এসে এক জন
ব্রিকলেন আর এক জন ভিক্টোরিয়া গেলেন। রাশেদ সাহেব ভিক্টোরিয়া টিউব স্টেশন থেকে কোচ
স্টেশনে যাবার পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন পৌঁছলেন তখন সোয়ান সির কোচ ছাড়ি ছাড়ি ভাব।
যাই হোক গাড়িতে উঠে পরলেন কিন্তু ভেবেছিলেন পথে খাবার জন্য কিছু কিনে নিবেন তা আর
হলো না। যাক,
সময় মতো
গাড়ি পেয়েছি এই যথেষ্ট সাথে এক বোতল পানি আছে এতেই চলবে। যদি কোন সার্ভিস স্টেশনে
থামে তাহলে আর কোন কথা নেই। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, যথারীতি এদেশের প্রথানুযায়ী ড্রাইভার
মাইকে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়ে দিল। বাকিংহাম প্যালেস রোড ছেড়ে
একটু পরে টেমস নদীর পাড় দিয়ে চেলসি হয়ে কোচ এগিয়ে যাচ্ছে ব্রীজেন্ডের পথে। পথ হারিয়ে
ফেলায় ভীষণ চিন্তায় পড়েছিলেন, দৌড়িয়ে আসতে হয়েছে। গলা শুকিয়ে গেছে, ব্যাগ থেকে পানির বোতল
বেড় করে একটু পানি খেয়ে নিলেন।
আজ
দিনের বেলা,
রাস্তায়
দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেলো শহর এলাকা ছাড়িয়ে আসতে। বাম
দিকে কোথাও হিথরো এয়ারপোর্ট, রাস্তার সাইন পোস্ট দেখে অনুমান করলেন। বেশ কিছু দূর যাবার
পর দেখলেন ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে অনেক গুলি। বিশাল টিলার মত এলাকা নিয়ে ভেড়ার খামার।
দূর থেকে দেখে ভাবছিলেন কতো বিশাল এলাকা নিয়ে খামার। ভেড়া গুলি এই শীতের মধ্যেও
কেমন চড়ে বেড়াচ্ছে, তাজা
ঘাস খাচ্ছে।
১৩৪।
ইচ্ছে
করে মন থেকে চিন্তা দূরে রাখতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। দেশ থেকে এসেছেন আজ প্রায়
আড়াই মাস হয়ে গেছে, মনি
চলছে কি ভাবে। সেতো কোন টাকা পয়সা পাঠাতে পারেনি। ওদিকে আবার মামার টাকাগুলিও দিতে
হবে, অবশ্য মামা টাকার জন্য
তাগাদা দিবে না,
তবুও।
দেখি ওখানে গিয়ে কি অবস্থা হয়। এ পর্যন্ত টাকা যা পেয়েছে তা খরচ বাদ
দিয়ে বাকি গুলি সাথেই আছে, অবস্থা বুঝে পাঠিয়ে দিবে। মনি কি এমনিতেই কম চিন্তা করতে
পারে? লন্ডনে এসে কি হলো তাও
জানাতে পারেনি,
সময় বা
সুযোগ হলো কোথায়? দেখি ওখানকার অবস্থা জেনে একবারেই জানানো যাবে। এখন
যেখানে যাচ্ছে সেখানে কেমন কে জানে? সামনে কিছু দূর যাবার পর তার ভাই যে শহরে থাকে
সেদিকে যাবার পথ নির্দেশ দেখতে পেয়ে মনটা আবার কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো।
না তাকে এই যন্ত্রণার কথা ভুলতেই হবে এই ব্যথা কিছুতেই পুষে রাখা যাবেনা তাহলে
সে পঙ্গু হয়ে যাবে, কিছুই
করতে পারবেনা। মানসিক শক্তি হারালে চলবে না, তাকে শক্ত হতে হবে, কঠিন হতে হবে, নিজেকে ভেঙ্গে যেতে
দেয়া যাবেনা। জোড় করে নাসিরের কথা মনে করার চেষ্টা করলো, নাসির কি করছে ও কি ডিড কোটের
কাজটা পেয়েছে?
কখন যাবে, আজ নাকি কাল? নাসিরের সাথে যখন আলাপ
হলোই যদি লন্ডনে আর একটা দিন সময় পেতো তাহলে একটা মোবাইল নিলে খারাপ হোত না। এখন
ফোন করে জানা যেত ওর কি হয়েছে।
১৩৫।
আমাদের
মত গরীব দেশে সরকারি বড় বড় অফিসারদেরও একটা মোবাইল ফোন কিনতে হলে হিশেব নিকাশ করে
কিনতে হয়। এখানে এক জন সাধারণ সর্বনিম্ন আয়ের মানুষও তার এক সপ্তাহের আয়ের চার
ভাগের এক ভাগ দিয়েই মোটা মুটি মানের একটা মোবাইল কিনতে পারে। এদেশের মানুষের অসুখ
বিসুখ হবে কেন?
এদের
খাওয়া পরার কোন চিন্তা নেই, ভাবনাহীন জীবন। যা আয় করছে তা দিয়ে নিশ্চিন্তায় দিন চলে
যাচ্ছে, আনন্দ করছে, সখ মেটাচ্ছে। কাল কি
খাবো, কি পরবো, ছেলে মেয়ের লেখা পড়ার
খরচ কি দিয়ে চালাবো সে চিন্তা নেই। অথচ আমাদের দেশে দোকানে বা বাজারে সখের কোন
জিনিস, ঘড় সাজাবার জিনিষ বা
নতুন কোন খাবার যা কিছু দেখা যায় তা দেখেই তৃপ্তি পেতে হয়। সে জিনিস আর কেনার
সুযোগ হয়না। এখানে রাস্তায় কোন ধুলাবালি নেই, ডাস্টবিনের বাইরে কোন আবর্জনা নেই, কোন পচা গন্ধ নেই, নাকে রুমাল চেপে হাঁটতে
হয়না। হাবিজাবি কোন পোকা মাকড় নেই। এতো দিন
হয়ে গেলো এসেছে এর মধ্যে কোন মশা বা মাছি দেখেনি। দোকানে কোন ভেজাল খাবার নেই, চিকিৎসায় কোন খরচ নেই
সরকার বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছে শুধু চিকিৎসা না, সাথে এক্সরে, প্যাথলজি পরীক্ষা, আলট্রা সনো ইত্যাদি যা
যা দরকার হচ্ছে সব করছে। এর মধ্যে একদিনের জন্যেও কোথাও বিদ্যুৎ নেই এমনও চোখে
পড়েনি। লন্ডন শহরে যতগুলি টিউব স্টেশন আর সুপার স্টোর আছে তাতে সারা দিনে শুধু
চলমান সিঁড়িতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে তা দিয়ে মনে হয় কয়েকটা ঢাকা শহর চালানো
যাবে।
এই যে
এত দূরের পথ গেলো আবার এলো কই মনেই হয়নি যে এত দূরের জার্নি করে এসেছে। গত পরশু যে
কাপড় পরে ওবান থেকে বের হয়েছিলো এখনও সেই সার্ট সেই প্যান্ট সেই মুজা পরনে রয়েছে।
জুতাটাও এক বার ব্রাশ করা হয়নি। মনেই হচ্ছে না গত তিন দিন ধরে এই এক কাপড় পরে এতো
জার্নি এতো দৌড়া দৌড়ী করেছে। আসার পর থেকেই তো কত অচেনা খাবার খেতে হয়েছে অচেনা
খাদ্যে অভ্যাসের ব্যতিক্রম হলেও পেট তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেনি। এরা ভালো
থাকবেনা কেন?
এক কাপড়
পরেই ছয় দিন ডিউটি করেছে ঘাম ধুলোর কোন গন্ধ হয়নি তবে গন্ধ যা হয়েছে তা শুধু মদের
গন্ধ। বিয়ারের গন্ধ মনে হোত খাদ্য বিভাগের কোন গোডাউনের গম পচা গন্ধ। সব চেয়ে বিকট
গন্ধ হলো রেড ওয়াইনের। উফ, বোতল খুললেই মনে হোত পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে
চাইছে। অথচ এরা তা অবলীলায় গিলছে!
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।