৩২।
মনিরা
আর রাশেদ সাহেব আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে তাদের ঘরে চলে এলো। ছোট্ট
একটা ঘর,
সিঙ্গেল
একটা খাট। এর মধ্যেই তাদের দুজনকে থাকতে হবে। রাশেদ সাহেব বাঙ্গালির স্বাভাবিক
উচ্চতার চেয়ে একটু
বেশি লম্বা বলে দেশের বাজারে যে মাপের খাট তৈরি হয় তাতে শুতে
পারে না। নিজে কাঠ কিনে এনে বাড়িতে মিস্ত্রী ডেকে তার নিজের মাপ মত খাট বানিয়ে
নিয়েছেন। আজ এই ছোট্ট খাটে দুজনকে শুতে হবে। মনির দিকে চেয়ে হেসে বললেন কি করবে, এর মধ্যেই শুয়ে পর।
লম্বা জার্নি করেছ তুমি ক্লান্ত। খাটের দিকে চেয়ে লাভ নেই। এখানে যা পেয়েছ তাতেই
শোকর কর। না হলে এতক্ষণে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছা কাছি বা হোয়াইট চ্যাপেলের কাছে
কম দামের ‘বেড এন্ড ব্রেক ফাস্ট’ খুঁজতে হতো। অনেক
পেয়েছি এখানে।
দেখেছ, ফিরোজের বোন, বোন জামাই আমাদের জন্য
এই ঘর ছেড়ে অন্য বাসায় গিয়ে থাকছে। এদেশে যার যার নিজের যতটুক দরকার ততটাই ঘর
কিনে। এতো বড় ঘর দিয়ে কি করবে? এটাই এই লন্ডনের জীবন। দেশের
মানুষ যেমন ভাবে যারা লন্ডন থাকে তারা না জানি কত সুখে আছে আসলে তা নয়। হ্যাঁ
রোজগার ভাল কিন্তু জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় এখানে। ক’দিন
থাক দেখবে,
এখানকার
জীবন কেমন।
এই যে
এই জানালা দেখছ দেখ এতে মোটা দুইটা কাঁচ লাগানো রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ডাবল গ্লেজিং যাতে
শীতের তাণ্ডব দ্বিতীয় কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে না পারে। শীত বল আর গরম বল কখনোই
জানালা খুলে রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের মত বারান্দায় বসা কাকে বলে এরা জানেই
না। কাল দিনে দেখবে বাড়ি ঘর একেকটা একেক দিকে মুখ করা। দক্ষিণ মুখী হতে হবে নয়তো
একান্ত পূর্ব মুখী না হলে বাতাস এসে দেহ মন জুড়িয়ে দিবে এদের এমন ভাবনা নেই। আরও
দেখবে, এখানে কেও কারো নয়। কেও
কাউকে এক কাপ চাও খেতে বলে না নিতান্ত কোন উদ্দেশ্য না থাকলে। তবুও যা করেছে আমি
ভাবতেও পারিনি। সেই কবে স্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি, জানা না থাকলে ওকে দেখে হয় তো
চিনতেও পারতাম না। ও যা করেছে সে ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারব কিনা জানি না। ওর
বৌ যদি এমন না হতো তাহলে হয়ত ফিরোজের পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না।
সবই
আল্লাহর ইচ্ছা নয়তো এমন জামাই আদর? অসম্ভব। আমি তো ভাবতেই পারিনি, শুনেছি এদেশের মেয়ে তাই ভেবেই
নিয়েছিলাম সাদা কেও হবে, এতো দিন তাই মনে করেছি। নিজের আপন ভাই তো রয়েছে তাকে তো
জানাতেও পারিনি। যাক কাল থেকেই সব দেখতে পাবে। এখন শুয়ে পর, আমরা তো আর হানিমুন
করতে আসিনি বা সখ করে বেড়াতে আসিনি। আমাদের ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।
ভোরে
সেহরি খাবার জন্য উঠেছিলো, কোন রকম সেহরি খেয়েই আবার ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক
দেরীতে। ভাবী বা ফিরোজ কেও ইচ্ছা করেই ডাকেনি।
মনিরার
সাড়া পেয়ে ভাবী উপরে এসে জিজ্ঞেস করলেন -কি ভাবী ঘুম হয়েছে?
-হ্যাঁ
ভাবী দুই দিন পথে থেকে ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম শোবার সাথে সাথেই ঘুম কোথা দিয়ে এত বেলা
হয়েছে বুঝতেই পারিনি।
নিচে
নেমে সবাই গল্প করছে। চলো দেখি তোমাদের জায়গাটা কেমন দেখায়। ঘরের বাইরে বের হলো, প্রচণ্ড শীত, গরম কাপড় গায়ে তবুও
কাঁপুনি লাগছে। ওর বাড়িটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু ফুলের বাগান, এখন শীত বলে কোন ফুল
নেই শুধু গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই বাচ্চাদের খেলাধুলার একটু জায়গা। আবার তার
পরেই রাস্তা। কাল যে গাড়িতে করে এসেছে সেটা রাস্তার পাশেই ওর বাড়ির সামনে রেখেছে।
ফিরোজ বললো ওটা শেফালির।
-তোমার
কোনটা?
-ওই
তো ওর পিছনের টা।
শীত
সহ্য করতে না পেরে মনি ভিতরে চলে এলো। বাড়ির পিছনে শাক সবজি করার মত খানিকটা মাটি, চারদিকে কাঠের বেড়া
দেয়া। এক কোনায় একটা আপেল গাছ। নীচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘরে আবার ছোট একটা খাবার
টেবিল পাতা আছে,
ছোট একটা
টয়লেট আর একটা ঘর যেখানে ওর মা থাকে। উপরে দোতলায় দুইটা ঘর, বাথরুম টয়লেট, তিনতলায় চিলে কোঠার মত
একটা ঘর। বেশ ছিম ছাম করে সাজানো। সারা বাড়িতে মোটা কার্পেট বিছানো। এমনকি
বাথরুমেও। বাথরুমের এক পাশে পর্দা ঘেরা বাথ টাব। এখানে আমাদের দেশের মত ঘরে ঘরে
জনে জনে একটা করে বাথরুম নেই। অতিরিক্ত কোন ঘর নেই। এখানে একটা বাড়ি আছে এই যথেষ্ট। বিলাসিতা
করার মত বা অনর্থক খরচের বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। শীত কালে বাড়ি গরম রাখার জন্য
যথেষ্ট গ্যাস বিজলী খরচ হয়ে যায়। এর নাম লন্ডন শহর। সারা দিন কাজ আর কাজ, বাড়িতে কতক্ষণই থাকার
সুযোগ পায়। রাতে কোন রকমে শরীরটাকে একটু বিছানায় ফেলে দেয়া।
বাড়িতে
সেন্ট্রাল হিটিং চলছে তবুও বসার ঘরে আলাদা একটা হিটার চলছে। নভেম্বরের প্রথম, এর মধ্যে লন্ডন শহরে
আর কেও জায়গা পাক আর না পাক শীত মহোদয় তার আসন পেতে নিয়েছে। ফিরোজের মা মনিকে ডেকে
পাশের রান্না ঘরে গেলো।
৩৩।
ফিরোজ
জিজ্ঞেস করলো
-এবার
বল দেখি কি ব্যাপার, হঠাৎ
করে চলে এলে,
নাকি কোন
কাজ আছে?
কামরুলের
কাছে শুনেছি তুমি তো ভাল চাকরি করতে তারপর আবার বিরাট ব্যবসা করছিলে।
-সে
ব্যবসা আর নেই সব শেষ, সেই
জন্যই তো আসা। একটা কাজকর্ম কিছু যোগাড় করে দাও। সম্ভব হলে দুজনকেই নয়তো অগত্যা
আমার যা হোক একটা কিছু।
সব খুলে
বললো । শুনে ফিরোজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো-
-এই
ব্যাপার! আমি তো ভাবতেও পারছি না তোমার এমন হলো কি করে। যোগাযোগ বা দেখা না হলে কি
হবে আমি তোমার সব খবরই জানি। তুমি মালেকের বোনকে বিয়ে করেছ এ ও জানি তবে তোমার এই
শেষ দিকের কিছু জানার সুযোগ পাইনি।
একটু
ভাবল।
-ঠিক
আছে এই অবস্থায় এসেছ যখন কিছু একটা করতে হবেই। তবে শুধু তোমার জন্য, ভাবীর জন্য কোন
অবস্থাতেই না। সে কিছু দিন বেড়িয়ে দেশে চলে যাক ওখানে তোমার মেয়েরা রয়েছে। যদিও
তারা বড় হয়েছে তবুও তাদের মা কাছে থাকা দরকার। তুমি থাক।
এমন সময়
শেফালি ভাবীর কাছে ড্রাইভিং শিখছে এমন এক ছাত্রী ফোন করে জানতে চাইল সে কখন যাবে।
বাংলাদেশ থেকে মেহমান এসেছে বলে আজ যাবে না জানিয়ে দিল। ফিরোজও সেদিন কাজে গেলো
না।
ফিরোজের
মা এসে বললো যাও ওকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আস।
তারাও
এর মধ্যে মনিরার কাছে ওদের আসার উদ্দেশ্য সব শুনেছে।
-এসেছ
কদিন বেড়িয়ে লন্ডন দেখে নাও, ভাবীকেও দেখিয়ে দাও তারপর দেখি কি করা যায়।
শুনে
ওরা উভয়েই যেন হাতে স্বর্গ পেলো। মনিরা বললো-
-দেখেন
ভাই যে করেই হোক ওর যেমন তেমন একটা কিছু না হলে যে আর কোন উপায় নেই।
-চিন্তা
করবেন না কিছু একটা হয়ে যাবে, এখন চলেন একটু ঘুরে আসি। আপনার ভাবী আবার ফার্স্ট ক্লাস ড্রাইভার।
-হ্যাঁ
সেতো কালই দেখলাম। তবে আজ না ভাই। শরীর এখনও টলমল করছে। কাল না হয় যাওয়া যাবে, আজ ঘরেই থাকি।
মনি তো
বেড়াতে আসেনি। ওর মনে চলছে সেই ঝড় যে ঝড় তাদের এখানে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। তার পাগল
আজ ঘর ছাড়া,
দেশ ছাড়া, দেউলিয়া। কি করে ঋণ
শোধ হবে,
মেয়েদের
মানুষ করবে,
তার
রাশেদ কি ভাবে একা এখানে থাকবে এই সব চিন্তায় সে জর্জরিত। তার
এখন বেড়াবার মত মন নেই। এ কথা কি আর বলা যায়? এ যে তার একান্ত নিজের যন্ত্রণা।
সুখ কারো সাথে ভাগ করে নেয়া যায় কিন্তু দুঃখ? সে তো একান্ত আপনার। সে ভাগ কাউকে
দেয়া যায় না! আনন্দ করতে হয় সবাইকে নিয়ে, কাঁদতে হয় নীরবে, একা একা।
[চলবে] Back to home
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।