৫৪।
-কবির
ভাই বলেন কি করতে হবে।
-আসেন
আমার সাথে।
কিচেনের
পাশের রুমে যেখানে আর একটা বড় শুকনো মালামালের স্টোর ওখানে বিরাট দুটা ফ্রিজ খুলে বললো-
-এই
যে এই গুলি বের করে নিয়ে আসেন আমার সাথে।
বিভিন্ন
সাইজের ট্রে এবং বড় বড় বাটিতে নানান রকমের জিনিষ। এতে আছে আলাদা আলাদা রকমের মশলা
দিয়ে সেদ্ধ করা দুই তিন পদের মুরগির মাংস, ভেড়ার মাংস, কোনটা লাল কোনটা
হলদেটে কোনটা সাদা। আরও আছে ওই রকম সবজী, আলু, নানা ভাবে কুচানো পিঁয়াজের তিন চার পদ, আদা রসুনের পেস্ট, টক দই, টমাটো আর কি কি সব
মশলা দিয়ে বানানো কি কি যেন চিনতে পারল না।
কাটা
টমাটো, শসা, লেবু, লেটুস, সেদ্ধ করা নানা সাইজের
পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনে পাতা ইত্যাদি।
আবার এর সাথে হলুদ, ধনিয়া, শুকনা মরিচ, জিরার গুরা, শুকনা মেথি পাতা, কুরানো শুকনা নারকেল, লবণ, চিনি, কিসমিস, আলমন্ড বাদামের গুরা, পেস্তা বাদাম এবং আরও
কিছু যা চিনতে পারল না এগুলি নিয়ে কিছু সেফ এর পিছনে, কিছু পাশে সাজিয়ে রাখল।
-প্রতিদিন
এই ভাবে এসে সব কিছু যেটা যেখানে আজকে রাখলেন সেই ভাবে রাখবেন। আবার বন্ধ হবার আগে
যখন সেফ সাহেব বলবে তখন যেখান থেকে যেভাবে এনেছেন সেই ভাবে নিয়ে রাখবেন।
যারা
রেস্টুরেন্টে বসে না খেয়ে প্যাকেটে করে নিয়ে যায় তাদের জন্য আগে থেকে সাদা ভাত, পোলাও এসব প্যাকেটে
ভরে হট বক্সের ভিতরে রেখে দিতে হবে। যাতে করে তাড়াহুড়োর সময় হৈ চৈ না লাগে। পঁচিশ
টা পোলাও এবং চল্লিশটা সাদা রাইস এভাবে ভরে রাখল। আজকে মারুফই সেফ এর
কাজ এবং তার নিজের কাজ সহ চালিয়ে যাবে। ঘড়িতে দেখল সারে পাঁচটা বেজে গেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম অর্ডার এলো। কুমি ওয়েটার নুরুল ইসলাম অর্ডার পত্রটা এনে
সেফ এর পিছনে একটু উঁচুতে একটা লম্বা কাঠের ফ্রেমের সাথে আটকিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
শুরু হলো সেফ সাহেবের রান্না। ছোট ফ্রাই প্যান চুলায় চাপিয়ে তাতে একটু তেল দিয়ে
কুচানো পিঁয়াজ আর কিছু মশলা দিয়ে নারা চারা করে তার মধ্যে পাশে রাখা ওই যা ডেকচিতে
কি যেন জ্বাল দিতে দেখেছিলো তার থেকে চামচ দিয়ে উঠিয়ে ডালের মত কি যেন
দিল সেটা ফুটতে আরম্ভ করেছে পিছনে রাখা মাংসের ট্রে থকে গুনে গুনে কয়েক টুকরা মাংস
ছেড়ে দিয়ে নারা চারা করে নামিয়ে যে ধরনের অ্যালুমিনিয়ামের ছোট প্যাকেটে ভাত
ভরেছিলো তার চেয়ে একটু বড় প্যাকেটে ভরে ফ্রাই প্যানটা সিংক এর মধ্যে ছেড়ে দিয়ে
রাশেদ সাহেবকে বললো-
-ভাইছাব
এটায় ঢাকনা লাগিয়ে নাম লিখে দেন, তারপর প্যানটা ধুয়ে দিবেন।
-কি
নাম লিখব?
-লেখেন
চিকেন ভিন্দালু।
এর পর
উনি আবার আরও দুইটা প্যান একত্রে উনুনে চাপিয়ে দিল। এবার
কি করল
তা আর দেখা গেলো না। ওই প্যান ধোয়ার কাজে লেগে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার বললো-
-এটা
চিকেন টিক্কা মাশাল্লা আর এটা ল্যাম্ব কোরমা, এগুলি যখন নিতে আসবে এর সাথে
দুইটা বয়েল রাইস আর একটা প্লেইন নান দিয়ে দিবেন। নানটা আমি দিচ্ছি, এই যে এই ব্যাগে ভরে
দিয়ে দিবেন। আর আপনে এই যে এই বিল এইটা দেখে নিবেন তাই বুঝতে পারবেন কোন অর্ডারে
কি আছে এটা খেয়াল করে ব্যাগে ভরে দিবেন। দেখবেন ভুল যেন না হয় ভুল হলে কিন্তু কাস্টমার
ফিরে আসবে এবং তা আমাদের গুড উইল নষ্ট করবে। আমি তো চিল্লাই না। দেখবেন সেফ আসলে
কি করে। তার চিল্লানিতে কিচেনে থাকা মুশকিল।
রাশেদ
সাহেব আবার ওই দুই প্যাকেটে ঢাকনা লাগিয়ে নাম লিখে নিচের হট বক্সের ভিতর রেখে দিল। আবার ওই দুই
প্যান সিঙ্কে জমা হয়েছিলো এখন তা ধুয়ে দিল। এবারে মারুফ বললো-
-ভাইছাব
এই যে প্যান ধুইতেছেন দেখবেন যেন এই হ্যান্ডেলের ভিতর পানি না থাকে তা হইলে হ্যান্ডেল গরম হয়ে
যায় আর তা ধরা যায়না।
-বেশ।
এর
মধ্যেই ফ্রাই প্যান ধোয়ার সময় তারের জালি দিয়ে ডলতে গিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতে
দুএক যায়গায় কেটে গেলো। একটু পরেই আর একটা অর্ডার। এটা দেখে মনে হলো বেশ বড় অর্ডার।
হ্যাঁ
বেশ বড়ই বটে। মারুফ আবার তার কাজে লেগে গেলো। কবির বললো-
-এইযে
নয়া ভাইছাব আমাকে একটু পোলাও রাইস গরম করে দেন, ওই যে মাইক্রোওয়েভ ওইটাতে দুই
মিনিট গরম করলেই হবে।
সাথে
সাথে দেলোয়ার বলে উঠলো-
-ঢাকাইয়া
ভাইছাব আমারে একটা সালাদের প্লেট দিবেননি?
রাশেদ
এক এক করে ওগুলি দিয়ে দিল। ওদিকে আবার সিঙ্কে মারুফের দেয়া ফ্রাই প্যান জমে গেছে ।
ওতে হাত দিতে যাবে এমন সময় সামনে থেকে আসাদ এসে বললো-
-রাশেদ
ভাই আমাকে চারটা স্টারটার প্লেট রেডি করে দিবেন।
-এটা
আবার কি?
-আচ্ছা
আমি দেখিয়ে দিব ভাববেন না।
মারুফ
বলে উঠল -ভাইছাব দুইটা প্রন ককটেল গ্লাস লাগান।
হিমশিম
অবস্থা। মারুফকে দেখেছিলো যে ডিশ গুলি রান্না করে পেয়ালায় ঢেলে হট
বক্সের ভিতর রেখে দিতে। এখন দেখল সামনে থেকে আসাদ একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাতে ওই সব
পেয়ালা, কয়েকটা প্লেইন রাইসের
পেয়ালা দুইটা পোলাও রাইসের পেয়ালা, বড় একটা প্লেটে দুইটা নান রুটি নিয়ে গেলো। এর মধ্যে
দেলোয়ার কয়েকটা মুরগির টুকরা টমাটো আর ক্যাপসিকাম সহ শিকে গেঁথে গন গন করে গ্যাসের
আগুন জ্বলা তন্দুরের ভিতর ঝলসাতে দিয়েছিলো সেটা উঠিয়ে ছোট একটা লোহার ট্রেতে যেটা
আগে থেকে চুলার উপর গরম হতে দিয়েছিলো সেটায় কিছু কুচানো পিঁয়াজ ছেড়ে তার মধ্যে
ঢেলে দিতে ছর ছর করে শব্দ আর ধোয়ার সাথে জিবে জল আসা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে গেলো। আসাদ
আবার এসে একটা কাপড়ের ন্যাপকিন দিয়ে ধরে ওটা নিয়ে গেলো। ওদের কথায় জানতে পেল এর
নাম চিকেন শাসলিক। রাশেদ বুঝল ভিতরে কাস্টমার এসেছে যাদের জন্য এগুলি যাচ্ছে। একটু
পরেই নুরুল ইসলাম এসে বললো-
-ভাইছাব
একটা পোলাও রাইস দেন তো!
এইভাবে
প্রায় দুই ঘণ্টা চলে গেলো ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে। সময়ের সাথে ক্ষুধায় রাশেদ
সাহবে
অস্থির হয়ে গেলেন। কি করে, এখন লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা। সবাই ব্যস্ত। না, আর থাকা যায়না। দেয়াল
ঘড়িতে দেখল দশটা বাজে। এবার যে
করেই হোক কবিরের কানে কানে বললো।
-হা
আমাদেরও তো খুধা পেয়েছে একটু অপেক্ষা করেন সবার জন্যই বানাবো।
এতোক্ষণ
কি ভাবে যে সময় কেটে গেলো টের পায়নি শুধু লক্ষ করলো হাতের বেশ কতগুলো কাটা যা এখন
জ্বলছে। একে একে সামনে থেকে প্লেট পেয়ালা এসেছে সেগুলি রাখার জায়গা কবির দেখিয়ে
বলে
দিয়েছে।
-প্লেটের
উচ্ছিষ্ট গুলি এই বিনে ফেলে এই যে দুইটা সিংক এর এইটা ধোয়ার জন্য আর এই সিংক এর
ভিতর প্লেট,
হাফ
প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট, ছোট পেয়ালা, বড় পেয়ালা সুন্দর করে
স্ট্যাক করে রেখে দিবেন। যখন সব আসা শেষ হবে তখন সব এক সাথে ধুয়ে ফেলবেন। অবশ্য
যদি মাঝে কোনোটার টান পরে তখন এখান থেকে ধুয়ে দিতে হবে।
কবির
কিছু পোলাও রাইস আর ওই যে সেদ্ধ করা সবজি ছিলো ওগুলি দিয়ে সাথে কিছু মশলা দিয়ে
নাড়াচাড়া করে একটা কি যেন বানিয়ে আট দশটা বাটিতে বেড়ে সবাইকে বললো খেয়ে নিতে। সামনে থেকে সবাই একে
একে এসে খেয়ে গেলো। আসাদ একটু পরে একটা ট্রে করে লেবু আর বরফের টুকরো দিয়ে কোক
নিয়ে এলো চার গ্লাস। রাশেদের সামনে এসে বললো-
-নেন
ভাই আপনি নতুন এসেছেন আপনি আগে নেন।
রাশেদ
সাহেব একটা গ্লাস তুলে নিলেন। রাশেদ সাহেবের গলায় টনসিল, বরফ এড়িয়ে চলে তবুও প্রথম বার কোন
আপত্তি করলো না। গ্লাসটা পাশে রেখে কবিরের দেয়া নাম না জানা বিলাতের প্রথম ডিশটা
তুলে নিয়ে চামচ দিয়ে খেতে আরম্ভ করলো। কাজ চলছে কাজেই নিশ্চিন্তায় খাবার উপায় নেই।
তাড়াতাড়ি খেয়ে গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে মনে হলো শরীরটা একটু স্থির হলো। এই
রকম হাঁকা হাঁকি ছোটা ছুটি ব্যস্ততার মধ্যে এক সময় খেতে আসা লোকজনের ভিড় ধীরে ধীরে
কমে এলো। রাত এগারোটা বাজল। এবার সব কিছু গুছিয়ে নেবার পালা। বারোটায় রেস্টুরেন্ট
বন্ধ। সামনে থেকে আনোয়ার এসে বললো-
-মারুফ, কাস্টমার শেষ। আজকে আর
ব্যবসা হইবেনা আটাইয়া লও বাড়ি যাই।
এবার
মারুফ কবির কে ডেকে বললো-
-নয়া
ভাইছাবকে হেল্প কর।
-আচ্ছা
ঠিক আছে,
আসেন
ভাইছাব।
শুরু
হলো আর এক প্রক্রিয়া। প্রায় তিন থেকে চারশত প্লেট বাটি পেয়ালা বিশ পঁচিশটা
বিভিন্ন সাইজের ডেকচি ট্রে ইত্যাদি মিলিয়ে আরও চল্লিশ পঞ্চাশটি। এগুলি যখন জমা
হচ্ছিল তখনি ভাবছিলো এতো গুলি ধোয়া হবে কিভাবে? এ তো রাত পেরিয়ে যাবে। ভীষণ
চিন্তা হচ্ছিল। কবির ওই খালি সিংকটা গরম পানি দিয়ে ভরতে বললো । আঁটান
শব্দটি
আগে কখন শোনেনি তবে কথার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী অনুমান করে নিল মানে কি হতে পারে।
সিংক এর মধ্যে তো আর সব বাসন পেয়ালা জায়গা হয়নি, বেশীর ভাগই নিচে নামিয়ে রেখেছিলো।
সিংক যেটা খালি ছিলো সেটা সহ দুইটাতেই পানি ভরা হলে পাশে রাখা লিকুইড সাবান ঢেলে
দিল। যেটা ভরা ছিলো সেটায় একটু বেশি। এবারে বড় একটা স্পঞ্জের টুকরো দিয়ে এঁটো বাসন
বাটি গুলি ভরতি সিংক এর মধ্যে একটা ডলা দিয়েই সাথে সাথে পরিষ্কার সিংক এর মধ্যে
ছেড়ে দিল আর রাশেদ সাহেব সেগুলি উঠিয়ে উপরে পাশে পাশে খাঁচার মধ্যে সাজিয়ে রেখে
যেতে লাগলেন। এতেই রাশেদ সাহেবের ঘর্মাক্ত অবস্থা। ওই সিংক শেষ হলে রাশেদ
সাহেব নিচে থেকে উঠিয়ে আবার ওই নোংরা সিংক এর মধ্যে ছেড়ে দিলেন। আবার
সেই একই
প্রক্রিয়া। মোটামুটি যা ভেবেছি্লেন রাশেদ সাহেব তার চেয়ে অনেক কম সময়ের মধ্যেই
সিংক খালি। অবশ্য রাশেদ সাহেব একা করলে হয়ত সারা রাতেও পারত কিনা সন্দেহ। এই দেখে
দেলোয়ার বললো-
-দেখলেন
ফাস্ট কারে কয়, এমনে করবেন।
ওদিকে
ওই যে উপরে যেগুলি খাঁচায় রেখেছিলো সেগুলির পানি ঝরে শুকিয়ে গেছে। ওগুলি
আবার ওখান থেকে নামিয়ে কবিরের দেখিয়ে দেয়া ভিন্ন একটা হট বক্সের ভিতরে রেখে দিল।
ওদিকে দেলোয়ার আর মারুফ তাদের চুলা যেটায় এক সাথে ছয় টা বার্নার ব্যাবহার হয় ওটা
আর তন্দুর ধোয়া মুছা করছে। জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখছে। এমন সময় মালিক আনোয়ার এসে বললো-
-কি
নয়া ভাই সাহেব ঠিক আছেন তো? আরও ফাস্ট করবেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।