কাল পরীর সমাধি [৭]-পর্ব-১
১।
পাথুরি লাল মাটির পাহাড়ি এলাকায় চারিদিকে তুলা, আঁখ,
ভুট্টা আর কিছু কাসাভা সহ অন্যান্য ফসলের জমি এবং নানা আকারের,
নানা ধরনের ছোট বড় বাওবাব এবং এলোমেলো ডালপালা ছড়ানো এথাল গাছ সহ
অন্যান্য নানা গাছপালা
বেষ্টিত হালকা জনবসতি পূর্ণ একটি গ্রাম। গ্রামের নাম আরযো।
গ্রামের প্রতিটা বাড়িতেই কলার ঝোপ, কয়েকটা পেঁপে গাছ সহ
দুই একটা আম, কাঁঠাল, কমলা কিংবা শ্যরন ফলের গাছ দেখা
যায়। সৌখিন কারো বাড়ির পাশে চেরি এবং ডুমুরের গাছও আছে, এমনকি
কারো বাড়িতে দুই একটা তেঁতুল গাছও দেখা যায়। বাড়ির আশেপাশে মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা মরিচ, টমাটো, সাদা
গোল বেগুন, ফণী মনসা, নানা জাতের ক্যাকটাস ঝোপ দেখা যায়।
বেশ সুন্দর গ্রাম। অধিবাসীরা অধিকাংশই অবস্থাপন্ন। কৃষি কাজই এদের প্রধান পেশা।
নিজেদের উৎপাদিত পণ্য গাধা কিংবা মহিষের গাড়িতে করে দূরে নিকেমতা নামের ছোট শহরে
নিয়ে বিক্রি করে এদের জীবন ভালই চলে যায়। মনে সুখ শান্তির অভাব নেই। প্রায়ই
পূর্ণিমা রাতে গানের আসর বসে সেখানে নাচ গান পান সবই হয়।
গলায় সিংহের দাঁতের মালা এবং ঈগল ও বাজ পাখির
পালকের মুকুট মাথায় শক্ত চোয়াল আর শক্ত কঠিন পেশির শক্তিশালী যে পুরুষটিকে দেখা
যায় সেই ওবি এই গ্রামের মোড়ল বা লিয়ের। গলায় সিংহের দাঁতের মালা পড়া এদের গোত্রের
মান মর্যাদা এবং শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক। যার মালায় যত বেশি দাঁত থাকে সে তত
শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান লিয়ের। এই দেখেই বোঝা যায় সে কতগুলি সিংহ মেরেছে। গ্রাম
থেকে একটু দূরে দক্ষিণ দিকে ছোট দেদেসা নদীর পরেই বিশাল দিগেত বোস বা ঘন জঙ্গল।
নদীর পার দিয়ে জঙ্গলের আকৃতি বেশ ঘন, উঁচু গাছগাছালিতে ভরা
গাছপালার নিচে মিমোসা ও আঠা গাছের ঝোপ। সাথে আছে শন, নল
খাগরা, হোগলা, স্বট এবং আখের মত বেশ বড় বুনো ঘাস প্রায়
মানুষ সমান উঁচু এবং অন্যান্য ঝোপঝাড়। তবে নদীর কিনার থেকে কিছু দূরে রুক্ষ পাহাড়ি
মরু এলাকা। পাহাড়ের আশেপাশে মসৃন বালু সমৃদ্ধ এর্গ এবং আবার কোথাও ছোট বড় নানা
সাইজের পাথুরে এলাকা রেগও দেখা যায়। বাওয়াবাব, এথাল গাছ এবং কাটা বাবলা সহ
অন্যান্য বেশ বড় বড় গাছপালা মাঝে মাঝে বনের শোভা বৃদ্ধি করেছে। পাহাড়ের ফাকে ফাকে
নিচু অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এক দুই মাইল জুরে প্রায়ই এমন
জলা ভূমি রয়েছে। এই জলাভূমির চারিদিকেও ওইরকম ঘাস এবং মিমোসা ও হিবিসকাস সহ বিভিন্ন রকমের
ঝোপঝার। আশেপাশে কালাও এবং ফিলিকি সহ নানা জাতের পাখপাখালির কিচিরমিচিরে দিনরাত এই
সব লেক এলাকা মুখর থাকে। বনে বিশেষ করে
সিংহ এবং হাতির সংখ্যাই বেশি, কিছু বুনো মহিষ বা সিগুই
আছে আর এর সাথে চিতা, নেকরে, জেব্রা,
হরিণ, বানর এগুলি তো আছেই। জঙ্গলের ভিতরে এ রকম অনেক ছোট খাট লেক
থাকলেও এখানকার বাসিন্দারা মাঝে মাঝেই সম্ভবত রুচি বদলের জন্য দল বেধে পাশের নদীতে
পানি পান করতে কিংবা গোসলের জন্য আসলেও সাধারণত নদী পার হয়ে এপারে আসার ইচ্ছা করে
না। তবে কখনও কখনও যে নদী সাতরে গ্রামে আসেই না সে কথা বলার উপায় নেই। এইতো সেবার
নদীর পাড়ে আখ ক্ষেতে কাজ করার সময় নুবিয়াকে ধরে নিয়ে গেল। সাথে জিঙ্গো, চিকা, মিন্ডি আর দাগুর স্ত্রী এবং আরও কয়েকজন
ছিল কিন্তু কিছুতেই তারা ওই বনের রাজা লিউ বা সিংহটাকে কাবু করতে পারেনি। এছাড়াও
মাঝে মাঝে গ্রামের মেঠো পথে বা কারো বাড়ির উঠানে সিংহের পায়ের ছাপ দেখা যায়।
বিশাল এলাকা নিয়ে মাইলের পর মাইল জুরে এই
বনভূমি। আরযো গ্রাম থেকে পুবে বা দক্ষিণে কোথাও যেতে হলে এই বনের মধ্যে দিয়ে গেলে
পথ অনেক কমে যায়। মাত্র দুই মাইল পথ হেটেই ওপাশের কোসি গ্রামে যেতে পারে। তবে
উত্তরে বা দক্ষিণে বনের প্রশস্ততা অনেক, প্রায় দশ থেকে বিশ মাইলের
মত। শুধু ওই জায়গাটা সরু। বনের পশু এবং গ্রামবাসীরা যাতায়াত করতে করতে মেঠো পথের
মত হয়ে গেছে। কিন্তু একা একা এই পথ কোন অবস্থাতেই নিরাপদ নয়। দল বেধে যেতে হলে
সবাই এই পথেই যায়। কোসি গ্রাম থেকেও যখন
লোকজনেরা কোন কাজে এদিকে আসে তখনও তারা এই ভাবেই দল বেধে আসে। সাথে থাকে
নানা রকম অস্ত্র এবং মশাল। দমন করা যাবে না এমন জীবের সামনে পরলে মশাল থেকে আগুন
নিয়ে নরম ঘাসের গোলা বাধা তীর ছুড়ে দেয় পশুর দিকে। আগুন দেখে ওরা দূর থেকেই বুঝতে
পেরে ভয়ে আর কাছে আসে না। বুনো পথে চলাচলের জন্য এদের জানা আছে প্রচলিত নানা
মন্ত্র। সাথে যে মোড়ল থাকে সেই প্রধানত মন্ত্র আওড়ায় এবং সঙ্গীরা তার সাথে সুর
মিলিয়ে পথ চলে। বনের ভাষা এরা বুঝতে পারে। কোথায় কোন শব্দ হলে সে কিসের শব্দ তা
এরা ভাল করেই জানে। সবচেয়ে ভয় হলো সিংহ আর চিতা নিয়ে। এরা বড়ই ভয়ংকর! চিতা গাছে
উঠতে পারে এবং নিঃশব্দে চলাফেরা করে বলে আশেপাশে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না
বললেই চলে। দৌড়ে গিয়ে যত বড় গাছেই ওঠা হোক না কেন চিতা ঠিক পিছনে পিছনে উঠে পড়ে।
সিংহ গাছে না উঠলেও নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এবং তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন ব্যাপার।
আমাবস্যা পূর্ণিমা রাতে কিংবা মেঘলা দিনে বিচিত্র সব হাঁক ডাকের শব্দ পাওয়া যায়।
তার কোনটা প্রিয়কে কাছে আহবান করার ডাক আবার কোনটা ক্ষুধার ডাক কিংবা কোনটা শত্রুর
উপর আক্রোশ তা ডাক শুনেই বোঝা যায়। সন্তান হারা মায়ের করুণ কান্নার সুরও বড়ই বিষাদ নিয়ে বাতাসে ভেসে আসে। গ্রাম থেকে
নদী পার হয়ে বনে যাবার জন্য ওবির বাড়ির কাছে নদীর ঘাটে একটা আস্ত গাছের গুড়ি দিয়ে বানান ভেলার মত বাঁধা
থাকে।
পশ্চিমে গোরে এবং বেদেলে গ্রাম, উত্তরে
নিকেমতা, মান্ডি এবং আমতো গ্রামের সাথে মোটামুটি ভাল ভাব
আছে। পূর্ব দিকে বেশ অনেকটা দূরে সেনেন, মুতুলু এবং বিলা
গ্রাম। পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে ওদিকে খুব একটা যাতায়াত নেই বললেই চলে। আর ওই জঙ্গল
পেরিয়ে আরও বেশ দূরে দক্ষিণে আটনাগো গ্রাম। অনেকদিন ধরে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা বা
অপরোর হয়নি। অনেকদিন আগে ওবির দাদা জীবিত থাকতে যখন ওবি ছোট ছিল তখন দেখেছিল
মান্ডি গ্রামের সাথে কি ভয়ংকর দাঙ্গা হয়েছিল। মান্ডিবাসিদের সাথে আমতো গ্রামও যোগ
দিয়েছিল তবে পার্শ্ববর্তী পশ্চিমের গোরে এবং বেদেলে গ্রাম ওদের পক্ষে এসেছিল। কত
মানুষ মরেছিল সে যুদ্ধে তা গুনে দেখা হয়নি। তবে এটুক মনে আছে অনেকেই মরে গিয়েছিল
এবং তাদের এনে নদীর কিনারে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়েছিল। ও পক্ষের কতজন মরেছিল তা
জানা যায়নি। নানা রকম নানা আকারের সিফ, জাকিতকা (তরবারি,
বর্শা), মহিষের শিং বা গিসকা দিয়ে বানান
নানা রকমের অস্ত্র এবং আগুনের গোলা আর বিষ মাখা তীর ধনুক কি ভাবে ব্যবহার করতে হয়
তখনই ওবি দেখেছিল। তার দাদা তাকে শিখিয়েছিল।
[কাল পরীর সাথে পরিচয়ের জন্য
পরবর্তি পর্বের অপেক্ষা করতে হবে বন্ধু!]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।