৮৭।
আজ
বৃহস্পতিবার। রাশেদ সাহেব দিন গুনছেন। এখান থেকে মুক্তির দিন। দেলুর গালাগালি না
শোনার দিন। আবার ভাবেন যেখানে যাবেন সেখানে যে এরকম হবেনা কে জানে। সেখানেও তো
দেলু আছে। দেলুরা সব জায়গায় থাকে।
রাশেদ সাহেব ভাবছেন চলে যাওয়াটা কি ঠিক
সিদ্ধান্ত হলো?
না কী হলো বুঝে উঠতে পারছেন
না। না, ঠিকই হয়েছে। এখন বলছে সামনে কাজ করবেন কিন্তু আগে বললে
একথা বলতো না। বলতো সামনে কাজ করতে হলে কম বয়স লাগে আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন সামনে
পারবেন না। ইত্যাদি নানা ছল ছুতা করত। নুরু সেদিন যেমন বলেছে আপনি চশমা পরেন চোখে
কম দেখেন মদের গ্লাস ঠিক মত ভরতে পারবেন না। ভালো করে টেবিল পরিষ্কার করতে পারবেন
না, মদের গ্লাস মুছতে
পারবেন না এটা সেটা অনেক কিছু। না, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। প্রবীণ ঠিক বলেছে এখানে কে কার? কার কথা কে ভাবে? এরা গত বার বছর ধরে এই
রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে। আমার মত কত মানুষ এসেছে গেছে তা কি এদের মনে আছে না মনে
রাখা সম্ভব? এর মধ্যেই একজনকে চলে যেতে দেখল আবার প্রবীণ ও চলে যাবে, সে নিজেও যাচ্ছে।
পৃথিবীটাই এই রকম। সবাই নিজের স্বার্থ দেখে। নিজেকে বাদ দিয়ে কে অন্যের কথা ভাবে? এই সত্যটা শুধু আমি
এতদিন বুঝি নাই বলে যে আর কেও বুঝে নাই তা কি করে হয়। না, ভালোই হয়েছে। দেখা যাক সামনে কি
আছে।
৮৮।
-কি বেয়াই
কী ভাবলেন,
থাকবেন
নাকি সত্যিই চলে যাবেন?
-দাঁড়ান
চা করি, খেতে খেতে বলি।
চায়ের
পানিতে একটা তেজপাতা একটু দারচিনি দিয়ে চাপিয়ে দিলো চুলায়। সামনে থেকে ওসমান এসে
একটা ব্যাগ থেকে লাল টকটকে কতগুলি আপেল বের করে বললো-
-নেন
সবাই খান আমার গাছের আপেল। নেন ভাই সাহেব খান।
একটা
আপেল এগিয়ে দিয়ে বললো-
-কি
খবর ভাই সাহেব চিন্তা করলেন কিছু?
-হ্যাঁ, আমিও তাই জিজ্ঞেস
করলাম।
রাশেদ
সাহেব আপেল হাতে নিয়ে পাশে রেখে দি্লেন। চায়ের পানি ফুটছে। পাতা ছেড়ে আপেল হাতে নিয়ে বললো-
-বেশ
সুন্দর আপেল তো! গাছটা কি আপনার বাড়িতে?
-হ্যাঁ, বাড়িতেই। খেয়ে দেখেন
খুব মিষ্টি।
আপেলে
কামড় দিয়েই বললেন-
-কবে
পেড়েছেন গাছ থেকে?
-এইতো
আজ বিকেলে,
কেন?
-না, এর আগে কখনো এরকম গাছ
থেকে সবে মাত্র ছেড়া আপেল দেখিনি তাই। অনেক ধন্যবাদ ভাই একটা নতুন জিনিস দেখালেন।
হ্যাঁ, সত্যিই মিষ্টি।
-তা
তো হলো কিন্তু আপনি কী করবেন?
-ভাই
সাহেব, আমার মনে হয় আমার চলে
যাওয়াই ভাল।
-কেন?
-বললাম
তো আমার ভালো লাগছে না তাই।
-ও, ঠিক আছে তা হলে যান, কবে যাবেন?
-রবিবার
পর্যন্ত থাকবো,
সোম
বার সকালে যাব ভাবছি।
এ
সপ্তাহের শুক্র শনিবার আগের মতই কেটে গেলো। রবিবারে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার আগেই
আনোয়ার এসে সবার প্রাপ্য যার যার হাতে দেবার সময় রাশেদ সাহেব মনে মনে বিসমিল্লা
বলে টাকাটা নিয়ে পকেটে রেখে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন-
-ভাই
সাহেব আমি কাল সকালে যাচ্ছি।
-ও, তার মানে বিদায়?
-হ্যাঁ
তাই।
-ঠিক
আছে আপনাকে বললাম থাকার জন্য থাকবেন না যখন তাহলে কি আর বলবো যেখানে থাকেন ভাল
থাকবেন। অনেক আজেবাজে কথা বলেছি কিছু মনে রাখবেন না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
-হ্যাঁ
ভাই, আমার জন্যও দোয়া
করবেন। বুঝতেই পারেন আমি কি অবস্থায় এবং কেন এসেছি। যাতে করে তাড়াতাড়িই আমি সব
কিছু সমাধান করে দেশে ফিরে যেতে পারি সেই জন্য দোয়া করবেন সবাই।
দেলু
যাবার আগে বললো-
-বেয়াই
সাহেব, আপনে কোথায় যাবেন? লন্ডন যাবেন তো, আমার সাথে গেলে আমি
বেকার স্ট্রিটে নামিয়ে দিতে পারতাম।
-আমি
একটন যাবো কিন্তু আমিতো ব্যাগ লাগেজ কিছু গুছিয়ে রাখিনি, আমি জানতাম না আপনি নিয়ে যেতে
পারবেন তাহলে গুছিয়ে রাখতাম। আপনি চলে যান আমি কাল সকালে
অক্সফোর্ড এক্সপ্রেসে করে চলে যাব।
এবারে
আনুষ্ঠানিক বিদায়ের পালা। কাল সকালে আমি যখন যাব তখন সবাই ঘুমে থাকবে একথা মনে করে
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে উঠে আসলেন। সবাই এলো সাথে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে
সবাই নিচে চলে গেলে প্রবীণকে বললেন-
-কই
তুমি না তখন বলেছিলে কি বলবে।
-কি
বলেছিলাম?
-ওই যে
তোমার কি সমস্যা তাই।
-ও
আচ্ছা। বলবো চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে আসি।
-হ্যাঁ
তাই, এই ফাঁকে আমিও এগুলি
গুছিয়ে ফেলি,
কাল
সকালেই বের হতে হবে। তুমি কখন বের হবে? তুমি গোছাবে না?
-না
আমি কি গোছাবো?
আমার
মাত্র এই একটা ব্যাগ, আপনি
কখন বের হবেন?
-ভাবছি
সকাল আটটায় বের হব কি বল?
-ঠিক
আছে, আমাকে ডাকবেন আমিও এক
সাথেই বের হব।
কি
ব্যাপার,
রাত একটা
বেজে গেলো প্রবীণ এখনও আসছে না! স্যান্ডেলে পা ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে বাথরুমের দিকে
এগিয়ে গেলেন। তার নিজেরও হাতমুখ ধোয়া দরকার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই প্রবীণ বের হলো।
-একেবারে
শাওয়ার সেরে ফেললাম।
-ও
তাইতো ভাবছি এতো দেরি হচ্ছে কেন, আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।
সকালে
ঘুম থেকে উঠে আগে প্রবীণকে ডেকে তুলল। তাড়া তাড়ি মুখ হাত ধুয়ে নামাজ সেরে কাপর
বদলে লাগেজ নিয়ে প্রবীণের সাথে নিচে নেমে যেখানে চাবি থাকে সেখানে এসে দাঁড়ালেন।
প্রবীণ বললো-
-কি
ব্যাপার কিছু খাবেন না?
-না
চলো বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিব।
-বাইরে
কোথায় কি পাবেন?
এখন বাজে
সাড়ে আটটা,
কোন
দোকান পাট কিচ্ছু খুলেনি এখনও। এখান
থেকে খেয়ে যাই।
-আমরা
চলে যাচ্ছি এখন কি এখানে খেতে পারি?
-কেন
পারব না?
এখানে
যতক্ষণ আছি ততক্ষণ আমরা এখানকার স্টাফ কাজেই খেতে অসুবিধা কি, ওসব চিন্তা বাদ দেন
আসেন খেয়ে নেই।
দুধ
কর্ণ ফ্ল্যাক্স খেয়ে বাটি পেয়ালা ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখে সেই গোপন জায়গা থেকে চাবি
বের করে বাইরে চলে এলেন।
মুক্তির
আনন্দে চারিদিকে তাকালেন। বুক ভরে শ্বাস নিলেন। খোলা আকাশ দেখে বুকের ভিতর থেকে
একটা আহ! শব্দ বেরিয়ে এলো। তেরই ডিসেম্বর সোমবার সকাল নয়টা। হাড় কাঁপানো কনকনে শীত।
মুখের যত খানি খোলা আছে মনে হচ্ছে ছুরি দিয়ে চামড়া ছিলে নিচ্ছে। রাশেদ সাহেব
এগিয়ে চললেন অজানা নিরুদ্দেশ্যের পথে যাত্রার জন্যে। বাসস্ট্যান্ডে
দাঁড়ানোর মিনিট দুয়েকের মধ্যে বাস এসে দাঁড়াল। ভিতরের যাত্রীরা নেমে গেলো। আগে
রাশেদ সাহেব পিছনে প্রবীণ বাসে উঠলেন। পকেট থেকে পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বের করে
ড্রাইভারকে দিয়ে বললেন ‘টু সিংগ্যাল অক্সফোর্ড’।
প্রবীণ
চেঁচিয়ে বললো-
-আরে
ভাইয়া আপ কিয়া কারতায়? এদেশে
সবাই নিজের ভাড়া নিজে দেয় কেও কারোটা দেয় না, রাখেন আমি দিচ্ছি আমারটা।
রাশেদ
সাহেব কিছু বললেন না, ড্রাইভারের
পাশের মেশিন থেকে টিকেট দুইটা ছিঁড়ে নিলেন। ড্রাইভারের কাছ থেকে ভাংতি ফেরত নিয়ে
বললেন-
-চলো
বসি। আমিতো এখনও এ দেশী হতে পারিনি আর তা হবেনা কাজেই এদেশের রীতি আমি কি করে মেনে
চলি, বস।
বসে
বললেন-
-দেখ
আমরা আজ দুজন দু প্রান্তে চলে যাচ্ছি, স্রোতের টানে যেমন নদীর বুকে কোথা থেকে কত কি ভেসে একটা
আরেকটার সাথে জড়িয়ে মিশে থাকে আবার স্রোতের টানেই ছেড়ে যায় ঠিক তেমন করে গত কয়েক
দিন আমরা একত্র হয়েছিলাম যে স্রোত আমাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই স্রোতের টানে।
আবার কখনো দেখা হবে কিনা জানিনা। এই কয়েক দিন একত্রে থাকার এই ছোট্ট স্মৃতি সময়ের
প্রয়োজনে এক সময় হারিয়ে যাবে। তুমিও ভুলে যাবে আমিও হয়ত ভুলে যাব, তাই আজকের এই সামান্য
সময়টা অন্তত কিছুক্ষণ উজ্জ্বল হয়ে থাকুক।
বাস
অক্সফোর্ড এসে দাঁড়াল। ওরা নেমে একটু হেঁটে কোচ স্টেশনে চলে
এলো।
প্রবীণ বললো-
-চলেন
একটু কফি খাই।
-তুমি
কফি খাও আমি চা খাবো তবে আগে টিকেট করে নেই।
-কী
এমন তাড়া,
এখান
থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর লন্ডনের গাড়ি ছাড়ে।
-তুমি
তো রেডিং যাবে না?
-তাতে
কি, আমি বাস না পেলে
ট্রেনে যাব ঐ যে দেখেন ট্রেন স্টেশন দেখা যাচ্ছে। চলেন আগে চা নিয়ে আসি।
এই কোচ
স্টেশনে যেদিন প্রথম এসেছিলেন সেদিন দেখেছি্লেন লোক জনেরা ভিতরের এই দোকান থেকে
কাগজের কাপে চা কফি খাচ্ছে, সেদিন কোন দিকে তাকাবার মত ইচ্ছা বা শক্তি কোনটাই ছিলোনা।
একটা দুরু দুরু ভাব, অজানা
আতঙ্ক, মনির বিচ্ছেদ সব
মিলিয়ে কেমন যেন একটা মিশ্র ঘোরের মধ্যে ছিলো। আজ অনেকটা স্বাভাবিক, এর মধ্যে তার পকেটে
এদেশের রানীর মাথার ছবি ছাপানো বেশ কতগুলি পাউন্ডের নোট রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে
দামী নোট। যা সে প্রতি সপ্তাহ ভরে দেলুর গালাগালি শোনা আর মানসিক
নির্যাতন ভোগ করার জন্যে পেয়েছে। আজ মন অনেকটা হালকা। ভালো
লাগছে। ইতোমধ্যে একবার একা লন্ডন গিয়ে এদেশের যাতায়াতের কলা কৌশল দেখে এসেছে। সেই
জড়তা সেই ঘোর অনেকটা কেটে গেছে। এখন সহজ স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।
-চলো, আগে চা ই হোক।
এগিয়ে
গেলো দুজনে। কাউন্টারের কাছে গিয়ে প্রবীণ বললো-
-ভাইয়া
আপনি বাস ভাড়া দিয়েছেন আমি চায়ের দাম দিচ্ছি আপনি কিছু বলবেন না।
-আচ্ছা
তুমি যা বল।
চা কফির
অর্ডার দেয়া হলো। প্রবীণ গুনে দাম দিয়ে অপেক্ষা করছে। একটু পরেই চা কফি এলো। কালো
চা, কালো কফি। দুইজনে হাত
বাড়িয়ে কাগজের কাপ দুইটা নিয়ে পাশে রাখা ট্রে থেকে ছোট্ট তরল দুধের এক কাপ চায়ের
উপযোগী প্যাকেট,
সুইট্যাক্সের
দুইটা ট্যাবলেটের প্যাকেট আর ব্রাউন সুগার এর প্যাকেট আর কয়েকটা ন্যাপকিন নিয়ে
কাছের বেঞ্চে বসলেন। কাপে দেয়া কাঠি দিয়ে নেড়ে চা বানিয়ে
খেতে খেতে কথার ফাঁকে তামাকের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট বানালেন রাশেদ সাহেব। কোচে সিগারেট
খাওয়া যাবেনা। চা শেষ হলো। কাপ গুলি বিনে ফেলে দিয়ে প্রবীণ বললো-
-চলেন
এবার আপনার টিকেট নেয়া যাক।
লন্ডনের
টিকেট নেয়া হলো। পনের মিনিট পরে গাড়ি কিন্তু রেডিং এর গাড়ি নেই। প্রবীণের মুখের
দিকে তাকাতেই প্রবীণ বললো-
-তাহলে
আমি ট্রেন ধরবো ভাববেন না।
কাউন্টার
ছেড়ে এসে রাশেদ সাহেব বললেন-
-স্টেশনে
যাবে না?
-হ্যাঁ
যাবো আপনার গাড়ি ছাড়ুক আগে।
গাড়িতে
লোকজন উঠছিলো। ওরা কাছে এসে রাশেদ সাহেবের লাগেজগুলি ড্রাইভারের কাছে দিয়ে বললো বেকার
স্ট্রিটে নামবো।
-না, লাগেজ নিয়ে ওখানে
নামতে পারবে না,
তোমাকে
ভিক্টোরিয়া নামতে হবে।
-ও
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রাশেদ
সাহেব কোচে উঠে বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোচ ছেড়ে দিল। যতক্ষণ দেখা যায় প্রবীণ
দাঁড়িয়েই ছিলো,
রাশেদ
সাহেব জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আবার কোনদিন দেখা হবে কিনা কে জানে! হয়ত কালের
স্রোতের টানে কোথায় হারিয়ে যাবে! স্মৃতিটা হয়ত কিছুদিন জেগে থাকবে। কোচ এগিয়ে চলল স্বপ্ন নগরী লন্ডনের
পথে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।