৯৫।
বাদলের
দেয়া সেই হাসিল লেখার কাজ কিংবা জাকিরের বাবার যোগাড় করে দেয়া টিউশনির কিছু করতে
হয়নি শেষ পর্যন্ত। কত দিন হয়ে গেছে, ত্রিশটা বছর! কত কি হয়ে গেছে এর মধ্যে। বাদল বিএসসি পাশ
করে পূর্ব পুরুষের তৈরি
করা জমিদারী দেখছে। জাকির এমএসসি শেষ করে কোন একটা
প্রাইভেট কোম্পানিতে কিছুদিন চাকরি করে বসের সাথে গণ্ডগোল করে চাকরি ছেড়ে এসে
বাবার রেখে যাওয়া তালুক দেখছে। নীলার মত একজন ধীর স্থির শান্ত সুন্দরি মেয়ে, যে কোন দিন তার চোখের
ভাষায় নিজের মনের কথা রাশেদ নামের এক তরুণকে বুঝাতে পারেনি, সেই মেয়ে স্বামীর সাথে
সংসার করে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার একমাত্র ভাইকে একা রেখে এই পৃথিবী থেকে চির
দিনের জন্যে চলে গেছে। রাশেদ নামের সাঁতার না জানা এক তরুণ জাহাজের
চাকরিতে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে কূল কিনারা সীমাহীন অথৈ সাগরের বুকে
ভেসে বেড়িয়েছে। নিজে ডুবে যাবার ভয় ভুলে গিয়ে ভাই বোনদের মুখের হাসি কেনার জন্য
ডলার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ডুবন্ত প্রায় সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করেছে।
নীল আকাশে অনেক সাদা মেঘ ভেসে ভেসে ঠিকানা হীন নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে উড়ে গিয়ে
কোথায় হারিয়ে গেছে। বিবিসি, রয়টারকে না জানিয়ে এই ত্রিশ বছরে চারিদিকে এরকম আরও অনেক
কিছু ঘটে গেছে। রাশেদ সে সব খবরের কিছুই জানার সুযোগ পায়নি।
মাইকে
কোচের ড্রাইভার জেনির কণ্ঠ শোনা গেলো, ত্রিশ বছর পেরিয়ে রাশেদ সাহেব আবার ফিরে আসলেন গ্লাসগোর
পথে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে সামনের সার্ভিস স্টেশনে গাড়ি
থামাচ্ছি ত্রিশ মিনিটের জন্যে, আপনারা নিজ নিজ প্রয়োজন সেরে সময়মত গাড়িতে চলে আসবেন, ধন্যবাদ।
একটু
পরে রাত একটা বিশ মিনিটে ড্রাইভার কোচ পার্ক করে গাড়ির ভিতরে আলো জ্বেলে ইঞ্জিন
বন্ধ করে নেমে গেলো। যাত্রীরা সবাই তার পিছনে নেমে গেলো। রাশেদ সাহেব ভাবছিলেন কি
করবেন। তার সাথে ভাবীর দেয়া নাস্তা পানি রয়েছে, গাড়ির ভিতরে টয়লেটও আছে। একটু
নেমে পায়ের জড়তা ছাড়িয়ে নিলে ভাল হয়। অনেকক্ষণ বসে ছিলেন, একটা সিগারেট টানতেও মন চাইছে। আর
সার্ভিস স্টেশন কেমন সেও দেখা হবে। নেমে পরলেন গাড়ি থেকে। নামতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার
এক ধাক্কা। গলার মাফলার দিয়ে কান ঢেকে হাতে গ্লোভস পরে নিলেন। ভিতরে গিয়ে অবাক
হলেন। এতো রাত তবুও এতো ভিড়! পার্কিং এলাকায় দেখেছে অনেক গাড়ি পার্ক করা। সব গাড়ির
যাত্রীরা টয়লেটে যাচ্ছে, খাবারের রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে। খাবারের অর্ডার দেয়ার
জন্যে কাউন্টারে কিউতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েকটা দোকান দেখা যাচ্ছে তাতে বই পত্রিকা
থেকে শুরু করে নানান জিনিষ রয়েছে। দোকান থেকে কেও কেও কেনাকাটা করছে। ক্যামেরা, ক্যামেরার ব্যাটারি, ছাতি, রেইন কোট, বই, বাচ্চাদের খেলনা আরও
কত কি। বাড়ি থেকে আনতে ভুলে গেছে কিংবা যেখানে যাচ্ছে সেখানে নেয়ার জন্য সৌজন্য উপহার
কেনার সুযোগ হয়নি। সমস্যা নেই, সার্ভিস স্টেশন থেকে কিনে নিলেই হবে। জুয়া খেলার মেশিনও
দেখা গেলো এক পাশে, কয়েকজন
খেলছে।
মটর
ওয়েতে এই রকম দশ বিশ মাইল পর পর সার্ভিস স্টেশন থাকে। ড্রাইভারদের ক্লান্তি দূর
করা, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া, যাত্রীদের একঘেয়েমি
কাটানোর জন্য। যেসব লড়ি ইউরোপ জুড়ে নয়তো সমস্ত ব্রিটেনে চলাচল করে সে সব
ড্রাইভারদের জন্যে লড়ির ভিতরে ড্রাইভিং সিটের পিছনে উপরে ভাজ করে
রাখা যায় এমন
বিছানার ব্যবস্থা রয়েছে, নিচে ফ্রিজ রয়েছে তাতে খাবার নিয়ে এসেছে। লড়ি পার্ক করে
রেখে খেয়ে দেয়ে বিছানা খুলে ঘুমিয়ে নিতে পারে। একটু দেখে ফিরে এলেন গাড়িতে। নাস্তা
খেয়ে আবার নেমে কোচের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। ভিতরে সমস্তটাই ধূমপান নিষিদ্ধ
এলাকা। দুটা বাজার পনের মিনিট থেকেই যাত্রীরা একে একে ফিরে আসছে। সিগারেটটা ফেলে
পা দিয়ে নিভিয়ে উঠে এলেন। তখনো গাড়ি ছাড়ার দুই এক মিনিট বাকি। ঠিক দুটা বাজার দশ
মিনিট হতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
৯৬।
সকালে
কাটায় কাটায় ছয়টায় পৌঁছল গ্লাসগো বুচানান বাস টার্মিনালে। বিশাল টার্মিনাল। লাগেজ
নামিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে টার্মিনালের ভিতরে ঢুকলেন। মাত্র কয়েক জন যাত্রী সোফায় বসে
ঝিমুচ্ছে। হয়ত তার মত এরাও ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার, অন্য কোথাও যাবে। পরের কোচের
অপেক্ষায় আছে। শীত শীত করছে। আশে পাশে খুঁজে দেখলেন কোন হিটার নেই। কি সাঙ্ঘাতিক
অবস্থা! শীত ক্রমে বাড়ছে। তার সাথে যা রয়েছে সবই গায়ে দিয়েছে কিন্তু মানছে না। উঠে
কোনায় একটা কাউন্টারের পাশে দাঁড়ালেন, এখানে ঠাণ্ডা একটু কম মনে হচ্ছে। অন্য কোন উপায় না পেয়ে
ভাবলেন এখানেই ফ্লোরে বসে থাকি, এই ভালো। শীতে ঠক ঠক করে সোফায় বসার চেয়ে এই ভালো। সামনে
ব্যাগ নামিয়ে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। বেশ
অনেক সময় চলে গেলো, শীত
লাগছে কিন্তু আর কিছু করার নেই। মাঝে মাঝে উঠে হাঁটছে আবার বসছে তবুও শীত দূর করতে
পারছে না। পরের কোচ সকাল সাতটায়। এমন সময় কোচ থেকে নেমে যে গেট দিয়ে ভিতরে
ঢুকেছিলেন সেই দিকের অন্য আর এক গেট দিয়ে কয়েকজন পুরুষ মহিলা যাত্রী ভিতরে আসতে
দেখলেন। অন্য কোন কোচ এসেছে কোথা থেকে, এরাও ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার। একটু
পরে লক্ষ করলো একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। চেহারা দেখে বুঝতে পারল বাঙ্গালি। অল্প
বয়স, হয়তো ছাত্র। কাছে এসে
ইতস্তত করছে,
বুঝতে
পেরে জিজ্ঞেস করলো-
-কি
ভাই কিছু বলবেন?
-আপনি
বাঙ্গালি?
-হ্যাঁ, কি ব্যাপার বলেন।
-আপনি
কোথায় যাবেন?
-আপনি
কোথায় যাবেন?
-আমি
যাবো ইনভারনেস।
-সে
তো নর্থে অনেকদূর, এখানেই
বসেন গল্প করি।
-না
আমি,
বলে
একটু ইতস্তত করছে।
-কি, কোন সমস্যা হয়েছে?
-হ্যাঁ, আমি এদেশে নতুন এসেছি, মাত্র কয়েক দিন হলো।
এখন আসছি ব্রিস্টল থেকে। লন্ডনে আমার পরিচিত এক জন রিসিভ করে আমাকে ব্রিস্টলের
কোচে তুলে দিয়েছিলো। সেখানে এক বন্ধুর কাছে ছিলাম এই দুই দিন। ব্রিস্টল থেকে আমার
কোচ ছিলো বার্মিংহাম, আবার
বার্মিংহাম থেকে গ্লাসগো, গ্লাসগো থেকে ইনভারনেস। বার্মিংহামে গাড়ি বদলের সময়
আমার একটা সুটকেস ওই গাড়িতে ফেলে এসেছি এখন আমি কি করবো?
-ভালোই
করেছেন পথের বোঝা কমিয়ে দিয়েছেন।
-ওটার
মধ্যেই আমার সব জরুরি জিনিস পত্র রয়েছে।
-আমার
মনে হয় জরুরি জিনিস হলে আপনি এরকম ভুল করতে পারতেন না, যাই হোক এখন আমি কি করবো বলেন, আমিও এসেছি মাত্র মাস
দেড়েক হবে। এখানে এই রাতের বেলা তো দেখছেন ইনফরমেশন ডেস্ক, লস্ট এন্ড ফাউন্ড ডেস্ক সবই বন্ধ।
খোলা থাকলে না হয় আলাপ করে দেখা যেত। আপনার ইনভারনেসের গাড়ি দেখছি সকাল সাতটা বিশ
মিনিটে। আমি যাবো ওবান, আমার গাড়ি সকাল সাতটায়। সমস্যায়
পরলাম, কি করি এখন? আচ্ছা, আপনি যে কোচে এসেছেন
সেই ড্রাইভারকে কিছু বলেছেন?
-না।
-তাকে
বলতে পারতেন তা হলে সে ওই টার্মিনালে জানিয়ে দিত, তারা সেভ করে রেখে দিত।
-গাড়ি
ছেড়ে আসার অনেক পরে আমার মনে হয়েছে তাই বলিনি।
-আরে, এদেশে দূরের যাত্রার
ড্রাইভারদের সাথে টার্মিনালে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকে।
-একথা
আমি জানতাম না।
-কিন্তু, একটা ব্যাপার লক্ষ
করেছেন?
-কি?
-আজকাল
সব টার্মিনালেই একটা ঘোষণা দিচ্ছে যে, কোন লাগেজ অরক্ষিত ভাবে কোথাও ফেলে রাখবেন না, তা হলে টার্মিনাল
কর্তৃপক্ষ সে লাগেজ নিয়ে নষ্ট করে ফেলবে। সকলের নিরাপত্তার জন্যেই এই ব্যবস্থা
নিয়েছে। কারণ আজকাল দেখা যাচ্ছে এধরনের লাগেজের মধ্যে বোমা টোমা রেখে মালিক সরে
পরে, পরে সেটা বার্স্ট হয়ে
জান মালের ক্ষতি হচ্ছে। তাই সব টার্মিনাল কর্তৃপক্ষই এই
ব্যবস্থা নিয়েছে, এই
ঘোষণা শুনেছেন?
-হ্যাঁ
শুনেছি।
-কাজেই
এতক্ষণ হয়তো আপনার লাগেজ টার্মিনাল সার্ভাইভ্যাল ইউনিটের হাতে পরে গেছে এবং হয়তো
তা নষ্ট হয়ে গেছে বা অপেক্ষায় আছে। ইনভারনেসে আপনার কে থাকে?
-ওখানে
আমার মামা থাকে তার কাছে যাব।
-তাহলে
আমার যা মনে হচ্ছে আপনি এর মধ্যে কিছু করতে পারবেন না, যা করার ওখানে গিয়ে করতে হবে।
আপনার টিকেট রেখে দিবেন এই টিকেট দিয়ে ওখানে রিপোর্ট করবেন। এ ছাড়া আমি আর কোন
সমাধান দিতে পারছি না। আপনার কোচ কোন গেট থেকে ছাড়বে দেখে নেন, ওই যে ওই গেট থেকে, ওই দেখেন গেটের উপর
মনিটরে লেখা। আমিতো সাতটায় চলে যাব এর পর যদি দেখেন এইযে এই দুই ডেস্কের একটাও
খোলে তাহলে ওদের বলবেন, দেখেন কি হয়। আপনি যেখানে যাবেন তার ঠিকানা ফোন নম্বর আছে
সাথে?
-হ্যাঁ
আছে।
-বেশ
ভাল কথা,
তাহলে
অসুবিধা হবেনা। তবে কথা হলো ততক্ষণে খুলবে কিনা এবং আপনার লাগেজ নিরাপদে আছে কি না, যদি থাকে তা হলে ফেরত
পেতে পারেন। এখন চিন্তা করে কোন লাভ নেই। শীত লাগছে?
-হ্যাঁ
লাগছে,
-অবাক
হচ্ছি যে এতো বড় গুরুত্ব পূর্ণ একটা কোচ টার্মিনাল অথচ এই শীতের রাতে একটা হিটার
চলছে না। আমরা না হয় নাতিশীতোষ্ণ এলাকার মানুষ বলে আমাদের শীত সহ্য করার ক্ষমতা কম
কিন্তু, দেখেন ঐযে ইউরোপীয়রা, ওদেরও দেখছি শীত
লাগছে। শীতের ভয়েই এই কোনায় বসে আছি, একটু গরম চা হলে ভাল হোত অথচ একটা দোকানও খোলা নেই।
এতক্ষণ
পর রাশেদ সাহেব ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করলেন। সে সাধারণত বাঙ্গালি দেখলে এড়িয়ে চলার
চেষ্টা করে। বাঙ্গালিদের কৌতূহল একটু বেশি। কবে এসেছেন, কি ভাবে এসেছেন, কোথায় থাকেন ইত্যাদি
অপ্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের সামনে পরতে হয় তাই। তবুও
জিগ্যেস করলেন-
-আপনার
নাম কি?
-আমার
নাম তৈয়ব আলি।
-ও
আচ্ছা।
কিছুক্ষণ
চুপ চাপ বসে থাকার পর হাতের ঘড়ি দেখে বললেন-
-আমার
গাড়ির সময় হয়ে এসেছে তাহলে আমি চলি, আপনাকে যা বললাম তাই করে দেখেন আর ওখানে যাবার পর আপনার
মামাকে বলে দেখবেন সে যদি কিছু করতে পারে, আমি কিছু করতে পারলাম না বলে
দুঃখিত।
কথা
বলতে বলতে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। ছেলেটাও সাথে এসে গেটে
দাঁড়ালো।
-আচ্ছা
ভাই ভালো থাকবেন।
হাত
নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গিয়ে টিকেট দেখিয়ে লাগেজটা বক্সে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।