১৮৩।
মেয়ের এ
অবস্থা দেখে রাশেদ সাহেবের মন আরও দুর্বল হয়ে গেল কিছুতেই স্বস্তি পায় না। কি
জন্যে আনা হলো ওকে? ঢাকায়ই
ভাল ছিল,
ওখানে কি
আর পড়াশুনা করে ছেলেমেয়েরা মানুষ হচ্ছে না? ছোট ভাইয়ের বুদ্ধিতে কি
করলাম? নাসির চলে গেছে। আর
হয়তো আসবে না। আলাপ করে মনের বোঝা ঝেরে ফেলার আর কেও নেই। নাসির পোলিওতে আক্রান্ত
ছেলের চিকিৎসার জন্য এবারে চেষ্টা করবে আমেরিকা যেতে। নিজে যে কাজ করছে তাতে খরচ কুলিয়ে
উঠতে পারছে না। দেশে ছোট দুই মেয়ে নিয়ে মনির খুব কষ্ট হচ্ছে। এখানে এর চেয়ে বেশি
বেতন আশা করা যায় না। তার কি আছে? না আছে এদেশে থাকার অনুমতি, না আছে এনআই কার্ড।
তার মত মানুষদের এর চেয়ে বেশি বেতন আশা করা যায় না। তবুও যাদের সাথে চেনা জানা
হয়েছে তাদের জানাচ্ছে এর চেয়ে ভাল কোথাও কোন কাজ পেলে যেন তাকে জানায়। শুক্র শনি
বারে কাজ করার জন্য ভিক্টোরিয়া নামে যে মেয়েটা আসত সে আর আসে না বলে ওর জায়গায়
রাসেলকে নেয়া হয়েছিল। রাসেল সোয়ান সির এক ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, এখানে পার্ট টাইম কাজে
আসত। শুক্রবার বিকেলে এসে আবার রবিবার সকালে চলে যেত। পাবনার ছেলে। রাশেদ সাহেবকে
বেশ শ্রদ্ধা করত এবং চাচা বলে ডাকত। সে রাসেলও এখান থেকে নিউ ক্যাসেল
ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে তবে রাশেদ সাহেবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। এই রাসেলকেও
বলেছে ওদিকে শীত বেশি বলে অনেকেই যেতে চায় না তাই বেতন বেশি, আমার জন্য ওদিকে একটা
কাজ দেখবে। বাহাদুরকেও বলেছে।
মাঝে
মাঝে রাশেদ সাহেব মেয়ের কাছে দুই এক দিন থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যায় কিন্তু বাবা
যতক্ষণ থাকে তিথি ততক্ষণই ভাল থাকে আবার বাবা চলে গেলেই যা ছিল তাই। অবস্থা যখন
সহ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে তখন একদিন কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে আবদার করল দেশে গিয়ে
মার কাছে কয়েকদিন থেকে আসি!
দেশে
যাবে? মনে মনে ভাবল এ যে মা
অনেক টাকার দরকার! কিন্তু মেয়ের কথা ভেবে না করতে পারল না। গফুর ভাইয়ের কাছে ধার
করে মেয়ের যাতায়াতের টিকেট কিনে লন্ডন এসে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে
সন্ধ্যায় ফিরোজের বাসায় চলে গেল। পরদিন ব্রীজেন্ড ফিরবে। রাতে ফিরোজ এবং ভাবীর
সাথে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বার্তা হলো। ফিরোজ পরামর্শ দিল -মেয়েকে বিয়ে দিবে এখন? ভাল এক ছেলে আছে, ব্রিলিয়ান্ট।
-দেখ, ও আসলে জিজ্ঞেস করে
দেখি, বাড়িতে ওর মায়ের সাথে
আলাপ করে দেখি কি বলে।
-ভেবে
দেখ, আমার মনে হয় ভাল হবে
অন্তত এখানে ওর লোনলিনেস থাকবে না।
-হ্যাঁ
ভালই বলেছ। দেখি আলাপ করে দেখি। জানাব তোমাকে।
১৮৪।
পরদিন
সকালে মনিরা ফোন করে মেয়ের পৌঁছার সংবাদ জানাল।
দুপুরে বের হয়ে ভিক্টোরিয়া এসে টিকেট নিয়ে বোর্ডিং গেটের পাশে ওয়েটিং
লাউঞ্জে বসে নানা কিছু ভাবছে। তার খুকুর কথা, কি ভেবেছিল, কি হতে চলেছে, ফিরোজ কি বললো এমনি
নানা কিছু। বছর খানিক আগের কথা মনে হলো যেদিন প্রথম খুকুকে লন্ডনে রেখে সে
যাচ্ছিল। খুকু পাশের ইন্ডিয়ান স্টল থেকে সিঙ্গারা আর স্যান্ডউইচ কিনে দিয়েছিল
স্টলটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। সেই স্টেশন, সেই দোকান, সেই সেলস ম্যান সবই
আছে আজ, শুধু তার খুকু এখানে
নেই! খুকু আছে তার থেকে ছয় হাজার মাইল দূরে তার মায়ের মাছে! কি আশ্চর্য এই পৃথিবী!
একটু
পরেই কোচের ড্রাইভার এসে সোয়ান সি এবং কার্ডিফের যাত্রীদের গাড়িতে ওঠার জন্য বললো । ড্রাইভারের
কথায় ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল। দেখল সামনের সোফায় তিথির বয়সী এক মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে উঠে
দাঁড়িয়েছে,
পাশে
একটা ট্রলি লাগেজ আর একটা ছোট হাত ব্যাগ। সম্ভবত বাংলাদেশি। এগিয়ে
কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। রাশেদ সাহেব উঠে গেট দিয়ে বের হয়ে কোচে উঠল। হাতের ব্যাগ আর কোলে
বাচ্চা নিয়ে ওই মহিলাও এই কোচেই উঠল। মিনিট পাঁচেক পরেই কোচ ছেড়ে দিল।
পথে নিউ
পোর্ট এবং কার্ডিফে কয়েকজন যাত্রী নামিয়ে লন্ডন থেকে ছেড়ে আসার প্রায় তিন ঘণ্টার
মধ্যে ব্রীজেন্ড ওডিওন সিনেমা হলের পাশে দাঁড়িয়ে ব্রীজেন্ডের যাত্রীদের নামার জন্য
বললো । রাশেদ সাহেব নেমে পরের লোকাল বাসে ওঠার জন্য রাস্তার পাশে
যাত্রী ছাউনির নিচে দাঁড়াল। বেশ শীত পড়েছে। ঘুরে দেখল সেই মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে
এক হাতে
ট্রলি টেনে এদিকেই আসছে। মহিলাকে দেখে এতক্ষণ ভাবছিল হয়ত কেও এসে নিয়ে যাবে কিন্তু
আশেপাশে কোন গাড়ি নিয়ে কাওকে অপেক্ষা করতে দেখেনি। এবার একটু সন্দেহ
হলো। এর মধ্যে ৩২ নম্বর লোকাল বাস এসে দাঁড়াল, রাশেদ সাহেব বাসে উঠতে যাবে এমন
সময় পিছন থেকে মহিলার ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াল।
-একটু
শুনবেন?
-বলেন।
-আমি
ব্রীজেন্ড যাব কি করে?
-আসেন
আমার সাথে আসেন।
বলে
একটু পিছিয়ে মহিলার হাত থেকে ট্রলিটা টেনে বাসে উঠিয়ে দিল। পিছনে মহিলাও বাচ্চা
কোলে নিয়ে হাতের ব্যাগটা নিয়ে উঠে বসল। বাস ছেড়ে দিল। মিনিট দশেকের মধ্যে
ব্রীজেন্ড বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল। রাশেদ সাহেব ভদ্র মহিলার ট্রলিটা নিয়ে যেমনি
উঠেছিল তেমনি নামিয়ে দিয়ে তার পথে চলে যাচ্ছিল। মহিলা আবার ডাকল,
-ভাই
একটা কথা শুনবেন?
-রাশেদ
সাহেব ফিরে এসে কাছে দাঁড়াল।
একটু
ইতস্তত করে হাতের ব্যাগ থেকে একটা ঠিকানা বের করে দেখাল। নাদিরুজ্জামান, টণ্ডু রোড, ব্রীজেন্ড বাসার
ঠিকানার সাথে মোবাইল নম্বরও আছে। রাশেদ সাহেবের রেস্টুরেন্টের কাছে, হেঁটেই যাওয়া যায়।
মিনমিনে
কণ্ঠে বললো,
-আমাকে
এই ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারবেন?
-আপনাকে
সে নিতে আসেনি?
-আসার
কথা ছিল,
আমাকে
লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকেই নিয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু ওখানে পুরো এক রাত বসে কাটিয়েছি
অথচ এখনও তাকে দেখছি না।
কি
সাংঘাতিক কথা বলছে এই মহিলা! রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে গেল। মহিলাকে দেখে খুব শিক্ষিত
বলে মনে হলো না অন্তত বাংলাদেশ থেকে একা এক বাচ্চা কোলে নিয়ে লন্ডনের হিথরো থেকে
তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে এমন মেয়ে নয়। খুবই সাধারণ গোছের মেয়ে তবে বুদ্ধি
করে ভাল শীতের কাপড় নিয়ে এসেছে। যা করছে নিতান্ত ভাগ্যের বিড়ম্বনার জন্য করতে
হচ্ছে এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে পথে যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু এই শীতের মধ্যে
এটা কি করে হয়?
মহিলা
বাংলাদেশ থেকে এসে এই বাচ্চা কোলে নিয়ে এয়ারপোর্টে সারা রাত বসেছিল! কি ব্যাপার? ওখান থেকে গার্জেনরাই
বা কি করে এই মেয়েকে একা ছেড়ে দিল! কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। মহিলাকে নিয়ে পাশের
ওয়েটিং সোফায় বসল।
-আপনি
কোন এয়ারলাইনে এসেছেন?
-বিমানে
-যাক
অন্তত পথে কোথাও ট্রানজিট হয়নি!
-সারা
রাত বসে ছিলেন তাহলে এই বাচ্চা কি খেয়েছে, আর আপনিই বা কি খেয়েছেন?
-বাচ্চা
বুকের দুধ খায় আর আমার কোন ক্ষুধা নেই তবুও আমি ভিক্টোরিয়া থেকে কি যেন বলে
পাউরুটির মত তাই খেয়েছি।
গলা
দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছে না তবুও বলছে আর রাশেদ সাহেব কান পেতে শুনছেন।
-তবুও
ভাল যে কিছু খেয়েছেন, আপনি
কোথা থেকে আসছেন,?
-আমি
বাংলাদেশ থেকে এসেছি
-তা
বুঝতে পেরেছি,
হিথরো
থেকে এখানে কেমন করে এসেছেন?
-একজন
বাঙালি তার গাড়িতে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে এনে সোয়ান সির কোচ দেখিয়ে দিয়েছিল তারপরে
আপনি যে কোচে এলেন ওতেই এসেছি।
-নাদির
সাহেব কি হয়?
-আমার
স্বামী
-তাকে
ফোন করেছিলেন?
-আমি
অনেকবার চেষ্টা করেছি তারপরে যিনি ভিক্টোরিয়া নিয়ে এসেছিলেন সেও করেছে কিন্তু
প্রথমে কয়েকবার রিং হলেও পরে ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাই করার
আগেও কথা হয়েছে। বলেছে ও একটু পরে রওয়ানা হয়ে এয়ারপোর্টে থাকবে।
-দেখি, বলে রাশেদ সাহেব নিজেও
তার মোবাইল দিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করে একই ফল পেল।
-তাহলে
আপনি এখন কি করবেন, কোথায়
যাবেন?
-আমি
কিছু বুঝতে পারছি না।
বলেই
কান্না শুরু করল। এমনিতেও দেখে মনে হয়েছিল অনেক কেঁদেছে।
-আচ্ছা
আপনি চলেন দেখি কি করা যায়।
বলেই
বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী কাছে গিয়ে দেখে ঘরে তালা দেয়া। শীতের
মধ্যে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশের দরজায় একজনকে দেখে জিজ্ঞেস করল-
-এই
ঘরে যে থাকে তাকে দেখেছে কিনা!
-সরি, আমি কয়েকদিন যাবত ওকে
দেখিনি।
এদেশে
এমনটাই স্বাভাবিক। কে কার খোঁজ রাখে?
রাশেদ
সাহেব নিজেও কিছু ভেবে পাচ্ছিল না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে তার ডিউটির
সময় হয়ে যাচ্ছে। কি করবে এখন? গফুর ভাইও নেই যে তার সাথে পরামর্শ করবে। গফুর ভাই ছুটিতে
বাংলাদেশে গেছে। উপায় না দেখে সমসু ভাইকে ফোন করলেন।
-কি
আর করবেন মহিলাকে নিয়ে আসেন তার পরে দেখি কি করা যায়
-আচ্ছা।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।