১৬৬।
চার
নম্বর টার্মিনালে কোন দিন যেতে হয়নি বলে এখানে যাত্রীরা কোথা দিয়ে বের হয় জানে না
যদিও গেলেই দেখে নিতে পারব। তবুও মনে হচ্ছিল দেরি হয়ে যায় নাকি। এই সব ভাবতে ভাবতে
ট্রেন হান্সলো ইস্টে এসে পড়েছে।
ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। মনে
মনে যা ভাবছিল তাই বুঝি হয়! ঠিক পৌনে চারটায় যেখান দিয়ে যাত্রীরা বের হয় সেখানে
পৌঁছে একটু দূর থেকে দেখলেন যা ভেবেছিল তাই। খুকু দাঁড়িয়ে চাচার সাথে কথা বলছে
পাশে জাহিদের মেয়ে। বাবাকে দেখেই এক দৌড়ে এসে হঠাৎ করে এ পাশে জমে থাকা কোন বাঁধ ভেঙ্গে গেলে জলধারা
যেমন প্রবল বেগে ছুটে যায় তেমনি করে বুকে আছড়ে পড়লো। কত দিনের জমে থাকা পিতৃস্নেহ থেকে
বঞ্চিত খুকু শুধু আব্বু বলে বুকে মাথা রেখে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মনে হচ্ছিল
যেন ওর বাবাকে কেও ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে আর তাই বাবাকে আপ্রাণ শক্তি দিয়ে ধরে
রেখেছে। কোন কথা বলতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলেন-
-কখন
এসেছ?
কোন
জবাব নেই। সাহারার বুকে অজস্র ধারা বইলে যেমন সমস্ত পানি শুষে নেয় তেমনি ঘড়ির
কাটার হিসেবে নিজেও জানে না এ ভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে। জাহিদ এসে যখন বললো চলেন
গাড়িতে উঠি তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখে চোখে স্রোত বইছে। গায়ের জ্যাকেটের হাতায় চোখ মুছে খুকুর
মাথাটা টেনে ভেজা কণ্ঠে বললো চল আব্বু। পাশে জাহিদের বউ এক কাপ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে
রয়েছে। খুকু চাচীর হাত থেকে কাপটা নিয়ে বাবার হাতে দিল। বললো -নাও, তুমি আসার আগে আমরা
খেয়েছি।
-জাহিদকে
জিজ্ঞেস করলেন-তোরা কখন এসেছিস?
-প্রায়
ঘণ্টা খানিক হবে, আপনাকে
কয়েক বার ফোন করলাম কিন্তু ‘আউট অফ রিচ’ রিপ্লাই পেয়ে বুঝলাম আপনি হয়ত টিউবে রয়েছেন। আমরা আসার আধা
ঘণ্টা পরেই ও বের হয়েছে।
-তোরা
আসবি আমাকে একটু বলবি না? এ খবর জানলাম ঢাকা থেকে।
জাহিদ বললো
-গত
রাতে ওরা যখন বের হয় তখন আমি ঢাকায় ফোন করে ভাবীকে বলেছিলাম।
-বেশ
করেছিস, ও এসেছে তা জানিয়েছিস?
-হ্যাঁ
এইতো, আপনি আসার একটু আগে
জানিয়েছি।
-চল, গাড়ি কোথায়?
-পার্কিং
এ রেখে এসেছি।
ওরা
আগেই সব মালামাল একটা ট্রলিতে উঠিয়ে রেখেছিল। সেটা নিয়ে বাইরে এলো। জাহিদ সবাইকে
দাঁড়াতে বলে গাড়ি আনতে গেল।
জাহিদরা
বরাবরই লন্ডনের বাইরে থেকেছে বলে লন্ডনের পথ ঘাট খুব একটা ভাল চিনে না তাই প্রায়
দেড় ঘণ্টা লেগে গেল স্টেপনি গ্রিনে পৌঁছাতে। গাড়িতে বসে নাসিরকে,তানিমের বৌকে, ফিরোজের
স্ত্রীকে আরখুকুর মাকে ফোন করে মেয়ে পৌঁছার খবর জানিয়ে দিলেন।
বাসায়
পৌঁছে জাহিদরা নেমে একটু বসল এই ফাঁকে খুকু ওর মা ওর সাথে আচার, মোরব্বা বানিয়ে
দিয়েছিল ওগুলি বের করে কিছু দিয়ে দিল। বেশিক্ষণ বসল না। আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে
বলে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল যেন ক্লাস শুরু হবার আগেই ওদের ওখানে গিয়ে ঘুরে
আসে।
১৬৭।
ওরা বের
হয়ে যাবার পর খুকু গোসল করতে চাইলে রাশেদ সাহেব ওকে আগে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করে
নেয়ার কথা বলেনিচে নেমে বসার ঘরে এসে দেখলেন ওর চেয়ে একটু বড় এক মেয়ে আছে এ
বাড়িতে। সকালে যখন এসেছিল তখন কাজে গিয়েছিল বলে দেখা হয়নি। নাম বর্ণা, লাল মাটিয়া কলেজ এবং
ঢাকা সিটি কলেজ থেকে পাশ করে এসেছে আবার ছায়ানট থেকে নজরুল সঙ্গীত শিখেছে। খুকুও
লাল মাটিয়া এবং ঢাকা সিটি কলেজের ও ছায়ানটের নজরুল সঙ্গীতের ছাত্রী জেনে বেশ
আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করে নিল। শুনে রাশেদ সাহেবও বললেনযাক ভালই হলো তুমি এক
সাথে মুরুব্বি এবং সাথী দুইই পেলে। বর্ণা ওকে নিয়ে বাড়ির সব কিছু দেখিয়ে দিল।
গোসল
খাওয়া দাওয়া সেরে এসে ঘরটা একটু গুছিয়ে বিছানা পত্র বিছিয়ে বসা মাত্রই তানিম এলো
ওর বউকে নিয়ে। কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে কাল ওদের বাসা চিনিয়ে দেবার কথা বলে চলে
গেল। ওরা যাওয়ার পরেই খুকু শুয়ে পড়ল রাশেদ সাহেব পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে
আর বাড়ির কথা আলাপ করছে। আস্তে আস্তে খুকুর কথা জড়িয়ে আসছে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বুঝল
জার্নির ক্লান্তিতে আর পারছে না। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে আর রাশেদ সাহেব কথা বলেই
যাচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ করল ওর কোন জবাব নেই, ওমা! ও ঘুমিয়ে পড়েছে! যাক এদিকে রাত
হয়ে গেছে,
রাশেদ
সাহেবও প্রায় সারা রাত জেগে এসেছেন বলে শুয়ে পড়ল।
রাশেদ
সাহেব সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নিচে থেকে নাশতা করে দেখলেন খুকু তখনও অঘোর ঘুমে। ওর
ঘুমের ভাব দেখে আর ডাকতে ইচ্ছা হলো না, পাশে বসে রইলেন। দশটায় একবার ডাকলেন, না কোন সারা নেই।
বারোটা বেজে যায় তখনও গভীর ঘুম। না এখন আর না ডাকলে চলছে না। ডেকে তু্ললেন।
-না
আব্বু আমি আরও ঘুমবো।
-ওঠ এখন
বেশি ঘুমলে রাতে ঘুম হবে না তখন আরও খারাপ লাগবে বলে টেনে টুনে উঠিয়ে দিলেন। কিছু
খেয়ে নাও তারপর চল তোমার তানিম কাকু আর ফিরোজ কাকুর বাসা চিনে আসি। আমি কিন্তু
শুধু আগামী পরশু পর্যন্ত আছি পরশু রাতেই চলে যাব। যা করার এর মধ্যেই সব দেখে চিনে
নাও।
খুকু
চমকে উঠল,
-কেন
আব্বু, তুমি আর ক’দিন থাকবে না?
-না
বাবা উপায় নেই। আর ক’দিন থাকলেই বা কি সর্বক্ষণ তো আর থাকতে পারবো না, তোমাকে একাই থাকতে
হবে।
শুনেই
ওর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। প্রবোধ দিলেন, -তবুও তোমার ভাগ্য ভাল তোমার বাবা, চাচা চাচী সব আছে তারপর তানিম, ফিরোজ কাকু এরা আছে
আবার এ বাসার বর্ণাকে পেয়েছ। বাবার সাথে লন্ডনের অনেক কিছু দেখে চিনে নিতে পারছ।
কলেজে গেলে হয়তো দেখবে তোমার স্কুল কলেজের কোন বান্ধবীকেও পেয়ে যেতে পার। অন্য
যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখবে কয় জনকে তাদের বাবা চাচা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ
করেছে!
দুপুর
দুইটার দিকে বের হয়ে বাসার পাশের ওই কুইন্স মেরি ইউনিভার্সিটির পিছনের গেট দিয়ে এসে
মাইল এন্ড থেকে ফিরোজের বাসায় এলেন। টিউবে টিকেট করা, টিউব ম্যাপ দেখে জায়গা
খুঁজে বের করা,
কোন
ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে সেটা খুঁজে বের করা সব দেখিয়ে দিলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।