২১৬।
দেশে
যেয়ে কি করবে?
তার
উপযুক্ত চাকরী কি আর পাবে? এখন বয়স হয়েছে, এই বয়সের মানুষকে কে চাকরী দিবে? সবাই চায় তারুণ্য। এই নিয়ে অনেক
কথা বার্তা হয়েছে। ফিরোজও বলছে চলে যেতে। মনিও বলছে সে আর
পারছে না। রাশেদ সাহেব
জানে আবেগ দিয়ে কিছু হয় না। এই সামান্য জীবনে অনেক দেখেছে। এবারেই তো ৪৫ বছর বছর
বয়সে দেশে ছেড়ে এসেছে আর এখন ৫৩ চলছে। ব্রিটেনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছে এর মধ্যেও কত কি
দেখেছে। সামান্য কয়েকটা পাউন্ডের জন্য কতজনে কত কী করছে। কে কাকে কী দেয়? এক জনে আর একজনকে
ঠকাবার জন্য কত রকমের ফন্দি আঁটে তার কি কোন সীমা আছে? ছলনা। শুধু
দয়ার মুখোশ আঁটা।
আর কিছুই নেই। তার কোম্পানিই তো মুল মালিকের কাছ থেকে তার জন্য ঘণ্টায় ৭ পাউন্ড করে নিচ্ছে
আর তাকে কত দিচ্ছে? মাত্র
তিন পাউন্ড! আর এই তিন পাউন্ডের জন্য তাকে কি করতে হচ্ছে? ভাবতেও অবাক লাগে। মাথায় কুলিয়ে
উঠে না। মানুষ কী ভাবে মানুষকে ঠকায়? রেস্টুরেন্টে কাজ করার সময় দেখেছে যে কাজের জন্য এদেশের
জুলি, বারবারা কিংবা
ভিক্টোরিয়াকে দিয়েছে ঘণ্টায় ৬ পাউন্ড করে সেখানে রাশেদ সাহেবের মত দরিদ্র দেশের
মানুষদের সারা দিনে বার চৌদ্দ ঘণ্টা খাটিয়ে দিয়েছে মাত্র ১৭ পাউন্ড। অথচ তারা
একই দেশের মানুষ। কাওকে না ঠকালে কেও ধনি হতে পারে না।
প্রায় প্রতিটা ধনির সাফল্যের পিছনে কাওকে না কাওকে ঠকাবার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে যা
সবাই জেনেও না জানার ভাণ করে। অনেকটা আবার গোপনই থেকে যায় কেও
জানতেও পারে না। কি জানি জানলেই যদি আবার কিছু করে ফেলে! সৎ পথে কে কত বড় হতে পারে? এই পাথরের পৃথিবীতে
আবেগের কোন দাম নেই। মায়া মমতা বলতে কিছুই নেই। সবই
পাষাণ পাথরের তৈরি। যার হাতে টাকা আছে তার সবই আছে, যার টাকা নেই তার কিছুই নেই। মান
সম্মান, বিবেক বুদ্ধি কিছুই
নেই। যার টাকা আছে তার মাছেই মানুষে বুদ্ধি চায় দরিদ্রের কাছে কেও বুদ্ধি চাইতেও আসে
না। টাকা মানুষের বুদ্ধি কাজে লাগাবার কৌশল দেখিয়ে দেয়, পথ বের করে দেয়। যার আছে তার
টাকার পাহাড় উঁচু হতেই থাকে। যার নেই সে শুধু নিচের দিকে যেতে যেতে একসময় তলিয়ে
যায় সভ্যতার আড়ালে, লোকচক্ষুর
আড়ালে। টাকা না থাকলে, সম্পদ না থাকলে রক্তের সম্পর্কও মুছে যায়। রাশেদ সাহেব অনেক
দেখেছে এবং এখনও তার নিজের জীবন দিয়েও তাই দেখছে।
২১৭।
খুকুরা
দেশে চলে যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব লন্ডন এসেছেন ওদের প্লেনে উঠিয়ে দিতে, এদেশে তার আশ্রয় মুছে
ফেলতে। এই মাটিতে যে মেয়ের বুকে তার জন্যে একটু ঠাই ছিল তা আজ মুছে ফেলতে
এসেছেন। খুকু এখানে আসার পর তিন চার বার দেশে
গেছে। প্রতিবারই রাশেদ সাহেব এসেছেন। তিথি যাবার
পরেই বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠেছে, দেশ কি আমাকে চায় না? দেশ না চাক আমার মনি, আমার মাঝু, আমার ছোটন কি আমাকে
চায় না? তাহলে ওদের জন্য আমি
কেন যেতে পারছি না? গফুর
ভাই, সমসু ভাই, আসিয়াদ ভাই, মনা ভাই, ফিরোজদের দেখেছে দেশে
যাচ্ছে আসছে তখন বুকের ভিতরে উথাল পাথাল উত্তাল ঢেউ উঠেছে, ঝড় উঠেছে। অনেক কষ্টে সে ঢেউ সে
ঝড় থামিয়েছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শরীরের ভিতরে হৃদয় নামে কোন বস্তু থাকলে তা
ভাঙ্গা কাঁচের মত টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কিন্তু রাশেদ সাহেব আবার সেগুলা কুড়িয়ে
জোড়া তালি দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। বিধাতা
মানুষকে অনেক কিছু দিয়েছে আবার সবাইকে সব কিছু না দিলেও ভুলে যাবার একটা অলৌকিক শক্তি দিয়েছে
যা দিয়ে মানুষ তার মনের যন্ত্রণা, ব্যথা, বেদনা ভুলে যেয়ে আবার পথ চলতে পারে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাশেদ
সাহেব কাওকে কিছু বুঝতে দেয়নি এমনকি মনিকেও কোনদিন কিছু বলতে পারেনি। আমার ব্যথা
আমার মধ্যেই থাক, শুধু
শুধু মনির মধ্যে, মেয়েদের
মধ্যে তা ছড়িয়ে দিয়ে কোন লাভ নেই। এতে ওদের কষ্ট বাড়বে বই কিছুতেই কমবে না। মনের
কষ্ট, মনের ব্যথা কাওকে
জানাতে নেই। এমন কোন কষ্ট নেই যা সইবার ক্ষমতা বিধাতা
মানুষকে দেননি। কষ্টের পরেই সুখ আসে সে এই প্রকৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য।
হয়ত তাদেরও একদিন সুখ আসবে। সেই আশা পথের দিকে চেয়ে থাকতেই হবে।
প্রতিবারেই
যাবার সময় খুকু বাবার পাথরের মত মুখ আর বরফের মত চোখের দিকে তাকিয়ে একটুও কাঁদতে
পারেনি। শুধু বাবার বুকের সাথে একটুক্ষণ মিশে থেকে বাবার লুকানো উষ্ণতার ছোঁয়া
নিয়ে পিছনে ঘুরে চলে গেছে সিকিউরিটি গেটের দিকে, এক বারও পিছনে ফিরে তাকায়নি। কি
জানি, বাবার চোখে যদি পানি দেখতে
পায় তাহলে
যে সইতে পারবে না! বাবারই তো মেয়ে! মনে যা আছে মনের মাঝেই থাক না! কান্না কাটি করে
শুধু শুধু বাবার কষ্টের বোঝা বাড়াবার এমন কি প্রয়োজন?
২১৮।
খুকুরা
চলে যাবার পর এদেশের হোম অফিস কঠিন হলো। মাঝে মাঝেই এমন হয় কিন্তু এবার একটু বেশি
কড়া। ইইসি দেশের সাদা মানুষেরা যখন পথ ঘাট
ভেঙ্গে বন্যার স্রোতের মত এদেশে আসতে শুরু করল যখন ওরা এসে কাজের জায়গা সব দখল করে
নিল বেকারের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলল তখন লন্ডনের প্রতিটা টিউবস্টেশন, কোচস্টেশন, ম্যাকডোনাল এবং
অন্যান্য যেখানে এই সব দরিদ্র মানুষ ভাগ্যের সন্ধানে আসে তারা যেখানে এই তৃতীয়
শ্রেণীর কাজ করে সেই সব জায়গায় জাল বিছিয়ে তল্লাশি শুরু করল। সাদাদের কোন সমস্যা
নেই। ওরা এদের সাথে এক সাথে বসে ড্রিংক করতে পারে, ধেই ধেই করে নাচতে পারে। আর কিছু পারুক আর না
পারুক অন্তত এদের গায়ের রঙ সাদা এটাই এদের সব চেয়ে বড় গুণ। সাদা চামড়া হলে আর কোন
কথা নেই এদের পাশে নিয়ে বসা যায় কিন্তু ওই উপমহাদেশীয় গুলা? ওরা না পারে এদের মত
পাবে যেতে,
না আছে
এদের মত সাদা চামড়া! মাসে মাসে এদের দেশের পাউন্ডগুলা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এই কি
সহ্য করা যায়?
মোটেই
না। এমনকি টিউবস্টেশনে ধরে ধরে নানা অবান্তর জেরা। কোথায় থাক, কি কর, কোন কলেজে পড়, পড়ার খরচ জোটাও কি করে, সকালে, দুপুরে রাতে কি খাও।
সব কিছু জানাতে হবে! যেন ওদের গোলামি করতে গেছে। তল্লাশির ঢেউ এসেছে জন বিউ এর
কোম্পানিতেও। মিজান চিন্তায় অস্থির, ওর দেয়া যত লোক আছে তাদের অধিকাংশই স্টুডেন্ট আবার কিছু
আছে যারা বৈধ নয়, এখানে
কাজ করা তো দূরের কথা এদেশে থাকারও অনুমতি নেই। লুকিয়ে চুরিয়ে পালিয়ে রয়েছে।
স্টুডেন্টদেরও সপ্তাহে বিশ ঘণ্টার বেশি কাজ করার অনুমতি নেই, তার মানে দাঁড়াচ্ছে
এরাও অবৈধ উপায়ে কাজ করছে! তল্লাশি আস্তে আস্তে লন্ডন থেকে সমস্ত ইউকেতে ছড়িয়ে
পড়ল।
মিজান
রাশেদ সাহেবকে জানাল।
-চাচা, গতকাল আমাদের অফিসে
হোম অফিস হানা দিয়েছিল। কোথায় কোথায় আমাদের ডিউটি চলছে তার ডিটেইলস
নিয়েছে, কোন স্টেশনে কে কাজ
করছে সব কিছু নিয়েছে। জন আপনার সাইটের ব্যাপারে কোন ইনফরমেশন দেয়নি। ওরা বারবার
জিজ্ঞেস করছিল আর কোন সাইট আছে কি না!
রাশেদ
সাহেব চমকে উঠে বললেন-
-চাচা, তাহলে এখন উপায় কি?
-দেখি
একটু অপেক্ষা করে দেখি কি হয়। যদি আগের মত থেমে যায় তাহলে তো গেল, না থামলে চাচা আপনাকে
অন্য কিছু ভাবতে হবে এখানে থাকা নিরাপদ হবে না।
কথাটা
শুনেই রাশেদ সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কি করবে এখন? দেশেই ফিরে যাবে? কিন্তু সেখানে ফিরে
গেলে চলবে কেমন করে? নানা
ভাবনায় এবং ভয়ে রাশেদ সাহেব মানসিক ভাবে দুর্বল হতে হতে এক সময় ভেঙ্গে পড়লেন। কেও
কোন পরামর্শ দিতে পারছে না। কে কী পরামর্শ দিবে? তবে একদিন মিজান নিজেই বললো-
-চাচা
আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না, একটা
উপায় বের করা যাবে।
-কি
উপায় চাচা?
-সে
দেখা যাবে এখানেই হোক বা অন্য কোথাও কিছু একটা করা যাবে।
-একটু
খুলে বল না!
-আচ্ছা
চাচা, আপনি এখান থেকে অন্য
কোথাও যাবেন?
-কোথায়?
-সাউথ
আফ্রিকাতে!
-আমি
কি করে যাব?
ভিসা
লাগবে না?
-সরাসরি
যাবেন না,
একটু
বাঁকা পথে যেতে হবে তবে আপনি যেতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিব। এখান থেকে
পাকিস্তানিরা যেভাবে যায়।
-দেখ, যদি এখানে তেমন সমস্যা
দেখা দেয় তাহলে তো যেতেই হবে। তুমি জেনে রাখবে যদি দরকার হয় তাহলে যাতে যেতে পারি।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।