বিকেল বেলার বৃষ্টি [৬]-১
১।
১।
ক্লাস শেষ করে রবিনসন লাইবেরি থেকে কয়েকটা বই নিবে বলে রেজার সাথে বের হলো।
দুই বন্ধু একসাথে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শীতের দুপুরে ফুটপাথের পাশে ন্যাড়া
পপলার গাছের নিচে দিয়ে হাঁটতে ভালই লাগছিল।
জেসমন্ড রোডের বায়েই লাইবেরিটা। বাম দিকে ঘুরে আবার ওপাশের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, যেদিকে জেসমন্ড রোড গেছে। কিছু দূর যাবার পর হঠাৎ কি মনে করে মাহমুদ থেমে গেল।
জেসমন্ড রোডের বায়েই লাইবেরিটা। বাম দিকে ঘুরে আবার ওপাশের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, যেদিকে জেসমন্ড রোড গেছে। কিছু দূর যাবার পর হঠাৎ কি মনে করে মাহমুদ থেমে গেল।
কিরে থামলি কেন?
তুই যা,
আমি একটু সিভিক সেন্টারে যাব!
কেন?
ওখানে কাল একটা বই দেখেছি, কার্ড ছিলনা বলে নিতে পারিনি আজ নিয়ে
আসছি, তুই
যা।
আচ্ছা ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসবি, আমি অপেক্ষা করব। এক সাথে বাসায় যাব
মনে রাখিস। আমাকে ফেলে আবার চলে যাবি না সেদিনের মত
ঠিক আছে তুই যা আমি বই নিয়েই চলে আসছি
আবার পিছনে ঘুরে সিগন্যালের কাছে এসে রাস্তা পাড় হবার জন্য অপেক্ষা করছে।
ডান দিকে একটু এগিয়ে গেলে ডানে হে মার্কেট আর বাম দিকে এগিয়ে নিউ ক্যাসেল রেল
স্টেশনের পথ। সিভিক সেন্টারের ডানে হে মার্কেট স্কয়ার, পাশেই হে
মার্কেট মেট্রো স্টেশন।
রাস্তার ওপাড়েই অনেকটা জায়গা নিয়ে সিভিক সেন্টার। পাশে মেইন রোড থেকে গেট দিয়ে
ঢুকলেই হাতের বায়ে একটা দেয়ালে যারা যুদ্ধে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে কাল পথরে
খোদাই করা তাদের বেশ কয়েক জনের ভাস্কর্য। ডানে সেন্ট থমাস গির্জা। মাঝে রাস্তার
দুই পাশে দিয়ে সাইকলো গাছের সাড়ি। সমস্ত চত্বরটাই সাইকলো, পপলার, ওক, কয়েকটা
পাইন এই রকম নানান গাছ গাছালিতে ভরা। গির্জার পিছনে জুনিপারের ঝোপ। শীত বলে গাছ
দেখে আর গাছের মত মনে হয় না। সব পাতা ঝরে গিয়ে শুধু কতগুলি কাঠির স্তূপ দাঁড়িয়ে
রয়েছে মনে হয়। তবুও দেখতে বেশ লাগে। গায়ে শীতের ভারী কাপর, নাক দিয়ে
শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বের হওয়া জলীয় বাষ্প দেখে মনে হয় শরীরের ভিতরের যত আবর্জনা
ছিল সব বের হয়ে যাচ্ছে। হাতের গ্লোভস খুলে সিগারেট টানতে গিয়ে হাত প্রায় জমে
যাওয়ার অবস্থা এমন শীত।
২।
মেইন রোড পার হবার আগেই ওপাড়ের সিগনালে দাঁড়িয়ে মাহমুদ দেখল একটা মেয়ে সিভিক
সেন্টার থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। মাত্র কয়েক ধাপ সিঁড়ি। নেমে গেটের দিকে
এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে মাহমুদ রাস্তা পাড় হয়ে সিভিক সেন্টারের গেটের ভিতরে ঢুকে
পরেছে। এগিয়ে ভিতরে ঢোকার সময় মাহমুদের পা
এগুচ্ছে কিন্তু চোখ দুটি দূর থেকেই থেমে গেল। সামনে এক দীর্ঘাঙ্গী এক হারা গড়নের
ফর্সা এক মেয়ে। পরনে নীল জিনসের প্যান্ট, গায়ে ফুল স্লিভ লাল টি সার্টের উপরে
কাল নেটের হালকা বুননের সোয়েটার। দেখে মাহমুদ অবাক হয়ে গেল। এই
শীতে এই পোষাকে কেন মেয়েটা? এদেশের নয় যে এই আবহাওয়ায় মানিয়ে
নিয়েছে, দেখতে
এশিয়ান মনে হচ্ছে, কাল চুল। কিছু কৌতূহল, কিছু বিস্ময়
এবং কিছু ঘোর নিয়ে মেয়েটা সামনে আসার আগেই
থেমে মেয়েটার দিকে এক পা এগিয়ে গ্লোভস পরা ডান হাত এগিয়ে বলল আমি নেয়ামত উল্লাহ
মাহমুদ ফ্রম ইরান। মেয়েটা সামনের এই আগন্তুকের কাণ্ড আর চেহারা দেখে থমকে
দাঁড়িয়েছিল। সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে হাত না বাড়িয়ে আস্তে করে এক পা পিছিয়ে বলল আমি সাবিহা খানম, ফ্রম ইন্ডিয়া।
সাবিহা খানম মানে মুসলিম?
হ্যাঁ,
তুমিও তো মুসলিম, মাহমুদ!
হ্যাঁ। তুমি কি এখানে নতুন এসেছ?
কেন?
আজকের আবহাওয়ার খবর তুমি জান?
কেন,
কি হয়েছে?
বলছ কি! ওই দেখ,
বলে ডান দিকের মনুমেন্ট টাওয়ারের ওপাড়ে একটা বিল্ডিঙের ছাদে লাগান ওয়েদার
বোর্ড দেখিয়ে বলল
দেখেছ আজকের তাপমাত্রা কত? -৫ ডিগ্রি, এখন আমরা
অপেক্ষা করছি কখন স্নো পরবে আর তুমি বিদেশিনী হয়ে এই পোষাকে! জান তোমাকে এই পোষাকে
দেখে আমি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম!
মাহমুদের এই কথা শোনার পর গোলাপের মত মুখে অনেকগুলি পিয়ানোর পঞ্চমী সুরের
ঝংকার তুলে হাসিতে ফেটে পরার উপক্রম হলো।
ওহ! এই জন্য তুমি আমাকে থামিয়েছ? কিন্তু আমি একটুও শীত বোধ করছিনা!
সাবিহা যখন এমন প্রাণ খুলে হাসছিল তখন আরও সুন্দর লাগছিল। যেন নিষ্পাপ কোন
শিশুর স্বর্গীয় হাসি! এত সুন্দর! মাহমুদ চমকে যায়। ক্যামেলিয়ার মত চোখ, গোলাপের
মত মুখ, প্রিমরোজের
পাপড়ির মত ঠোট,
বাহরাইনের মুক্তার মত দাঁত, নাক আর হালকা কোঁকড়ান কাল কুচকুচে
রেশমি চুল। ইরানেও এমন অনেক সুন্দরী দেখেছে কিন্তু এ যেন তাদের সবার চেয়ে অনেক
বেশী! কথা বলছে যেন সেতার বাজছে।
সুন্দর হলেই কি এত সুন্দর হবে! অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
তুমি এখনও কিছু বুঝবেনা কারণ তুমি সবে
মাত্র সিভিক সেন্টারের হিটার থেকে বের হয়েছ! কয়েক মিনিট যেতে দাও তখন বুঝবে!
তবে আমি মাত্র গত সপ্তাহে এখানে এসেছি একথা সত্য। এখনও এদেশের কিছুই বুঝে উঠতে
পারিনি।
বেশ,
তাহলে চল ওই হে মার্কেটের একটা কফি শপে বসে তোমার সাথে আলাপ করি!
বলেই সাবিহার মুখের দিকে তাকাল। একটু রাজী আর নিমরাজি দুয়ের ছায়াই দেখে বলল
ভয়ের কিছু নেই, আমি
পিছনে দেখিয়ে
এই নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটিতে চিফ মেট পরীক্ষা দিতে এসেছি। ম্যারিটাইম ডিপার্টমেন্টে। তুমি?
আমি সবে বার করার ইচ্ছা নিয়ে মাস্টার্সে এডমিশন নিয়ে এসেছি!
কোথায় থাকছ?
বাম দিকে দেখিয়ে
ওইতো ওই দিকে ওয়েস্ট গেট রোডে
কোথায়?
ওখানে একটা পিজা শপ আছে তার ওপরে
এশিয়ান পিজা শপ, হিন্দু রাম মন্দিরের বিপরীতে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি চেন?
চিনি মানে যেতে আসতে চোখে পরে, যাইনি কখনও। চল যত দেরি হবে ঠাণ্ডা
তত বাড়বে।
আবার একটু আমতা আমতা করে
বেশ চল
আবার গেট দিয়ে বের হয়ে বাম দিকে ঘুরে ফুটপাথ ধরে দুই জনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে
গেল। মার্কেটের কাছে এসে সাবিহা বল ও, ভীষণ শীত!
যাক,
এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ এই জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!
৩।
হে মার্কেট স্কয়ার পাড় হয়ে একটা কফির দোকানে ঢুকে টেবিলের পাশে এসে হাত বাড়িয়ে
দিয়ে মাহমুদ ইশারায় সাবিহাকে বসতে বলল। সাবিহা বসার পর মাহমুদ জিজ্ঞেস করল কফির
সাথে আর কিছু খাবে কিনা। না না শুধু কফি। মাহমুদ এগিয়ে কাউন্টারের কাছে গিয়ে দুই
কাপ কফির কথা বলে এসে টেবিলের এদিকে বসে বলল
দেখেছ কি ভয়ংকর ঠাণ্ডা! এই টুক আসতেই সবকিছু কেমন জমে গেছে মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ,
তুমি ঠিকই বলেছ। আমি বুঝতেই পারিনি ঠাণ্ডা এত ভয়ংকর! তুমি কি এদেশে অনেক দিন
ধরে আছ?
মোটেই না,
তবে এর আগে কয়েক বার এসেছি। সেকেন্ড মেট করার সময়, তা ছাড়া
অন্যান্য সময়ে জাহাজ নিয়ে এসেছি তবে নিউক্যাসেলে নয়, লন্ডন এবং
ব্রিস্টলে।
তাহলে তুমি অনেকবার এসেছ?
তা বলতে পার। আমিতো সিম্যান। আমার কাজই এমন, জাহাজ যখন
যেখানে যায় আমিও জাহাজের সাথে সেখানে যাই।
তুমি বললে তুমি ইরান থেকে এসেছ। ইরানের কোথায়, আই মিন, কোন
শহরে?
আবাদান রিফাইনারির নাম শুনেছ?
না
ও! তা ওই আবাদানেই আমার বাড়ি। আবাদান রিফাইনারি থেকে ২/৩ মাইল উত্তরে এগিয়ে
গেলেই
তোমাদের ইন্ডিয়া অনেক বড় দেশ, তুমি কোথা থেকে?
আমার বাড়ি কলকাতা
আরে আমি কলকাতা গেছি! ডায়মন্ড হারবার তাই না?
হ্যাঁ হ্যাঁ আমার বাড়ি আলিপুরে ডায়মন্ড হারবার রোডের ধারে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।