সাহেদ সাহেব এখন একটি বড় কোম্পানির ছোট্ট একটা
ইউনিটের এজিএম। মনে তার ফুরফুরে মনমাতানো হাসনাহেনার গন্ধের মত মাতাল করা একটা ভাব
লেগেই আছে। ধরাকে সরা মনে করা, মানি লোককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য
করা, যাকে তাকে যেখানে
সেখানে অপদস্থ করা এগুলিই এখন তার মুল পেশা। অফিসে বসে কোম্পানির কম্পিউটারে
কোম্পানির ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে ওয়েব সাইটে ঘুরে বেড়াতে তিনি খুব পছন্দ করেন।
অফিসের অফিসারদের যাতায়াতের গাড়ির পথ ঘুড়িয়ে নিয়মিত তিনি তার চাকুরে স্ত্রীকে নিয়ে
যাতায়াত করছে কারো কিছু বলার নেই। সবাই মুখ বন্ধ করে এসব মেনে নিয়েছে। আর হবেই না
কেন? সে যে কোম্পানির বড় সাহেবের খাস মহলের কুটুম। ধার করা নয়, ভাড়া করা নয় এমনকি
পাতানো নয় একে বারে সাক্ষাৎ কুটুম। একে বারে আপন চাচাতো বোনের আপন শশুরের
কোম্পানি। এইতো ক’দিন আগেও কোম্পানিটি মাটি খনন এবং ভরাট কাজে নিয়োজিত ছিল। ড্রেজারে
করে কোথা থেকে মাটি এনে জমি ভরাট কাজ তদারকি করার কাজই ছিল যার পেশা। সারাদিনে ৫টা
মিনিটের জন্য একটু চেয়ারে বসতে পারাটা তার জন্য ছিল স্বপ্নের ব্যাপার। সেই সাহেদ
সাহেব এখন কাচের দেয়াল দেয়া আলাদা ঘরে গদি আটা চেয়ারে বসে শুধু পারে না মনের
আনন্দে বাঁশী বাজাতে। এ ছাড়া আর যা আছে সবই করেন। একে ধমকান, ওকে বকাঝকা, যার যা পাওনা তা না
দেয়ার নানা ফন্দি বের করে কত্তাটিকে খুশি করা এসব অনেক কিছুই তিনি পারেন। মস্ত
ডাকসাইটে এজিএম তিনি। চেহারা সুরতে কোন দিন একটা শার্ট ইন করে পরেন না, পালিশ করা জুতাতো
দূরের কথা ভাল এক জোড়া অফিসের উপযোগী জুতাও পায়ে দেন না আর মাথায় কখনো চিরুনি
দিয়েছেন কিনা তা হয়তো তিনি ভুলেই গেছেন ওদিকে মাথা ভরা খুসকি। এই হচ্ছে গায়ে গতরের
সুরত হাল।
এই ঢাকা শহরের কোন এক কলেজ থেকে কোন রকম এমএ পাশ দিয়ে
ছোট খাট একটা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি পেয়ে যখন নিজেকে ধন্য মনে করে
অত্যন্ত বাধ্য কর্মচারীর মত এ দিক থেকে ও দিকে দৌড়চ্ছিল ঠিক তখনই চাচাতো বোনের
বিয়েটা হয়ে গেল আর এই সুযোগে ওষুধ কোম্পানির চাকরিটা ছেড়ে একেবারে কৌলীন্যে ভরপুর
এই এত বড় কোম্পানির মাটি কাটার চাকরিটা বাগিয়ে নিল। সেখান থেকে আজ তিনি মস্ত
এজিএম। বড় সাহেবের আত্মীয়ের সুবাদে ছোট বড় সবাই বেশ তোয়াজ তাজির করে। না হলে কখন
কার চাকরি চলে যায় তার কি ঠিকানা আছে? সারাদিন যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণই
সবার হুজুর হুজুর, স্যার স্যার শুনতে শুনতে এর বাইরে যে একটা জগত আছে তা তিনি ভুলেই গেছেন।
ভাবেন এমন তোয়াজ তাজির, হুজুর হুজুর শোনাটা এই অফিসে একমাত্র আমারই প্রাপ্য।
আমাকে ছাড়া কে কার সাথে এমন করবে?
কিছুদিন আগে এই অফিসে ভিন্ন এক বিভাগে সাব্বির সাহেব নামে এক বয়স্ক অভিজ্ঞ
ভদ্রলোক জয়েন করলেন। চাকরির সুবাদে পৃথিবীর নানা দেশে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে
অভিজ্ঞতার ঝুলি এমন ভারি করেছেন যে তা দেখে সাহেদ সাহেবের চক্ষু রীতিমত চড়কগাছ।
এখানে আসার আগেও প্রায় বছর দশেক ইউরোপে থেকে এসেছেন ভদ্রলোক। সে কি! আমি এই অফিসের
এই এত বড় অফিসার থাকতে আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার কে এলো, কেন এলো? মহা দুর্ভাবনায় পরে গেল। এই লোক কি
আমাকে এত তোয়াজ বা হুজুর হুজুর করবে? ভাবনার একটা কঠিন
গ্যাঁড়াকলে পরে গেল। শুরু করলেন তার আসল চেহারার আসল খেলা দেখান। সেই তো শুরু।
অফিসের গাড়ি প্রায় ফাঁকা থাকা সত্যেও সাব্বির সাহেবকে বলে দিলেন-
দেখুন অফিসের গাড়িতে সিট নেই তাই উপরে জানাতে হবে যাতে একটু বড় গাড়ি দেয়।
আচ্ছা ঠিক আছে ততদিন না হয় একটু চাপাচাপি করেই যাই!
কি আর করা অগত্যা সাব্বির সাহেবকে নিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে। গাড়িতে বসে এ
কথা ও কথার লেজ ধরে কি করে মনের মত একটা কটু বাক্য বলা যায় কিংবা পেট থেকে নিতান্ত
ব্যক্তিগত দুই একটা কথা টেনে বের করে পরে কোন এক সময় সবার সামনে হাটে হাড়ি ভাঙ্গার
মত তা বীর দর্পে প্রকাশ করেন। অমুক দিন অমুক সময় উনি এই কথা বলেছেন, বুঝুন উনি কোন
শ্রেণীর মানুষ। এমনকি ঘরের কথাও এমন সুন্দর করে বলেন যে রীতিমত লজ্জায় ফেলে দেয়।
সাব্বির সাহেব এর বিন্দু বিসর্গ কিছুই বুঝে উঠতে পারে
না, তার ওসব কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এদিকে সাব্বির সাহেবের পুরনো
যে সব কলিগ এবং বন্ধুরা দেশে রয়েছে তারা সরকারি অফিসের নানা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত
হয়ে গেছে এটাও তার চক্ষুশূল। যাদের কিনা সাহেদ সাহেব স্যার স্যার বলে সম্বোধন করছে
সেই তাদেরই কিনা এই সাব্বির সাহেব তুমি তুমি করে বলছে। না, এই এত নির্বিচার কি সহ্য করা যায়? আমিই হচ্ছি এখানকার
বিরাট হনুমান আর আমার উপর দিয়ে এসব হচ্ছে কি? মনের দুঃখে না পারে কাঁদতে না পারে
অন্য কিছু করতে। শুধু যখনই সুযোগ পায় তখনই সাব্বির সাহেবের সাথে লেগে মনের ঝাল
মিটিয়ে যা মনে আসে তাই গালাগালি করে। সাব্বির সাহেবও জেনে শুনে এত বড় হনুমানকে
কিছু বলার প্রবৃত্তি বা সাহস কোনটাই পায় না। এমনিতেও সে একটু মুখচোরা স্বভাবের, কাউকে কিছু বলতে
পারে না।
সাব্বির সাহেবের এবং তার পুরো পরিবারের নানা সুনাম
রয়েছে এগুলিও সাহেদ সাহেব কোন অবস্থাতেই মেনে নিয়ে সহ্য করতে পারে না, স্বীকার করতে পারে
না। আমার চেয়ে বড় এবং ভাল আর কে হতে পারে এই অফিসে? আমিই সবার সেরা। যদিও সারা অফিসে
শ্রমিক থেকে অন্যান্য সবাই তাকে কোম্পানির দালাল এবং একজন ভণ্ড প্রতারক বলে ডাকে
সে তো আর উনি কিছুতেই জানতে বা বুঝতে পারে না।
এক দিন হয়েছে কি, অফিসে যাবার পথে গাড়িতে বসে সাব্বির সাহেব অন্য
একজনের সাথে কথা বলছিল আর সাহেদ সাহেব সে কথা টেনে নিয়ে একটা অহেতুক প্রশ্ন করে
বসল। সাব্বির সাহেব সেটা না বুঝে বলে দিল ও কথা এর আগে কয়েকবার বলা হয়েছে। আর যায়
কোথায়? সাহেদ সাহেবের আতে ঘা লেগে গেল বিশাল এক বিশ কেজি ওজনের হাতুড়ির আঘাতের মত।
সঙ্গে সঙ্গে সাব্বির সাহেবকে বলে বসল আপনি মুখ সামলে কথা বলা অভ্যাস করুন। কাকে কি
বলছেন ? আমি আপনার সিনিয়র অফিসার আমি আপনাকে অর্ডার দিচ্ছি আমার সাথে আর কোন দিন
কোন কথা বলবেন না। আপনি কথা বলতে শিখেননি। এই গাড়িতে আপনার কথা সম্পর্কে আপনার
বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ আছে। বলেই নিজে একা একা বলতে লাগল বেশি আস্কারা দেয়া হয়েছে
বলে মাথায় উঠে গেছে। সাব্বির সাহেব শুধু বললেন এটা কিন্তু ভাই অন্যায় কথা বলে
ফেললেন।
চুপ! আমি বলেছি না কোন কথা বলবেন না।
আপনার যা ইচ্ছা হবে তাই বলে যাবেন আর কেউ প্রতিবাদ করবে না?
না! খবরদার! কোন কথা বলবেন না। একদম চুপ।
বেশ তাতেই মঙ্গল।
এর দুই এক দিন পরের ঘটনা বলছি। ঈদের ছুটি হয়ে গেছে, আজ অফিস করেই ছুটি।
ফেরার পথে গাড়ি থেকে সবাই নামার পর সাব্বির সাহেব সবার পরে তার জায়গায়
নামার আগে গাড়ির ড্রাইভার বলল, স্যার অনুমতি দিলে একটা কথা বলি?
বল।
স্যার, সেদিন কিন্তু সাহেদ সাহেব যা বলল তা ভীষণ অন্যায় বলেছে। এখানে আপনার কোন
দোষই ছিল না। তাছাড়া আপনার মত এক জন মানুষের সাথে এই ভাবে কথা বলা কোন ভদ্র বংশের
সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা নানা জায়গার নানা শ্রেণীর মানুষ নিয়ে গাড়ি চালাই
আমরা মানুষ দেখি এবং চিনে নিতে পারি। আমরা নিজেরা ছোট এবং গরীব বংশের সন্তান হতে
পারি কিন্তু ভদ্র লোকদের নিয়ে চলাফেরা করি। উনি নিশ্চয়ই এত বড় অফিসার না যে যাকে
যা খুশি বলতে পারে। যদি এত বড় অফিসারই হতো তাহলে একা এক গাড়িতেই চলাচল করত। কোন বড়
অফিসার কাউকে এমন কথা বলতে পারে না। আর দেখেন আজ সবাই নামার আগে সাহেদ সাহেব
সবাইকে ঈদ মোবারক বলেছে কিন্তু উনি যখন নেমে যায় তখন আপনি ছাড়া আর কেউ গাড়িতে ছিল
না অথচ আপনাকে কিন্তু ঈদ মোবারক বলেনি, পেট ভরা কত হিংসা থাকলে এমন সম্ভব, যার মনে এত হিংসা
অহংকার সে ভদ্রলোক হয় কি করে?
ড্রাইভার কি বলার অনুমতি চেয়েছে সে কথা সাব্বির সাহেব
না জেনে অনুমতি যখন দিয়েই ফেলেছে তখন সে শেষ না করা পর্যন্ত তো তাকে শুনতেই হবে, মাঝখানে থামিয়ে দিতে
পারেনি। ড্রাইভারের কথা শুনে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। একজন সাধারণ ড্রাইভারের যে
কাণ্ডজ্ঞান আছে একজন এজিএম সাহেদ সাহেবদের কি তা থাকতে নেই?
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।