১৪৮।
গ্রাহকেরা
অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পারিবারিক বা ঘরোয়া আপ্যায়ন বা আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে সপ্তাহ
শেষে এসে খেয়ে যায়। জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী বা অন্য যে কোন স্মরণীয় দিন গুলি বৈচিত্র্যময়
পরিবেশে উদযাপনের জন্য প্রায়ই এই সব
রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠান হচ্ছে। এমনকি বেশ কয়েক
দিন আগে থেকেই ফোন করে বুকিং দিয়ে রাখছে আমরা অমুক দিন এতটার সময় এত জন আসব।
সেগুলি আবার বুকিং ডাইরিতে লিখে রাখছে। কি ধরনের অনুষ্ঠান তাই বুঝে তাদের জন্য
টেবিল বা পুরো ফ্লোরটাই সাজিয়ে রাখে। কখনও গ্রাহকরা নিজেরাই একটু আগে এসে
সাজিয়ে নেয়।
এদেশে
দুপুরে সবাই কাজে ব্যস্ত থাকে বলে আমাদের দেশের মত দিবা নিদ্রার প্রচলন নেই। কাজেই
কাজে থাকা কালীন সাধারণ একটা স্যান্ডউইচ বা বার্গারের সাথে একটা আপেল আর এক ক্যান
পানীয় এই দিয়েই দুপুরের খাবার হয়ে যায়। প্রধান খাবার খায় রাতে। রাতে রেস্টুরেন্ট
থেকে খেয়ে
বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ঘুম। এদের আবার একটা খুব ভাল গুন হচ্ছে যত রাতেই ঘুমাতে
যাক না কেন খুব ভোরে উঠে। আমাদের মত এরা গভীর রাতে শোবার আগে খায় না। খাবার অন্তত
দুই ঘণ্টা পর বিছানায় যায়।
কাজেই
রেস্টুরেন্টগুলি দুপুরে বারোটার পর ঘণ্টা দুই আড়াই খোলা রাখলেও গ্রাহক খুব একটা
আসে না। সাধারণত রাতের প্রস্তুতির জন্যই এই সময় খোলা হয়। বিকেল পাঁচটা বা তার
কিছুক্ষণ পরেই খোলা হয়। এলাকা বুঝে রাত এগারটা থেকে একটা বা দুইটা পর্যন্ত খোলা
থাকে। শনি এবং রবি দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি বলে শুক্র এবং শনিবারের রাতে প্রচণ্ড
ভিড় হয়। সোম থেকে শুক্র বার পর্যন্ত যান্ত্রিক গতিতে কাজের চাপ থেকে
অব্যাহতি পাবার জন্য, সমস্ত
ক্লান্তি ধুয়ে মুছে নিজেকে ধোপদুরস্ত করতে গিয়ে বসে আমাদের দেশের চায়ের দোকানের মত
পানশালা গুলোতে। উত্তাল বাজনার তালে তালে জোড়ায় জোড়ায় বা যার কোন সঙ্গী বা সঙ্গিনী
নেই তারা একাই পান পাত্র হাতে নেচে গেয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত পৃথিবীতে গড়ে নেয় আপন
স্বর্গ। অবশেষে যখন ক্ষুধা নামের জীবের একান্ত শত্রুর আক্রমণের ছোবল অনুভব করে তখন
পানশালা থেকে উঠে এসে ভিড় করে এই সব রেস্টুরেন্টগুলিতে। এখানে তাদের জন্য
অপেক্ষা করছে চির সুবাসিত নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার।
খাবার
পরিবেশনের আগে আবার এক দফা পানীয় পূর্ণ গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে মত্ত অবস্থায় সঙ্গী
বা সঙ্গিনীর সাথে মানব জাতির ভালবাসা প্রকাশের আদিম ঢঙ্গে মগ্ন হয়ে যায়। তখন আর
স্থান কাল পাত্র বিবেচনার হুশ থাকে না। এর মধ্যেই বেরসিক ওয়েটার এসেই বলে উঠে
এক্সকিউজ মি স্যার/ম্যাডাম, ইওর মিল ইজ রেডি। তখন তারা চমকে উঠে পরস্পরের বন্ধন মুক্ত
হয়ে একটু নরে চরে বসে বলে দেয় ইংরেজদের কৃত্রিম ভদ্রতা মূলক কথা ‘থ্যাংকস’। মনে চেপে রাখে বিরক্তি, যা কখনো এই ইংরেজ জাতির
পক্ষে প্রকাশ করা হয়ে উঠে না। ইংরেজদের চারটা যাদু শব্দ আছে যেমন, এক্সকিউজ মি, থ্যাঙ্ক ইউ, সরি এবং প্লিজ এই দিয়ে
অনেক কিছু জয় করে নিতে পারে যা আমাদের জন্য অচল। এদেশে বাস থেকে নামার সময়
ড্রাইভারকে থ্যাংকস বলে নামে অথচ আমাদের দেশে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ বললে সে উলটো
জিগ্যেস করবে আমারে ধন্যবাদ কইলেন কেন? যাই হোক যা বলছিলাম, এদেশের মহিলাদের প্রিয় খাবার টক
মিষ্টি জাতিয় চিকেন টিক্কা মাশাল্লা বা চিকেন কোর্মা, তবে পুরুষেরা অনেকেই
চরম ঝাল পছন্দ করে।
ঝালের
মাত্রা বোঝানর জন্য এখানে চারটা নাম আছে প্রথমত সাধারণ কারি যা তেমন ঝাল নয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের
ঝালের নাম মাদ্রাজ কারি এখানে মাদ্রাজ দিয়ে ঝালের মাত্রা বোঝাচ্ছে, এর পর ভিন্দালু, এটা হচ্ছে ঝালের তৃতীয়
মাত্রা চতুর্থ মাত্রা হলো ফাল। এই দিয়ে কোন রকম রাতের খাবার সেরে আবার মেতে উঠে
গল্পে। দেখে মনে হয় এদের বাড়ি ঘর সব ক্রোক হয়ে গেছে কিংবা বাণ ভাসিতে তলিয়ে গেছে
যাবার কোন জায়গা নেই। কোথায় যাবে তাই এই রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছে। রাত বাড়তে থাকে
সেই সাথে বাড়ে কর্মীদের বিরক্তি। এরা মনের সুখে এখানে বসে আনন্দ করছে কিন্তু
বেচারা কর্মচারীরা সেই যে দুপুরে শুরু করেছে রাতের একটা বা দুইটা বেজে গেছে এখনও
কাজে লেগেই রয়েছে। সব কাস্টমার বের হয়ে যাবার পর সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার
করে, সব কিছু ধোয়া মুছা করে
তবেই ছুটি। এখনও হয়ত কেও কিছু খাবার সময় পায়নি অথচ অন্যের খাবার যোগান দিয়ে
যাচ্ছে। বিরক্তি আসাটাই স্বাভাবিক। আবার ইংরেজদের তৈরি করে দিয়ে আসা উপমহাদেশীয় গোলামি ভাব এখনও
রক্তের সাথে রয়ে গেছে বলে কাস্টমার অভিমান করে যদি আবার না আসে এই ভয়ে কিছু বলতেও
পারছে না। অবশ্য এ দেশিয় বা ইটালিয়ান বা ম্যাক্সিকান রেস্টুরেন্ট গুলিতে ভিন্ন
চিত্র, ওরা রেস্টুরেন্ট বন্ধ
করার নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা আগে মাইক দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলে দেয় “সম্মানিত গ্রাহক বৃন্দ, আমাদের রেস্টুরেন্ট আর
মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হবে আপনারা এর মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে নিন”। এ
প্রসঙ্গে এখানে প্রচলিত একটা কৌতুক মনে হলো, এক রেস্টুরেন্টে শেষ গ্রাহক খেয়ে
দেয়ে বসে বই পড়ছে, আর
ওদিকে ওয়েটার সাহেব তার অপেক্ষায় আছে যে সে কখন যাবে। এমন সময় গ্রাহক সাহেব হাত
উঁচিয়ে আঙ্গুলের ইশারায় ওয়েটারকে কাছে ডাকছে দেখে ওয়েটার মনে মনে ভাবছে যাক
বাঁচলাম এবার হয়তো বিল চাইবে। ওয়েটার কাছে যেতেই গ্রাহক বললো ‘ওয়ান কফি প্লীজ’। এর
মানে হচ্ছে কফির উছিলায় আরও অন্তত এক ঘণ্টা বসে থাকার সুযোগ পাবে আর ওয়েটারকে তার
সাথে বসে থাকতে হবে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।