৪৭।
ওহে অর্থ, ওহে বিত্ত, ওহে সম্পদ আজ এই পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে এসে তুমি আমার মনিকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে? আমার মনি আমাকে একা এই নির্জন বনবাসে রেখে একা চলে গেলো? এমন হবার কথা ছিলো না। কেন
এমন হলো? এ সময় মনিকে নিয়ে সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসারে সোহাগে আহ্লাদে আমোদে কাটাবার কথা ছিলো, তাহলে? এ কি? এই জন্যই কি মাত্র উনিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বের হয়েছিলাম? এই কি তার পরিণতি? সত্যিই অর্থ, তুমি মহান, তুমি বড়ই শক্তিমান। তোমার শক্তির জোড়ে চলছে বিশ্ব। তুমি যাকে ধরা দিয়েছ সেই ভাগ্যবান আর যাকে ঘৃণা করেছ সেই হতভাগা। অথচ যার প্রয়োজন তুমি তার কাছ থেকে দূরে সরে থেকেছ, পালিয়ে বেড়িয়েছ। যার প্রয়োজন নেই তার সাথেই তোমার যত প্রেম যত মাখামাখি। কেন এই লীলা? কেন এই প্রহসন? কোথায় রয়েছ তুমি, আমার এই কথা কি শুনতে পাচ্ছ? জবাব দাও! জবাব দাও! আর কত কাল তোমার এই লীলা চলবে? তোমার বোধোদয় কবে হবে? কবে? তুমি কি অন্ধ? কারো চোখের নোনা জলে কি তোমার পাষাণ হৃদয় ভিজে উঠে না? চোখের নোনা জলের, হৃদয় দুমড়ানো মোচড়ানোর কোন মূল্য কি তোমার কাছে নেই? তুমি কি এতই কঠিন, এতো বড় পাষাণ তুমি?
ভাবতে
ভাবতে রাশেদ সাহেব সুটকেসের হ্যান্ডেল ধরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বার বার পিছনে ফিরে
দেখছিলেন,
যদি মনি
ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়ায় তা হলে আবার একটু দেখতে পেত এই আশায়। রাশেদ
সাহেব ভালো
করেই জানে তা হবার নয়। তবুও মিছে আশায় ভেজা চোখে ফিরে ফিরে দেখতে দেখতে টার্মিনাল
থেকে বের হয়ে এলেন।
৪৮।
হিথরো
এয়ারপোর্ট,
তিন
নম্বর টার্মিনাল।
রাশেদ
সাহেব একটা ভাঙ্গা চূর্ণ বিচূর্ণ ক্ষত বিক্ষত মন, উদভ্রান্তের মত চেহারা, ভেজা দুটা চোখ আর তার
মনির গুছিয়ে রেখে যাওয়া দুটা লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এসে বাস স্ট্যান্ড খুঁজতে লাগলেন।
কোথায় বাসস্ট্যান্ড তা জানেন না। এর আগে কখনো এদিকে আসেননি। কাউকে যে জিজ্ঞেস করে
জেনে নিবেন সে জন্য তো কাওকে রাস্তায় থাকতে হবে কিন্তু সেরকম কাওকে দেখা যাচ্ছে
না। লোক জন দুই এক জন যা দেখা যাচ্ছে তা শুধু গাড়ির ভিতরে, তা তাদের গাড়ি থামিয়ে তো জিজ্ঞেস
করতে পারেনা। রাশেদ সাহেবের সেরকম সাহস নেই। তাছাড়া এদেশে সেটা মানানসই হবে বলেও
মনে হয়না।
গাড়ির
চলাচল দেখে অনুমান করে এক দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। সাথে
একটা সুটকেস আর একটা ব্যাগ। কোনটাই কম ভারি নয় তবুও রক্ষা যে সুটকেসটার হ্যান্ডেল
ধরে চাকার উপর টেনে নেয়া যায়। মনি যা পেরেছে ঠেসে ভরে দিয়ে গেছে। শুধু কি তাই? সাথে সহস্রাধিক উপদেশ, ওষুধের ব্যাগটা বার
বার করে দেখিয়ে দিয়েছে। অনুমান করে হাঁটা শুরু করলেও মোটামুটি সঠিক পথেই এসেছেন।
কিছুদূর এসে দেখেন সামনে কয়েকটা কোচ দেখা যাচ্ছে, ন্যাশনাল এক্সপ্রেস। তাতে বিভিন্ন
গন্তব্যের নাম লেখা, কার্ডিফ, সাউদাম্পটন, লিভারপুল, প্লিমাউথ, লীডস আরও অনেক কিন্তু
রাশেদ সাহেবের গন্তব্য অক্সফোর্ড।
যাই হোক
স্ট্যান্ড যখন পাওয়া গেছে নিশ্চয় তার বাস ঠিকই পাবেন। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলেন।
স্ট্যান্ডের কাছে এসে অক্সফোর্ড এর স্ট্যান্ড পেলেন। দেয়ালে লাগানো সময় সূচী
দেখলেন।
অক্সফোর্ড এর গাড়ি ছাড়বে আরও ১৫ মিনিট পর। দাঁড়িয়ে রইলেন। না শুধু শুধু দাঁড়িয়ে নয়, আবার তার মনির চিন্তা।
মনি এখন কোথায় কত দূর গেছে, ও কি প্লেনে একা ভয় পাচ্ছে, প্লেনে কি আদৌ উঠতে পেরেছে, নিজেকে কি সামলে নিতে
পেরেছে? একা তো কখনো কোথাও
যাবার প্রয়োজন হয়নি। মনি একা একা কোথাও যাবে এ তো মনি বা রাশেদ সাহেব কখনও কল্পনাও
করতে পারেনি। আজ তার মনিকে এই বিশাল পথ একা যেতে হবে। রাশেদের চোখ বেয়ে কি পানি
আসছিলো? তাহলে চশমা সরিয়ে
রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন কেন?
ভাবনার
সাগরে যখন হারিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন ঠিক তখনই একটা কোচ এসে দাঁড়াল। চেয়ে দেখে
কোচের সামনে অক্সফোর্ড লেখা। হয়তো কোচটা অক্সফোর্ড থেকে আসলো। ৪/৫ জন যাত্রী নামল
গাড়ি থেকে। প্রায় সাথে সাথে ড্রাইভার ও নামল কোচের দরজাটা বন্ধ করে। শীতের দিন, হলুদ রঙের হাই ভিজিবল
জ্যাকেট গায়ে,
ভিতরে
নেভি ব্লু জ্যাকেট আর টাই দেখেই রাশেদ সাহেব বুঝলেন ইনি ড্রাইভার।
কোথায়
টিকেট করবেন তেমন কিছু খুঁজে পেলেন না। অপেক্ষা করলেন। হ্যাঁ একটু পরেই অন্য একজন
ড্রাইভার এগিয়ে আসল। এর পরনেও একই ধরনের পোষাক। কোচের কাছে এসে বন্ধ দরজা খুলে
পাশে দাঁড়াল। ওই স্ট্যান্ডে রাশেদ সাহেব ছাড়া অন্য কোন যাত্রী নেই। রাশেদ সাহেব
এগিয়ে ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলেন
-আমি
অক্সফোর্ড যাব কিন্তু টিকেট কোথায় পাব?
-ড্রাইভার
বললো আমি গাড়িতেই টিকেট দিব। একটু দাড়াও তোমার সাথের মালামাল গুলি আগে উঠিয়ে নাও
বলেই পাশের লাগেজ বক্সের পাল্লাটা খুলে লাগেজ দুটো উঠিয়ে জানতে চাইল-
-কোথায়
নামবে, অক্সফোর্ড?
-হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ
পর ড্রাইভার উঠে ড্রাইভিং সীটে বসে বললো -ওঠো।
রাশেদ
সাহেব উঠে বললো -কত ভাড়া?
-১৪
পাউন্ড।
পকেট
থেকে ওয়ালেট বের করে ২০ পাউন্ডের একটা নোট বের করে দিলেন। ড্রাইভার ভাংতি ৬ পাউন্ড
আর সাথে ভাউচার এর মত একটা টিকেট লিখে দিলে ওগুলি নিয়ে পকেটে রেখে সুবিধা মত একটা
সিটে বসলেন। সমস্তটা বাসে সে একাই যাত্রী। সময় মত কোচ ছেড়ে দিল। কোথায় যাচ্ছেন, সেখানে কি করবে তার
কাজ কি হবে,
আসেপাশের
লোকজন কেমন হবে ইত্যাদি নানান রকম চিন্তা। সে তো কিচেন পোর্টার এর কাজ পেয়েছে।
কিচেন পোর্টার আবার কি জিনিস তা রাশেদ সাহেব জানেনা, ফিরোজ ও এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।
আসলে জানতে চাওয়াই হয়নি।
৪৯।
দুর্বলের
উপর যখন সবলের অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যখন দুর্বলের কিছু করার থাকে না,
দুর্বলের মনের যে হাহাকার তা শোনার মতো কেও থাকে না, সে যে কত মর্মান্তিক কত হৃদয়
বিদারক ব্যাপার তা একমাত্র দুর্বলেই বুঝতে পারে। এই
আঘাত শুধু মনের,
আর মনের
তো রক্ত নেই তাই তা দেখা যায়না কতটা আঘাত সে পেয়েছে। রক্ত থাকে শরীরের মাংসে, হাড়ে মজ্জায়। মনের যদি
রক্ত থাকত তাহলে যে কত মনরক্ত ক্ষরণ দেখতে পেতাম সে হিসাব করতে পারব কি আমরা? নাকি মনরক্তের কোন
মূল্য আমরা জানি? আমরা
শুধু জানি আহা মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান। কিন্তু যে বলিদান
হলো সে তো চলেই গেলো যে বলিদান হতে পারল না তার মন যে চুরমার হলো সে কথা কি কখন
জানতে পেরেছি না জানতে চেয়েছি? নাকি কারো দিকে তাকিয়ে দেখেছি কত মনরক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।
শরীরের আঘাতে রক্ত ঝরে নয়ত হাড় মাংস থেঁতলে বা ভেঙ্গে যায়। যা চিকিৎসা করা যায়, জোড়া তালি দেয়া যায়, সেলাই করা যায়। দরকার
হলে ভিন্ন শরীর থেকে রক্ত হাড় মাংস এনে পূরণ করা যায়। যার মন ভেঙ্গে গেছে তার কি
চিকিৎসা?
ভিন্ন মন
এনে কি তার মন জোড়া যায়? মন কি সেলাই করা যায়? কেন যায়না তা হলে সে কি করে
ভাঙ্গা ক্ষত বিক্ষত মন নিয়ে বেঁচে থাকবে?
বাসের
সিটে বসে ভাবছিলেন। দুপাশের কোন দৃশ্য তার চোখে পরেনি। কতক্ষণ সময় গেছে তাও চোখে
পরেনি। মনি কিভাবে পৌঁছবে, মেয়েরা কি ভাবে মানুষ হবে আমি কত দূর কি করতে পারব, কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে
ভাগ্য, ফেলে আসা জীবন। আমার
ভুল কোথায় ছিলো আদৌ কোন ভুল ছিলো কি? হ্যাঁ ভুল তো অবশ্যই ছিলো। অন্ধ বিশ্বাস আর সরলতা। কামরুল
তো বলেছিল তুমি যা করতে যাচ্ছ তার মূল্য কি পাবে? তোমার যে মানসিকতা তুমি কি পারবে
মানিয়ে নিতে?
কিছু মনে
করনা বাবা মা যাই বল কেও কিন্তু স্বার্থের বাইরে নয় তুমি যতক্ষণ দিতে পারবে ততক্ষণ
তুমি ভাল। যখনই দেয়া বন্ধ হবে তখনি শুরু হবে দ্বন্দ্ব? ভেবে দেখ তোমার ফ্যামিলি চাইবে এক
রকম আর তোমার বাস্তব হবে অন্য রকম। মাঝ থেকে তোমার বউ ভুগবে তোমার মেয়েরা ভুগবে
তাদের মনে কিন্তু ভীষণ প্রভাব পরবে। অফিসের কলিগরা সবাই বলেছিলো রাশেদ সাহেব ভালো
করে চিন্তা করে চাকরি ছাড়বেন। বস ক্যাপ্টেন মাযহার তো ছাড়তেই চাননি। বলেছিলেন
দেখুন এসব ক্ষেত্রে যা হয়, আপনি কিন্তু পারিবারিক সমর্থন পাবেন না আর তখন কিন্তু
আপনার দুই দিক সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আপনার কিন্তু অত টাকা নেই।
মেয়েরা
ভুগছে ঠিকই কিন্তু তারা অনেক কষ্টে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে আর মনি! সে তো তার
পক্ষে যা সম্ভব তা তো করেছেই যা সম্ভব নয় তাও করার চেষ্টা করেছে এই সব ভাবছিলেন।
এলো মেলো ভাবে কত কি আসছিলো মনে। আজ স্ত্রী সন্তান ছাড়তে হলো, সংসার ছাড়তে হলো, দেশ ছাড়তে হলো।
কিছুক্ষণ
পর কোচ লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনে এসে দাঁড়াল। সেখানে দশ বারো জন যাত্রী উঠে
যার যার সীটে বসার মিনিট চার পাঁচের মধ্যেই কোচ আবার ছেড়ে দিলো।
লন্ডন
শহর পেরিয়ে মটর ওয়েতে যখন বেরিয়ে এলো তখন গাড়ির গতি দেখেই বোঝা যায় নির্বিঘ্নে কোন
রকম বাঁধা হীন ভাবে এক গতিতে চলছিলো। সমস্ত গড়িতে কোন সাড়া শব্দ নেই। চুপ চাপ, শুধু গাড়ি চলার শব্দ। দুই
ঘণ্টা পরে কোচ এসে অক্সফোর্ড গ্লস্টার গ্রিন কোচ স্টেশনে দাঁড়াল। কোচ থেকে নেমে
মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে
অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে তার পথের সন্ধান পেতে চেষ্টা করলেন কিন্তু ডান বাম
সামনে পিছনে সবই তো তার কাছে সমান। কোন দিকে যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।
এখানে বেশ লোক জন যাচ্ছে আসছে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। পাশেই কফি শপ সেখানে চা কফির
সাথে নানান কিছু খাচ্ছে। তাদেরই এক জনকে জিজ্ঞেস করলো আমি আবিংডন যাবার বাস কোথায়
পাব? কিন্তু সে যা বললো তা
রাশেদ সাহেব কিছুই বুঝতে পারল না। হা না বলে মাথা ঝেঁকে কোন রকম তার হাত থেকে
রেহাই নিয়ে মোটামুটি ওই দিকে এগিয়ে যাবার ভান করে অন্য একজনকে আবার ওই একই প্রশ্ন।
এবারের লোকটা বয়স্ক। সে রাশেদ সাহেবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আর সাথের মালামাল গুলি
দেখে বললো আস আমার সাথে।
ভারি
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সুটকেসটা হ্যান্ডেল ধরে টেনে তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিছন
দিকে টার্মিনালের বাইরে এসে দাঁড়াল। লোকটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল এই রাস্তাটা পার
হয়ে ওই যে রাস্তা দেখা যাচ্ছে ওই খানে বাম পাশে যে গাছটা দেখছ ওখানেই বাস
স্ট্যান্ড। বেশি দূরে নয়, কাছেই ৩/৪ মিনিটের পথ মাত্র। ওখানে তুমি আবিংডনের বাস
পাবে। এক হাত বারিয়ে দিয়ে হ্যান্ড সেক করে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হেঁটে গাছের
নিচে এসে দাঁড়াল।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।