৪৬।
আঁচল
দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আস্তে আস্তে বের হয়ে গাড়িতে বসল। ফিরোজ গাড়ি স্টার্ট করে চলল
হিথরো এয়ারপোর্টের দিকে। পথে রাশেদকে এখানকার দুই একটা সাবধান বাণী শোনাল। ভাবীকে
বোঝাল, মন খারাপ করবেন
না।
রাশেদের দিনের পরিবর্তনের সাথে সাথেই সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখবেন এই ভাইই তার নিজের ভুল
বুঝতে পেরে ছুটে আসবে। মনি এক হাতে স্বামীর হাত চেপে ধরে রেখেছে যেন রাশেদকে কেও
কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাই ছুটে না যায়, অন্য হাতে চোখ মুছছে।
এয়ারপোর্টে
পৌঁছে টার্মিনালের সামনে গাড়ি রেখে ফিরোজ মালামাল নামিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
এখানে শুধু যাত্রীকে নামিয়ে দিতে পারে কিন্তু গাড়ি বেশিক্ষণ রাখা যাবে না তাই দেরি
করতে পারেনি। রাশেদ সাহেব মনিকে নিয়ে এয়ারলাইনের কাউন্টারে এসে সেদিন ফিরোজের সাথে
কথা হয়েছিলো সে অনুযায়ী টিকেটে লন্ডন থেকে কুয়ালালামপুর আবার কুয়ালালামপুর থেকে
ঢাকার কনফার্মেশন স্টিকার লাগিয়ে চেক ইন ডেস্কে চলে গেলো। ওখানে মালপত্র ওজন করে
বোর্ডিং কার্ড,
কুয়ালালামপুরে
ট্রানজিটের সময় হোটেল রিজার্ভেশন কার্ড নিয়ে সিকিউরিটি গেটের পাশে এসে দাঁড়ালো।
বেয়াইকে
যে দেখছি না,
আসেনি
নাকি এসে ভিতরে চলে গেছে বুঝতে পারছি না। ভয় পেয়ো না, এখনও আসুক বা না আসুক তুমি ওয়েটিং
লাউঞ্জে তাকে পাবে।
এমন সময়
এক জন বাঙ্গালি ভদ্রলোক সিকিউরিটি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকছে দেখতে পেয়ে রাশেদ সাহেব
তাকে থামিয়ে আলাপ করলো। আলাপে জানলো তাদের বাড়ির কাছেই তার বাসা, শুনে খুশি হয়ে বললো
তাহলে
ভাই আমিতো যাচ্ছি না মনিকে দেখিয়ে বললো ইনি যাচ্ছেন সম্ভব হলে একটু লক্ষ্য রাখবেন।
-ঠিক
আছে ঠিক আছে এ কি আর বলে দিতে হবে, দেখব।
রাশেদের
চোখ গেটের দিকে, যদি বেয়াই এর মধ্যে এসে পরে।
-লোকটা বললো
তাহলে আপনি আসুন আমি ঢুকে পরি।
-আচ্ছা
ঠিক আছে
রাশেদ
সাহেবের হঠাৎ মনে হলো তার কাছে যে পাউন্ড গুলি আর অল্প কিছু বাংলাদেশি টাকা রয়েছে
সেগুলি মনির কাছে দিয়ে দিতে হবে। পকেট থেকে বের করে মনির হাতে বুঝিয়ে দিল।
-তুমি
কিছু রেখে দাও,
না হলে
চলবে কি করে?
-হ্যাঁ
এইতো আমার জন্য দুইশ পাউন্ড রেখে দিলাম। আমি ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দিচ্ছি তবুও
যদি ওরা কেও ঢাকা এয়ারপোর্টে আসতে না পারে তাহলে তুমি একটা ক্যাব নিয়ে চলে যেও, এই যে দেশের টাকাটা
আলাদা করে সামনে রাখ।
লন্ডন
এবং কুয়ালালামপুরের বোর্ডিং কার্ড, হোটেল রিজার্ভেশন কার্ড, পাসপোর্ট সব কিছু মনিকে ভাল করে
বুঝিয়ে দিল। সাবধানে রাখবে। যেখানে যেটা দেখতে চাইবে সেটা দেখিয়ে আবার সাথে সাথেই
ব্যাগে ভরে রেখো। দেখবে কিছু ফেলে দিও না বা ফেরত না নিয়ে চলে যেও না। বিশেষ করে
এই পাসপোর্ট তো জানই এর কি কাজ। এটা হারালে কিন্তু আবার তোমাকে খোঁজার জন্য আমাকে
বের হতে হবে।
-কেন, খোঁজার আর কি দরকার?
-কি যে
বল তুমি! না খুঁজলে আমি মনি পাব কোথায়? আচ্ছা শোন, ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাবে? সকালে আসার আগে কিছু খেতে পারনি।
-না
ক্ষুধা লাগেনি।
-তা হলে
এক সাথে দু কাপ কফি খাই!
-কত
লাগবে?
-কি
জানি, মনে হয় চার পাউন্ডের
মত লাগতে পারে।
বাংলাদেশের
সমান কত হবে?
-চারশো
টাকার মত হতে পারে।
-চারশো
টাকা দিয়ে দু কাপ কফি খাব? থাক আমার কফি খেতে হবে না।
-দেখনা
আশে পাশে চুমুর বাহার দেখ, আমরা তো আর তা পারছি না তাই বলছিলাম এই হয়তো আমাদের শেষ
দেখা তাই ………।
কথা শেষ
করতে না দিয়ে মনি চমকে উঠে বললো
-কি
বললে! শেষ দেখা মানে কি? বল, তুমি এ কথা কেন বললে?
-না মনি, আমি আর কিছু ভেবে
বলিনি। তুমি যাচ্ছ, তোমাকে
যেতে হবে। দেশে আমাদের সন্তানরা রয়েছে তোমাকে ওদের মা, ওদের বাবা হয়ে থাকতে হবে। তুমি
যাও। দেশের প্রতি আমার আর কোন মোহ নেই। জীবনের উপর আমার একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে। বেঁচে
থাকারও কোন উত্সাহ পাচ্ছি না। ওদের জন্য, তোমার জন্য উপার্জন করতে হবে তাই থাকা।
-না
লক্ষ্মী সোনা,
ওকথা আর
মুখে এনো না,
মনেও না।
তুমি আছ ভাল থাক এতেই আমার শান্তি। মেয়েরা জানবে ওদের বাবা আছে আবার ফিরে আসবে সেই
আশায় পথ চেয়ে থকব। তোমাকে যেমন আমার প্রয়োজন আছে মেয়েদেরও তেমনি প্রয়োজন আছে।
তোমাকে সবার জন্য সুস্থ থাকতে হবে। এমন আবোল তাবোল কথা আর ভেবো না।
-মনি, রাশেদ সাহেব ডাকল।
-বল।
-এখানে
যা দেখে গেলে তার থেকে যে শিক্ষা আমরা পেলাম তা ভুলে যেয়ো না, মনে রেখ। দেশে গিয়ে
কাওকে কিছু বলারও দরকার নেই।
-সবাই
তো জিজ্ঞেস করবে, তখন
কি বলব? মেয়েরা যখন জিজ্ঞেস করবে
মেঝ কাকুর বাসায় থাকলে না কেন? তখন কি বলব?
-কি
জানি মনি,
আমার
মাথায় কিছু আসছে না, তুমি
উপস্থিত সময় বুঝে যা হোক কিছু বলে দিও। নিজের চোখে দেখে গেলে টাকার কি প্রয়োজন, টাকা দিয়ে রক্তের
সম্পর্কটাও কি ভাবে মুছে ফেলা যায়। টাকা না থাকলে মানুষের কোন মূল্য থাকে না। যার
টাকা নেই তাকে আর মানুষের প্রয়োজন হয় না। আমার টাকা থাকলে আজ তোমাকে এভাবে ফিরে
যেতে হোত না। অন্তত আর কয়েকটা দিন আমার কাছে থাকতে পারতে, আমি তোমাকে দেখতে পেতাম। আচ্ছা
মনি, এই যে সবাই আমাকে
ত্যাগ করলো তুমি করছ না কেন?
মনি
রাশেদের একটা হাত ধরে বললো,
-তুমি
যে আমার তাই। তুমি এত বোকা কেন, বোঝ না? আমার তো তোমার টাকার দরকার নেই আমার শুধু তোমাকে দরকার।
অনেকের জীবনে অনেক ধরনের সময় আসে, অনেক ধরনের পরীক্ষা এসে উপস্থিত হয়। জানিনা সামনে আমাদের
কেমন দিন অপেক্ষা করছে, যদি তেমন কোন দিন কখনও আসে তাহলে আমি তোমাকে ঝি গিরি করে
হলেও খাওয়াবো। আর তুমি বলছ কিনা তোমাকে ত্যাগের কথা, ছিঃ ও কথা তুমি ভাবলে কি করে? তুমিই আমার সব, আমার পৃথিবী। তুমি
ছাড়া এ পৃথিবীর কি মূল্য আছে, বল। এধরনের চিন্তা কক্ষনো যেন মাথায় আসে না।
-না মনি, আমার সব কিছু কেমন যেন
এলোমেলো হয়ে গেলো, কিসে
কি বলব কি করব মাথায় আসছে না। ধৈর্য ধর, আল্লাহর নাম স্মরণ রেখ, ঠিক ভাবে নামাজ পড়বে, ব্যাগে কোরান শরীফ
রেখে গেলাম মাঝে মাঝে সময় করে পড়বে। এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ গুলি মনে করে
খেও।
হঠাৎ
রাশেদ সাহেব হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল নয়টা বেজে গেছে। এখনি মনিকে সিকিউরিটি গেট
পেরুতে হবে।
-মনি, আর সময় নেই তোমাকে
ভিতরে যেতে হবে।
আস্তে
আস্তে ওরা গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মনিরার এক হাতে ব্যাগ অন্য হাত স্বামীর হাতে
ধরা। ক্রমেই সে হাতে চাপ বেড়ে যাচ্ছে যেন কঠিন ভাবে চেপে ধরে রাখলেই মনি যেতে
পারবে না। গেটের কাছে এসে মনিরা বললো -হাতটা ছাড়।
রাশেদ
চমকে হাত ছেড়ে দেখে মনির ফর্সা হাত লাল হয়ে গেছে।
-যা
বললাম মনে রেখ,
আসি
তাহলে।
মনি
সোজা এগিয়ে গেলো। রাশেদ সাহেবের ঠোট কেপে উঠলো, কিছু বলতে চেয়েও পারলো না, মনি
বেশ কিছু দূরে চলে গেছে। যতক্ষণ দেখা গেলো রাশেদ সাহেব চেয়ে রইলেন। বুকটা
শূন্য হয়ে গেলো,
এতক্ষণ
বুকের মধ্যে কি যেন ছিলো মনি তার সবটাই ফাঁকা করে নিয়ে গেলো। হতবিহবলের মত গেটের
দিকে তাকিয়েই রইল। কতক্ষণ এ ভাবে ছিলো খেয়াল নেই। পাশে দিয়ে যাওয়া এক দল কালো
মানুষের চিৎকারে ওর সম্বিত ফিরে এলো, সামনে দেখল মনি নেই। ঘড়িতে দেখল পৌনে দশটা বাজে। মনি
নিশ্চয় এতক্ষণ ওয়েটিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করছে। ওকে যে অক্সফোর্ড যেতে হবে তা মনেই
নেই। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ, চশমা মুছে নিলেন। এমন সময় দেখতে পেলেন কায়সার বেয়াই মাত্র
ঢুকছে। রাশেদ সাহেবকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-
-বেয়াইন
কোথায়?
-আপনি
এতো দেরি করলেন?
-আরে
বলবেন না আর্লস কোর্ট থেকে চেঞ্জের সময় হিথরোর পিকাডেলি লাইনে না উঠে ভুলে
ডিসট্রিক্ট লাইনে উঠে উইম্বলডনের দিকে চলে গেছিলাম, ফুলহ্যাম পর্যন্ত গিয়ে দেখি এতো
উইম্বলডন যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি
নেমে আবার আর্লস কোর্ট ফিরে এসে পিকাডেলি লাইন ধরে এলাম।
-আমিতো
আপনাকে না পেয়ে ভেবেছি আপনি হয়তো ভিতরে চলে গেছেন, তাই ওকে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে বলে
দিয়েছি ওয়েটিং লাউঞ্জে গিয়ে বেয়াইকে খুঁজলেই পাবে, সে তো কানার মত খুঁজছে আপনাকে। তাহলে
বেয়াই আপনি যান আমাকে আবার অক্সফোর্ড যেতে হবে, আমি তাহলে চলি।
বলেই
পিছন ফিরে বের হবার গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।