কাল পরীর সমাধি [৭]-পর্ব-৭
[ পূর্ব সূত্রঃ পানি পান করে
জলার কিনার ধরে আবেল যেখান দিয়ে পার হচ্ছে বুনো ঘাসের আড়াল দিয়ে তার বরাবর এসে ওত
পেতে রইল। কিনারার কাছাকাছি আসার সাথে সাথে এক লাফ দিয়ে আবেলের গলায় কামড়ে
ধরল।
হাতের ছুরি কিংবা বর্শা কিছুই কাজে লাগাবার সুযোগ পেল না। শুধু একটা চিৎকার করতে
পারল মালাইকা............................................. সমস্ত বন জুরে এই
চিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো মালাইকা, মালাইকা, মালাইকা বলে। পাশের গাছ থেকে কয়েকটা
পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল অজানা আশ্রয়ে।]
১৩।
মালাইকা চলছে তো চলছেই। চাঁদ যখন মাঝ আকাশে এলো তখন এক
মুহূর্তের জন্য থামল। আবেল কি সময় মত বের হতে পেরেছে? না, থামার সময় নেই। চলতে চলতে এক সময় আরযো থেকে বনের মধ্যে দিয়ে যেখানে
মেঠো পথ কোসি গ্রামে এসে মিশেছে ক্লান্ত হয়ে সেখানে এসে পৌঁছল। আকাশের দিকে তাকিয়ে
দেখল চাঁদ পশ্চিম আকাশের মাঝা মাঝি এসেছে। আশেপাশে এদিক ওদিক দেখল কিন্তু কোথাও
তার কেরেল আবেলকে দেখতে পেল না। পথের ধারে একটা
গাছের নিচে বসে কোমরে ছুরির অস্তিত্ব দেখে পরনের পোষাক দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল।
হাতের বর্শা হাতেই আছে। চাঁদ আরও হেলে পরেছে কিন্তু তার আবেল আসছে না কেন? তবে কি ও আসেনি? না না এ হতেই পারে না! এত
দেরি হচ্ছে কেন? এমন হবার কথা নয়! পথে কি কোন বিপদ হয়েছে?
না না, তার আবেলের কোন বিপদ হতে পারে
না। অনেকক্ষণ বসে নানা কিছু ভাবল। চাঁদ আরও পশ্চিমে ঢলে পড়েছে ভোর হতে খুব বেশি
দেরি নেই।
কি করব এখন? অনেক কিছু ভেবে উঠে দাঁড়াল। কোমরের ছুরিটা ডান হাতে নিল বাম হাতে বর্শা। আস্তে আস্তে বনের পথে পা
বাড়াল। এদিকটায় সমতল ভূমি, একটু দূরে দূরে বড় বড় গাছ আর
ছোট ছোট কিছু বুনো ঝোপ। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। দেখতে দেখতে অনেকটা পথ চলে
এসেছে, সামনে এবং আশেপাশে দুই একটা টিলা দেখা যাচ্ছে। চোখ,
নাক, কান সতর্ক রেখে মালাইকা এগিয়ে
যাচ্ছে। একটা টিলার ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে। টিলার উপরে উঠে বনে বসবাস কারিদের অভ্যাস
মত চারিদিকে দেখল। সবই ঠিক আছে আশেপাশে কিছু নেই। আবার এগিয়ে যাচ্ছে। একটা টিলা
পার হয়ে এসেছে কিন্তু এখনও আবেলের দেখা নেই। কোথায় গেল? ভাবতে
ভাবতে লক্ষ করেনি তার পিছনে স্বয়ং রাজা তাকে অনুসরণ করছে। রাজারা এভাবেই নিঃশব্দে
শিকারের পিছনে অনুসরণ করে। সামনের টিলার উপরে উঠে পাশের একটা বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে
এদিক ওদিক দেখে নিল।
পিছন থেকে বাতাস আসছে। সবগুলা
ইন্দ্রিয় সজাগ, পিছনে ঘুরে দাঁড়াল। কেমন যেন গন্ধ আসছে! হ্যাঁ তাইতো, রাজা মশাই! যে পথ পেরিয়ে এসেছে সেদিকে তাকাতেই দেখল একটু
দূরে রাজা মশাই দাঁড়িয়ে। পিছনে পিছনে আসছিল ওকে থামতে দেখে ওটাও থেমে গেল। সঙ্গে
সঙ্গে হাতের দুই অস্ত্র নিয়ে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হলো। কি করবে এখন? কাটা বাবলা গাছে ওঠা যাবে না, বোঝাই কাটা। ক্ষুধার্ত রাজা মশাই অনেকক্ষণ এক ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঘাড়ের কেশর ফুলে উঠেছে। শিকার ধরার জন্য প্রস্তুত। এক পা
এক পা করে এগিয়ে আসছে আর মালাইকাও তার অস্ত্র গুলি শক্ত হাতে ধরে প্রস্তুত। দ্রুত
গতিতে শ্বাস প্রশ্বাস চলছে, দুরন্ত
গতিতে বুক ওঠা নামা করছে, কপাল
বেয়ে ফোটা ফোটা ঘাম ঝরছে। জীবন মরণের লড়াই সামনে অপেক্ষা করছে। বন দেবতার নাম
স্মরণ করে মন্ত্র পড়ছে। ভোরের আলো ফুটে উঠতে চাইছে। রাজা মশাই আরও একটু কাছে এসে
আবার দাঁড়াল। দুইজনেই চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। কে আগে কাকে আক্রমণ করবে! অনেকক্ষণ
এভাবেই কেটে গেল। মালাইকা কোন অবস্থাতেই আগে আক্রমণ করবে না। ওর আক্রমণের অপেক্ষায়
প্রস্তুত। ও লাফ দেয়ার সাথে সাথে ডান হাত সহ ছুড়িটা আস্ত মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিবে,
সম্ভব হলে বর্শাটা গলায় গেঁথে দিবে তারপরে
যা হবার হবে।
দম বন্ধ করা মুহূর্ত কাটছে কিন্তু
কেও কাওকে আক্রমণ করছে না। ওর দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাবার কোন পথ নেই। মালাইকা একটু
এদিক সেদিক করলে বা অমনোযোগী হলে সাথে সাথেই লাফ দিবে! ভয়ংকর অপেক্ষায় দুই প্রাণী
শুধু আক্রমণের ক্ষণ গুনছে। যে কোন মুহূর্তেই ঘটবে একটা ভয়ংকর কান্ড। হঠাৎ পিছনের
পা দুইটা একটু নিচু হতেই মালাইকা মাথাটা বাম দিকে কাত করে ডান হাতের ছুরি বাড়িয়ে
দিল আর ওমনিই দেখল ওর ডান হাত রাজা মশাইয়ের মুখের ভিতর ঢুকে গেল সঙ্গে সঙ্গে
ছুরিটা ছেড়ে দিয়ে বাম হাতের বর্শাটা দিয়ে গলায় এক পার বসিয়ে দিল, সামনের থাবার ধাক্কা লেগে মালাইকা পরে যেত কিন্তু
বর্শাটা গভীর ভাবে গেঁথে গেছে এবং বর্শার এক প্রান্ত মালাইকার হাতে ধরা রয়েছে বলে
পড়ল না তবে এক পায়ের থাবা বুকে গেঁথে এক তাল মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেল। সেদিকে
ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে টেনে বর্শা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার গেঁথে দিল পেটের
ভিতরে। সিংহটা মুখের ভিতরে বেধা ছুরি নিয়ে এবং মুখের ভিতরে গলায় আঘাত পেয়ে বিকট এক
হুংকার দিয়েই পড়ে গেল। যা হবার মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেল। মালাইকা লাফ দিয়ে একটু
দূরে দাঁড়াল এবং আহত সিংহ আবার লাফ দিয়ে উঠে ওর দিকে আর এক লাফ দিল কিন্তু সঙ্গে
সঙ্গে মালাইকা সরে দাঁড়াল আর ওটা একটু দূরে আছড়ে পড়ল। এত কিছু করেও মালাইকা রক্ষা
পেল না। পিছনেই যে রানী আসছে সেটা মালাইকার চোখে পড়েনি। রানী এসে তার সাথীকে এভাবে
বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখেই এক লাফ দিয়ে মালাইকার ডান কাধে কামড়ে ধরে দৌড়ে চলল। পা
গুলি মাটিতে হেচড়ে যাচ্ছে।
১৪।
ভোরে ওবি আর রামলা ঘুম ভেঙ্গে
বাইরে এসে আবেলকে ডাকাডাকি করেও কোন সারা না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে দরজা খোলা এবং আবেল
ঘরে নেই। ভাবল হয়ত আশেপাশেই কোথাও আছে। কিন্তু বেলা বাড়ছে অথচ আবেলের কোন দেখা নেই
তখন ভাবল কি ব্যাপার আবেলের কি হলো কোথায় গেল? কখনও এমন হয় না। এর মধ্যে গ্রামের একজন ঘাটের দিক থেকে ওদের বাড়ির কাছে
দিয়ে যাবার সময় ওবিকে ডেকে বলল
ভেলাটা নিয়ে ওপাড়ে গেল কে?
কেন, কি হয়েছে?
ভেলাটা দেখলাম ওপাড়ে রয়েছে!
ওপাড়ে কে যাবে! কই আমাকে কেও কিছু
বলেনি তো কে গেছে? তবে আবেলকে খুঁজে পাচ্ছি
না!
তাহলে কি আবেল গেছে নাকি?
কি জানি আবেলের ওপাড়ে কি কাজ
থাকতে পারে, ও একা কেন ওখানে যাবে?
আবেলের মা অস্থির হয়ে বলল
দেখ খুঁজে দেখ আমার মনে হয় আবেলই
ওপাড়ে গেছে
আগন্তুক একটু উপযাচক হয়েই বলল
আমার মনে হয় সবাই মিলে একবার
খুঁজে দেখলে হয় না? কেওতো নিশ্চয় গেছে কিন্তু
কে গেছে আমরা জানতে পারছি না কাজেই একবার দেখি, আমি যাই সবাইকে ডেকে আনি। কি বল ওবি?
যাবে?
নিজের ছেলের কথা ভেবে বলল
চল তাহলে দেখি কি ব্যাপার!
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত গ্রাম জড়
হয়ে গেল। সবার সাথে নানা রকম অস্ত্র, মশাল এবং যা যা নিয়ে বনে যেতে হয় সব কিছু নিয়ে ওবির বাড়ির পাশে হাজির।
চল সবাই নদীর ঘাটে চল
এর মধ্যেই একজন সাতরে যেয়ে ওপাড়
থেকে ভেলাটা নিয়ে এসেছে।
ভেলায় করে নদী পার হয়ে হৈ হৈ করে
হাঁক ডাক ছেড়ে মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে এগিয়ে চলল। বনের ডালপালা লতাপাতার এলোমেলো ভাব
দেখে ওরা বুঝে নিল কেও একজন খানিক আগে এই পথে গেছে। সন্দেহ দূর হলো। কেও বনে এসেছে
কিন্তু কেন এবং কোথায়? দিনের আলোতে ভাঙ্গা
ডালপালা আর ছেড়া লতাপাতার চিহ্ন ধরে দল এগিয়ে চলছে। বনের পথ শেষ হলো, এবার পায়ের ছাপ খুজে পেল। পায়ের ছাপ দেখে
দেখে টিলার উঁচু নিচু পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় সেই গাছটার কাছে এসে পায়ের ছাপ
থেমে গেল। পায়ের ছাপ এখানে ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে সম্ভবত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল
না। গাছটার নিচেই বেশী ছাপ। গাছের উপরে দেখল, না গাছে ওঠার কোন চিহ্ন নেই। পথের
বাইরে আশে পাশে ছোট দুর্বা ঘাস, এখানে বুঝতেই পারছে না এর পরে পায়ের ছাপ কোন দিকে
গেল। ওবির সিদ্ধান্তে ওরা সামনেই এগিয়ে যাবার পথ ধরল। বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে ওই
জলাভূমি পার হয়ে একটু এগিয়ে সামনে দেখল পথের উলটা দিক থেকে একটা কিছু টেনে নেয়ার
দাগ এসে ডান দিকে গেছে, মাঝে
মাঝে তাজা রক্ত। এই চিহ্ন ধরেই পথ ছেড়ে ডান দিকে এগিয়ে গেল দলটা। পথ ছেড়ে একটু
এগিয়ে সামনের টিলার উপরে উঠে দেখল পরের টিলার উপরে বেশ কয়েকটা ছোট বড় গাছের নিচে
পাঁচ ছয়টা সিংহ বসে আছে। ওদের হৈ চৈ শুনে প্রায় সবাই উঠে দাঁড়াল। সিংহের স্বভাব
সুলভ গম্ভীরতা নিয়ে এদিকে তাকিয়ে দেখছে। কয়েক জনে তীরের মাথায় বাধা ঘাসের গোলায়
আগুন ধরিয়ে ধনুক দিয়ে ওদের দিকে ছুড়ে মারল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই তীর ছোড়া হলো, দুই
একটা সিংহের গায়েও লেগেছে। এতে কাজ হয়েছে। একে একে প্রায় সবাই ওই দিকে চলে গেল।
ওবির দল এগিয়ে কাছে গিয়ে দেখে একটা ছেলের উপরে একটা মেয়ের দেহ পড়ে রয়েছে। ছেলেটার
পিঠ থেকে নিচের অংশ প্রায় খেয়ে ফেলেছে।
ছেলেটার রক্ত মাখা মুখ দেখে চিনতে পারল আবেল। কিন্তু মেয়েটা কে? দুইজনে মিলে রক্তাক্ত মেয়েটাকে ধরে দেখল এখনও শরীর গরম, বুঝল
মেয়েটা এখনও জীবিত। কোলে তুলে দেখল বুকের এক পাশে হাড় দেখা যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করল তুমি কে? ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে পারল আমি মালাইকা আমার আবেলকে দেখেছ?
এই ঘটনার কয়েকদিন পরে কোসি থেকে
একদল লোক আরযো এসেছিল তারা জানাল পথে একটা সিংহ মরে পরে রয়েছে তার মুখের ভিতরে
সম্ভবত একটা ছুরি।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।