কাল পরীর সমাধি [৭]-পর্ব-৬
[পূর্ব সূত্রঃ মামার কোন ছেলে
মেয়ে নেই ইচ্ছে হলে ওখানেই থাকব কিংবা পরে যদি তোমার ভাল না লাগে তাহলে আমরা
আরযোতেও ফিরে আসতে পারি তবে এখানে আর নয়।
খারাপ বলনি। তাহলে আমি বাড়ি ফিরে যাই। আর
মাত্র দুই রাত পরেই পূর্ণিমা।
এবারে এখানে কেন এসেছে সে কথা বলে বলল তুমি
বুজিবাকে বলবে আমি কেন এসেছিলাম এবং কখনও দরকার হলে বাবাকে খবর দিতে যেন ভুলে না
যায় সে কথা মনে করিয়ে দিও।
সে যা বলার আমি বলব এ নিয়ে তোমাকে চিন্তা
করতে হবে না।]
১১।
ভরা পূর্ণিমার রাত। আটনাগো গ্রামে বুজিবার
বাড়িতে সন্ধ্যার একটু পরে প্রতিদিনের মত সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার ঘরে শুয়ে পড়েছে।
মালাইকাও এসে ওর ঘরে শুয়ে মা বাবার নাক ডাকার অপেক্ষা করছে। একটু পরেই মা বাবা
দুইজনেরই নাক ডাকার শব্দ পেয়ে উঠে ঘরের বাইরে এসে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখল। সব ঠিকঠাক
আছে। দুই ফালের একটা অত্যান্ত ধারালো ছুরি আর একটা বিষ মাখা বর্শা আগেই লুকিয়ে
রেখেছিল। এবার ছুরিটা কোমরে গুজে নিল আর বর্শা হাতে এসে বাড়ির বাইরে বাবলা গাছের
নিচে দাঁড়াল। ডাইনে বায়ে ভাল করে দেখে
নিল। জোসনা রাতে সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখে নিশ্চিত হয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকাল।
এ বাড়িতে এই তার শেষ পায়ের চিহ্ন। এর পরে তাকে আর এখানে কেউ দেখবে না। শৈশবের
স্মৃতি জড়ান অনেক কথা ঝরের মত মনে আসল। এই বাবলা গাছেরও কত স্মৃতি জড়ান আছে তার
জীবনে কিন্তু এখন আর সে সব মনে করার কোন উপায় নেই। তাকে এখন যেতে হবে অনেক দূরে
যেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করবে তার কেরেল। সে এখান থেকে চলে গেলে রক্ষা পাবে
অনেকগুলি জীবন। গ্রামের শান্তি বজায় থাকবে, কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে
না, কেউ আর উত্তেজিত হবে না। সারা গ্রাম জুরে ফিসফিস কানাকানি বন্ধ হয়ে যাবে। আগের
মত সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। প্রথমে উলটো পথে গ্রাম থেকে বের হতে হবে। বাড়ি থেকে বের
হয়ে বায়ের চরাই উৎরাই রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে আবার বায়ে মোড় নিয়ে আরও কিছু হেঁটে
গ্রামের বাইরে এসে সোজা হাঁটা শুরু করল পাহাড়ের দিকে। বুক ঢিপ ঢিপ করার মত মেয়ে
মালাইকা নয়। সে একা একটা নেকরে বাঘ মেরে বীরের পরিচয় দিয়েছে। এই মেয়েকে কি ভয় পেতে
আছে?
সামনে পাহাড়ের উপরে উঠে এসে আবার সামনে দেখে
পথ খুঁজে নিল। জোসনা রাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে ছোট বড় নানা আকারের
পাহাড়,
কখনও পাহাড়ের উপর দিয়ে, কখনও পাহাড়ের
ঢাল বেয়ে আবার কখনও দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলা পথ। কোথাও পাথুরি পথ কোথাও বালু আবার কোথাও হালকা ঘাস মানুষের
চলাচলে মসৃণ হয়ে আছে। মালাইকা চলছেতো চলছেই, চিতা বাঘের
মত দৌড়ে চলছে। তাকে যেতে হবে অনেক দূরের কোসি গ্রামে যেখানে আরযো গ্রামের দেদেসা
নদীর পাড় থেকে বনের ভিতর দিয়ে বুনো পথ এসে মিশেছে। যে পথে আসবে তার কেরেল। পথ
হারালে চলবে না। পথের মাঝে প্রতিটা পাহাড়ের উপরে উঠেই আগে দেখে নিচ্ছে তার পথ ঠিক
আছে কি না এই ফাকে হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছে।
১২।
আরযো গ্রামে আজও আগের সব পূর্ণিমার মত পূর্ব
আকাশে ভরা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। চারিদিকে চাঁদের আলো খৈ খৈ করছে। দূরে, অনেক দূরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়। গ্রামের মাঝখানে বসেছে নিয়মিত
নাচ গান আর পানের আসর। নারী পুরুষ সবাই এসেছে। কেও নাচছে, কেও গাইছে, কেও বাজাচ্ছে আবার কেও দেখছে এবং
কাটি কালা, তেলা পান করছে। আবেলের মা এবং বাবাও এদের সাথে কোথাও মিশে আছে। বাড়িতে
একা আবেল শুধু প্রহর গুনছে আর স্বপ্ন দেখছে। মালাইকা কি বাড়ি থেকে গ্রাম থেকে বের
হতে পেরেছে? রাতের পথ কি ঠিক মত চিনে আসতে পারছে? এখানে আকাশ ভরা জোসনা, আটনাগো গ্রামেও কি এমনি
জোসনা উঠেছে? প্রিয়তমা মালাইকা কি পথ দেখে চলতে পারছে?
সাথে দুই একটা অস্ত্র আনতে ভুল করেনিতো? মনে কত প্রশ্ন আসছে
যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাবা মা আসরে গেলে পরে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে এসেছে ভেলাটা ঠিক
আছে কি না। না থাকলেও অসুবিধা নেই এইটুক নদী সাতরেই পার হতে পারবে। নদীতে দুই একটা
ঘড়িয়াল আর গুই সাপ ছাড়া তেমন কিছু নেই। কুমির এখানে মোটেই নেই। বনের পথে যাবার
জন্য বিষ মাখা একটা বর্শা আর তার প্রিয় একটা ছুরি রেডি করে রেখেছে। বনে চলার
মন্ত্র আওড়ে দেখছে মনে আছে কি না। চাঁদটা যখন ঠিক মাথার উপরে আসবে তখনই বাড়ি থেকে
বের হতে হবে। বাবা মা এসে ডেকে কোন জবাব না পেলে ভেবে নিবে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে
উঠে খোজ হবে ততক্ষণে তারা নিকেমতার পথে থাকবে।
এমনি সব ভাবনায় মগ্ন হয়ে বাড়ির উঠানে
পায়চারী করছে আর চাঁদটা মাথার উপরে আসার অপেক্ষা করছে। এক সময় দূরে বনের দিকে একটা
রাতের পাখি ডেকে উঠল। তার শব্দে আবেলের ধ্যান ভেঙ্গে গেল। আকাশে তাকিয়ে দেখে
চাঁদটা ঠিক মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। এইতো! বের হবার এটাই উপযুক্ত সময়। এখনও মা
বাবা ফিরে আসেনি। তাদের ফিরে আসতে আরও কিছু সময় লাগবে। আর দেরি না করে এখনই বের
হতে হবে। মায়ের ঘরে ঢুকে মাটির পেয়ালা ভরে একটু পানি খেয়ে বন দেবতার নাম স্মরণ করে
অস্ত্র গুলি সাথে নিয়ে বের হলো।
নদীর ঘাটে এসে ভেলায় চড়ে এ পাড়ে এসে আবার বন
দেবতার নাম স্মরণ করে ভেলা থেকে বনের পথে পা নামাল। এই পথে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে
প্রায় আধা মাইলের মত যেতে হবে তারপরে মাইল খানিক রুক্ষ উঁচু নিচু টিলা মাঝে মাঝে
কিছু বড় বড় গাছ আর সামান্য কিছু ঝোপ, তারপরে আধা মাইলের মত
সমতল পথ। এদিক ওদিক দেখে ঝোপ ঝাড়ের ডাল পালা লতা পাতা সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে। বনের মধ্যে নানা রকম শব্দ কানে আসছে। সিংহ, বাঘ,
হাতি, বানর এবং আরও নানা পশু পাখির
নানান শব্দ। কোনটা কাছে থেকে আবার কোনটা দূর থেকে। এখানে ঘন জঙ্গল বলে জোসনার আলোয়
পথ আলোকিত হতে পারছে না তবুও মিনারের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা তাই রাতের অন্ধকারেও
নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘন ঝোপ ডিঙ্গিয়ে বেশি এগুতে পারছে
না। মনে শুধু একটাই ভয় কি জানি মিনার এসে কতক্ষণ অপেক্ষা করে! তার এসে পৌছার আগেই
কোসি পৌছাতে হবে।
এক সময় ঘন জঙ্গল এলাকা পার হয়ে এলো। এখন
শুরু হলো উঁচু নিচু টিলার উপর নিচ দিয়ে পথ। পথে আবার কিছুদূর পানিও আছে। তবে এখানে
জোসনার আলো পাচ্ছে। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সাবধানে সামনে এগুতে হচ্ছে। চোখ, নাক, কান এবং অনুভূতি সহ সমস্ত ইন্দ্রিয় সতর্ক
রাখতে হচ্ছে। একটু দাড়িয়ে গন্ধ শুকে দেখল, আশেপাশে কোন
হিংস্র প্রাণীর গন্ধ পাচ্ছে না। দূর থেকে রাজার হুংকার কানে এলো তবে কোন দিক থেকে
এসেছে বুঝতে না পেরেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। সামনে ওটা কি?
রাজার (সিংহ) মত মনে হচ্ছে! হ্যাঁ তাইতো! পা টিপে টিপে ডান পাশের
বড় গাছটার আড়ালে দাঁড়াল। মন্ত্র পড়ছে। গাছের উপরে দেখে নিল কোন চিতা গাছের ডালে
বিশ্রাম নিচ্ছে কিনা। বনের নিয়ম হলো রাজা মশাইয়ের নাম মুখে আনতে নেই। সে এদিকেই
এগিয়ে আসছে। একটা। একটু পরেই আরও দুইটা। এখানে নিরাপদ নয় কিন্তু কোথায় যাবে?
যে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছে ওটায় উঠবে? বাতাস
উলটো দিক থেকে আসছে বলে সে ওদের গন্ধ পাচ্ছে তবে ওরা এখনও ওর গন্ধ পায়নি। গাছে
উঠলে নিচে দিয়ে যাবার সময় গন্ধ পাবে। আর তাই যদি হয় তাহলে সারা রাত এমনকি ও নিচে
না নামা পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে এবং এর মধ্যে দুই এক জনে গিয়ে অতিথি
নিমন্ত্রণ করে আনবে। কি করা যায়? পিছনে ঘুরে দৌড় দিবে?
তাহলে এখানে এলেই গন্ধ পাবে আর সেই গন্ধ শুকে শুকে ও যেখানে আছে
সেখানেই চলে যাবে। তাহলে কি করা যায়? গাছেই উঠি! দরকার হলে সাত দিন গাছেই বসে থাকব। না, এটা হবে মারাত্মক সিদ্ধান্ত! তা হলে?
আচ্ছা, বাতাস বামদিক থেকে
কোণাকুণি ভাবে আসছে কাজেই পথ ছেড়ে ডানে ঘুরে গেলেই আর গন্ধ পাবে না। ভাবা মাত্রই
সিদ্ধান্ত, এটাই এক মাত্র পথ। সঙ্গে সঙ্গে পথ ছেড়ে ডান
দিকে নিঃশব্দে দৌড়ে সোজা চলে গেল প্রায় মাইল খানিক। ওরা আস্তে আস্তে আসছে তাই
অতক্ষণে ওর গন্ধ ওখানে থাকবে না। যত দূরে গেলে ওর গন্ধ পাবে না অন্তত অতখানি-তো
যেতেই হবে! এখানেও সামনে কি যেন দেখে একটু থামল। সামনে মনে হচ্ছে এক পাল হাতি।
পিছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। হাতিগুলি বেশ অনেকগুলি গাছের পাশে কেও দাঁড়িয়ে
কেও বসে। হাতি অন্তত পিছনে দৌড়াবে না। নিরাপদ মনে করে এবার এগুতে আরম্ভ করল। এবার
পথের কাছে আসতে হবে। আস্তে আস্তে বায়ে কোণাকুণি ভাবে পথের দিকে এগুচ্ছে। সামনে
ডানে বায়ে সমান দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে বুঝতে পারছে না পথ আর কত
দূরে। হাতির পাল যেমন ছিল তেমনই আছে ওদের কোন বিকার নেই। সামনের যে টিলা ওতে উঠে
দেখতে হবে পথ কোন দিকে এবং কত দূরে। এগিয়ে যাচ্ছে। টিলার উপরে উঠে চমকে উঠল। এ কি?
এখানেও সামনে বায়ের টিলার উপরে এক পাল রাজা বসে আছে! সম্ভবত
ওখানে যাদের দেখেছে তাদের দলেরই হবে। এদের সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না।
মহা সমস্যা! আকাশের চাঁদের দিকে দেখল, এর মধ্যেই পশ্চিম দিকে অনেকখানি নেমে এসেছে। হাতে সময়ও বেশি নেই।
তাড়াতাড়ি একটা কিছু করতে হবে। মালাইকা এসে কোথায় অপেক্ষা করবে? সামনের পথ বন্ধ। আবার কি ডান দিকে বনের ভিতর এলোপাথাড়ি পথে ঘুরে যাব?
দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ভাবল। কোন বুদ্ধি খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ খুব
শীগগিরই কিছু একটা করতে হবে। একা একজন রাজা হলেও সামনা সামনি যুদ্ধ করা যেত কিন্তু
এরা রয়েছে দল বেধে। দলের সাথে কিছুতেই পেরে ওঠা সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতেই চারিদিকে
দেখল। মুখে আঙ্গুল দিয়ে থুথু দিয়ে ভিজিয়ে বাইরে এনে সামনে ধরে দেখল বাতাস বাম দিক
থেকেই আসছে এখনও। দেরি না করে আবার ডান দিকে দৌড় শুরু করল। কিছুদূর যেতেই সামনে
দুই টিলার মাঝে এক জলাভূমি পরল। কিনারের বুনো ঘাস পাড় হয়ে পানির উপর দিয়েই হাঁটছে।
লক্ষ করেনি যে ওপাড়ে ডান দিকে একটু দূরে ঝোপের পাশে রাজা রানী এক সাথে পানি পান
করছে। আবেল একটু অসাবধানে পানিতে পা ফেলার সাথে সাথে যে শব্দ হলো এই শব্দই হলো
কাল। রাজা রানী দুই জনেই এই দিকে তাকিয়ে দেখল আবেল এ পাড়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। পানি
পান করে জলার কিনার ধরে আবেল যেখান দিয়ে পার হচ্ছে বুনো ঘাসের আড়াল দিয়ে তার বরাবর
এসে ওত পেতে রইল। কিনারার কাছাকাছি আসার সাথে সাথে এক লাফ দিয়ে আবেলের গলায় কামড়ে
ধরল। হাতের ছুরি কিংবা বর্শা কিছুই কাজে লাগাবার সুযোগ পেল না। শুধু একটা চিৎকার
করতে পারল মালাইকা............................................. সমস্ত বন জুরে এই
চিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো মালাইকা, মালাইকা,
মালাইকা বলে। পাশের গাছ থেকে কয়েকটা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল
অজানা আশ্রয়ে।
[শেষ পর্যন্ত কি মালাইকা তার
আবেলের কাছে পৌছাতে পারবে?]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।