৯৮।
আম্মাকেই
আসতে হয়েছিলো বৌ নামাবার জন্যে। উপরে যেতে যেতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। সেঝ
মামি রাত জাগা বৌয়ের শাড়ি, ওড়না, মাথার খোপা ঠিকঠাক করে মুখের মেকআপ রি টাচ করে আম্মার
সামনে নিয়ে গেলে আম্মা
বৌয়ের হাত ধরে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন-
-এই হলো
আমার অবোধ,
যে নিজের
ভাতটাও মাখিয়ে খেতে পারে না, লবণ ঠিক আছে কিনা বুঝে না। এতদিন আমি দেখে রেখেছি আজ থেকে, এখন থেকে তুমি দেখবে।
এর দায়িত্ব তোমার বলে ছেলের হাত তুলে দিয়েছিলেন বৌয়ের হাতে।
নতুন
বালিকা বৌ মনিরা অবাক হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। বিয়ের পরের দিনেই
দুপুরে খাবার টেবিলে বাবা, ভাইবোন সহ সবাই খেতে বসেছে। রাশেদ সাহেব প্লেটে ভাত নিয়ে
নাড়াচাড়া করছিলেন। মা সেটা লক্ষ্য করে বৌকে রান্না ঘরে ডেকে বলেছিলেন তুমি ওর
প্লেট থেকে একটু ভাত মুখে দিয়ে দেখত। সত্যিই মার কথা মত সেই প্লেট এনে একটু লবণ আর
একটু ঝোল নিয়ে মেখে তার সামনে দিয়েছিলেন এর পর দিব্যি তা খেয়ে নিয়েছিলেন। তাই দেখে
মা বললেন দেখলে তো!
এর কয়েক
দিন পর বিকেলে শাহিনের বাসায় গিয়েছিলো, গিয়ে দেখে সেখানে বন্ধুরা দশ বারো জনে মিলে রাজকীয় হালে
গাজার আসর বসিয়েছে। গোলাপ জলে ধোয়া কলকি, ছিপি, রংপুর থেকে আনা গাজা বিশেষ কাতানি দিয়ে কাটা। গোলাপের
শুকনো পাপড়ি মেশানো গোলাপ জলে গোলা তেঁতুল কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি টিকার আগুন। চলছে, সবাই নেশায় বিভোর হয়ে
আছে।
শাহিন বললো
-আরে
রাশেদ ঠিক সময় মত এসেছ, নাও ধর টান দাও।
-না
না কি বল,
আমার বৌ
টের পাবে।
-কিচ্ছু টের পাবে না, নাও ধর।
-শাহিন, তুমি যাকে এনে দিলে
তুমি চেন না তাকে?
-কি
যে বল রাশেদ,
কিচ্ছু
টের পাবে না টেনেই দেখ কি জিনিস। এক ছিলিমে যেমন তেমন, দুই ছিলিমে মজা, তিন ছিলিমে উজির নাজির, চার ছিলিমে রাজা। তো
তুম আজ রাজা বনকে বিবিকা পাস যাওগে অওর উসকো রানী বানা দেওগে। নাও নাও ধর, টান দাও।
যাই হোক
চাপাচাপিতে কয়েকটা টান দিয়েছিলো। এর পর পুরনো ঢাকার মিষ্টি আর চা, একেবারে সোনায় সোহাগা। নেশা ধরে
গিয়েছিলো। চোখ লাল টকটকে, মুখে কথার ফুলঝুরি, কণ্ঠ গম্ভীর, পা টলমল। বাসায় এসে
পরবি তো পর মায়ের সামনে। মা ই দরজা খুলেছেন। মুখের দিকে তাকিয়েই কিছু না বলে হাত
ধরে টেনে সোজা রান্না ঘড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন-
-কোথায়
গিয়েছিলি,
তোর চোখ
লাল কেন?
-কোথায়
আবার যাব বলে গেলাম না শাহিনের বাসায় যাচ্ছি। মোটর সাইকেল চালিয়ে
এসেছি চোখ তো লাল হবেই, বাতাস ছিলো আর চশমা নেই নি।
-চশমা
নিসনি তো তোর চোখে এটা কি?
আর কোন
কৈফিয়ত দিয়ে লাভ নেই, মাথা
নিচু হয়ে গেছে। মা বলেছিলেন, সেই নেশার মধ্যেই এখনও মনে আছে। আজ কাল তোদের মত ছেলেরা
যেখানে সেখানে গাজা খায়, খবরদার আর যেন কোন দিন দেখি না, ঘরে বৌ এনেছি, পরের মেয়ে। মার কাছ
থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের ঘড়ে যেতেই মা যেভাবে হাত চেপে ধরেছিলেন ঠিক সেই একই কায়দায়
বৌও হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিলো-
-মা
কি বললো?
-কি
বলবে আবার,
কিছু না।
-কিছু
না যদি তবে রান্না ঘড়ে নিয়ে গেলো কেন? তোমার চোখ লাল কেন? গায়ে এমন কড়া তামাকের গন্ধ কেন? তোমার কণ্ঠ এত গম্ভীর
কেন?
রাশেদ
সাহেব কত কেনর জবাব দিবেন? স্বীকার করলেন।
-শাহিনদের
বাসায় গিয়েছিলাম, ওখানে
ওরা রাজকীয় ভাবে গাজার আসর বসিয়েছিলো, ওরা চাপাচাপি করেছে বলে লোভ হলো তাই
একটু..............................
-তাই
একটু টান দিয়েছ?
-হ্যাঁ।
সাথে
সাথে স্বামীকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো মনি।
-তুমি
গাজা খেয়েছ বলে কষ্ট পেলেও খুব শান্তি পেলাম যে তুমি আমাকে লুকবার চেষ্টা করনি, মিথ্যা বলনি, স্বীকার করেছ। যাক, যা হয়েছে তা হয়েছে। ঐ
ভাবে বুকে জড়ানো অবস্থায়ই গালে চুমুর পর চুমু খেয়ে বললো আমার সোনা মানিক, আমি তোমার কাছেই এসেছি, এ বাড়িতে তুমিই আমার
আশ্রয় বল আর যাই বল সবই তুমি, তোমার কিছু হলে আমি যে ধুলোয় মিশে যাবো। আর কখনো এমন খেয়ো
না, মনে থাকবে?
-হ্যাঁ
থাকবে।
তার পরে
আর কখনো রাশেদ সাহেব তেমন কিছু করেনি। কিছু দিন যাবার পর আস্তে আস্তে রাশেদের
কার্যকলাপ দেখে মনিরা বলেছিলো-
-তোমাকে
এতদিন দেখে যেরকম মনে হয়েছে তুমি সেরকম নও।
-কেন, আমাকে আবার কেমন মনে
হয়েছে?
-তুমি
একে বারে শিশুর মত নাদু গোপাল। এতো দিন তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার চলাফেরা দেখে মনে হোত তুমি
খুব কঠিন মানুষ।
-ঠিকই
বলেছ। কঠিনই,
তবে
বাইরে, তোমার কাছে নয়। তোমার
কাছে আমি যেন কেমন হয়ে যাই।
-আহারে
আমার নাদু গোপালরে! থাক, তুমি এমন করে আমার নাদু গোপাল হয়েই থেকো। আমি তোমাকে সারা
জীবন এই ভাবেই বুকে করে রাখবো।
বাইরে
থেকে ফেরার পর মা বৌকে ডেকে বলতো বৌমা তোমার নাদু এসেছে যাও খাবার রেডি কর। তো সেই
মনিরা, যার বাবা মা ভাই বোন
সবাই ডাকে মনিরা বলে সেই মনিরা আজ তার মনি, তার নয়ন মনি। যাকে ছাড়া সে একটা
পা ও ফেলতে পারেনা, এক
কাপ চা খেতে হলেও মনি দেখে না দিলে সে চা রাশেদ সাহেব খেতে পারেনা। মনি তাকে সব
দিয়েছে। মায়া মমতা, সোহাগ, আদর যত্ন, প্রেম ভালোবাসা, মন প্রাণ, জীবন সব দিয়েছে। উজাড়
করেই দিয়েছে। তার সব কিছু বুঝেও নিয়েছে। কখন ক্ষুধা লেগেছে, কখন পানি খাবে, কখন চা খাবে, কখন শীত লাগছে মুখের
দিকে তাকিয়েই সব বুঝতে পারে। বাইরে থেকে রাশেদের ফিরতে দেরি হলে মনি তার সার্ট
গায়ে বাড়িতে ঘুরত, রান্না
ঘড়ে মার কাছে বসে থাকতো। মা জিজ্ঞেস করতো বৌমা কি গায়ে দিয়েছ? কেন দেখছেন না আপনার
নাদুর জামা,
দেখেন
আপনার নাদুর গন্ধ বলেই মার নাকের সামনে নিয়ে ধরত। বালিকা বৌয়ের কাণ্ড দেখে মা হাসতেন। বাড়ির কাজের মেয়েটা দাঁড়িয়ে
আছে, ধোয়ার জন্য কাপর নিতে
আর মনিরা ময়লা কাপড়ের ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে তার গেঞ্জি, মুজা, আন্ডার ওয়ার আলাদা করে রেখে বাকি
কাপর গুলি কাজের মেয়ের হাতে দিতে দেখে রাশেদ জিজ্ঞেস করেছে-
-ওগুলি
আলাদা করে রাখলে কেন?
-ওগুলি
ওদের কাছে দেই না, ওগুলি
আমি ধুই।
-কেন?
-ওগুলি
সরাসরি তোমার গায়ে লেগে থাকে তাই তোমার গায়ের ছোঁয়া অন্য কারো হাতে দিতে আমার ভালো
লাগেনা।
ধীরে
ধীরে কখন যে এই মনি তার সমস্ত মন প্রাণ জুড়ে নিয়েছে সে কথা তখনই বুঝে যখন মনি
একটুক্ষণের জন্য কাছে থাকেনা, মনে হয় বাড়িতে সবই আছে শুধু প্রাণ নেই। মনি তার জন্য তার
মায়ের কাছে যেয়েও দুই দিন থাকতে পারেনা। আমার নাদু কি করছে কে জানে, না মা আমি কালই চলে
যাব। তোমার জামাই আসতে পারলে আর দুই এক দিন থাকতে পারতাম। জানো না মা সারা
আলমারিতে একটা সার্ট খুঁজে পাবে না, আলনা থেকে প্যান্ট খুঁজে পাবে না, জুতা পাবেনা মুজা পাবেনা। সেবারে
আলমারির ড্রয়ারে টাকা রেখে এসেছিলাম সে টাকা খুঁজে না পেয়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা
নিয়ে চলেছে। গোসল করতে যাবে টাওয়েল নিতে ভুলে যাবে, নয়তো লুঙ্গি নিতে ভুল হবে। ক্ষুধা
লেগেছে কিনা তাও মাকে বলবে না। বলবে কি, বুঝলে তো বলবে? মা যাই হোক ডেকে খাইয়ে
দিলে খেয়ে বিছানায় শুয়ে বা সোফায় বসে বই পড়বে আর কিছু করবেও না কোথাও যাবেও
না। বড় আপা দুঃখ করে বলে তুই দুই এক দিন আমার কাছে এসে থাকিস না কেন? মনি বলেছে আমি এখানে
এসে থাকবো আর তোমরা আমাকে যে পাগল গছিয়ে দিয়েছ সে পাগল দেখবে কে? তোমরা ওকে বাইরে থেকে
দেখে যেমন কঠিন মনে কর আসলে ওটা ওর খোলস, ভিতরে একেবারে আলাদা, বাচ্চা ছেলেদের মত। আমি না থাকলে
মা ছাড়া কারো হাতে পানি খাবে না, চা খাবে না। মা কতক্ষণ পারে? আমি জিজ্ঞেস করি আমি না থাকলে
তুমি এতো এমন কর কেন, নিজে
একটু বুঝে চলতে পার না? এখন তুমি বড় হয়েছ, তোমার বৌ আছে, দুদিন পরে বাবা হবে। ও
বলে তুমি না থাকলে আমার কিছুই ভালো লাগে না, কাউকে ভালো লাগে না, কিছু করতেও ইচ্ছা
করেনা। তুমি আছ আমার সব আছে, তুমি নেই আমার কিছুই নেই। এখন বল এই মানুষকে রেখে আমি কি
করে থাকি?
জাহাজের
চাকরির ভয়েজে যাবার প্লেনের টিকেট কনফার্মেশনের তারিখ সহ এজেন্টের টেলিগ্রাম পেয়ে
সব কিছু গুছিয়ে নির্দিষ্ট তারিখে চিটাগাং যাবার জন্য বের হবে। সকাল দশটায় ট্রেন, আর মাত্র আধা ঘণ্টা
বাকি আছে। মা ভাই বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে। কোলে খুকু সহ মনিকে বুকে
নিয়ে কিছুক্ষণ পর বললো-
-ছাড়ো
মনি, আসি এখন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মনি
ছেড়ে দিলো। রাশেদ সাহেব ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘড়ের দরজা দিয়ে বের হচ্ছেন, এক পা দিয়েছেন এমন সময়
পিছন থেকে সার্ট টেনে ধরেছে, ঘুরে তাকিয়ে দেখে মা সার্ট টেনে ধরেছে আর তার কোলে মেয়ের
ছোট্ট হাত বাবার দিকে বাড়ানো। সাথে সাথে রাশেদকে মনি জড়িয়ে ধড়ে কেমন যেন এক অচেনা
কণ্ঠে বলেছিলো-
-আমি
তোমাকে যেতে নিষেধ করছি তুমি শুনছ না?
সে
কণ্ঠে যে কী ছিলো, মিনতি, নাকি অনুরোধ, নাকি নির্দেশ বুঝতে পারেনি। মনে
হচ্ছিলো অনেক দূর থেকে কে যেন কি বলছে। অনেকক্ষণ ওই ভাবে থেকে শুধু বলেছিলো-
-যেতে
নিষেধ করছ কিন্তু না গেলে চলবে কি ভাবে খাবে কি? আমাদের খুকুকে মানুষ করবে কি দিয়ে?
-না
তুমি ওখানে আর যাবেনা, তুমি
সাঁতার জানো না আমার ভয় করে।
-কি
যে বল তুমি,
সমুদ্রের
মধ্যে সাঁতার জানলেই কি আর না জানলেই কি। সাঁতরে কি সাগর পাড়ি দেয়া
যায়?
-না
তুমি যাবেনা।
-তা
হলে কি করবো?
-আমার
অত টাকার দরকার নেই, তুমি
এখানেই চেষ্টা করে খুঁজে দেখ, এখানেই ভালো চাকরি পাবে। এখানে যা পাবে তাতেই আমি চলতে
পারবো, শুধু তুমি আমার বুকে
থাকলেই হবে।
সেদিন
মনির কথা শুনে রাশেদ সাহেব সেই যে হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখেছিলেন আর তুলে নিতে
পারেন নি।
আর
যাওয়া হয়নি। টেলিফোনে তার না যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছিলো। খুকুকে কোলে নিয়ে মার
সামনে এসে দাঁড়ালেন। মা জিজ্ঞেস করলেন-
-কিরে
কি হলো গেলি না?
-না
আম্মা ওখানে যাব না, দেখি
এখানেই খুঁজে দেখি একটা কিছু করা যায় কিনা।
মা বাবা
কিংবা বাড়ির আর সবাই কে কি ভেবেছিলো তা আর খুঁজে দেখা হয়নি, তবে সেদিন রাশেদ
সাহেব আর
কোথাও বের হয়নি। সারা দিন খুকু আর মনিকে বুকে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলো। বিকেলে উঠে বললো-
-চলো
একটু শাহিনের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি।
-চলো।
খুকু
তার দাদুর কাছে রইলো। শাহিন ওদের দেখে অবাক হয়েছিলো।
-কি
ব্যাপার রাশেদ,
তুমি
চিটাগাং যাওনি?
-আমি
চিটাগাং গিয়েছি এ কথা মনে করলে এই জায়গাকেই চিটাগাং বলতে হয়।
-হেঁয়ালি
করবে না কি ব্যাপার খুলে বল।
মনি
গিয়েছে দেখে শাহিনের মা আর বড় ভাবী খুব খুশি।
আরে
মনিরা! এস এস,
তুমি তো
আসই না, রাশেদ এলেই ওকে বলি
বৌকে নিয়ে আসলে না কেন? চলো,
বলে ওকে
উপরে নিয়ে গিয়েছিলো। ওরা মনিকে খুব পছন্দ করে। শাহিনের মা বৌ দেখে রাশেদের মাকে
বলেছিলো আপা একটু তারা হুড়ো করলেও বৌ পেয়েছেন একজন মনের মত, এরকম বৌ পাওয়া ভাগ্যের
ব্যাপার। মনি উপরে চলে গেলে রাশেদ শাহিনকে খুলে বললো।
-ও এই
ব্যাপার,
মনিরা
যখন যেতে দিবে না তাহলে ভালোই করেছ। এখন দেখ, পেপার দেখতে থাক, এখানেই কোথাও না কোথাও
পেয়ে যাবে। চিন্তা কর না প্রায়ই বিজ্ঞাপন দেখা যায়, পাবে। আরে বৌ ভাগ্য বলেও একটা কথা
আছে না?
এই
ঘটনার দেড় দুই মাসের মধ্যে সত্যিই একটা ভালো চাকরি পেয়েছিলেন। একটা সরকারি
প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির অফিসার পদে। যেদিন জয়েন করতে যাবেন সেদিন বাবা বলেছিলেন-
-আমার
ছেলে অফিসার পদে চাকরি পেয়েছে বলে আমি খুশি কিন্তু বাবা, জীবনের প্রথম থেকে বিদেশের
চাকরিতে হাজার হাজার টাকা রোজগার করে এসে হাত বড় করে ফেলেছ। এখন দেশের সরকারি
চাকরির সামান্য বেতনে কুলাবে কিভাবে? তার পরে আবার এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর অধস্তনদের সাথে
তাল মিলিয়ে চলা যে কত কঠিন তুমি তা জানো না। আমার ভয় হয় তুমি কি তা পারবে? বিদেশে থেকে, বিদেশিদের সাথে
চলাফেরা করে তোমাদের মন মানসিকতা বদলে গেছে। জয়েন করার আগে ভালো করে ভেবে দেখ।
-আমি
পারবো আব্বা,
আপনারা
শুধু দোয়া করেন,
আমাকে যে
পারতেই হবে।
মনে মনে
বললেন, আমার মনির জন্যই আমাকে
পারতে হবে। যেখানে আমার মনি আছে সেখানে আমার কাছে বাকি সব তুচ্ছ। আমাজনের গভীর
অরণ্য বলেন,
আর সাহারা মরুভূমি বলেন, কিংবা হিমালয়ের বরফ
ঢাকা চূড়া থেকে কারাকোরামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বলেন, যত গহীন প্রতিকুল
অবস্থাই হোক শুধু আমার মনিকে বুকে নিয়েই আমি সারা জীবন কাটাতে পারবো। জয়েন করার
জন্য খুলনা গিয়েছিলেন, সেখানে
তার এক বন্ধু,
ভিন্ন আর
একটি প্রতিষ্ঠানের সহকারি পরিচালক পদে
চাকরিরত এমরানের বাসায় উঠেছিলেন।
কম্পাউন্ডের
মধ্যে বাসা খালি নেই বলে দুইটা পর্যন্ত অফিস করে বের হতেন বাসা খুঁজতে। অফিসের সব
সহ কর্মীদের বলেছিলেন তার জন্য ছোট একটা বাসা দেখতে। মাস খানিকের মধ্যে রকিব সাহেব
একটা বাসা ঠিক করে দিয়েছিলেন, বাসা পেয়ে মনিকে চিঠি লিখেছিলেন:
মনি,
তোমার
স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। একটা বাসা পেয়েছি, যদিও ছোট তবে আমার মনে হয় আমাদের
খুকু আর তার বাবাকে নিয়ে তোমার স্বপ্নের সংসার পাতার জন্য যথেষ্ট। সামনে খোলা আকাশ, ছোট্ট একটু খালি যায়গা
আছে ওখানে বাগান করা যাবে। ওই বাগানে খুকু খেলবে আর পাশে বারান্দায় বসে বিকেল বেলা
আমরা আকাশ দেখবো আর চা খাবো। আমাদের অফিস কম্পাউন্ডের ভিতরেই স্কুল আছে খুকু বড়
হলে ওখানে ভর্তি করা যাবে। আর একটা সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আমার
অফিসের এক্কেবারে কাছে মেইন গেটের বাইরে রাস্তার ওপাড়ে। অফিসে যখন তোমার কথা মনে
হবে তখন এসে চুমু খেয়ে যেতে পারবো। তুমি আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবার চলে আসার
ব্যবস্থা কর এর মধ্যে আমি এখানে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।
তোমার নাদু
গোপাল।
সাথে
মাকেও একটু লিখেছিলেন:
আম্মা,
এখানে
বাসা পেয়েছি,
নতুন
অবস্থায় ছুটি পাব না। আপনি জাহিদের সাথে মনি আর খুকুকে পাঠিয়ে দিবেন, ঢাকার কোচ এখানে নিউ
মার্কেটের সামনে থামে, আমি
ওখান থেকে রিসিভ করবো।
ইতি, রাশেদ।
চিঠি
পাঠিয়ে দিয়ে শুরু করেছিলেন বাসা গোছানো। অফিস থেকে সুইপার ডেকে এনে সারা বাসা
ধুইয়ে নিয়েছিলেন। অফিস সেরে নিউমার্কেট আর বড়বাজার ঘুরে জানালা দরজার পর্দা, বিছানাপত্র, ফার্নিচার, রান্না ঘড়ের হাড়ি
পাতিল চুলা সব কিনেছিলেন। শুধু সংসারের টুকিটাকি যা মেয়েদের নিজস্ব পছন্দের না হলে
হয় না সেগুলি বাদ রেখেছিলেন, মনি এলে তাকে সঙ্গে নিয়ে কিনবেন বলে। সেই শুক্রবারেই মেঝ
ভাই জাহিদের সাথে মনি এসেছিলো সাথে মার একটা চিঠি নিয়ে।
বাবা
রাশেদ,
বৌমাকে
যেতে দেয়ার ব্যাপারে তোমার বাবা ভীষণ আপত্তি করেছিলেন, নতুন চাকরি এখনই বৌকে নিয়ে গেলে
সামাল দিবে কিভাবে এই ভেবে। আমি তোমার সকালে ঘুম থেকে উঠে সময় মতো অফিসে যাওয়া আর
খাওয়া দাওয়ার অসুবিধার কথা বলে কোন ভাবে রাজী করিয়েছি। আমি জানি প্রত্যেক মেয়েই
তার নিজের সংসারের স্বপ্ন দেখে সেই ছোট বেলা থেকে, যখন সে মিছে মিছি মাটির পুতুল
দিয়ে খেলে,
হাবিজাবি
দিয়ে খেলনা হাড়িতে ভাত তরকারি রান্না করে তখন থেকে। তাই আমি বৌমাকে পাঠিয়ে দিলাম।
সে শুধু তোমার সুখের সাথী নয় সে তোমার সারা জীবনের সুখের এবং দুঃখের সাথী, কথাটা মনে রেখ। ওর মা
ওদেরকে কখনো গায়ে হাত তুলে মানুষ করেনি। আমাকে যেন কখনো কিছু শুনতে না হয় বাবা।
সাবধানে থেকো,
দোয়া করি
তোমরা সুখী হও। আর একটা কথা বৌকে নিয়ে যেখানেই যাবে সন্ধ্যার অন্ধকার হবার আগেই
বাসায় ফিরবে।
ইতি, তোমার মা।
মনে হয়
এইতো সেদিনের কথা। কিন্তু কোথা দিয়ে পঁচিশটা বছর কটে গেছে। আজ সেই খুকু এমকম করছে, তার পরে বীথী এসেছে
সেও কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। সবার শেষে যূথীও আগামী বছর এসএসসি দিবে। খুকুর পরের
দুই বোন আসার আগেও রাশেদ আর মনি সেই একই স্বপ্ন দেখেছে, মনির অবস্থাও সেই একই রকম
হয়েছিলো। ওরা তিন বোন কেও কারো চেয়ে কম না। সবাই মা বাবার জন্য অস্থির। মার কাছেই
সব মেয়ের হাতে খড়ি, পড়ালেখা, রান্নাবান্না, ঘড় গেরস্তি সব কিছুতেই
একেবারে যেন মায়ের ছায়া। কিভাবে কোথা দিয়ে দিন চলে যায়। আজ সন্ধ্যায় সূর্য ডুবতে
দেখা গেলো,
দিনের
পরে রাত এলো আবার রাত শেষ হবার আগেই আরেকটা সূর্য এসে হাজির, সাথে করে আর একটা দিন
নিয়ে এসেছে। আগের রাত আগের দিন কোথায় রেখে এলো? কোন কালো গহ্বরে চলে গেলো দিন আর
রাত গুলি?
কোথায়
গেলে সূর্যের ফেলে আসা সেই সব দিনের সন্ধান, রাতের সন্ধান পাবে কাওকে জিগ্যেস
করে কোন জবাব পায়নি। শুধু আসা আর যাওয়াই দেখে আসছে চিরদিন। কোথায় যে যায় আর কেনই
যে যায় এরও কোন জবাব পায়নি। কেন, একটা দিন হলেই চলতে পারতো, এর মধ্যেই পালা করে কাজ কর্ম, আরাম বিশ্রাম যার যা
করার করতো। একের পর এক দিন রাত্রি আসবে যাবে এমন কি দরকার ছিলো?
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।