নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৫১



৯৯
আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটতে চাইছে কিন্তু কুয়াশার জন্য পারছে না। সেই গ্লাসগো থেকেই ঘন কুয়াশা। অভিজ্ঞ ড্রাইভার গাড়ির স্পিড নিয়ন্ত্রণে রেখে চালাচ্ছে। সকাল দশটার মধ্যে পৌছার কথা থাকলেও মনে হয় কুয়াশার জন্য
চালাতে পারছেনা বলে দেরি হবে। দুই পাশে যতটুক দেখা যাচ্ছে তাতে ডান পাশ দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে আর তার পরেই নদীর মত মনে হচ্ছে, ওপাড়ে কি আছে কিছুই বোঝা যায় না শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। বায়ে পাহাড়, এলো মেলো ভাঙ্গাচুরা, এবড়ো থেবড়ো কালচে দেখাচ্ছে। দূরে বলে কুয়াশার জন্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেনা। পৌনে নয়টা বাজে, এখনও কোন লোকালয় বা শহরের মত কিছু দেখেনি তবে পিছনে কোথায় কোথায় যেন দুইবার থেমেছিলো সেখানে কোন লোকালয় আছে কিনা দেখতে পারেনি। একটু তন্দ্রা ভাব এসেছিলো। দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা পরিষ্কার হচ্ছে, আশে পাশের দৃশ্য আরও পরিষ্কার হচ্ছে। শীতকাল বলে গাছে কোন পাতা নেই। গাছ গুলি পায়ের উপর দাঁড়িয়ে হাজার হাজার আঙ্গুল সহ হাত বাড়িয়ে কাকে যেন ডাকছেসুন্দর, এতো সুন্দর আগে দেখেনি। স্কটল্যান্ডের প্রকৃতির সৌন্দর্যের সুনাম আগে অনেক শুনেছে, দেখেনি। এই প্রথম। কিছু সুন্দর আছে যা মন ভরে শুধু দেখা যায়। তার বিবরণ প্রকাশ করা যায় না, ধরেও রাখা যায় না।
মানুষ যা ভাবে তার সব ভাষায় বলতে পারেনা, আবার যা মুখে বলতে পারে তা সব লিখতেও পারেনাভাষার স্বল্পতার কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক সব কিছু প্রকাশ করা হয়ে উঠে না। মনের আবেগের কারণে ভালো করে দেখাও হয়ে উঠে না। চোখ যেখানে আটকে যায় সেখানেই স্থির হয়ে থাকতে চায়। চোখ ফেরাতে মন চায় না। শুধু অনুভব করেই মনটা ভরে উঠে। মন থেকে আহ কি সুন্দর! বলে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় যে শব্দ কেও শোনে না। মনে মনে অনেক কথা বলা হয় কিন্তু সে কথাও কেও শুনতে পায়না। সাথে ক্যামেরা থাকলেও ছবি তোলা হয়ে উঠে না। আর ছবি তুললেই বা কয়টা তুলতে পারে? এই বিশাল পৃথিবীর কত টুকু ছবি তোলা যায়? প্রকৃতির চারিদিকে সব সৌন্দর্য আপনিই ছড়িয়ে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে মিনিটে মিনিটে তার রূপ বদলায়। এর কতটা মানুষ ধরে রাখতে পারে? ধরে নিয়ে আরেক জনকে দেখাতে পারে? একই জায়গার ভোরের সৌন্দর্য, সকালের সৌন্দর্য, দুপুরের সৌন্দর্য, বিকেলের সৌন্দর্য, সন্ধ্যার সৌন্দর্য, রাতের সৌন্দর্য আবার জোছনার সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেদিনের বেলাও কুয়াশা, মেঘে ঢাকা সূর্য কিংবা পরিষ্কার আকাশের সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট সহ সূর্যালোকের সাথে আসা নানা পদের রশ্মির কারণে প্রকৃতির রঙের হের ফের হয়, এ সেই সৌন্দর্য।

আবার মনের ভাবের জন্য বা মানসিক অবস্থার কারণে সেই সৌন্দর্য একেক জনের কাছে একেক সময় একেক রূপে ধরা দেয়। শুধু স্মৃতি হয়েই থাকে মনের মধ্যে। কাকে দেখানো যায়না। শুধু বলতে পারে খুবই সুন্দর, আহ কি সুন্দর! ব্যাস এই পর্যন্তইকতটা সুন্দর কেমন সুন্দর তা আর বলা যায় নাবর্ণনা করতে পারেনা। সুন্দরের কোন সীমা নেই, আকার মাত্রা নেই, কোন একক নেই, বৈজ্ঞানিক কোন থিওরি নেই। শৈল্পিক ধারনা দিয়ে সামান্য কিছু বর্ণনা দেয়া যায়। যদিও যার কাছে বর্ণনা দিচ্ছে তার যদি শৈল্পিক মন থাকে কিন্তু তবুও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছবি একে কিছুটা দেখানো গেলেও তাও পূর্ণতা পায়না। শুধু চোখে দেখেই যার পূর্ণতা। এ হচ্ছে সেই রকম সুন্দরযতই এগুচ্ছেন ততই দেখছেন আর মুগ্ধ হচ্ছেন। রাশেদ সাহেব শুধু দেখে নিচ্ছেন। তার চোখ নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করে যা পারে দখল করে নিচ্ছেক্রমে ক্রমে গাড়ি উঁচু নিচু দুর্গম পাহাড়ি এলাকা পিছনে রেখে এগুচ্ছে। কখনো উঁচুতে উঠছে আবার কখনো নিচুতে নামছে। ডান পাশের দেখা সেই নদীর ওপাড়ে পাহাড় আর পাহাড়সবুজ, ঘন সবুজ, হালকা ধূসর, ধূসর, কালো, কুয়াশা মেশানো নানান রঙ। নদীর বুকে ভেসে থাকা থরে থরে সাজানো কুয়াশার ঢেউয়ের উপর দিয়ে দূরের পাহাড়ের চূড়া মাঝে মাঝে দেখা যায় আবার হারিয়ে যায়। শিল্পীর তুলিতে এর কতটা আঁকা সম্ভব রাশেদ সাহেব জানে না। তার ছোট্ট একটা শৈল্পিক মন থাকলেও সে ছবি আঁকতে পারে না। শুধু অনুভব করতে পারে।

গাছ পালার সংখ্যা বাড়ছে। পাহাড়ের এবড়ো থেবড়ো ভাব কমে আসছে। রাস্তার সংযোগ বাড়ছে। দূরে কোথাও দুই একটা বাড়ি ঘরের মত দেখাচ্ছ। নদীটা বাঁক নিয়ে আরও ডানে অনেক দূর চলে গেছে। এই দেখে বুঝলেন শহরের কাছে এসে পরেছি।
ঘড়ি দেখলেন, সাড়ে দশটা বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরে ঢুকল। একটু পরেই দেখলেন জর্জ স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, এখানকার ঠিকানাও আবিংডনের মত জর্জ স্ট্রিট। রেস্টুরেন্টের মালিক বলেছিলো রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়েই গাড়ি যাবে। একটু সামনে এগিয়েই ওপারে পাহাড় ঘেরা একটা ক্রিকের মত দেখা গেলো। এপাড়ে জেটিতে একটা প্যাসেঞ্জার জাহাজ ভিড়ে রয়েছে। সামনে পিছনে কয়েকটা ছোট ছোট লঞ্চ। ক্রিকের জলে বয়ায় বাঁধা অনেক গুলি ইয়োট। অসংখ্য গাংচিল আর বালি হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে আর রাজহাঁস সাঁতার কাটছেআর একটু এগিয়েই রাস্তার পাড়ে পুরনো একটা বিল্ডিং এর সামনে কোচ দাঁড়াল। ড্রাইভার মাইক দিয়ে বলে দিল আমরা ওবানে পৌঁছেছি, যাত্রী বৃন্দ, আপনারা আপনাদের মালামাল নিয়ে যাবেন এবং গাড়ির ভিতরে কিছু ফেলে যাচ্ছেন কিনা দেখে নিবেন। ধন্যবাদ।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।