ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের পথে ধামরাই ছাড়িয়ে একটা বাস স্টপেজ
আছে নাম সুতি পাড়া। এই সুতি পাড়া দিয়ে প্রায় মাইল তিনেক দক্ষিণে এগিয়ে গেলে
নান্নার ছাড়িয়ে হাতের বাম দিকে কাছেই রৌহা গ্রাম আর ওই রাস্তা ধরে আরও
কিছুটা
এগিয়ে গেলে সুয়াপুর বাজার। নান্নার এলাকায় আগের দিনের জমিদারদের বসবাস ছিল। তাদের
কেউ এখন নেই। দেশ ভাগের পর প্রায় সবাই ভারতে চলে গেছে। তাদের দালান কোঠা বিনা
যত্নে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে ভেঙ্গে পরি পরি অবস্থায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় কি ছিলনা
ওখানে? বৈঠক খানা ছিল, রংমহল ছিল তাতে ঝাঁর
বাতি ছিল,
নাচ গান
জলসা হতো। পাশেই মন্দির ছিল, কালি ঘর ছিল। বার মাসে তের পাবন, পূজা, মেলা ইত্যাদি নানা ধরনের উৎসব
লেগেই ছিল। নানা নানীর কাছে গল্প শুনেছি। সে এক মহা আনন্দের দিন ছিল তখন। হিন্দু
মুসলমান মিলে নানা আনন্দ উৎসব উল্লাসে তাদের দিন মাস বছর কেটে যেত। তারা চলে গেছে
বলে তাদের দেখিনি তবে তাদের রেখে যাওয়া দালান কোঠার অবশিষ্ট আমিও দেখেছি।
আমরা সেবারে মানিকগঞ্জের পশ্চিমে আমাদের গ্রাম ঝিটকা থেকে
গরু গাড়ি করে সবাই আম কাঁঠাল খাবার জন্য মামা বাড়ি বেড়াতে গেছি। পথে মার সে কি
আনন্দ! কতদিন পর বাবার বাড়ি যাচ্ছে। সারাটা পথে মা আমাদের ভাই বোনদের একটুও বকা
বকি করেনি,
এ মা যেন
ভিন্ন মা! মানিকগঞ্জে এসে বাবা দোকান থেকে পরটা হালুয়া কিনে আনলেন গাড়োয়ান কোন এক
কুয়ো থেকে এক কলস ভরে পানি ভরে আনল তাই দিয়ে দুপুরের খাবার হলো। বাড়ি থেকে দাদিও
কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছিল। সারা পথে সেগুলি খেয়েছি। সন্ধ্যার একটু আগে পৌঁছেছি। সে রাতে অন্ধকার হয়ে
এলো তাই আর কিছু দেখার ছিল না। নানা বাড়ি পৌঁছে সারাদিনে পথের কাপর চোপর বদলানো, মুখ হাত ধোয়া, খাওয়া দাওয়া করতে
করতেই মনে হলো রাত দুপুর হয়ে গেছে। মামা খালা, মামাত ভাই বোনদের সাথে এটা সেটা
গল্প করে সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে মায়ের পাশে শোবার সাথে সাথেই ঘুম। এর আগেও মামা
বাড়ি এসেছি কিন্তু তখন মনে হয় ছোট ছিলাম বলে সেসব দিনের কথা বিশেষ কিছু মনে পড়ছে
না। এবারের কথাই মনে আছে। মামা বাড়ির পশ্চিমে দুই এক বিঘা জমির পরেই খেলার মাঠ, পুবে আর এক বাড়ি, দক্ষিণে বিশাল চক, চকের ওপাশে ডিসট্রিক্ট
বোর্ডের রাস্তা আর রাস্তার সাথেই নান্নার জমিদার বাড়ি দেখা যায়। উত্তরে এক ভিটা
বাড়ি, আগে হিন্দুদের বসতি
ছিল। তারা এ সব বিক্রি করে ওপাড়ে চলে গেছে। ওদের আবার বাড়িতেই একটা মন্দির ঘর ছিল
তাতে নানান দেব দেবীর মূর্তি ছিল এবং বছর
বছর নতুন মূর্তি গড়ার সময় পুরনো গুলি পিছনের ডোবায় ফেলে দিত। নানা নিজের বাড়ি
সংলগ্ন বলে সম্ভবত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওই বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন। পরে ঘর দরজা
অন্যত্র সরিয়ে ওই বাড়িতে যে সব ভাল ভাল গাছ গাছালি ছিল সে গুলিই শুধু রেখে
দিয়েছিলেন। খুব ভাল জাতের সাত আটটা আম গাছ ছিল। এক এক গাছের ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল, চাপিলা, ঝুনকি, লম্বা, দক্ষিণের গাছ এমনি
কিছু। নানী আবার ওই ভিটা বাড়িকে আমবাগান বলে ডাকত।
আমরা যখন গেলাম তখন ছিল ঝড়ের সময়। কাল বৈশাখীর শেষের দিক।
পরদিন বিকেলের একটু আগে হঠাৎ করে ঈশান কোণে কাল মেঘ করে ঝড় উঠে এলো। ঝড় বয়ে গেল
প্রচণ্ড বেগে। থেমে থেমে বেশ
অনেকক্ষণ ধরে, সাথে বৃষ্টি। মেঘলা ঝড়ো আকাশে একটু তারা তাড়ি সন্ধ্যা নেমে
এলো। ঘরে ঘরে হারিকেন বা কুপি বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হলো। এর একটু পর পরই ঝর বৃষ্টি
থামলে সম বয়সী ছোট মামা রাজীব, মামাত ভাই সাহেদ আর মামাত বোন শেফালি বলল চল আম কুড়িয়ে
আনি। দেখলাম ওরা ছোট ছোট ঝুরির মত নিয়ে যাবার জন্য রেডি। জিজ্ঞেস করলাম কোথায়? শেফালি হাতে ইশারা করে দেখিয়ে বলল ওই আম বাগানে, চলনা ভাইয়া! ‘চল’ বলে আমিও ওদের পিছনে
পিছনে গেলাম। বেশ আম কুড়চ্ছি। মাকে দেখলাম একটু পরে বাড়ির পাশে এসে আমাদের দেখে
গেল। শেফালিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল
কি রে শেফালি আম আছে?
হ্যাঁ ফুফু অনেক আম পড়েছে,
কুড়িয়ে নিয়ে আয়।
ফুফু তুমিও আস
না আমি যাব না, তুই দেখিস তোর ভাই যেন ওদিকে যায় না
আম কুড়াতে কুড়াতে ছোট মামা আর সাহেদ পুবের ওই বাড়ির ছেলে
মেয়েদের সাথে ওদিকে চলে গেল শেফালি আর আমি এই ভিটায় রয়ে গেছি। আমরা জানি না যে ওরা
ওদিকে চলে গেছে। আমরাও আস্তে আস্তে ভিটার উত্তর দিকে চলে এসেছি যেখানে পুরানা
মূর্তি ফেলা হতো। মূর্তির ব্যাপারটা আমাদের কেউ জানতাম না। বেশ অন্ধকার, একটু ভয় ভয় করছে। আমি
কিছু দেখছিনা বলে কিছুই কুড়াতে পারছি না।
শেফালি চল বাড়ি যাই, ভীষণ অন্ধকার আমার ভয় করছে।
দূর ভাইয়া তুই কি বোকা, ওইতো বাড়ি এখানে ভয় কি?
শেফালির কথা শেষ না হতেই লক্ষ করলাম আম গাছ থেকে সাদা দব
দবে পোশাক পড়া কে যেন নেমে শেফালির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লম্বা লম্বা পা ফেলে।
শেফালিকে ডাকলাম কিন্তু লক্ষ করলাম শেফালি কিছু শুনছে না, ওকে আমের নেশায় পেয়ে বসেছে। এর
মধ্যেই দেখলাম পাশের গাছ থেকে আরও একজন নেমে এলো। শেফালিকে ডাকছি কিন্তু ও শুনছে
না। একটু পরেই বুঝলাম ভয়ে আমার গলা দিয়েই কোন শব্দ বের হচ্ছে না। হঠাৎ আমার পায়ের
সাথে কিসের এক ডালে লেগে যেন একটু শব্দ হলো তাতেই শেফালি এবার পিছনে তাকিয়ে দেখে
দুই ভূত শূন্যে ভর করে ওর দিকে যাচ্ছে।
থমকে থমকে এক অচেনা ভঙ্গিতে হাঁটছে। সম্ভবত ওদের দেখেই শেফালি এক চিৎকার দিয়ে আমার
দিকে দৌড় দিল। আমি দেখছি ও সমানে হাত পা ছুড়ছে কিন্তু কিছুতেই এগুতে পারছে না ওর
মুখ দিয়ে কেমন যেন গোঙ্গানির মত শব্দ হচ্ছে শুধু। একটু পরেই লক্ষ করলাম আমিও আর
হাটতে পারছি না। সামনের ডান দিক থেকে কাল কুচকুচে চেহারার মাথা ছাড়া কি যেন আমার
দিকে ফাঁত ফাঁত শব্দ করে ঝোপ ঝাঁর ভেঙ্গে এগিয়ে আসছে। মাথা নেই শুধু বুকের উপর
একটা চোখ। কি করি এখন, কিছু
ভাবার মত সুযোগ নেই। চিৎকার দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। মা বলে এক চিৎকার দিলাম।
ব্যাস এই পর্যন্তই মনে আছে।
হঠাৎ চোখে মুখে পানির ঝাপটা পেয়ে চেতনা ফিরে এলে দেখলাম
নানুর বড় ঘড়ের বারান্দায় পাতা পাটিতে আমি মায়ের প্রায় কোলে কোন ভাবে পরে আছি আমার
পাশে শেফালি তার মায়ের পাশে বসে আছে।
পরে সবার কাছে যা শুনেছি:
আম কুড়িয়ে ছোট মামা আর সাহেদ বাড়িতে ফিরে আসার সময় শেফালির
আর আমার চিৎকার শুনে আম বাগানে যেয়ে দেখে আমি আর শেফালি দুই জনেই ওখানে যে ডোবা
তার ধারে পরে রয়েছি, শেফালির
পা ডোবায় জমা বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে সমস্ত শরীর কাদায় মাখান এবং শরীরে ভীষণ
দুর্গন্ধ। তখন সাহেদ চিৎকার করে তার দাদি এবং আমার নানীকে ডাকলে বাড়ি থেকে লাঠি আর
হারিকেন নিয়ে যেয়ে আমাদের উদ্ধার করে আনে।
নানী খুব রাগ করল
আমাদের এই আম কুড়ানোর অভিযাত্রার জন্য।
কেন কাল সকালে আম আনা যেত না? এই রাতে কেন গেল? আমার মাকেও খুব বকাবকি
করল তুই দেখলি ওরা ওখানে রয়েছে তা ওদের ফিরিয়ে আনলি না কেন বা তুই ওখানে থাকলি না
কেন?
মা যতই বলছে আমি কি জানি এমন হবে?
নানু ততই বলছে জানতে হবে কেন, ওই ভিটার কথা তোর মনে নেই? আমি যে এখানে বসে পান খাবার
সময় কত কি দেখতাম সেগুলির কথা এত তারা তাড়ি ভুলে গেলি কেমনে? কত নাচ, কত কি দেখেছি! সবতো
বলেছি তোদের। তখন জানলাম আমি যেটা দেখেছি মাথা ছাড়া তার নাম ওখানকার স্থানীয় ভাষায়
নিস্কাইন্ধ্যা। মানে যার কাঁধ নেই মাথা নেই বুকের উপরের দিকে একটাই চোখ এমন এক
দেহ।
**গল্পটি রূপ মহলের কূপিবাতি নামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত।
**গল্পটি রূপ মহলের কূপিবাতি নামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।