১।
সূর্য ওঠার
একটু আগে, আকাশের পূর্ব দিগন্তে ছড়িয়ে আছে লাল আভা। পাখিরা কিচির মিচির শব্দ করে বাড়ি
ছেড়ে যার যার কাজে যাচ্ছে। দুই একটা কাক কা কা করে কাউকে ডাকছে কিংবা নিজের অস্তিত্ব
জানান দিচ্ছে। চারিদিকে দুই
এক জন করে লোক জন রাস্তায় বের হতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝে
দুই একটা রিকশার টুং টাং শোনা যাচ্ছে আর ঝাড়ুদারেরা গত সারা দিনের আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে
এক পাশে জমা করে রাখছে। ওদিকে ময়মনসিংহ রেল স্টেশনের সামনে রোডের বায়ে ঝুপড়ি ঘরের এক
চায়ের দোকানের কড়াইতে দুধ জ্বাল হচ্ছিল, পাশের আর একটা চুলায় কেটলিতে জ্বালান চায়ের
গন্ধে পুরো স্টেশন এলাকা মৌ মৌ করছিল তখন ময়মনসিংহ ডিআইজি (প্রিজন) এর বাংলো থেকে সোজা
এসে দাঁড়াল রিক্সাটা। ঢাকা থেকে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিল হিরণ আর তার বন্ধু নাসির।
এখন ঢাকা ফিরে যাচ্ছে।
পিছনের সিটে
বসা হিরণ বলে উঠল ওই চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াও। শেখ মোহাম্মদ রিকশাটা টেনে আর একটু
এগিয়ে চায়ের দোকানের সামনে নারকেল গাছটার নিচে দাড় করাল। নাসির হিরণের পায়ের নিচে রাখা
ব্যাগটা নামিয়ে দাঁড়াল। প্রায় সাথে সাথে হিরণও নেমে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে রিকশা
ভাড়া দিয়ে হাতের ঘড়িটা দেখল। মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে। ট্রেন ছাড়বে সাতটায়। এই আধা ঘণ্টার
মধ্যে ঝুপড়ি ঘরের চায়ের দোকানে গরুর দুধে বানান
চা খেয়ে নেয়া যায়। তখনও মফস্বল শহরে কন্ডেন্সড দুধের চা রপ্ত হয়নি তবে ঢাকা শহরে সবে
শুরু হয়েছে। ঢাকায় মানুষ তখনও গরুর দুধের চা এর স্বাদ ভুলে যায়নি।
এখানে থামলি
কেন?
দেখছিস না
দুধ জ্বাল হচ্ছে, আর চায়ের গন্ধ পাসনি?
ও, বুঝেছি।
গলা শুকিয়ে গেছে, তা টিকেট নিয়ে এসে বসলে হত না?
ঘড়ি দেখ,
যথেষ্ট সময় আছে, টিকেট পরে নিলেও চলবে।
চল।
ঝুপড়ি ঘরের
সামনে একটা আধা ভাঙ্গা মানে এক পাশে দুই পায়া আর এক পাশ ইটের উপরে এমন একটা বেঞ্চ পাতা
রয়েছে। ভিতরে আরও কয়েকটা চেয়ার বেঞ্চ মিলে মোটামুটি কয়েকজন বসতে পারে এমন ব্যবস্থা
আছে। ওগুলির সামনে আবার টেবিলও আছে। ভিতরে একজন বয়স্ক লোক ঝারা মুছা করে দোকান ঠিক
ঠাক করছে। দুই বন্ধু মিলে এই সাত সকালে খোলামেলা বাইরের বেঞ্চেই বসল। সাথে সাথেই খালি
গায়ে শুধু একটা লুঙ্গি পরা ১০/১২ বছরের এক ছেলে দেখে মনে হল এখানেই কোথাও রাতে ঘুমিয়ে
ছিল, এসে জানতে চাইল
মামা, কি
খাইবেন?
তোদের এখানে
চা ছাড়া আর কিছু দেখছি না! কি দিবি?
কেন, বিস্কুট
আছে, কেক আছে ইকটু বাদে পরটা হইব।
আচ্ছা থাক
তোর কেক বিস্কুট বা পরটা কিছুই লাগবে না তুই ভাল করে গরম পানি আর লবণ দিয়ে দুইটা কাপ
ধুয়ে চা দে।
চিনি কতটুক
দিমু মামা?
কে আমি?
দে, দুই
চামচ করেই দে।
ইকটু বন
আনতাছি।
বলেই ছেলেটা
চলে আসছিল।
এই শোন,
তোর নাম কি?
ওর কাজের
দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিল
বেবাকতে
ফইটক্যা কইয়া ডাহে মামা!
ওরা দেখল
ওদের কথা মত ছেলেটা কাপ ধুয়ে চা এনে সুন্দর পরিপাটি করে ওরা যে বেঞ্চে বসেছে সেখানে
ওদের দুই পাশে কাপ দুইটা নামিয়ে রাখল।
নেন মামা,
খাইয়া লন, ঠাণ্ডা হইয়া গেলে মজা পাইবেন না। আপনে গো ঢাহায় এমুন চা পাইবেন না
কে বলল তোকে?
আমি জানি,
কত জনে কয়, আমি হুনছি
এই শোন!
আর কিছু
লাগব মামা?
গলাটা যতটা
সম্ভব নামিয়ে বলল
এই খানে
কত দিন যাবত আছিস?
একটু ভেবে
এই এক বছর,
কেন মামা?
কত করে পাস?
কত আবার,
খাওন দাওন দেয় এইতো, আর কি!
শোন, আর
কিছু লাগবে না তবে তুই আমাদের সাথে ঢাকা যাবি?
এদিক ওদিক
তাকিয়ে
ঢাহা? আমারে
নিবেন?
তুই গেলে
নিতাম!
শোনার সাথে
সাথে ফইটক্যার চেহারায় একটা আলোর আভা ফুটে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই তা মুছে ফেলে একটু ভেবে
ফিস ফিস করে বলল
হ যামু!
তয় আর কিছু কইয়েন না। আপনেরা গাড়িতে যাইয়া উঠেন আমি সময় মত আইয়া পরুম!
শুনে নাসির
আর হিরণ একটু দৃষ্টি বিনিময় করল। দেখা যাক, ও হয়ত যাবে কিন্তু ভিতরে সম্ভবত ওর মালিক
আছে বলে জোরে কিছু বলতে পারছে না। ওরা আস্তে আস্তে চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। একটু এগিয়ে
ডাকল
এই ফইটক্যা,
নে চায়ের দামটা রাখ।
ভিতর থেকেও
একই কথা ভেসে এলো,
ওই ফইটক্যা
যা চার দাম ল।
ফইটক্যা
বেরিয়ে এসে দাঁড়াল
কে আমি?
কত’রে?
এক ট্যাহা!
এক টাকার
একটা নোট হাতে দিয়ে হিরণ ফইটক্যার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ফইটক্যা আস্তে
করে এদিক ওদিক দেখে ঘার কাত করে চোখের ইশারায় ওদের স্টেশনে চলে যেতে বলল। হিরণ আর নাসির
রাস্তায় এসে সিগারেট জ্বালিয়ে পায়ে পায়ে সমনের নারকেল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। একটু
পরেই ফইটক্যা বেড় হয়ে ওদের দেখে আবার ইশারা দিল। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিয়ে পায়ে
চেপে আগুন নিভিয়ে ওরা স্টেশনে ঢোকার গেট দিয়ে ঢুকে সোজা টিকেট কাউন্টারে। হিরণ একটু
চিন্তা করল টিকেট কয়টা নিবে? নাসির বলল দুইটাই নে ও যদি এসেই পরে তখন দেখা যাবে, দরকার
হলে গাড়িতে টিটির কাছে টিকেট করে নিব।
হ্যাঁ তাই
ভাল।
পকেট থেকে
আবার ওয়ালেট বের করে একশ টাকার একটা নোট কাউন্টারের ওপাশে চোখে ঘুম জড়ান টিকেট বাবুর
দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
দুইটা কমলাপুর
কাউন্টার
থেকে ভাংতি টাকা আর দুইটা টিকেট নিয়ে সোজা প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে
আছে। ঘড়িতে দেখল আর মাত্র ২/৩ মিনিট বাকি। ট্রেনের কাছে গিয়ে নাসির ব্যাগটা নিয়ে একটা
বগিতে উঠে সিট খুঁজে বসে পরল। হিরণ ট্রেনের দরজার পাশে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল। একটু
পরে। লাস্ট হুইস্যাল দিয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিন গিয়ারে দেয়া হয়েছে, ড্রাইভার আস্তে আস্তে
থ্রটল টানছে, ট্রেন চলতে শুরু করেছে কিন্তু ফটিকের দেখা নেই। হিরণ গাড়িতে উঠে স্টেশনের
দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। এখনও নিরাশ হয়নি। এই ছেলে ফাকি দেয়ার ছেলে নয়। ট্রেনের গতি আস্তে
আস্তে বাড়ছে। নাহ! ও আসছে না, হয়ত বের হবার সুযোগ পায়নি! এর মধ্যে ট্রেনের চাকা বেশ
জোড়েই ঘুরতে শুরু করেছে। ঠিক আছে না আসল। হিরণও ঘুরে সিটের কাছে এগিয়ে যাবার জন্য পা
বাড়িয়েছে হটাত প্ল্যাটফর্মের ওপাশে চোখ যেতেই দেখে একটা ছেলে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। চিনতে
পারল। হিরণ আবার ঘুরে দাঁড়াল। ছেলেটা কাছে আসতেই এক হাত বাড়িয়ে দিল আর ছেলেটা ওর হাত
ধরে এক লাফে হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রেনে উঠে পরল।
মামা এক্কেবারে
সময় মত আইয়া পরছি!
মুখে একটু
তৃপ্তির হাসি নিয়ে আবার বলল
কইছিলাম
না আপনেরা যান আমি আইতাছি!
আমি ভাবছিলাম
তুই বুঝি আর আসবি না।
কি যে কন
মামা আমুনা কেন, আমি হেই কবেত্থন সুযুগ খুঁজতাছি! কতজনেরে কইছি আমারে ঢাহা নিয়া যাইবেন?
হজ্ঞলেই খালি কইছে আনব কিন্তু কেউ আনে নাই! আমি মনে করছিলাম আফনেও বুঝি হেই রহম!
২।
ট্রেনে উঠে
নাসির যেখানে বসেছিল তার পাশে হিরণ বসে একটু চেপে ফইটক্যাকে বলল বস এখানে। ফইটক্যা
একটু ইতস্তত করে হিরণের কাছে বসে পরল।
কে আমি?
বল দেখি
এবার তোর আসল নাম কি?
আসল নাম
মাইনে আবার কি? কইলামনা বেবাকতে ফইটক্যা কইয়া ডাহে
আচ্ছা ঠিক
আছে, তোর বাড়ি কোথায়?
কইবাম পারতাম
না
কেন, তোর
মা বাবা কোথায় থাকে?
বাপ মা নাই
একটু জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে নাসির জিজ্ঞেস করল
নাই মানে?
কেউ নাই?
নাই মাইনে
কুনদিন কেউরে দেহি নাই
বাপের নাম
কি?
মামা, কইলামতো
কুন দিন দেহি নাই!
ও, তাহলে
এই এত বড় হলি কি ভাবে?
এই যে যেমনে
দেখলেন এমনে। আইজ এই হানে কাইল ওইহানে, কেউ জাগা দেয় আর কেউ খাউন দেয় কুন দিন কেউর
কাছে চাইয়া খাই। যহন কেউ কামের জন্য কয় তহন কাম কইরা দেই। যে কয়দিন কাম করি হেই কয়দিন
খাউনের অসুবিধা হয় না
এর আগে কোথায়
ছিলি?
ওইযে সামনের
যে দোহানডা দেখছুইন, ওইডায় থাকতাম
তা ওখান
থেকে এখানে আসলি কেন?
ওরা খাউন
দিত না, ট্যাহা দিত, হেই ট্যাহা দিয়া খাউন হইত না।
এই হিরণ
বাদ দে, এসব জেনে তুই কি করবি? নিয়ে যাচ্ছিস, চল দেখি কি হয়। এখনও কিছু বুঝতে পারিসনি?
বুঝেছি তবুও
একটু আলাপ করলাম
আর আলাপ
করতে হবে না এবার থাম।
৩।
কমলাপুর
রেল স্টেশনে নেমে বাইরে এসে ফুটপাথ থেকে ফইটক্যার জন্য একটা হাফ প্যান্ট, একটা সার্ট
আর একটা গামছা কিনে ওগুলি ওকে পড়িয়ে পড়নের ময়লা লুঙ্গিটা ফেলে দিল। একটা রিকশা নিয়ে
গেণ্ডারিয়া যাবার পথে নারিন্দার মোড়ে নাসিরকে নামিয়ে হিরণ আর ফইটক্যা চলে গেল হিরণদের
সাধনার গলিতে দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার পর মা, ভাবী এরা ফইটক্যাকে দেখে
অবাক!
কি রে হিরণ,
এ কে?
এর নাম ফটিক,
ময়মনসিংহ স্টেশনে পেয়ে নিয়ে আসলাম, দোকানে খাবার আনা নেয়ার কাজে লাগবে তাছাড়া মাঝে
মাঝে যখন কাজের চাপ বেশী হয় তখন দোকান বা প্রেস কিংবা মেলার কাজেও লাগবে।
কে আমি?
মা জানতে
চাইল
জোগাড় করে
দিল কে?
কেউ না,
চায়ের দোকান থেকে একরকম ধরে নিয়ে এসেছি
কোথাকার
কে না কে চেনা জানা নেই তুই এমনি হুট করে নিয়ে এলি?
হুম, আনলাম
দেখি কি হয়!
গ্রন্থ নীড়
প্রকাশনী নামে দেশের খ্যাতনামা বই প্রকাশনীর ব্যবসা হিরণের বাবা করেছিলেন। বাংলাবাজারে
বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁসে দোকান। বড় ছেলে তারেক হাসান ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া শুনার
পাট শেষ করে দোকানে যাতায়াত করত। বাবার ইন্তেকালের পর এখন দায়িত্ব নিয়ে চালাচ্ছে। সাথে
ছোট ভাইকেও নিয়ে নিয়েছে। হাসান সাহেব বাড়ির পিছন দিকে নিজেদের ছাপাখানা করেছেন, দুই ভাই আর ১০/১২ জন কর্মচারী নিয়ে প্রেস এবং দোকান চালায়। রাতে দোকান বন্ধ করে
বাড়িতে এসে প্রেসের প্রডাকশন বা নতুন কাজ ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দেয়া বা বইয়ের প্রুফ দেখার
কাজগুলি বড় ভাই করে।
দুপুরে প্রেসের
কর্মচারীরা বাড়িতে খায় আর দোকানের জন্য বড় টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে যেতে হয়।
এই কাজের জন্য উপযুক্ত মানুষ পাওয়াই যায় না। যাক এখন থেকে ফটিক যদি এই কাজটুকও করতে
পারে তাহলেও অনেক। এই উদ্দেশ্যেই নিয়ে এসেছে।
বাড়ির সবার
সাথে ফটিকের পরিচয় পর্ব চলছে
ইনি আমার
মা ইনাকে নানী ডাকবি আর ইনি আমার ভাবী কাজেই ইনাকে বড় মামি বলবি, আরও একজন মামি আছে
সে এখন বাড়ি নেই বিকেলে আসবে, এলে তখন চিনিয়ে দিব। চল এখন গোসল করবি।
একটা সাবান
দিয়ে ফটিককে বাথরুম দেখিয়ে বলল যা গোসল করে আয় তারপরে খেয়ে নিই। এমন বাথ রুমের সাথে
ফটিকের পরিচয় নেই। ভিতরে ঢুকে সাথে সাথেই আবার বের হয়ে এলো।
মামা!
কি রে?
মামা, এই
ইকটু খানি ঘরে কেমনে গোসল দিমু?
ও, এই কথা!
এই দেখ, কল খুলে বালতি ভরে এই মগ দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে গোসল করবি! ভাল করে সাবান দিয়ে
পরিষ্কার করে গোসল করবি, গায়ের ময়লা যেন থাকে না, বুঝেছিস?
হ বুঝছি
আচ্ছা তাহলে
তুই আয় আমিও গোসল করে নিই
গোসল সেরে
যখন বাইরে এলো তখন ওর চেহারা দেখে হিরণ আর ওর মা অবাক! সাবান ঘসে গায়ের কাদা দূর হওয়া
ফর্সা গায়ের রঙ, কালো চুল তেল জলের অভাবে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে তবুও সদ্য কেনা নতুন
কাপরে চেহারায় একটা চমক ফুটে উঠেছে। হিরণ ভাবছে এই কি সেই ফটিক যাকে এত দূর থেকে সাথে
করে নিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকিয়েছিলাম!
৪।
কে আমি?
গোসল সেরে
তেল পানি নিয়ে মাথা আঁচড়ে ফটিক মামার সাথে খাবার টেবিলে বসল। বড় ভাবী পাশে বসে। লাল
শাক, ভাজা মেনি মাছ, টাটকিনি মাছের ঝোল, গরুর মাংস আর ডাল দিয়ে হাপুস হাপুস খাবার ভঙ্গি
দেখে ভাবি আর হিরণের চোখে চোখে অনেক কথা হল কিংবা অল্প কথায় অনেক বেশী ভাব আদান প্রদান
হল।
হিরণ জিজ্ঞেস
করল-
কিরে ফটিক
কেমন লাগছে?
মামি, খুব
মজা! আপনেরা কি এমনেই খান পরতি দিন? আমি কি এই গুলা জীবনে দেখছি? কুন দিন ইকটু ডাইল,
কুন দিন ইট্টূ আলু ভর্তা এই পাইলেই হাজার শোকর। কুন দিন তো দোহানে মাইনসেরে খাওয়াইয়া
কিছু বাঁচলে তাই খাইতাম না বাঁচলে খালি একটা হুকনা রুটি পানি দিয়া চাবাইয়া খাইয়া হুইয়া
থাকছি।
খা, তোর
যা লাগে তুই যত পারিস খা। এখন থেকে এখানেই থাকবি কাজেই কোন লজ্জা করবি না, যখন ক্ষুধা
লাগে আমাকে বলবি।
খাবার পর
বিকেলে ফটিককে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ির পিছনের প্রেসটা দেখাল। তারপরে নিয়ে গেল বাংলাবাজারের
দোকানে। যাবার সময় ফটিক লক্ষ করল যে সূত্রাপুরের লোহার পুলে প্রতিটা রিক্সা ঠেলার জন্য
আট আনা করে দিতে হয়। পুলের এ পাশে এসে মামা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে খুচরা আট
আনা পয়সা বের করে যে লোকটা ঠেলছিল তার হাতে দিল। ও দেখে জিজ্ঞেস করল কিসের পয়সা দিলেন
মামা? মামা বুঝিয়ে বলল।
বড় ভাই এখনও
ফটিকের দেখা বা পরিচয় পায়নি বলে সে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল,
কে? এখানেও আগাগোড়া সব জানাতে হল। এবার ওকে নিয়ে ভিতরে এবং দোতলার গুদাম সহ সমস্ত দোকান
দেখাল। এবার নিচে এসে মজিদ ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল যান মজিদ ভাই একে আশে পাশের চায়ের
দোকান এবং আমাদের যে সব জিনিস পত্র কিনতে হয় সেগুলি দেখিয়ে আনেন। ফেরার সময় ওর কাপড়
চোপর সহ যা যা লাগে কিনে নিয়ে আসবেন। টাকা নিয়ে যান।
সন্ধ্যায়
বাড়ি ফেরার পথে রিকশায় বসে ফটিক অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
মামা একটা
কতা কমু?
বল
এই এতক্ষণ
ভইরা যা দেখলাম সব আপনেগো?
হ্যাঁ, কেন?
না এমনেই,
আপনেরা কত বড় নোক তাই চিন্তা করলাম!
বাড়ি ফিরে
এসে ড্রইং রুমে টেলিভিশন অন করে ফটিককে বলল দেখ টেলিভিশন দেখ, খাবার সময় হলে মামিকে
বলবি।
কে আমি?
৫।
এই ভাবেই
ফটিকের জীবনের রুটিন বদলে গেল। দুপুরে নিজে খেয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে দোকানের সবার
খাবার নিয়ে হেটে দোকানে যাবার সময় মনে হল এখানে একটা রিকশা ঠেললেই আট আনা, বাহ! বেশতো!
আমিও এটা করতে পারি। দোকানে যাবার সময় হাতে টিফিন ক্যারিয়ার থাকে বলে এটা সম্ভব নয়।
ফেরার পথে চেষ্টা করতে হবে। দোকানে গিয়ে মজিদ ভাই, মামা আর অন্য যারা আছে তাদের সাথে
মিশে গেল। সবার মুখে মুখে ফটিক শোন, ফটিক এটা নিয়ে আয়, ফটিক ওটা কর। এই ভাবে ধীরে ধীরে
একদিন ফটিকের দোকানের সমস্ত লেখকের সমস্ত বই কোনটা কোথায় থাকে সব মুখস্থ হয়ে গেল। বই
এর কভার দেখেই ও বুঝতে পারে এটা কোন লেখকের কোন বই। বড় মামা এখন শুধু বলে দেয় যা তো
ফটিক গগন বাবুর ৫ টা অরণ্য নিয়ে আয়। মানে গগন বাবুর লেখা ৫ কপি অরণ্য বিলাস নামের বই
নিয়ে আয়। ফটিক জানে এই লেখকের বই দোতলার কোন সেলফে থাকে। লেখাপড়া কিছু না জেনেও ঠিক
লেখকের সঠিক বইটাই এনে হাজির,
নেন মামা।
আর কিছু লাগব?
না
তাইলে আমি
বাড়ি যাইগা?
বাড়ি যাবি?
কি করবি বাড়ি গিয়ে?
মামা, কাইল
দেখছি আমাগো বাড়ির পিছনে একটা স্কুল আছে, পেরেসের ওই মুরা (ওই পাশে)
হ্যাঁ আছেতো,
কেন?
আমারে নিবনা
ওই স্কুলে?
তুই কি ভর্তি
হতে চাস?
হ, চিন্তা
করলাম রাইতে আমারত কোন কাম নাই তাই দেখতাম পারি নাকি। আপনাগো বাড়ির বেবাকতে শিক্ষিত
মানুষ আবার আপনেরা বই বানান বই বেচেন আর আমি যদি মুক্কু থাহি তাইলে মাইনসে কি কইব?
বেশ, তাহলে
তোর ছোট মামাকে ডেকে নিয়ে আয়
আচ্ছা মামা
আমি অহনই আনতাছি
দাদা, আমাকে
ডাকছ?
হ্যাঁ, শোন
আজ বাড়ি গিয়ে ফটিককে স্কুলে ভর্তি করে দিবি।
হ্যাঁ, আমিও
তাই ভাবছিলাম কিন্তু দেই দেই করে হচ্ছিল না। ঠিক আছে আজই দিয়ে দিব।
সন্ধ্যার
পর বাড়ি ফিরে হিরণ ফটিককে বলল যা তো দেখে আয় স্কুল খুলেছে নাকি
কথাটা ফটিকের
কানে ঢোকার সাথে সাথে এক দৌড়ে বাড়ির পিছনে প্রেসের পাশের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে দেখে এসে
জানাল
মামা খুলছে
চল, একটু
দাড়া চা টা খেয়ে নিই
আচ্ছা মামা
ফটিকের বুকের
ভিতর এক অজানা ঢেউ উথাল পাথাল শুরু করে দিল। আমি স্কুলে ভর্তি হমু?
কে আমি?
এই ফটিক
চল।
স্কুলে এসে
ফর্ম লিখতে গিয়ে হিরণ এক বিপদে পরল। ওর নাম, বাবার নাম কি করবে? একটু ভেবে ওর নাম দিল
আরিফুর রহমান। ফটিককে জিজ্ঞেস করল তোরা বাবার নাম কি রে? কি জানি মামা তা কইতারতাম
না।
তোর কি কিছুই
মনে নেই?
না মামা
আচ্ছা ঠিক
আছে, বলে হিরণ ওর নিজের বড় ভাইয়ের নাম দিয়ে দিল।
আজ থেকে
ফটিকের পরিচয় নতুন নামে শুরু হল।
আরিফুর রহমান।
ফইটক্যার
নতুন এক জীবন শুরু হল, বলা যায় নতুন করে জন্ম হল।
বাসায় এসে
হিরণ সবাইকে বলে দিল ওকে এখন থেকে সবাই আরিফ নামে ডাকবেন। বড় ভাইকে আরিফের বাবার নামের
ঘটনা বলে জানিয়ে রাখল। প্রেসে এসে সবাইকে বলে দিল, কাল দোকানেও সবাইকে জানিয়ে দিতে
হবে।
৬।
দুপুরে দোকানে
খাবার নিয়ে যাবার পর আরিফের স্কুল খোলার আধা ঘণ্টার আগ পর্যন্ত দোকানে থাকে। বই লেখক,
পাবলিশার এদের সবার নাম ধাম চিনে নেয়। কার বই, কোন ধরনের বই কোথায় থাকে সব জেনে নেয়।
স্কুল খোলার আধা ঘণ্টা আগে চলে আসে। আসার সময় খালি টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে একটা রিকশা
ঠেলতে কোন অসুবিধাই হয় না। বাড়ি এসে মুখ হাত ধুয়ে মাথা আঁচড়িয়ে বড় মামিকে বলে কিছু
খেয়ে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। ক্লাস শেষ হলে ফিরে আসে।
রাতে ড্রইং
রুমে যখন সবাই টেলিভিশন দেখে আরিফ তখন কার্পেটে বসে স্কুলের দেয়া বাড়ির কাজ রাতেই করে
রাখে। একদিন ছোট মামি বলল
কিরে আরিফ
তুই টেলিভিশন দেখছিস না কি করছিস?
মামি, এখনতো
গান হইতেছে, গান কানে শুনতেছি, ও আর কি দেখুম? তাই অংক কয়টা কইরা রাখলাম। নাইলে কাইল
স্কুলে বেঞ্চে খাড়া কইরা রাখবে।
বাড়ির সবাই
লক্ষ করছে আরিফের ভাষার বেশ উন্নতি হয়েছে।
দুপুর পর্যন্ত
আরিফের তেমন কোন কাজ নেই। প্রেসের কাদের ভাই কাঁচা বাজার করতে যায় তার সাথে বাজারে
যায় আর ফেরার পথে ব্যাগটা নিয়ে আসে। বেশী দূরে না কাছেই বাজার। তবুও এত গুলি মানুষের
বাজার একেবারে কম না। বাজার এলে রান্না রান্না হতে থাকে, এদিকে আরিফের স্কুলের পড়া
শেষ করে রাখে। যখন যেটা না বুঝে ছোট মামির কাছে জেনে বুঝে নেয়। ছোট মামির কাছেই ওর
যত আবদার। মামি আমার এইটা লাগব ঐটা লাগব, কাইল দোকান থিকা আসার সময় এই রহম দেখলাম,
এইডারে কি কয়?
কে আমি?
ছোট মামি
আবার বলে রহম না বল রকম, এইডা না বলবি এটা, আমরা যেমনে কথা বলি সেভাবে বলার চেষ্টা
করবি।
আচ্ছা মামি
করুম।
আবার করুম!
বল করব।
করব।
হ্যাঁ, এইতো
এমনি করে বলবি।
পড়া শেষ
হলে গোসল করে খেতে আসে ওদিকে নানী বা বড় মামি দোকানের খাবার রেডি করে। আরিফের খাওয়া
হলে টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। মনে একটা আগ্রহ কাজ করে, দোকানে গেলেই ফেরার
পথে নগদ আট আনা পাবে! এভাবে এর মধ্যে ৭/৮ টাকা জমিয়ে ফেলেছে। মনে মনে ভাবছে দোকানের
সামনে একটু এগিয়ে সদরঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে পোস্ট অফিসের পাশে মাটির ব্যাংক দেখেছে।
এক দিন নিতান্ত কৌতূহল বশে দাম জিজ্ঞেস করেছিল। মাত্র আট আনা। ওখান থেকে একটা ব্যাংক
কিনতে হবে। আজ গিয়ে সবার খাওয়া হলে সব কিছু গুছিয়ে একটু বেরুতে হবে।
বিকেলের
আগে আরিফ একটা ব্যাংক হাতে নিয়ে ফিরছে। হিরণের সামনে পরে গেল।
কি রে এটা
দিয়ে কি করবি?
টাকা জমামু
মামা!
টাকা পাবি
কোথায়?
কেন, রিকসা
ঠেলি রোজ
রিকশা ঠেলিস!
কখন?
হিরণ ভেবে
পায় না
কেন মামা,
বাড়ি যাইবার সময় একটা রিকশা ঠেললেইতো আট আনা
তাই নাকি?
হ মামা,
আমার যা লাগে হে তো আপনেরাই দেন
ও! সেই পয়সা
জমাবি? বেশ ভাল।
তাছাড়া আপনেরাও
মাঝে মইধ্যে দেন হেই ট্যাহা দিয়া আমি কি করুম? তাই।
একটু হেসে
হিরণ বলল
বেশ, তুই
এভাবে জমা করতে থাক যেদিন তোর এই মাটির ব্যাঙ্ক ভরে যাবে সেদিন আমাকে বলবি তোর নামে
ব্যাঙ্কে একাউন্ট করে দিব।
আমারে ব্যাঙ্কে
একাউন্ট কইরা দিবেন?
হ্যাঁ, তোর
যখন অনেক টাকা হবে তখন আমাকে ধার দিবি!, কি দিবি না?
কি যে কন
মামা!
কে আমি?
৭।
এদিকে বাড়িতে
এক বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে বড় মামি মারা গেল। যেদিন আরিফ
এ বাড়িতে এসেছে সেই দিনই লক্ষ করেছে বড় মামির পেট একটু উঁচু। ভেবেছে অনেকের যেমন ভুঁড়ি
থাকে তেমন কিছু হবে। অবশ্য ময়মনসিংহ স্টেশনে থাকতেও এমন ভুঁড়ি ওয়ালা অনেক মহিলা দেখেছে
কিন্তু মহিলাদের এমন ভুঁড়ি কেন হয় তা আরিফ আগে জানত না। এক দিন খুব ভোঁরে বাড়িতে সবার হুলস্থূলের শব্দ পেয়ে
ঘুম ভেঙ্গে দেখে বড় মামিকে নিয়ে বড় মামা, ছোট মামি আর নানী কোথায় যেন যাচ্ছে। আরিফ কিছু বুঝে উঠার আগে গাড়ি ছেড়ে দিল। ছোট মামাকে
কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস না পেয়ে আবার শুয়ে পরল। হিরণের রুমের পাশে দিয়ে সিঁড়ি ঘরের
চিলে কোঠায় আরিফের থাকার ঘর বরাদ্দ হয়েছে। আরিফ ওর নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছে সেই ছোট্ট
চিলেকোঠা।
পরের দিন
জানতে পারল বড় মামি আর নেই। তার মৃত দেহ যখন বাড়িতে নিয়ে এলো তাই দেখে ফটিক বড় মামির
পায়ের কাছে আছড়ে পরল। মামি আমারে থুইয়া কই গেলেন মামি! আমার নিয়া যান। ছোট মামির কাছে
আবদার আহ্লাদ থাকলেও ছোট মামি বড়ই ছেলে মানুষ। বড় মামি না থাকলে পুরো বাড়িটাই যেন কেমন
ফাঁকা মনে হত। কখনও আরিফ বিষণ্ণ মুখে বসে আছে আর বড় মামির সামনে পরলে সে হাত ধরে রান্না
ঘরে টেনে নিয়ে যেত,
কিরে ক্ষুধা
লেগেছে? কি খাবি বল!
মামি আমার
ভুখ লাগে নাই
তাহলে কি
হয়েছে বল
কইলামত কিছু
হয় নাই, আমার আবার কি হইব?
এক দিন বৃষ্টির
দিনে-
মামি, বিস্টির
মধ্যে খিচুরি মজা লাগে না মামি?
খিচুরি খাবি?
আচ্ছা রাতে করব। ঈদের মধ্যে সবার আগে আরিফের জামা, প্যান্ট জুতা কেনার জন্য বড় মামি
আলাদা করে টাকা দিয়ে দিত হিরণকে, আরিফের জন্য ঈদের কাপর চোপর নিয়ে আসবি। বাড়িতে মেহমান
জন এলে আরিফ দৌড়ে এসে জেনে নিত মামি কি লাগব তাড়াতাড়ি কন আইনা দিয়া যাই।
সেই মামি
আরিফকে ছেড়ে এভাবে চলে গেল?
দুপুরে জানাজার
পর ফরিদাবাদ গোরস্তানে নিয়ে গেল। আরিফ গেল সাথে। দাফনের কাজ শেষ করে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে
সবার সাথে হাত তুলে বলল ‘আল্লা আমার মামিরে তুমি ভেস্তের দরজা খুইলা দিও, আমার মামিরে
তুমি মাটির নিচে রাইখা না, আমার মামির কষ্ট হইব। আরিফের আল্লা তার এ অনুরোধ রেখেছিল
কিনা তা আমি জানি না।
সেই মামি
তাকে এই ভাবে রেখে গেল! দুই তিন দিন পরে একটা ছোট্ট পরী নিয়ে এলো ছোট মামি আর নানী।
বড় মামি নাকি এরে আনবার যাইয়া আল্লার কাছে চলে গেছে। সেই থেকে প্রথম দিকে একটু বাঁকা
দৃষ্টিতে দেখত কিন্তু দিনের সাথে সাথে ছোট্ট পরীর হাসি কান্না শুনে কেমন একটু একটু
করে মায়া এসে ভর করল অবুঝ এই কিশোরের মনে। কখনও এত ছোট বাচ্চা দেখেনি। এই ছোট্ট বাচ্চাটা
কি দোষ করছে?
কে আমি?
হেয়তো কোন
দোষ করে নাই। কি সুন্দর হাসে আবার কান্দে একটু আদর কইরা কোলে নিয়া কইলেই চুপ
করে, দেখতেতো
এক্কেবারে পরীর মত, বড় মামিও এই রকম আছিল! এই পরীর প্রায় অর্ধেক দেখাশুনার ভার আরিফ
নিজেই নিয়ে নিল। ঘটা করে নিতে হয়নি। আজ এই কাপড়, কাল বিছানার কাঁথা ধোয়া থেকে শুরু
করে এটা ওটা করা, ফিডার ধুয়ে আনা এবং যা যা প্রয়োজন তা করে নানী আর ছোট মামিকে সাহায্য
করতে গিয়ে কখন যেন অলিখিত ভাবেই অনেক দায়িত্ব আরিফের উপরেই বর্তে গেল। দোকানে যাবার
আগে নানীকে জিজ্ঞেস করে যেত
পরীজানের
জন্যে কিছু লাগব নানী?
না।
যেদিন নানী
কিছু লাগবে বলে দিত সেদিন সারা পথ মনে করে করে যেত নয়ত লিখে নিয়ে যেত। মামা যতক্ষণ
পরীর জিনিস কিনে না আনত ততক্ষণ মামাদের অস্থির করে রাখত।
মামা পরীজানের
কিন্তু এইটা লাগবই, নানী কইয়া দিছে
আচ্ছা আচ্ছা
একটু সবুর কর।
৮।
পরী এখন
হাঁটতে পারে। একটু একটু কথাও কয়। ছোট মামিও কেন যেন ইদানীং একটু পরে পরে বমি করে। এতদিন
ছোট মামি পরীর দেখাশুনা যতটা করতে পারত এখন অতটা পারে না। মা হারা পরীও আরিফকে চিনে
ফেলেছে। ছোট চাচী, দাদি সবাইকে চিনে নিয়েছে। পরীর বিছানা গুছিয়ে রাখা থেকে দুধের ফিডার
ধোয়া, টুকিটাকি যখন যা লাগে দোকান থেকে কিনে আনা থেকে শুরু করে কোলে নিয়ে ছাদে বা বারান্দায়
ঘোরা, যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেদিন পরীকে কোলে নিয়ে ধুপ খোলার মাঠ থেকে ঘুরে আসা। এভাবেই
চলতে চলতে পরী এখন আর কোলে থাকতে চায়না। মা হারা মেয়ে মাটি মায়ের টানে মাটির বুকে হেঁটে
বেড়াতে চায়, একা একা। আরিফের হাত না ধরে। দিন মাস বছরের সাথে একদিন পারেও। যেমন চাইছিল
তেমনি করেই। দাদি, বাবা, চাচা-চাচী আর আলি ভাইয়ের (ছোট থেকেই সে আরিফ উচ্চারণ করতে
না পেরে আলি ভাই বলে ডাকত) আদরে পরী বেশ বড় হয়েছে। স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সকালে আলি ভাই
স্কুলে দিয়ে আসে। সংসারের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ছোট মামিও এক বাচ্চা নিয়ে এসেছে, সেও
বেশ বড় হয়েছে। পরীর এখন আর একাকীত্বের কোন সুযোগ নেই। আরিফের সাথে সাথে পরীও বেড়ে উঠেছে।
পরীর ছোট চাচাত বোনটিও বেড়ে উঠেছে। বাড়িটা এখন সারাদিন হৈচৈ হাঁক ডাকে ব্যস্ত থাকে।
পুরনো আমলের বাড়ির দোতলার লম্বা টানা বারান্দায় টানানো রশিতে এখন ছোট ছোট ফ্রক, ন্যাপকিন
শুকাতে দেখা যায়। বড় মামির কথা আরিফ এখনো ভুলতে পারেনি। তারিখটা ঠিক মনে করে রেখেছে।
বড় মামাকে
সকালে মনে করিয়ে দেয়। মামার সাথে সেও গোরস্তানে যায়। আরিফের পোশাক আশাক আর বাড়িতে ওর
চলাফেরা দেখলে বাইরের কেউ বুঝতে পারে না এই ছেলেকে রেল স্টেশন থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছিল,
যার কোন পরিচয় ভিন্ন কেউতো দূরের কথা সে নিজেই জানে না। সে তার বাবা-মা কারো পরিচয়
কে আমি?
কিছুই জানে
না। সে শুধু জানে ছোট মামা তাকে সঙ্গে করে ময়মনসিংহ রেল স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে। চোখে
একটু ছায়ার মত আসে, দৌড়ে এসে ছোট মামার হাত ধরে ট্রেনে উঠে বসল। এই বাড়িতেই আমার জন্ম।
কমলাপুর নেমে ফুটপাথ থেকে তার পুরনো পরিচয় সব ফেলে দিয়ে নতুন পোষাকে নতুন করে ঢেকে
নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে। গায়ে লাগা যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা বাথরুমে ঢুকে সাবান দিয়ে
ঘসে ঘসে একেবারে মুছে ফেলেছে। এখন এটাই তার পরিচয়। এর বেশী আর কিছু সে জানে না। মনে
নেই। ফইটক্যা বা ফটিকের ইতিহাস এখন আর বিশেষ কিছু মনে পরে না। শুধু বাদলা দিনে যখন
চিলেকোঠার জানালা দিয়ে বাইরে ঘুণ্টি ঘরের পাশে ওই রেল লাইনের দিকে তাকায় তখন একটু একটু
ছায়ার মত কখনও উড়নচণ্ডী মেঘ হয়ে ভেসে আসতে চায় কিন্তু আরিফ কিছুতেই সে দরজা খুলতে চায়
না। তবুও ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু আধটু চুরি করে মনের ঘরে ঢুকেই পরে। শত চেষ্টা
করেও আরিফ তা ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। ওই যে সেদিন, চায়ের কাপ ভাল করে ধোয়া হয়নি বলে
কেব্বাত আলী রাতে খাবার দেয়নি। কাস্টমর নোংরা কাপ দেখে চলে গিয়েছিল বলে দুই গালে দুই
চর মেরে বলেছিল আইজ রাইতে তর খাওন বন্ধ। আজাইরা বইয়া বইয়া খাইয়া গতরে চর্বি জইমা গেছে
তাই কাপ ধুইতে মন লাগে না? এই কথা কি আর ইচ্ছা করলেই ভুলা যায়?
ঘড়ির কাটা
ঘুরুক আর না ঘুরুক তাতে কার কি আসে যায়? সময়
ঠিক তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেছে, একটুও থামেনি। এই সুযোগে আরিফকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
ভাবতে শিখিয়েছে। বিচার বিবেচনা করতে শিখিয়েছে। না শুধু তাই না, আরও অনেক কিছু শিখিয়েছে
যা ধীরে ধীরে আরিফের কাজে লাগবে।
আরিফ জানে,
তারেক হাসান তার বাবা নয়। এই নামটা শুধু স্কুলের ভর্তির জন্য ছোট মামা ভর্তির ফর্মে
লিখে দিয়েছিল। বাপের নাম না থাকলে নাকি স্কুলে ভর্তি হওন যায় না! কি আশ্চর্য কথা! যার
বাপ মা নাই হে কি তাইলে পড়তাম পারব না? হে কি নিজে ইচ্ছা কইরা তার বাপ মায়েরে গুম কইরা
থুইয়া আইছে?
সূত্রাপুর
লোহার পুলের নিচে ধোলাই খাল দিয়ে ঢাকা শহর ধোয়া অনেক পানি বুড়িগঙ্গায় মিশেছে এর সাথে
কি আরিফের কান্নার কিছু পানি ধোলাই খালের পানির সাথে মিশেছিল? তাহলে আরিফের কান্না
গুলি সব কেন ধুয়ে নিয়ে গেলনা? সারা জীবন কি আরিফের কাছে তার জন্ম পরিচয় অজানা থাকবে?
যা কেবল রাতের বালিশ আর চিলেকোঠায় দেয়ালের পাশে পাতা বেঞ্চ ছাড়া এই পৃথিবীর কেউ জানবে
না? আরিফের স্কুলে শিখেছে বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত আর
বসন্ত। কিন্তু আরিফ অনেক হিসেব করে দেখেছে তার জীবনে একটাই ঋতু। আমি কে?
আজ না হয়
এভাবে গেল কিন্তু কাল? যখন আরিফের সন্তানেরা তাদের দাদার নাম জানতে চাইবে, দাদির মায়ায়
ছোঁয়া একটু নারকেলের নাড়ু পেতে চাইবে কিংবা দাদির বুকের উষ্ণতায় শুয়ে গল্প শুনতে চাইবে,
কিংবা নিদেন পক্ষে দাদার ভিটেটা দেখতে চাইবে তখন? কি জবাব আছে তার কাছে?
কিরে আরিফ
কোথায় গেলি?
নানী ডাকছে।
দোকানে যাবি
না?
কে আমি?
জাল ছিঁড়ে
গেল। আরিফ উঠে পা টেনে নিয়ে গেল নানীর কাছে
নে, তড়াতাড়ি
খেয়ে ছাপান কাগজ গুলি নিয়ে দোকানে যা। হাসান তোকে বলে গেছে না?
হ কইছে,
যাইতাছি।
৯।
ময়মনসিংহ
রেল স্টেশন থেকে কুড়িয়ে আনা ফইটক্যা ওরফে ফটিক ওরফে আরিফ পরীকে বড় করার সাথে সাথে একদিন
দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করল। এর মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গেছে। বাংলাবাজার এলাকায় আরিফকে
চিনে না এমন কেউ নেই। যে কোন দোকান থেকে ২/৪ হাজার টাকার মাল নিয়ে এলেও সবাই দিয়ে দিবে।
শুধু আরিফ গিয়ে বললেই হবে মামা ১০রিম কাগজ দেন। কে পাঠিয়েছে, কি করবে বা কেন নিবে কেউ
জিজ্ঞেস করবেনা। সবাই জানে এই আরিফ বিখ্যাত পান্থনীড় প্রকাশনীর দেশের বিশিষ্ট প্রকাশক
তারেক হাসান সাহেব এবং হিরণের একান্ত সহকারী। শুধু কি তাই, সে আরও অনেক কিছু। দোকানের
চাবি, আলমারির চাবি থেকে শুরু করে সব হিসাব নিকাশের খাতা পত্র এই আরিফের কাছেই থাকে।
কোন লেখকের বই কতটা চলছে কার পাণ্ডুলিপি কিনে নিতে হবে আর কার পাণ্ডুলিপি লেখক নিজে
ছাপাবে সে আরিফ জানে।
বই মেলায়
কোন বই যাচ্ছে, কোন বই যাচ্ছে না, স্টলের ডেকোরেশন কেমন হবে, কোন সেলফে কোন বই থাকবে।
কোন লেখকের বই কোন সেলফে থাকবে। কোন লেখকের বইতে কোন কাস্টমারকে কত কমিশন দিতে হবে
সব কিছুই বড় মামার কাছে শিখে নিয়েছে। এখন মেলার আগে বড় মামা শুধু বলে দেয় আরিফ, ফেব্রুয়ারি
মাস এসে গেছে, মনে আছে?
হ মামা,
গুছাইতাছি। আপনে চিন্তা কইরেন না, আমি আর ছোট মামা সব ঠিক কইরা নিমুনে।
এই ছোট বড়
নানা কাজেকর্মে আরিফ এখন প্রকাশনা জগতটাকে বেশ ভাল করে চিনে নিয়েছে। খুঁটিনাটি অনেক
কিছু এখন আরিফের জানা। সেই সাথে ছাপাখানার ভিতর-বাহির, বাইন্ডিং, ফর্মা, বই এর হিসাব,
কাগজ কালির হিসাব, দশ ফর্মার বই ছাপাতে কত সময় লাগবে ইত্যাদি সহ বই সংক্রান্ত আয় ব্যয়ের
নানান খুঁটিনাটি শিখে নিয়েছে। কোথা থেকে কি ভাবে বই মফস্বলের ডিলারদের কাছে পাঠাতে
হয়, কে পেমেন্ট করেছে কে করেনি, কারটা আগে, কারটা পরে পাঠাতে হবে সব আরিফের নখদর্পণে।
আরিফের এসএসসি
পাশ করার খবর যেদিন হিরণের ভাই প্রথম শুনেছিল সেদিন হাসান সাহেব নিজে আরিফকে সাথে নিয়ে
বাংলাবাজারের সব দোকানে দোকানে নিয়ে মিষ্টি খাইয়ে এসেছে। এযে হিরণের আবিষ্কার ইতিমধ্যে
এলাকার সবাই তা জেনে গেছে। দোকান আর প্রেস মিলে আরিফের এখন অনেক কাজ। এখন আর সে টিফিন
ক্যারিয়ারে করে দোকানে ভাত আনে না। এজন্য অন্য আর একজনকে নেয়া হয়েছে।
আরিফের মাথার
চিন্তাভাবনার নিউরনগুলি কাজ করতে শিখছে। এখানে যাদের কাছে রয়েছে, যারা তাকে আজ রেল
স্টেশনের পিচ্চি থেকে এখানে নিয়ে এসে আরিফ বানিয়েছে, যারা তাকে মানুষের পরিচয় দিয়েছে
তাদের কারো সাথে তার রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। কেবল একটু মায়ার বাঁধন। দেয়া নেয়ার হিসাব
মেলাতে পারে
কে আমি?
না। কি পেয়েছে
কি দিয়েছে সে হিসাব করতেও চায় না মেলাতেও চায় না। ও কথার কাছে যেতেও মন সায় দেয় না।
শুধু কিন্তু কিন্তু পর্যন্তই এগুতে পারে এর বেশী আর একটুও এগুতে পারেনি কোন দিন।
১০।
তবুও ভাবে
এ ভাবেতো আর সারাটা জীবন বয়ে যাবে না। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি ভাবে? কার সাথে
পরামর্শ করবে? একা একাই ভাবে। কারো সাথে পরামর্শ করতে পারে না। একদিন দোকান বন্ধ করে
বাড়ি যাবার পথে ছোট মামাকেই বলল
মামা, একটা
কথা কমু কইয়া ভাবতেছি কিন্তু সাহস পাই না
কি কথা?
মামা, আমি
কে, কইত্থিকা আইছি তার সব আমার মনেও নাই আর মনে করতামও চাই না। এইটুক জানি যে আপনেই
আমারে নতুন কইরা জন্ম দিছেন। আমার ছোট বেলার কথা আমার আর কিছু মনে নাই। আপনেই চোখে
চোখে রাইখা খাওয়াইয়া পিন্দাইয়া বড় করছেন, লেখা পড়া শিখাইছেন, কাম কাজ শিখাইছেন। অহন
আমি সব পারি।
হ্যাঁ তা
বুঝলাম, কিন্তু তুই আসলে কি বলতে চাচ্ছিস?
মামা, রাগ
করবেননাতো?
তুই বল
আচ্ছা মামা
বাড়ি যাইয়া কমুনে
ঠিক আছে।
সেদিন রাতে
বাড়ি ফিরে খাবার পর ড্রইং রুমে সোফায় বসে সবাই টিভি দেখছিল আর হিরণের পায়ের কাছে কার্পেটে
বসে আরিফ।
হ্যাঁ বল,
তখন কি বলছিলি
মামা, কইছিলামকি
আপনে আমার জন্যে যা করছেন তা আমি এই জীবনে শোধ দিতাম পারুম না। তাই কইছিলামকি কবে কি
বেয়াদবি কইরা ফালাই তহন আপনেরাও মনে কষ্ট পাইবেন আর আমিও সারা জীবন তাই মনে কইরা কষ্ট
পামু। তার চাইতে আমিতো এহন বড় হইছি।
এই পর্যন্ত
বলে আরিফের আর কোন কথা আসছিল না।
থামলি কেন
বল
কেমনে কমু
মামা? এই কথা কি এত সহজে কওয়া যায়?
বল তুই না
বললে আমি বুঝব কেমনে?
আমারে একটা
কিছু কইরা দেন আমি আমার মত থাকি! আপনেগো কাছাকাছিই থাকুম, যহন দরকার হইব আমারে ডাকলেই
যাতে আইতে পারি! আপনেরাই পাইলা মানুষ করছেন চোখ মেলতে শিখাইছেন। আমার বড় ডর করে যদি
কোন দিন আপনাগো অবাধ্য কিছু কইরা ফালাই! তহন আপনেরাও সহ্য করতে পারবেন না আবার আমিও
যন্ত্রণায় জ্বলুম।
তা তুই এমন
করবি কেন?
কে আমি?
মামা আপনেরা
জানেন না মাইনসে কত কিছু কয়!
কে কি বলে?
থাক, এগুলি
শুনলে মনে খালি কষ্টই পাইবেন। আমিতো আর তাগো কথা শুনতে চাই না। কে আমার বাবা কে আমার
মা কোথায় আমার বাড়ি, কোথায় আমার ঠিকানা কিছুই ত জানি না। খালি এক আপনাগোই চিনি। কনতো
মামা আমি কে?
কেন, তুই
আরিফ!
মামা, আমারে
আপনে নিজেই টোকাইয়া আনছেন আপনে এই কথা কেমনে কইলেন? আর কেউ জানুক আর না জানুক আপনে ঠিক জানেন আমারে কইত্থিকা
নিয়া আইছেন!
চোপ কর,
থাম এত কথা কোথা থেকে শিখলি?
না মামা
আমি কথা শিখি নাই, যা আসল আমি তাই কইতেছি! যেডা কাইল হইব হেইডা আইজই কইয়া দিলাম। মামা
আপনে বড় মামারে একটু কইয়েন!
আচ্ছা বলে
দেখি।
দেখেন মামা
বলেই একটু
মামার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সাথে সাথে মুখ নামিয়ে নিল।
ও! এই কথা?
হ্যাঁ বুঝেছি, আর বলতে হবে না। আচ্ছা সবুর কর মা আর দাদা ভাইয়ের সাথে আলাপ করে দেখি।
আইচ্ছা মামা।
১১।
কয়েকদিন
পরে আবার একদিন সন্ধ্যায় দোকান থেকে ফিরে ড্রইং রুমে। হাসান সাহেব, হিরণ বসে কি আলাপ
করছিল।
যাতো আরিফকে
ডেকে নিয়ে আয়!
আরিফ!
জী মামা
আইতাছি!
দুরু দুরু
বুকে আরিফ এসে সামনে দাঁড়াল।
বোস ওখানে।
আরিফ তার
নির্দিষ্ট জাগায় কার্পেটে বসল। আরিফ জানে মামারা এখন কি বলবে।
তুই খুব
ভাল কথা মনে করে দিয়েছিস। রফিক সাহেবের দোকানের এক পাশে ভাড়া দিবে। শোন এখন
ওটা তোর
নামে ভাড়া নিয়ে নিই। তুই আপাতত আমাদের নিজেদের পাবলিকেশন গুলি বিক্রি করবি।
বলে একটু
আরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে,
কি, পারবি
না?
পারুম।
কে আমি?
পরে আস্তে
আস্তে অবস্থা বুঝে যখন যা ভাল হয় করবি। আমি বলে দিব।
থাকুম কোথায়
মামা?
ও!
এখানে থাকবি
না?
না, মানে
কইছিলাম কি......
আচ্ছা বুঝেছি,
আর বলতে হবে না।
তা হলে ওদিকে
প্যারিদাস রোডের কাছাকাছি কিংবা লক্ষ্মী বাজারে কোন মেস খুঁজে দেখ
মামা, একটা
কথা কমু?
কি?
ওই প্রেসের
কাগজের গুদামের পাশে যে একটু খালি জাগা আছে ওখানে একটা চোকি পাতলে হয় না? পরে গুদামের
পাশে কয়টা টিন দিয়া ছাইয়া দিলে একটা রুমের মত হয়।
ও! ঠিক আছে
থাক।
১২।
এই শুরু
হল আরিফ ওরফে ফটিক ওরফে ফইটক্যার জীবনের আর একটা নতুন জীবন। কাগজের গুদাম ঘরের এক পাশে
একটা চৌকি পেতে বেশ থাকছে। খাওয়া দাওয়া আগের মতই চলছে। বাড়ির টুকিটাকি কাজ, বাজার করা
সহ যতটা সম্ভব করে। ওদিকে ব্যবসা বেশ ভালই চলছে। এ ভাবে আরও কয়েক বছর থাকার পর আরিফের
বিয়ের প্রস্তাব এলো। হিরণের মা তখনও বেচে। ছোট মামি, আর নতুন বড় মামি যেয়ে একদিন মেয়ে
দেখে আসল। ঢালকা নগরে বাড়ি। বাবা রেলের সিগন্যাল ম্যান। বাড়ির বৌরা মেয়ে দেখে এসে হাসান
সাহেবকে বলল। হাসান সাহেব দোকান আর বাড়ির পাশের ৪/৫ জনকে নিয়ে পাকা কথা দিয়ে তারিখ
ঠিক করে আসল।
কথা দিয়ে
আসার পর ওই সেই আগের দেখান আরিফের প্রস্তাব অনুযায়ী কাগজের গুদামের পাশে ৭/৮টা টিনের
চালা দিয়ে টিনের বেড়া দিয়ে একটা ঘর তুলে সেখানেই নতুন বৌ এনে তোলার জায়গা করে দিল।
পাশেই একটা খোলা বাথরুম আর টয়লেট ছিল আগে থেকেই। সেগুলি একটু বেড়া দিয়ে মেরামত করতে
হয়েছিল। মেয়ের বাড়ি থেকেই আসবাব পত্র যা দেবার দিয়ে দিয়েছে। হিরণের মা বৌয়ের জন্য কয়েকটা
গহনা তৈরি করিয়ে দিয়েছিল।
আরিফের নিজের
পরিচয় মুছে গেল। এখন সে নতুন বৌকে নিয়ে তার সেই “কে আমি” প্রশ্নের জবাব খুঁজে দেখার
জন্য ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
---------------------0000000000000--------------------
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।