বিকেল বেলার বৃষ্টি [৬]-৬
২১।
আবাদান নেমে দেখে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে মা অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠে বসার আগে
সাবিহার নম্বরে ফোন করে মায়ের হাতে ফোনটা দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?
দেখ কে!
হ্যালো,
মাহমুদের মায়ের কণ্ঠ শুনে সাবিহা নিজেকে সংযত করতে চাইল। ক্ষীণ কণ্ঠে হ্যালো
বলে জিজ্ঞেস করল মা বলেন আপনি কেমন আছেন, আপনার
ছেলে পৌঁছেছে?
সাবিহার ভারি কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারল ও কাঁদছিল। হ্যাঁ ও পৌঁছেছে কিন্তু তুমি
কাঁদছ কেন মা?
এ পাশে নিশ্চুপ। শুধু মাঝে মাঝে সাবিহার ফুঁপানির শব্দ শুনতে পারছিল।
আমি এখন কি করে থাকব? এখানে আসার পর থেকেই ও আমাকে কোনদিন
কিছু করতে দেয়নি। সব কিছু ওই করে দিয়েছে। আমার ভারি একা লাগছে মা, অসহায়
মনে হচ্ছে!
না না এমন করে ভেঙ্গে পড়তে নেই, তোমাকে শক্ত হয়ে ওর জন্য প্রস্তুত
হতে হবে,
তুমি না মায়ের জাত! তুমি ভেঙ্গে পড়লে ওকে কে দেখবে? ও কাকে নিয়ে
জীবন কাটাবে। ও যে তোমাকে ভীষণ ভালবাসে!
হ্যাঁ মা আমাকে শক্ত হতেই হবে।
২২।
মাস ছয়েক পরে একদিন সাবিহা সকালে যথারীতি ক্লাসে এসেছে। দুপুরে মৌ মিতা ফোন
করে বলল
সাবিহা তুমি কোথায়?
লাইবেরিতে
তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আস
কেন,
কি হয়েছে?
ডান্ডি থেকে তোমার এক রিলেটিভ এসেছে
সাবিহা অবাক হয়ে বলল, ডান্ডি থেকে?
হ্যাঁ,
তাইতো বলল
কিন্তু ডান্ডিতে আমার কেও আছে বলে কখনও শুনিনি, নাম বলেছে?
না নাম বলেনি শুধু বলল সাবিহাকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বল।
নামটা জিজ্ঞেস করবে না? আচ্ছা আসছি।
বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতেই মাহমুদ দরজা খুলে সাবিহার দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল আর
তার পিছনে মৌ মিতা মিটমিট হাসছিল। সাবিহা অবাক হয়ে ওকে দেখছে। যেন নিজের চোখকেও
বিশ্বাস করতে পারছে না। অস্ফুট কণ্ঠ বেরিয়ে এলো, তুমি!
ম্যাডাম কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আসুন ভিতরে আসুন! আমি নিয়ামত উল্লাহ
মাহমুদ, আসুন!
কোথা থেকে কেমন করে এলে? আমাকে আগে জানাওনি কেন?
তুমিই বল আগে জানালে কি তোমার এই চেহারা দেখতে পেতাম? আস, ভিতরে
আস
হঠাৎ কোথা থেকে কেমন করে এসেছ?
পরশু আমাদের জাহাজ ডান্ডি এসেছে আর আজ দুপুরের ডিউটি সেরে সোজা এখানে চলে
এলাম। তোমাকে চমকে দেব বলে আগে কিছু জানাইনি, বুঝলেন
ম্যাডাম?
এবার বল তুমি কেমন আছ?
পরশু এসে একটা ফোন করলে না কেন? আবার পরশু এসে আজ কেন এলে?
বললামতো ইচ্ছে করেই ফোন করিনি আর ছুটি পাচ্ছিলাম না বলে আগে আসতে পারিনি, দয়া
করে ক্ষমা করা যাবে না? এর আগে ইজিপ্ট থেকে যখন ফোন করেছিলাম
তখন থেকেই ভেবে রেখেছি এবার তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব তাই
আমাদের নেক্সট পোর্টের কথা তোমাকে বলিনি
মৌ মিতা ওদের একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে বসতে বলে চা আনতে গেল।
কত দিন থাকবে?
কালই যেতে হবে, জাহাজ আন লোড হচ্ছে ছুটি পাবার উপায় নেই। আগামী পরশু সেইল
করে সাউথ আফ্রিকা যাব
রাতের খাবারও মৌ মিতাই রান্না করল।
প্রায়ই ফোনে কথা হচ্ছে তবুও মনে হচ্ছে কত কথা জমে আছে। কত কি বলার আছে। অনেক
রাত পর্যন্ত কথা বলে মৌ মিতা সহ এক সাথে রাতের খাবার খেয়ে মাহমুদ কাল সকালে আবার
দেখা হবে বলে রেজার বাসায় চলে গেল।
বের হবার আগে বলে দিল, সকালে কিন্তু এখানে এসে খাবে।
২৩।
বিভিন্ন বন্দরে থাকার সময় ফোনে আলাপ, জাহাজ যখন সাগরে থাকে তখন ই মেইলে
পত্রালাপ আর দুজনে দুজনার স্বপ্ন দেখে দিন গুলি চলে যাচ্ছিলো। মাহমুদের মাও নিয়মিত
ফোন করে হবু পুত্র বঁধুর খোজ খবর নেয়। সাবিহার মা বাবা এক বার এসে মেয়ের কাছে প্রায়
মাস খানিক থেকে বেড়িয়ে গেছে। এক
ভয়েজে জাহাজ মুমবাই গিয়েছিল সেখান
থেকে কলকাতা গিয়ে আলিপুরে ডায়মন্ড হারবার রোডে সাবিহাদের বাড়িতে হবু শ্বশুর শাশুড়ির সাথেও দেখা করে জামাই আদর পেয়ে আবার পরের দিনের ফ্লাইটে মুম্বাই ফিরে এসেছে।
মাহমুদও আর একবার লন্ডনে এসেছিল তখন সাবিহা লন্ডনে যেয়ে ৩/৪ দিন থেকে দেখা করে
এসেছে। সাবিহা এমএতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এমনিতেও ছাত্রী হিসেবে সাবিহা খুবই
ভাল। সাবিহা এখন ব্যারিস্টার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লেখাপড়ার ভীষণ চাপ। যে করেই
হোক তাকে এবারই শেষ করতে হবে, সময় নেয়া যাবে না। এত
সময় হাতে নেই। যত দিন যাবে মাহমুদের সাথে তাদের মিলনের দিনও তত পিছিয়ে যাবে।
নিতান্ত নিরুপায় হয়ে যোগাযোগের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। আগের মত ইচ্ছে করলেই ফোন
নিয়ে বা মেইলে লিখতে বসতে পারে নে। মাহমুদ মনে মনে কষ্টে থাকলেও নিজেই মনকে প্রবোধ
দেয়, এইতো
আর একটা বছর একটু ধৈর্য ধরতেই হবে। সাবিহাকেও তেমনি সান্ত্বনা দেয়। সামনে প্রচুর
সময় পাব। সাবিহার বার হয়ে গেলে ওকে নিউ ক্যাসেল বা লন্ডনে এফিলিয়েট করে রেখে আগে
অন্তত একটা বছর এক সাথে ভয়েজ করব। দুজনে এক সাথে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব তারপরে
নিউ ক্যাসেলে সেটল করব। সাবিহা এক বার ব্যারিস্টারি শুরু করলে ওকে নিয়ে যখন তখন
বের হতে পারব না।
বিরহ বড়ই কঠিন যন্ত্রণা। হৃদয়ের
অলিতে গলিতে কাটার মত বিধতে থাকে। এক পলকের জন্যেও ভুলে থাকতে দেয় না,
অনবরত দহন হতেই থাকে। তুষের আগুন যেমন শিখা না তুলে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে জলে
তেমনি করে। এ আগুনে যে একবার হাত দিয়েছে তার আর কোন উপায় থাকে না। ফিরেও আসতে পারে
না আবার সহ্য করাও কঠিন। এত কিছু সহ্য করে একসময় মাহমুদের
চিফ মেট হিসেবে দুই বছর এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেল
এবার নিউ ক্যাসেলে এসে মাস্টার ম্যারিনার পরীক্ষার জন্য রিফ্রেশর কোর্স করতে হবে।
মাস ছয়েকের ব্যাপার। এদিকে সাবিহার ফাইনাল পরীক্ষার সময়ও
ঘনিয়ে আসছে। মাহমুদ আবার সাবিহাকে ফিরে পেয়েছে। ঠিক তেমনি করেই সব ব্যবস্থা করে
নিয়েছে যেমনটি আগে ছিল। এসে আগের মতই রেজার বাসায় উঠেছে।
রেজা মাহমুদের মত ম্যারিনার নয় সে স্পেস সাইন্সের ছাত্র। ওর শেষ হতে এখনও দেরি
আছে।
২৪।
পৃথিবীর পথ পরিক্রমায় দিন থেমে থাকে না। সময়ের ঘড়ি চলতেই থাকে। অনেক আনন্দ
বেদনা, সুখ
দুঃখ, হাসি
কান্না আর সাবিহার চোখের জল নিয়ে মাহমুদের হিসেব অনুযায়ী দুইটা বছর চলে গেছে। দুই
জনেরই পরীক্ষা হয়ে গেছে এবং দুইজনেই পাশ করেছে। সাবিহা এখন ব্যারিস্টার সাবিহা
খানম হয়েছে,
তার একটা সাধ পূর্ণ হয়েছে আবার মাহমুদও ক্যাপ্টেন মাহমুদ হয়েছে। এত দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী
প্রতীক্ষার অবসানের জন্য এবার বিয়ের পালা। নিউ ক্যাসেল, আবাদান
এবং কলকাতার টেলিফোন লাইন অনেক সময় ধরে ব্যস্ত থাকছে। নানা কথা বার্তা, জল্পনা
কল্পনা আলাপ আলোচনা ইত্যাদিতে অনেক ফোন বিল পাচ্ছে লাইন
প্রোভাইডার। কিন্তু এরা উপযুক্ত কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে
না। এদিকে সাবিহা এবং মাহমুদ একরকম ভাবছে, ওদিকে
আবাদানে মাহমুদের মা এক রকম ভাবছে আবার কলকাতায় সাবিহার মা বাবা আর এক রকম ভাবছে।
ওরা চাইছে নিউ ক্যাসেলেই বিয়ে হবে, এতে
ঝামেলার মধ্যে শুধু কোন হল ভাড়া করে
হোম অফিসের পারমিশন নিয়ে বর কনের ধর্ম মতে বিয়ে হবে। তারপরে এদেশে থাকার অনুমতি
চেয়ে হোম অফিসে আবেদন করতে হবে। আবার মাহমুদের মা ভাবছে কনে আবাদান যাবে বিয়ে
সেখানে হবে কিন্তু সাবিহার মা বাবা বলছে বিয়ে কলকাতায় হবে। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন
পর্যন্ত আলাপ আলোচনা চলে এক সময় কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল। কবে রোদ উঠে এই কুয়াশা
কাটবে?
২৫।
মাহমুদ এবং সাবিহা চোখে মুখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কোন পথ দেখছে না। কিন্তু
এতদিন ধরে অপেক্ষা করে যে পরিকল্পনা চলে এসেছে তাতে
পথ দেখা না গেলে চলতে পারে না। যে করেই হোক একটা বিহিত করতেই হবে। সাউথ শিল্ড
মেট্রো স্টেশনের পিছনে লম্বা মাঠের মত আছে তার এক পাশে বেঞ্চে বসে কথা হচ্ছিল।
সাবিহা মাহমুদকে তাগিদ দিচ্ছে, কি করবে এখন? বাবা যে কড়া
মেজাজের মানুষ তাকে বশ করা কঠিন ব্যাপার। আমি কিছু ভাবতে পারছি না, কি
হবে? তুমি
কিছু করছ না কেন? তুমি জান না সব সময় বর পক্ষ কনের বাড়ি যেয়ে বৌ নিয়ে আসে? তাহলে
মাকে বোঝাচ্ছ না কেন?
আবার মাহমুদ বলছে তুমি কলকাতা চলে যাও বাবার সাথে আলাপ করে একটা সিদ্ধান্ত
নিয়ে এসো
না, আমি
একা যাব না,
যেতে হলে তোমাকে নিয়েই যাব
তার চেয়ে চল আমরা ইরান চলে যাই
না আমি এখন বিয়ের আগে ইরান যাব না
তাহলে চল আমরা এখানেই বিয়ে করে ফেলি
বিয়ে করে ফেলি বললেই হলো?
আমার মা বাবা তোমার মা এদের কি হবে? আচ্ছা এক কাজ করা যায় না?
কি কাজ?
তুমি যাও মাকে বুঝিয়ে মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আস
তাহলে চল দুইজনে এক সাথেই যাই
সাবিহা একটু ভাবল। দাও দেখি ফোনটা দাও
আবাদানের নম্বরে ডায়াল করে অপেক্ষা করছে, হ্যালো
মা আমি সাবিহা
বল মা কেমন আছিস? মাহমুদ কেমন আছে
মা আমরা ভাল আছি, আমরা আবাদান আসছি
তাই নাকি?
যাক তোদের মত বদলেছে তাহলে, খুব ভাল হয়েছে আয় মা কবে আসবি?
না মা তুমি যা ভাবছ আসলে তা নয়, আমি যেতে পারি কিন্তু একটা শর্তে
সে আবার কি কথা? কি শর্ত?
আমি আর তোমার ছেলে এক সাথে তোমার কাছে যাব আর তোমাকে নিয়ে কলকাতা যাব এবং
সেখান বিয়ে হবে,
তুমি যদি এই শর্ত মেনে নাও তাহলে আমরা আজই টিকেট বুকিং দিবো।
না মানলে কি করবি মা?
কি আর করব,
সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় থাকব, তুমি যেদিন নিজে এসে নিয়ে যাবে
সেদিনই যাব তার আগে নয়
পারবি মা তুই আমার ছেলেকে আগলে রাখতে পারবি, আমি এমন
মেয়েই খুজছিলাম। আয়, তোরা কবে আসবি? আমি তোর সব শর্ত মেনে নিলাম
এখনই ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে যাব, যেদিন টিকেট পাই ওই দিনেই চলে আসব।
তুমি কলকাতা যাবার জন্য রেডি হয়ে
থাকবে কিন্তু
আচ্ছা বাবা আমি রেডি হয়েই থাকব।
তাহলে এখন রাখছি।
২৬।
ফোন রেখে মাহমুদের হাত ধরে উঠিয়ে কাছে মেট্রো স্টেশনের পাশের একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে গেল।
আবাদানের দুইটা টিকেট কবে পাব?
কাউন্টারে বসা লোকটা কম্পিউটারে দেখে বলল
আগামী পরশুর আগে কোন ফ্লাইট নেই।
ঠিক আছে তাই দাও
মাহমুদ পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে কার্ড দিয়ে পেমেন্ট দিয়ে টিকেট নিয়ে সাবিহার
বাসায় এলো।
নাও এবার গোছগাছ করে রেডি হও
রেডি আবার কি! যেমন আছি তেমনিই চলে যাব
তাহলে অন্তত কলকাতায় একটা ফোন করে বলে দাও
হ্যাঁ তা করতে হবে, কিন্তু আমাকে বলছ কেন তুমি বলতে পারছ
না?
আমি বলব?
হ্যাঁ তুমি বল, মাকে নিয়ে আসছি আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
২৭।
সময় মত আবাদান পৌঁছে দেখে বাইরে মা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এই প্রথম সাবিহাকে
দেখে মা মুগ্ধ হয়ে হা করে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মাহমুদ যা বলেছে, ছবিতে
যা দেখেছে তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী এই মেয়ে।
কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চেয়ে থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে আয় মা বলে সাবিহাকে বুকে চেপে ধরল। মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়ে সাবিহা ছোট্ট বাচ্চার মত
অনেকক্ষণ ওই ভাবেই রইলো।
আমি তোমার কাছে এসেছি মা, এবার তুমি আমার সাথে যাবে
যাব মা নিশ্চয় যাব
মাহমুদ তাগিদ দিল, কি হলো বাড়ি যাবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ চল, বলে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো।
সাবিহা বাড়ি এসে দেখে মা রীতিমত বধূ বরণের আয়োজন করে
রেখেছে। সাবিহা অবাক হয়ে শুধু এই সব কাণ্ড দেখছিল। জার্নির
ধকল কাটিয়ে পরদিন সকালে মাহমুদকে নিয়ে গাড়ি বের করে আবার আবাদানের এক ট্রাভেল
এজেন্টের অফিসে গেল এবং যথারীতি আবাদান-কলকাতা-আবাদানের তিনটা
টিকেট নিয়ে ফিরে এসে মাকে জানাল
মা, আমরা
সামনের বুধ বারে কলকাতা যাচ্ছি, ফেরার কনফার্মেশন ওখানে গিয়ে করবো।
আচ্ছা তাহলে এখন চল তোর মা বাবার জন্য কিছু নিয়ে আসি, সময়তো বেশি
নেই
না কিছু নিতে হবে না তুমি এমনিই চল
আরে আমার পাগলী মেয়ে বলে কি! এক দেশ থেকে আর এক
দেশে নতুন আত্মীয়ের বাড়ি কি এমনি এমনি যেতে আছে, কিছু উপহার
নিয়ে যেতে হয়।
মাহমুদের মা বেয়াইনের সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই তার মেয়ের প্রশংসা করে কোন
কুল পাচ্ছে না। বেয়াইন সাহেব আপনি একজন সার্থক মা, এমন মেয়ে
জন্ম দিয়েছেন বলে আপনাকে আগেই আমার সালাম এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সত্যিই এমন মেয়ে
আমার চোখে পড়েনি। প্রথম দিনে টেলিফোনেই ও আমার মন জয় করে নিয়েছে। আমি সেই থেকে এমন
মেয়ের মাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম, আজ মনে হচ্ছে আমার এখানে আসা সার্থক
হয়েছে। আমিতো এখানে আসতে চাইনি কিন্তু মেয়ের কথায় আমাকে আসতে হয়েছে। মেয়ে বলে কিনা
তুমি যতদিন নিজে এসে আমাকে নিয়ে না যাবে দরকার হলে ততদিন আমি অপেক্ষা করবো।
শুনেছেন মেয়ের কথা? এই কথা শুনে কোন মা বসে থাকতে পারে? তাই চলে
আসলাম।
আপনার ছেলের মত ছেলেও কিন্তু সচরাচর চোখে পড়ে না। খুব
ভাল ছেলে, আমাদের খুবই ভাল লেগেছে। এই মেয়ে কিন্তু এখন আপনার আপনি ওদের জন্য দোয়া
করবেন যাতে ওরা সুখী হয়।
হ্যাঁ বেয়াইন ওরা সুখী হলেইতো আমরা সুখী।
২৮।
মাহমুদের মা আয়েশা আক্তার এই প্রথম ভারতে এসেছে। প্রথমত ভাষা নিয়ে সমস্যা হবে
ভেবেছিল কিন্তু এখানে এসে দেখে এরা উর্দু ভাষায় কথা বলে। আয়েশা আক্তার এর বাবার
বাড়ি ইরান পাকিস্তানের সীমানার কাছে তাই সেও
মোটামুটি উর্দু বলতে এবং বুঝতে পারে। কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে ভারি খুশি। এদের
চালচলন, আচার
আচরণ, খাবার
দাবার এবং বাড়ির রীতিনীতি দেখে অবাক হলো। প্রায় তাদের মতই, ভাবতেই
পারছে না সে ভিন দেশের কোন বাড়িতে এসেছে। মনে হচ্ছে ইরানেই রয়েছে। রাতে খাবার পরে সাবিহার মা সাজান পানের বাটা
এগিয়ে দিল কিন্তু ইরানে পান খাবার প্রচলন নেই তাই টেবিলে বসে এসব নিয়েই আলাপ হচ্ছিল। আলাপে আলাপে এই
প্রথম জানতে পারল এদের পূর্ব পুরুষ ইরান থেকেই এসেছিলো। অবাক হলো, কই
ওরাতো এ ব্যাপারে কেও আমাকে কিছু বলেনি!
এ বাড়ির বিয়ের আয়োজন দেখছিল আর ভাবছিল ইরানে যে ভাবে বিয়ে হয় তেমনি সব আয়োজন
চলছে। মাঝে মধ্যে কিছু এ দেশিয় আচার অনুষ্ঠান রয়েছে তবে বেশির ভাগই তাদের মত।
তাহলে মাহমুদ সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, কোন ভুল করেনি!
মহা ধুমধামের সাথে জাঁকজমক করে
বিয়ে হলো। বিয়ের পরে আবাদান ফিরে যেতে আরও তিন
দিনের আগে কোন ফ্লাইট পাওয়া যায়নি বলে এখানেই বাসর সাজান হয়েছে।
অনেক প্রতীক্ষা, অনেক দিনের চাওয়া, অনেক চোখের জল ফেলে আজ সাবিহা এবং
মাহমুদের বাসর হবে।
সাবিহা আগে থেকেই পালঙ্কে বসে ছিল। মাহমুদ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে যখন
পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়াল সাবিহাও পালঙ্ক থেকে নেমে মাহমুদের সামনে দাঁড়াল অনেক, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা সেই অচেনা
সুরের মূর্ছনায় উভয়েই মগ্ন, নিশ্চুপ। কারো
মুখে কোন কথা নেই শুধু এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। অনেকক্ষণ এভাবে থেকে সাবিহা
মাহমুদের বুকে মাথা রেখে আলিঙ্গন করল। এ আলিঙ্গন শুদ্ধ পবিত্র ভাল বাসার আলিঙ্গন, এ
আলিঙ্গন আপনজনকে কাছে পাবার আলিঙ্গন। প্রিয়জনের হাত ধরে চলার আলিঙ্গন, এ
আলিঙ্গন সাবিহা খানম থেকে সাবিহা মাহমুদ হবার আলিঙ্গন। এ আলিঙ্গনে রয়েছে প্রিয়জনের
বুকে নিজেকে সঁপে দেয়ার তৃপ্তি। প্রিয় জনকে কাছে পাবার, একান্ত আপন
করে পাবার সীমাহীন বাধ ভাঙ্গা নির্মল পবিত্র স্বর্গীয় আনন্দ।
ওরা যেদিন আবাদানে ফিরবে সেদিন বাড়িতে বঁধু বরণের আয়োজন করে রেখেছে, বাড়ি
ভরা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব পাড়া পড়শি আনন্দ করছিল। সাবিহা যখন মাহমুদের হাত
ধরে বঁধু বেশে গাড়ি থেকে বাড়ির ল্যান্ডিঙ্গে নামল তখন
মাহমুদের মা বলল,
তোমরা শোন, আজ আমার
বাড়িতে অনেকদিন পরে বিকেল বেলা বৃষ্টি এসেছে ওকে বরণ করে ভিতরে নিয়ে চল।
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।