বিকেল বেলার বৃষ্টি [৬]-৫
১৭।
এর মধ্যে নাজিয়া আর জয়া সাউথ শিল্ডে ওশেন রোডের পাশে
আজদা সুপার মার্কেটের সাথেই একটা বাসায়
সাবিহার সাথে কলকাতার বাঙালি মেয়ে মৌ মিতার
থাকার ব্যবস্থা করেছে। বাসাটা পাবার জন্য মাহমুদ হন্যে হয়ে লেগে ছিল।
ইউক্রেনের এক
কাপল বাসাটা প্রায় নিয়েই নিয়েছিল লেটিং এজেন্টের সাথে অনেক জোরাজুরি করে তবে
সাবিহাদের পাইয়ে দিয়েছে। এতে করে আসা যাবার পথে মাহমুদের সাথে দেখাতো হয়ই বেশির
ভাগ দিনে যেদিন কাছাকাছি সময়ে দুই জনের ক্লাস থাকে বা ক্লাস থেকে ফিরে আসে তখন এক
সাথেই আসা যাওয়া করে। এভাবেই দিন মাস
গড়িয়ে যায় আর সাথে বয়ে নিয়ে যায় নিউ ক্যাসেলের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া আপ-অন-টাইন নদীর পানি উত্তর সাগরে। আর সেই সাথে
সাবিহা এবং মাহমুদের কাহিনী গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। ধীরে ধীরে শীতের আমেজ কেটে
যাচ্ছে গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা যাচ্ছে, কোন কোন গাছে ফুল ফুটেছে, পথের
পাশে হলুদ ডেফোডিল ফুটে বসন্তের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতি
তার আপন মহিমায় সেজে উঠছে। শীতের ভারি পোষাকের বোঝা কমছে ছুটির দিনে দুই জনে নানা
জায়গায় বেড়াতে যায়। রঙ্গে রঙ্গে অনেক প্রতীক্ষিত সময় গুলো ভরিয়ে দিতে চায়।
সাবিহা একদিন জিজ্ঞেস করল
আচ্ছা তোমার পরীক্ষা হয়ে গেলে অক্টোবরে তুমি এখান থেকে চলে যাবে তখন কি হবে?
কেন?
আমি কি আর আসব না ভেবেছ? ব্রিটেন রুটে চলে এমন ইরানি জাহাজ না
পেলে দরকার হলে আমি এই দেশের জাহাজেই চাকরি নেব! এতে ভাবনার কিছু নেই। তারপরে আবার
যখন মাস্টার ম্যারিনার এর জন্য পরীক্ষা দেব তখন এখানেই আসতে হবে। তোমাকে ছেড়ে কি
আমি বেশি দিন থাকতে পারব ভেবেছ? তুমি যে আমার স্বপ্ন, আমার
জীবন, যে
গোলাপ আমি সারা পৃথিবী খুঁজে পাইনি তুমি যে আমার সেই গোলাপ। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব
কি নিয়ে?
তুমি আমাকে যে
পৃথিবী দেখতে শিখিয়েছ, ভাল লাগতে শিখিয়েছ সে পৃথিবী মিথ্যে
হয়ে যাবে না?
একদিন নিউ ক্যাসেল মেট্রো শপিং মলে কেনাকাটা করার সময় দোতলার এক কফি শপে বসে
আলাপ করছিল। সাবিহা কথায় কথায় বলল জান মাহমুদ
আমার পূর্ব পুরুষেরা কিন্তু তোমাদের ইরান থেকে ভারতে গিয়েছিল!
তাই নাকি?
বল কি?
এত দিন বলনি কেন? তাহলে তুমিও ইরানি! তাহলে তোমাকে ইরানে যেতেই হবে। যে গোলাপ ইরান থেকে তুলে নিয়ে ভারতে রোপণ করেছিল কোন দিনের কোন এক
মহা পুরুষ আমি সেই গোলাপ আবার ইরানে ফিরিয়ে নিয়ে যাব, ইরানের
সম্পদ ইরানেই ফিরে যাবে।
১৮।
ক্যালেন্ডারের পাতায় একদিন সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ এসে উপস্থিত হলে মাহমুদের
পরীক্ষা শুরু হলো এবং দেখতে দেখতে একদিন
শেষও হয়ে গেল। এবারে শুরু হলো প্রতিদিন ক্যাফেটেরিয়াতে বসে সাবিহার ক্লাস শেষ হবার
অপেক্ষা। প্রতি দিন এসে ক্যাফেটেরিয়ার একটা জানালার পাশের এক টেবিলে বসে থাকে কখন
সাবিহা আসবে। সাবিহা আসার সাথে সাথেই উঠে যায়। কিছুক্ষণ কোথাও বসে গল্প করে যার
যার মত বাসায় ফিরে আসে। সে গল্প গুলা কোন গতানুগতিক গল্প নয়। কোথা থেকে কোথায় যায়
তার কিছুই ঠিক ঠিকানা থাকে না। সামনের দিনগুলো কেমন করে কোথায়
কাটবে কি করবে এমনি সব নানা স্বপ্নের কথা, কে কবে কি স্বপ্ন দেখেছে এই সব। কোন
দিন রাত দুপুরও হয়ে যায়। সময় সম্পর্কে কারো কোন হুশ থাকে না।
আমার পরীক্ষা আপাতত শেষ কিন্তু তোমার এখনও দেরি আছে তোমাকে ভাল করে পড়াশুনা
করে এক বারেই পাশ করে যেতে হবে। ভাল রেজাল্ট না হলে কিন্তু বার করার সুযোগ পাবে
না। রেজেল্ট বের হবার আগে ইচ্ছেমত কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করল। আশেপাশে
যা যা ছিল সব এক এক করে দেখা হল। সান্ডার ল্যান্ড,
ডারহ্যাম, ডার্লিংটন সব দেখল কিন্তু এভাবেই একদিন তার
যাবার সময় হলো।
তুমি চলে যাবে? তুমি চলে গেলে আমি থাকব কেমন করে? এখানে কোথাও কাজ পাবে
না?
হ্যাঁ,
না গেলে,
চাকরি না হলে যে এক্সপেরিয়ান্স দেখাতে পারব না আবার
পরের পরীক্ষাটাও দেয়া হবে না। আর এখানে
কাজ পাবার মত এখনও উপযুক্ত হয়ে উঠিনি পরের মাস্টার ম্যারিনার পরীক্ষাটা দিলে তখন
পারবো।
আবার কবে আসবে? এত দিন তোমাকে না দেখে থাকব কেমন করে?
আরে পাগল,
এত উতলা হলে কি চলবে? আমাদের উভয়ের ভবিষ্যতের জন্য যে এটুক
ধৈর্য ধরতেই হবে! মাত্র দুইটা বছর। বলছিতো এর মধ্যে তোমার বার হয়ে যাবে আবার ওদিকে
আমার মাস্টার ম্যারিনার পরীক্ষায় এপিয়ার করার সি টাইম হয়ে যাবে। এর মধ্যে জাহাজ
এদিকে এলে কি আমি এখানে আসব না?
যদি জাহাজ না আসে?
দেখে শুনে এমন জাহাজ বেছে নিব যে জাহাজ এদিকে আসবে। কখনও এমন হতে পারে জাহাজ
লন্ডন কিংবা ব্রিস্টল কিংবা অন্য কোন পোর্টে আসবে তখন তোমাকে আগে থেকে জানিয়ে দিব
তুমি সেখানে চলে যাবে।
১৯।
মাহমুদ পাশ করেছে। টিকেট নেয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে যাবার
দিন ঘনিয়ে আসছে আর সাবিহার মন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। নাওয়া
খাওয়া অনিয়মিত হচ্ছে, এটা সেটা ভুলে যায়। এসব
দেখে মৌ মিতা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে।
তোমার মত এমন স্মার্ট মেয়ে এত বোকা কেন বলত?
সে কথা তোমাকে বোঝাব কেমন করে? ওর যাবার কথা শুনে আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। মনে হয় আমিও সব ছেড়ে চলে যাই
কোথায় যাবে? চলে গেলেই কি এর সমাধান
হবে ভেবেছ? তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে, সহ্য করতে হবে এবং সবার পরে পরিস্থিতি মেনে নিতেই হবে।
চেষ্টা করতে চাই কিন্তু পারছি কোথায়? কিছুতেই মন মানতে চায় না
দেখ তুমি খুবই ভাগ্যবতী, মাহমুদ ভাইয়ের মত ছেলেকে পেয়েছ। ওর জন্য তোমাকে মানিয়ে নিতেই হবে,
তুমি যত সহজে বলতে পারছ আমি অত সহজে পারছি না মিতা
তুমি যে কি বল বুঝি না, এমন ছেলের জন্য সারা জীবনও অপেক্ষা
করা যায়। কি, মিথ্যে বললাম?
না, সত্যিই
বলেছ আমিও বুঝতে পারি কিন্তু মনকে বোঝাতে পারি না ও চলে যাবে মনে হলেই আর কিছু ভাল
লাগে না
তাহলে পারবে না কেন বলছ, পারতে তোমাকে হবেই, এমন ছেলে
কয়টা মেয়ের জীবনে আসে বলতে পার?
২০।
সকাল দশটায় ফ্লাইট। মাহমুদ রেজার গাড়িতে উঠে সকালেই
সাবিহার দরজায় এসে থেমে সাবিহাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেলো। রেজা গাড়ি চালাচ্ছে আর
মাহমুদ এবং সাবিহা পিছনের সীটে। সাবিহা রেজার হাত ধরে শুধু কেঁদেই চলেছে, কিছুতেই থামছে না। মাহমুদ বোঝাচ্ছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে
না। এয়ারপোর্টের টিকেট ইত্যাদির কাজ সেরে আসলে রেজা একটু দূরে সরে দাঁড়াল। মাহমুদ
সাবিহার পাশে এসে দাঁড়াল আর সাবিহা আবার ওর হাত চেপে ধরল কিছুতেই মাহমুদের হাত
ছাড়তে চাইছিল না। জোরে চেপে ধরে রেখেছে যেন
ছুটে না যায়। ইরানীয়ান এয়ারলাইন্সের ডেস্ক থেকে বারবার
যাত্রীদেরকে প্লেনে বোর্ড করার জন্য ঘোষণা দিচ্ছিল কিন্তু সে ঘোষণা সাবিহার কানে
আসতে পারছিল না। এক সময় মাহমুদ ভেজা কণ্ঠে বলল
ছাড়, যেতে
দাও।
না, আমি
তোমাকে যেতে দিব না
পাগলামি করে না, আমি যেয়েই ফোন করব। তোমাকে ছাড়া আমার কেমন কাটবে তুমি জান না?
সাবিহা অনবরত কেঁদেই চলেছে কিছুতেই থামছে না। টিসু দিয়ে
মাহমুদ বারবার চোখ মুছে দিচ্ছে। সাবিহার কান্না মাহমুদের মধ্যেও সংক্রমিত হলো।
মাহমুদও নিজেকে সামাল দিতে পারল না। তার চোখ দিয়েও কয়েক ফোটা জল সাবিহার হাতে পড়ল।
তাই দেখে সাবিহা উতলা হয়ে উঠল। একি! তুমি
কাঁদছ কেন? ছি! পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই বলে
স্কার্ফের আঁচল দিয়ে মাহমুদের চোখ মুছতে মুছতে বলল প্রতিদিন ফোন করবে। বিদায়ের
আগে মাহমুদের বুকে, তার পৃথিবীর বুকে মাথা রেখে পৃথিবীর উষ্ণতা অনুভব করতে
চাইল কিন্তু তার অবচেতন মন তাকে থামিয়ে দিল। এত দিনের সংস্কার আর বিশ্বাস সাবিহাকে
এগিয়ে যাবার সায় দিতে পারল না, সে সময়
এখনও আসেনি। এবার শেষ ঘোষণা শুনে মাহমুদ শক্ত হলো। সাবিহার কানের কাছে মুখ এগিয়ে
বলল এবার যেতে দাও!
সাবিহা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে হাতটা ছেড়ে দিল। শুধু
বলতে পারল সাবধানে থেকো। মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল চোখে জল টলমল করছে।
মাহমুদ আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সিকিউরিটি গেটে। রেলিং
ধরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে শুধু কাঁদছে।
রেজা পাশে এসে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাশে দাঁড়িয়েই রইল। এক সময় হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে
বসিয়ে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবিহা রেজার
সাথে বাসায় ফিরে এলো। রেজা ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে কাঁদতে নিষেধ করে চলে গেল।
মাহমুদ উড়ে চলল ইরানের আবাদান বিমান বন্দরের পথে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।