বিকেল বেলার বৃষ্টি [৬]-৪
১৪।
১৪।
পরের দিন বিকেলে ক্লাস শেষ হতে চাচ্ছে না। সময় যেতে চায় না। মনে হচ্ছে সময় যেন
স্থির হয়ে আছে,
ঘড়ির কাটা কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও এক সময় ঘড়ির কাটার হিসেব করে সাবিহার
ক্লাস শেষ হলো।
মাহমুদের ক্লাস দুপুরেই শেষ করে দুইটার মধ্যে সিভিক সেন্টারে এসে দরজার দিকে
মুখ করে বসে আছে। রাস্তার মাঝ খানে ইঞ্জিন বিকল হয়ে রেল গাড়ি যেমন থেমে থাকে কোন
দিকে যেতে পারে না তেমনি মনে হচ্ছে আজকের দিনটাও থেমে আছে। স্নো পড়ছে বলে সূর্যের
দেখা নেই কয়েকদিন থেকেই। হে মার্কেটের টাওয়ারের ঘড়িটাও কি কেও বন্ধ করে রেখেছে
নাকি? তাহলে
বিকেল হচ্ছে না কেন? অপেক্ষা অত্যন্ত ভয়ংকর। সেটা যদি হয় কোন প্রিয়জনের জন্যে
তাহলে আরও বেশি ভয়ংকর। বুক ঢিব ঢিব করার শব্দ কাছের যে কেও শুনতে পায়, ঘন
ঘন গলা শুকিয়ে আসে আর কেমন যেন এক অচেনা অনুভূতি হয়। কোথাও স্থির হয়ে বসার উপায়
থাকে না,
বারবার উঠছে আবার বসছে। উঠে জানালা দরজার কাছে দিয়ে ঘুরে এসে আবার বসছে, হাতের
ঘড়ি দেখছে,
কিছুই ভাল লাগছে না। প্রতিবারে দরজা খুলে যেই ঢুকছে তাকেই দেখছে। প্রতীক্ষার
উৎকণ্ঠায়,
উত্তেজনায় চোখ, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে তখন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তাকাল।
দেখল এক ইয়া মোটা মহিলা রুমে ঢুকছে এবং পিছনে তার প্রতীক্ষিত সাবিহা মাথার টুপি
খুলতে খুলতে রুমে ঢুকছে। মাহমুদ বিশাল এক হাফ ছাড়ল।
সময় হলো তোমার?
কি করব বল সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস ছিল টিচার বের হবার সাথে সাথেই এক দৌড়ে
চলে এসেছি,
তুমি কখন এসেছ?
সে কথা আর বলো না, সেই দুইটা থেকে বসে আছি
বল কি,
তোমার ক্লাস ছিল না?
ছিল,
দেড়টায় শেষ হয়েছে
তাই বলে এতক্ষণ ধরে বসে ছিলে? আশ্চর্য! চল বসি
কোথায় বসবে?
কেন কাল যেখানে বসেছিলাম
না আজ এখানে নয়, এখানে ফিস ফিস করে কথা বলতে হয়, চল সেই কফি
শপে যাই
চল। সাবিহা মাথার টুপি পড়ে হাতের গ্লোভস পড়তে পড়তে মাহমুদের পিছনে চলল।
বাইরের রাস্তা পাড় হয়ে সেদিনের সেই কফি শপে গিয়ে বসল। কয়েকদিন থেকেই অনবরত
স্নো পড়ছে। রাস্তায় বরফ জমে গেছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় লোকজন তেমন বাইরে নেই। দোকান
প্রায় ফাকা। সুবিধা মত জানালার পাশে একটা টেবিলে দুইজনে মুখোমুখি বসল।
কফির সাথে আর কিছু খাবে?
হ্যাঁ ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে
আমারও। মাহমুদ উঠে বারে গেল।
সাবিহা ভাবছিল, ঝোঁকের মাথায় কাল বলে দিয়েছি আজ দেখা হবে কিন্তু এখন ওকে কি
বলব? একটু
পরেই জিজ্ঞেস করবে। এমনও হতে পারে কফি নিয়ে এসে বসার আগেই জিজ্ঞেস করবে। তখন? সাবিহা
এত ভাবলে কি হবে? স্নো পড়ে রাস্তায় জমে বরফ হবার আগে যেমন ঝুর ঝুরে দানার মত
হয় তেমনি করেই সাবিহার মনেও মাহমুদের ছায়া দানা বাধতে শুরু করেছে। হয়ত কিছুক্ষণের
মধ্যেই সেটা জমে স্নিগ্ধ শীতল নীলচে আভা
মেশান স্বচ্ছ বরফ হয়ে যাবে। তবুও ভাবছে, কি বলব, কি করব এখন?
সত্যিই,
একটু পরেই দুই হাতে দুই ট্রে নিয়ে মাহমুদ টেবিলের কাছে এসে ট্রে নামাবার আগেই
জিজ্ঞেস করল
তুমি এখনও বললে না?
কি বলব?
কাল যে আমি বললাম, আমার কথার জবাব দিবে না?
আজই বলতে হবে?
আজ নয় এখনই
আমাকে একটু ভেবে দেখার সময় দিবে না?
না। বলেই মাহমুদ একটু এগিয়ে সাবিহার হাত ধরে বলল
জান,
আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি শুধু তোমার জবাবের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি। যেদিন
তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই আমার সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে।
সাবিহা অনেকক্ষণ চুপ করে আছে কোন কথা বলছে না। সামনে টেবিলে স্যান্ডউইচ আর কফি
ঠাণ্ডা হচ্ছে। আচ্ছা ঠিক আছে আগে খেয়ে নাও, চল শুরু কর
বলে একটা স্যান্ডউইচ সাবিহার হাতে তুলে দিল।
উভয়েই চুপচাপ খাচ্ছে। এবার কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মাহমুদ সাবিহার চোখের দিকে
তাকিয়ে বলল
আমার জবাব কিন্তু এখনও পেলাম না! আমি আর দেরি করতে পারছি না, প্লিজ
কিছু বল সাবিহা,
চুপ করে থেক না
তোমার জবাব শোনার আগে যে তোমাকে আরও কিছু শুনতে হবে!
বল, তুমি
যাই বলবে আমি শুনব
আমাকে আর কয়েকটা দিন একটু ভাবার সময় দাও
না না,
সময় দেয়া যাবে না, তোমাকে এখনই বলতে হবে। প্লিজ সাবিহা তুমি বোঝার চেষ্টা কর
আস্তে আস্তে সাবিহা কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল
তুমি জান আমি কে?
এটা আবার কেমন কথা বললে? তুমি সাবিহা খানম, ফ্রম
ইন্ডিয়া
হ্যাঁ সে কথা ঠিক কিন্তু আমার একটা ইতিহাস আছে সে ইতিহাস তুমি জানবে না?
আমি কিছুই শুনতে চাই না। ইতিহাস আবার কিসের? ইতিহাস জেনে
কি হবে? আমি
ইতিহাস চাই না আমি তোমাকে চাই
এ কথা না জানালে তোমাকে প্রতারণা করা হবে আর আমি সেটা পারব না। শোন মাহমুদ, কোন
সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যে তোমাকে সব জানতে হবে! আমার পিছনের কাহিনী কোন সরল সোজা
কাহিনী নয়
কফির পেয়ালা এক পাশে সরিয়ে রেখে বলল, বল তাহলে কি বলতে চাইছ। তোমার মত
মেয়ের এমন আর কি কাহিনী থাকতে পারে বল শুনি
এর মধ্যে সাবিহা কফি শেষ করে টেবিলের এক পাশে খালি পেয়ালা সরিয়ে রেখে একটু
প্রস্তুতি নিয়ে বলতে শুরু করল। একে একে নাদিমের সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে দীর্ঘ
পাঁচ বছরের কথা সব বলল। এমনকি এখানে আসার আগের বিকেলে বেহালার কফি শপের কথা সব
খুলে বলল। সব কথা বলা হলে সাবিহা ক্লান্ত হয়ে বলল আর একটা কফি আনবে?
মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল। একটু পরে কফি নিয়ে এসে বলল
দেখ সাবিহা,
এতক্ষণ তুমি যা বলেছ আমি তার প্রতিটি বর্ণ শুনলাম কিন্তু তুমি এটাকে আমাদের
মাঝে টেনে আনছ কেন? তুমিতো সে ইতিহাস মুছে ফেলেছ! আর তাছাড়া সে এখন অতীত। অতীত
নিয়ে কি ভবিষ্যৎ বা বর্তমান চলে? অতীততো এক সময় এমনি এমনিই মুছে যায়, সে
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে ভাবেই হোক। এমন করে ভেবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছ? চল, এখন
থেকে তুমি একা নও আমি তোমার সাথে আছি, এভাবেই নিজেকে বুঝিয়ে নাও। আমরা
দুজনে মিলে এগিয়ে যেতে পারব না?
সাবিহা চুপ করে ওর কথা শুনল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কি করবে কি বলবে
কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কোন
সুরের মূর্ছনায় মগ্ন। কি বলবে?
কি হলো,
কিছু বল,
পারব না?
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সাবিহা মাথা নিচু করে আস্তে বলল, পারব।
কি বললে একটু জোরে বল
এবার সাবিহা মাথা উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, পারব
মাহমুদ চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে সাবিহার দুই হাত ধরে চিৎকার করে বলল
ওহ! সাবিহা! তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ!
মাহমুদের চিৎকার শুনে বার থেকে মেয়েটা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
এনি প্রবলেম?
নো নো এভরি থিং অলরাইট! নো প্রবলেম!
শোন,
আমি আজই বাড়িতে ফোন করে জানাব। তোমার ছবি পাঠাব।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে সাবিহার কয়েকটা ছবি নিয়ে নিল।
আমি মাকে সব জানাব। তোমার কথা সব বলব।
মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলল
চল, তাহলে
এবার উঠি
চল।
১৫।
সাবিহাও বাড়িতে বাবাকে জানিয়েছে কিন্তু প্রথমে বাবা সাবিহার মার সাথে আলাপ করে
মৃদু অসম্মতি জানিয়েছিল।
কেন,
ইন্ডিয়াতে কি ছেলের অভাব? ভাল ছেলে কি এখানে নেই?
আছে বাবা! তুমি না বলেছিলে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিল! তাহলে?
তারা এসেছিল তেহরান থেকে আর এ হলো আবাদানের
তাতে কি?
দেশ জাততো একই!
তাই বলে কি তুই আমাদের ছেড়ে দেশ ছেড়ে যাবি?
তা কেন হবে বাবা? ও বলেছে আমার বার
করা হয়ে গেলে তত দিনে ও মাস্টার ম্যারিনার হয়ে যাবে আর তখন আমরা বিয়ে করে এখানেই
সেটল করব। মাঝে মাঝে কি আর ছুটিতে ইন্ডিয়া
বা ইরানে যাব না? তোমরাও কি এখানে আসবে না? তুমি আমাকে
না দেখে কয়দিন থাকতে পারবে বাবা? তুমিতো এখানেই আসতে দিতে চাইছিলে না!
বাবা মায়ের সাথে এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক যুক্তি
তর্ক হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা মা উভয়েই সম্মতি দিয়েছে।
১৬।
একদিন মাহমুদ সাথে নিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে রেজার সাথে
পরিচয় করিয়ে দিল। রেজা ইয়ার্কি করে মাহমুদকে বলল তুই সত্যি কথাই বলেছিলি! আমি ওকে
আগে দেখলে সত্যিই পাগল হয়ে যেতাম হয়ত পিছে পিছে ঘুরে মরতাম।
সাবিহা না বুঝে জিজ্ঞেস করল এর মানে কি?
তখন রেজা মাহমুদের প্রথম দেখার গল্প শোনাল।
ও! এই কথা!
আচ্ছা সাবিহা বলত তুমি কাকে বেছে নিতে?
যাকে বেছে নেয়ার তাকেই পেয়েছি, তোমার কি কোন সন্দেহ আছে?
যাক খারাপ করনি, অন্তত আমার বন্ধু একজন উপযুক্ত সঙ্গী পেয়েছে এতেই আমি ধন্য। তোমরা একটু বস
আমি চা নিয়ে আসছি, আর কিছু খাবে?
না, তুমি বস
আমি নিয়ে আসছি, তোমরাতো প্রতিদিনই নিজেরা করে নাও আজ না হয় আমি করি
না না তাই কি হয় তুমি হলে মেহমান, আমিই যাচ্ছি, বল আর
কিছু খাবে?
না, শুধু চা হলেই চলবে।
মাহমুদ এখন সাবিহাক নিয়ে তার নতুন পাওয়া সুন্দর পৃথিবীতে প্রজাপতির মত ঘুরে
বেড়াচ্ছে। নানা রকম রঙ্গিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাবিহাকে
ফোন করে জেনে নেয় আজকে তার কি প্রোগ্রাম। মাঝে মধ্যে নাদিম এসে সাবিহার মনে
বৃশ্চিকের মত দংশন করে, সাবিহা ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও মনকে
বুঝিয়ে উঠতে পারে না। তবে কি সে মাহমুদকে ঠকাচ্ছে, তার সংগে
প্রতারণা করছে?
নানা চিন্তা এসে ভিড় করে। নিজে কোন দিশা না পেয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে
মাহমুদকে জানাল। শুনে মাহমুদ হো হো করে হেসে উঠল।
কি যে বল তুমি! যেই আসুক তাতে হয়েছেটা কি? এখন থেকে
শুধু তুমি আর আমি, এর বাইরে আর কিচ্ছু নেই আর কিছুই ভাববে না।
কিন্তু ও যে আমার পিছু ছাড়ছে না!
তাতে কি হলো? তোমাদের দেশে ছেলেরা মেয়েদের পিছু নেয় না? অবশ্য শুধু তোমাদের দেশের কথা বলছি কেন সব দেশেই
মেয়েরা বড় অসহায় সবসময় নিরাপত্তাহীণতায় ভুগে। ছেলেরা সব সময় মেয়েদের পিছু নিয়েই
থাকে। এখন থেকে ওসব নিয়ে মোটেই ভাববে না, forget it forever!
দেখি,
চেষ্টা করব তুমি যা বলছ তাই হবে
শোন,
একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে
সাবিহা চমকে জিজ্ঞেস করল কি সমস্যা?
এখন বাড়িতে ফোন করলেই অর্ধেক সময় কেটে যায় তোমাকে নিয়ে। মা এটা সেটা নানা কিছু
জিজ্ঞেস করে,
সাবিহা কি করছে, কেমন আছে, কোথায় থাকে, তুই দেখবি, সবসময়
লক্ষ রাখবি,
ওর বাড়িতে মা বাবা কেমন আছে এই সব। আমি বলেছি তোমাকে ওর নম্বর দিয়ে দিব তোমার
যখন ইচ্ছে হবে তখন তুমি নিজেই ফোন করে নিও। তোমার নম্বর দিব?
এ কথা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে?
পকেট থেকে মোবাইল বের করে ইরানের আবাদানে মাহমুদের বাড়ির লাইন পেয়ে
হ্যালো মা!
কিরে,
কেমন আছিস?
ভাল আছি মা। এই দেখ তুমি যার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে তাকে নাও। বলেই মোবাইলটা
সাবিহার হাতে দিয়ে দিল।
হ্যালো,
হ্যালো,
কে সাবিহা?
এর পর থেকেই প্রায় প্রতি রবিবারে নিয়মিত ভাবে মাহমুদের মা সাবিহাকে ফোন করে
তার কুশলাদি জানতে চায়, আরও নানা কথা হয়। আমার ছেলে তোমাকে
ভালবেসেছে আমি যে কত নিশ্চিন্ত হয়েছি মা তা বোঝাবার নয়। তুমি
আমার বৌ হবে,
আমার বাড়ির লক্ষ্মী হবে আমি খুউব খুশি। তোমার বাড়ির ফোন নম্বর দিও আমি তোমার
বাবা মার সাথে কথা বলব।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।