৭০।
মনে আর
কত থাকবে?
তুমি তো
জান না মারুফ আমার মনে কত বোঝা বয়ে বেড়াই। এতো বোঝা মাথায় রেখে আর কত মনে রাখা যায়? এই যে কথায় কথায় ভুলে
যাই আমি এমন ছিলাম না। আমার মা বাজার থেকে কখনো কিছু
আনার কথা বললে সে কথা আমার এক
মাস পরেও মনে থাকতো। বাজার থেকে নিয়ে আসতাম মা বলতেন বাব্বাহ! সেই কবে বলেছিলাম এখনও
মনে রেখেছিস কিন্তু এই দিন তো সেই দিন নয়। এখান থেকে শুনছি আর ওখানে যাবার আগেই
ভুলে যাচ্ছি। এজন্যে যে কত বিড়ম্বনা হচ্ছে তা কাকে বলি? মাংস রান্না হয়ে গেছে। এই ফাঁকে
কিচেন ব্রাশ করা হয়েছে। মারুফকে দেখল ইফতারের জন্যে কাবলি
ছোলা ভুনতে। সাড়ে চারশো গ্রামের ছোট টিনের মধ্যে সেদ্ধ কাবলি ছোলা এখানে যার নাম
চিক পিজ। ফ্রাই প্যানে তেল পিঁয়াজ মশলা গরম করে তার মধ্যে দুইটা টিনের মুখ খুলে
পানি ফেলে দিয়ে ছোলা ছেড়ে দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই ছোলা ভুনা। মারুফ জিগ্যেস করেছিলো-
-ইফতারির
জন্যে আর কিছু বানাবেন? আপনি খিচুরি খান না।
-না
আমি পারিই বা কি আর বানাবোই বা কি যা আছে এতেই চলবে। আচ্ছা এখানে তো বেসন আছে
দেখলাম আপনারা অনিওন ভাজি বানান তা ওরকম করে কিছু পাকোরা বানানো যায় না?
-হ্যাঁ
যাবে না কেন বানান সব কিছুই আছে যা লাগে নিয়ে নেন বানান নিজেও খান আমরাও খাই।
-ঠিক
আছে তবে আজ না কাল বানাবো কিন্তু কথা হলো আমার কোন আন্দাজ অনুমান নেই আমাকে লবণ
দিয়ে দিবেন।
-আচ্ছা
আচ্ছা তা দেয়া যাবে। বেশ কালই বানাবেন।
এখনকার
মত কাজ শেষ।
এপ্রণটা খুলে তিন লিটারের একটা দুধের বোতল খালি হয়েছিলো সেটা রেখে দিয়েছিলো ওটা
ভরে পানি নিয়ে উপরে চলে গেলো।
আজ রাতে
তেমন ভারি কিছু মনে হলো না। গত দুই দিনের তুলনায় এ যেন কিছুই না। অনেক হালকা, বেশ নীরবে চলেছে সব
কিছু। কোন হাঙ্গামা নেই, ভুল ভ্রান্তি নেই। হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচি
কিছুই নেই। এর মধ্যে মালিকরা এসে গল্প করেছে অনেকক্ষণ। দেশের কি অবস্থা, রাজনীতির অবস্থা কেমন, লোকজন কেমন আছে এখানে
কেমন লাগছে এইসব। এরকম হলে চলে কিন্তু তাই কি আর হয়? এভাবে চললে মালিকের ব্যবসা হবে কি
করে? এইযে এতো গুলো মানুষের
বেতন দেয়া,
মালিকরা
তিন জন, বাইরের ছয় জন এদের বেতন, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, কাউন্সিল ট্যাক্স কত
কি! নাহ তবুও এভাবে এই কাজ করা যাবে না সামনে যেতেই হবে। ডিউটি
শেষ হয়ে আসছে এমন সময় আনোয়ার এসে বললো-
-ভাইছাব
আপনার ফোন,
যান উপরে
যেয়ে ধরেন।
উপরে
উঠে ফোন ধরতেই কাজলের কণ্ঠ-
-কে, মামা?
-হ্যাঁ
মামা, তা কি মনে করে, নম্বর
কোথায় পেলে?
-কেন
ফিরোজ মামার থেকে নিয়েছি।
-ও
আচ্ছা, বল কি খবর!
-না
এমনিই, মামা বললো আপনার খোঁজ খবর কি কোথায় গেলেন কি
করছেন জানার জন্যে তাই ফোন করলাম।
-ঠিক
আছে, এইতো আসলাম। আজ মাত্র তিন দিন, এর মধ্যে গত দুই দিনের অবস্থা
দেখে ভাবছিলাম এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। তা আজ একটু সহজ মনে হচ্ছে।
-মামা
আসল কথা হলো প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে তবে আপনি সামনে কাজ পেলেন না?
-না
পাইনি।
-ঠিক
আছে করতে থাকেন দেখা যাক আর কখন কোথায় থাকেন ঠিকানাটা অন্তত ফোন নম্বরটা জানাবেন।
তাহলে রাখি মামা পরে আবার ফোন করব।
-আচ্ছা
ঠিক আছে।
-ওহ
ভালো কথা! কখনো
দরকার হলে রাস্তার মোরে মোরে দেখবেন ফোন বক্স আছে সেখান থেকে ফোন করবেন বিশ পেনি
লাগে।
-আচ্ছা।
নিচে
আসতেই সবাই এক সাথে বললো-
-আপনে
না বলেছেন আপনার কেও নেই তাহলে এতো ফোন করে কে?
-না
এমনিই পরিচিত চেনা মানুষ।
কাজ
কর্ম শেষ করে উপরে আসবে এমন সময় ওসমান দৌড়ে এসে বললো-
-ভাইছাব
একটু দাঁড়ান এই যে নেন এটা রাখেন।
-কি
এটা?
-আপনে
কাজ করলেন এই তিন দিনের পয়সা।
-ও, মানে কি আমার কাজ ঠিক
হচ্ছেনা তাই বিদায়?
-আরে
না না বিদায় কেন এটা আমাদের নিয়ম আমরা প্রতি রবিবারে যার যার বেতন দিয়ে দেই। এখানে
আপনার সাথে জব সেন্টারে যে ভাবে কথা হয়েছিলো সেই হিসাবে তিন দিনের পয়সা আছে।
-ও
তাই? তাহলে দেন।
৭১।
নিয়ে
ধন্যবাদ জানিয়ে বিসমিল্লা বলে টাকাটা পকেটে ভরে উপরে উঠে আসলেন। এসেই
আবার নিঃসঙ্গ
একা। টাকাটা পকেট থেকে বের করে দেখলো। টাকা নয় পাউন্ড, পাউন্ড স্টার্লিং।
ব্রিটেনের রানীর মাথার ছবি আঁকা
ব্রিটিশ পাউন্ড। বিশ্বের সবচেয়ে দামি নোট। যার এক পাউন্ডের মূল্য বর্তমানে বাংলাদেশের
বিরানব্বই টাকা। হায়রে টাকা! তোমার জন্যে আমাকে দেশ ছাড়তে
হয়েছে, আমাকে আমার মা
মনিদেরকে ছেড়ে আসতে হয়েছে, আমার মনিকে আমাকে এখানে একা রেখে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে হাতে ধরে নোট গুলি বার
বার নাড়া চাড়া করছেন। হায়রে অর্থ! তোমার মূল্য কত? মানুষের প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা
এর চেয়ে কত বেশি, কত
বেশি তোমার মূল্য?
সিঁড়িতে
কার যেন পায়ের শব্দ পেলেন। টাকা গুলি পকেটে রাখার আগেই কবির রুমে ঢুকে হাতে টাকা দেখে জিজ্ঞেস
করলো-
-কি, টাকা দিছে?
-হ্যাঁ
দিলো, এইতো।
-রেখে
দেন, সাবধানে রাখবেন।
-সাবধান
আর কি কোন লকার তো নেই।
-সাথে
রাখবেন, সবসময় সাথে রাখবেন
ভাববেন না এদেশে চোর নাই। এদেশেও চোর আছে পকেটমার ছিনতাইকারি আছে। আপনে একা একা
থাকতে চান কেন?
একা একা
থাকবেন না। একা থাকলে মন খারাপ হবে, নানান রকম চিন্তা এসে মাথায় ঢুকবে, থাকতে পারবেন না। তাস
খেলতে পারেন?
-জানি
তবে একমাত্র ব্রিজ, তাও
বেশীক্ষণ খেলতে পারি না মথা ঘুড়ে।
-আর
কিছু পারেন না?
-না
আর কিছু পারিনা। কেন আপনারা কি খেলেন?
-আমরা
খেলি টুয়েন্টি নাইন।
-না
আমি ওটা পারিনা।
-আপনার
অফের কথা কিছু বলেছে?
-অফ
মানে?
-অফ
মানে ছুটি,
যেদিন
কাজ করবেন না।
-না
তা কিছু বলেনি।
-বুঝেছি
আপনার অফ দেলু ভাই এসে দিবে।
-দেলু
ভাই কে?
-দেলু
ভাই আমাদের কিচেনের সেফ এবং এই রেস্টুরেন্টের আর এক জন পার্টনার।
-ও
আচ্ছা, ওনার নামও কি দেলোয়ার?
-হ্যাঁ
আমরা দেলু ভাই বলি।
-কবির
ভাই আপনি এখানে কতদিন যাবত আছেন?
-অনেক
দিন প্রায় এক বৎসর।
-আমাকে
একটু অফ সম্পর্কে বলেন তো!
-কি
বলবো, সাধারণ ব্যাপার। রাতে
ডিউটি শেষ হলেই আপনার অফ শুরু। আপনি ইচ্ছা করলে তখনই কোথাও যেতে পারেন। তারপর দিন
সারা দিন ছুটি। যেখানে ইচ্ছা যাবেন, লন্ডন যান বারমিংহাম যান, অক্সফোর্ড যান যেখানে খুশি, তারপর দিন সন্ধ্যায়
এসে ডিউটিতে হাজির হবেন। ব্যাস আর কি?
-আমার
বাইরে যাবার জায়গা নেই তাহলে আমি কি করবো?
-কেন, অক্সফোর্ড যাবেন না
হলে এই টাউনেই ঘোরাঘুরি করবেন। ভালো কথা, এখানে লাইবেরি আছে ওখানে যেতে পারবেন, কেনা কাটার দরকার হলে
করবেন কাপর চোপর ধুবেন।
-আর
খাওয়া দাওয়া?
-কেন
সময়মতো এসে খেয়ে যাবেন।
-কেও
কিছু বলবে না?
-আরে
না, কে কি বলবে? সবাই তাই করে।
-হ্যাঁ
আমার বন্ধু বলেছে লাইবেরিতে যেতে। ওটা কোথায়?
-আসেন
দেখিয়ে দেই।
জানালার
কাছে গিয়ে-
-এই
যে রাস্তা এটা যেখানে শেষ হয়েছে ওখান থেকে বায়ে যাবেন একটু এগিয়েই দেখবেন বায়ে
আবিংডন লাইবেরি,
ডানে
সমারফিল্ড সুপারস্টোর। ফল টল কিছু খাইতে চাইলে ওখান থেকে কিনবেন।
-আপনারা
কাপর চোপর কোথায় কিভাবে ধুয়ে থাকেন?
-কেন
বাথরুমে ইয়েলো বাকেট আছে না?
-মানে
তাজমহল ডালডার বাকেট?
-হ্যাঁ
ওতে কাপর ভিজিয়ে রাখবেন, সকালে উঠে গোসলের সময় ধুয়ে বাথরুমের পাশে যে রুম ওটার
বাইরে একটা বারান্দার মত আছে ওখানে শুকাতে দিবেন তবে কাপর ভালো করে আটকাবেন নয়তো
বাতাসে নিয়ে যাবে। রশিতে ক্লিপ আছে দেখবেন, হ্যাঙ্গারও আছে।
নুরু
ভাইয়ের বেডের ওপাশে দেখে বললো -
-হ্যাঁ
এইযে ইস্ত্রি আপনের রুমেই আছে চাইলে কাপর ইস্ত্রি করে নিবেন। আপনের কিছু ধুইতে হলে
পাউডার আছে?
না থাকলে
আমার আছে নিয়ে নিবেন।
-না
এখন ধুতে হবে না আর পাউডার নেই কিনতে হবে।
-দেখেন
কবে অফ দেয় সে দিন বাইরে যাবেন।
-আর
একটা কথা,
আমি যে
বাইরে যাব ফেরার সময় চাবির কি ব্যবস্থা?
-সবই
আছে কাল দেখিয়ে দিব। আজও কি আগেই সেহেরি খাবেন?
-হ্যাঁ
তাহলে যান আপনের সেহেরি খাবার সময় হয়ে গেছে।
-যাক
ভাই আপনার সাথে কথা বলে সময়টা ভালোই কাটল।
-হ্যাঁ
তাইতো বলি একা থাকবেন না একা থাকলেই বিপদ।
-হ্যাঁ
কবির ভাই,
ঠিকই
বলেছেন। চলেন সেহেরি খেয়ে আসি।
-আমাদের
সাথে খান আমরা সালাদ বানাই খেতে পারবেন।
-আসলে
ভাই আমার একটু আগে সেহেরি খাবার অভ্যাস তাই আর কি।
-ঠিক
আছে যার যাতে সুবিধা খান আপনার যেভাবে সুবিধা, জানেন তো কোথায় কি থাকে ইচ্ছা হলে
সালাদ বানিয়ে নিতে পারেন। তারপর রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকতে ডান পাশে সেলফ দেখেছেন
ওতে আচার আছে খেতে পারেন। যা খাইতে ইচ্ছা হয় এখানে যা আছে খাবেন কেও কিছু বলবে না।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।