১৫০।
ইদানীং
অনেক জায়গায় এমনকি বাসের গায়েও বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে যে “স্বল্প মাত্রায় পান করুন সুস্থ
ভাবে বেশি দিন বাঁচুন” “কেও
আপনার কাছে ভিক্ষা বা কোন পয়সা চাইলে তা দিবেন না” তা হলে সে ওই পয়সা দিয়ে নেশা করে
মারা গেলে কি আপনি তার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? এই ধরনের বিজ্ঞাপন।
এদের
বাবা মা নিজের সন্তান যেদিন আঠার বছর পেরিয়ে উনিশে পা দেয় সেদিন তারা নিজেরাই
সন্তানের হাতে পানপাত্র তুলে দেয় এমনকি এই দিন উদযাপনের জন্য কোন রেস্টুরেন্টে
পার্টিও দেয়। এমনও দেখা যায় যে কোলের বাচ্চার মুখে নিজের বিয়ারের গ্লাস ধরে তাকে
খাওয়াচ্ছে।
১৫১।
এদেশে রেস্টুরেন্টে যে সব খাবার রান্না
হয় সেগুলি রান্না করা অত্যন্ত সাদামাটা কৌশল। আমাদের দেশে পোলাও যে ভাবে রান্না হয়
এখানে সে ভাবে রান্না করার তেমন কোন প্রয়োজন নেই। খুব সাধারণ ভাবে চালের সাথে
ডালডা, তেজপাতা এবং গরম মশলা
দিয়ে পানি মেপে এক বারে চুলায় বসিয়ে দিলেই হলো। চাউল
কষান বা সাথে বিশেষ কোন স্বাদের ভিন্নতার কোন ঝামেলা নেই। বিরিয়ানি বলতে এখানে যা
বোঝায় তা যদি আমাদের দেশে কাউকে দেয়া হয় তাহলে সে লাঠি নিয়ে আসবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত! আগে থেকে হলুদ, আদা রসুন দিয়ে সেদ্ধ
করে রাখা মুরগী বা ভেড়ার মাংসের সাথে কিছু হলুদ মরিচের ছোঁয়া দিয়ে পোলাওর সাথে
একটু নেড়েচেড়ে মিশিয়ে চিকেন বিরিয়ানি হয়ে গেলো। কাস্টমারেরা এই খেয়েই তৃপ্ত।
সন্ধ্যা
থেকে মদ খেয়ে এসে আড়ষ্ট জিহ্বায় অনেকেই ভিন্দালু পছন্দ করে তবে মহিলারা সাধারণত এই
মাত্রার ঝাল খেতে পারে না। স্প্যানিশ বড় পিঁয়াজ একটু বড় চৌকো সাইজ করে কেটে তার
সাথে কিছু ক্যাপসিকাম মিশিয়ে চিকেন রান্না হলে তার নাম জালফ্রেজি। আবার একই জিনিস
ভেড়ার মাংস দিয়ে হলে তার নাম ল্যাম্ব সাতকানিয়া। এই রকম বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের
মেনুতে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোথাও সিলেটী চিকেন, কোথাও চিকেন কাফরিল, কচি মুর্গ, চিকেন বনানী, চিকেন চামেলি, চিকেন পাতিয়া, চিকেন মুলি যার যা
ইচ্ছা একটা মন গড়া নাম দিলেই হয়ে গেলো। রান্নার পরে উপরে দুই টুকরা টমাটো দিলে এক
নাম আবার চার টুকরা টমাটো রান্নার সাথে দিলে আর এক নাম। একটা কাঁচা মরিচ ফালি করে
কেটে উপরে দিয়ে দিলে এক নাম মরিচ না দিলে আর এক নাম। স্বাদের
তেমন কোন তারতম্য নেই। কোথাও চিকেন জামদানি, এটা একটা ওভাল ডিশে দিয়ে পাশে
কিছু টমাটো শসা জামদানি শাড়ির মত খাঁজ কাঁটা নক্সা করে কেটে সাজিয়ে দিচ্ছে বলে এই
নাম।
এর পর
রয়েছে কড়াই ডিশ। ছোট ছোট কড়াই চুলায় গরম করে তাতে সামান্য একটু তেল আর রসুন ছেড়ে
দিয়ে ফ্রাই প্যান থেকে কারি ঢেলে দিতেই ছর ছর করে এক শব্দ হয় আর ধোয়া উঠে, সেই কড়াই আবার কাঠের
ছোট ট্রেতে করে এনে টেবিলে নামিয়ে দেয়। কেওকেও আবার এর উপরে একটু ব্র্যান্ডি
ছিটিয়ে তাতে আগুন জ্বেলে দেয় তাতে ব্র্যান্ডির এলকোহল জ্বলে আগুনের শিখা জ্বলতে
থাকে যা দেখতে খারাপ দেখায় না। ইংরেজ খরিদ্দার এতেই মহা খুশি। আবার বালটি ডিশ আছে
এগুলি ছোট ছোট তামার বালতিতে করে পরিবেশন করে নানা রকম চমকের সৃষ্টি করে। তবে কিছু
কিছু মেনু আছে যেগুলি প্রায় সব জায়গায়ই সমান। যেমন, কারি , দোপিয়াজা, জালফ্রেজি, রগন, পাতিয়া, ধান শাক, মাদ্রাজ, ভিন্দালু, কোর্মা, পাসান্দা, টিক্কা মাশাল্লা, তন্দুরি, শাসলিক, কাশ্মীরি ইত্যাদি।
নানা রকম পুর দেয়া নান রুটি, বাদাম কিসমিসের সাথে চিনি মিশিয়ে রান্না করা হালুয়ার মত পুর দেয়া যে
নান রুটি সেটা পেশোয়ারি নান, রান্না করা কিমার পুর দিলে সেটা কিমা নান, রসুন দিলে গারলিক নান, কাঁচা মরিচ দিলে তার
নাম কুলচা নান। সকলেই নিজ নিজ একেকটা ঘরানা তৈরি করে নিয়েছে। আমাদের
দেশের সাধারণ নামের সাথে এর কোন মিল নেই এমনকি রান্নার মশলা বা ধরনের মধ্যেও কোন
মিল নেই। সাধারণত মালিক নিজেই সেফ এর কাজ করে। কোথাও যদি বেতন ভুক্ত সেফ থাকে
তাহলে মালিক এসে গ্রেভি বা মাংস সেদ্ধ করে রাখার সময় মশলা মিশিয়ে দিয়ে যায়।
১৫২।
মুল কথা
হচ্ছে যে জাতি এক সময় প্রায় সমস্ত পৃথিবী শাসন থেকে শোষণ এবং অত্যাচার অনাচার
নির্যাতন করে যে সাম্রাজ্য গড়েছিলো যেখানে সূর্য অস্ত যেত না সেই জাতিকে এমন করে
কাবু করে জেঁকে বসেছে সে এক পরম পাওয়া বললে অন্যায় হবে না। তবে এই পর্যায়ে আসতে কম
কাঠ খর পোড়াতে হয়নি। প্রথম দিকে বখাটে ছেলে পিলে বা বয়স্ক লোকেরাও খেয়ে দেয়ে পয়সা
না দিয়ে চলে যেতে চাইত। পয়সা চাইতে গেলে ধমকে উঠত যে “তোমরা আমাদের দেশ থেকে সব টাকা
পাচার করছ,
লুট করে
নিয়ে যাচ্ছ,
কাজেই
আবার কিসের দাম দিব”? তোমাদের
এই ব্যবসা করতে দিব না। ক্রমে এই কথা রানীর কানে গেলে সে পাত্তা দেয়নি। রানী বলেছে
এরা যদি এভাবে রান্না না করে তা হলে তোমরা খাবে কি?
উনিশ’শ আশীর দশকে এক সময়
ছিলো যখন রেস্টুরেন্টের মালিকেরা হিথরো এয়ারপোর্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কোন বাঙ্গালি
আসছে কিনা তাই দেখার জন্য। কোন বাঙ্গালিকে দেখলেই তার সাথে গিয়ে আলাপ করত, ভাই
আপনি কোথায় যাবেন? এগিয়ে
নেয়ার জন্য কেও এসেছে কিনা, না হলে চলেন আমি নিয়ে যাই। গাড়িতে উঠিয়ে নিজের ঠিকানা লেখা
একটা কাগজ হাতে দিয়ে বলে দিত যদি ভাই কাজকর্মের প্রয়োজন হয় তা হলে আমার সাথে
যোগাযোগ করবেন। আমার রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে কাজ করতে পারবেন, ওখানেই থাকবেন, খাবেন। এমন করেও
কর্মচারী সংগ্রহ করতে হয়েছে। এরা আগে থেকে এই সুযোগ করে রেখেছিলো বলে অনেক
বাঙ্গালি এখানে এসে কোন বিপদে পড়েনি। অন্তত থাকা খাওয়া সহ কিছু একটা কাজের সংস্থান
হয়েছে।
এক দিনে
যেমন রোম নগরী তৈরি হয়নি তেমনি এই শিল্পও রাতারাতি এক দিনে গড়ে উঠেনি। যতটা সহজ ভাবে
ভাবা যায় ততটা সহজে এই সুনাম গড়ে উঠেনি। যারা এর সাথে জড়িত কেবল তারাই জানে কি
মূল্য দিতে হয়েছে। ঘড়ে স্ত্রী সন্তান রাত জেগে শেষ পর্যন্ত হয়ত না খেয়েই ঘুমিয়ে
পরেছে অথচ কর্তা তখন খরিদ্দারের মনোরঞ্জনের জন্য, তাদের রসনা তৃপ্তির জন্য ফ্রাই
প্যান নিয়ে জালফ্রেজি রাঁধছে কিংবা লোহার শিকে মাংস, পিঁয়াজ, টমাটো, ক্যাপসিকাম গেঁথে
শাসলিক বানাচ্ছে। এদিকে ঘরে তার নতুন বিয়ে করা বৌ একা ছটফট করছে। হয়তবা কারো
সন্তানকে কাল সকালে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে ভর্তির জন্য অথচ বাবা তার গ্রাহকদের মন
তুষ্ট করে রাত তিনটা বা তারও পরে ঘড়ে ফিরে বিছানায় যাবার সাথে সাথেই ঘুমে বেহুশ।
সকালে সময় মত উঠতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি বলে ছেলের স্কুলে
ভর্তিও হয়নি।
সবাই যখন
দিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছে তখন এই রেস্টুরেন্টের মালিক বা
কর্মচারীরা ছুটে আসছে রেস্টুরেন্টে। এসেই রেস্টুরেন্ট খুলে বাতি জ্বালিয়ে
সুগন্ধি ছড়িয়ে সাজসজ্জা করে নানা খাদ্যের পসরা সাজিয়ে বসছে। কখন ঘড় মুখো ক্ষুধার্ত
গ্রাহকেরা ভুরি ভোজনের জন্য আসবে সেই পথ চেয়ে তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকছে।
খরিদ্দার এলেই হাসির
টেবলেট খেয়ে একটা হাসি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে জিজ্ঞেস করছে-
-গুড
ইভনিং ম্যাডাম,
টেবিল ফর
টু?
-ইয়েস
প্লিজ।
-ইয়েস
ম্যাডাম/স্যার প্লীজ ফলো মি।বলেই আগে আগে যেয়ে সাজানো টেবিল থেকে চেয়ারটা একটু
টেনে দেখিয়ে বলবে হ্যাভ ইয়োর সিট প্লিজ। তারপর শুরু হবে যান্ত্রিক হাঁটা চলা, মাপা কেতা দুরস্ত মেকী
কথা বার্তা। কাজকর্ম শেষ করে মালিক তার গাড়িতে করে চলে যাবে বাসায় বা অন্যান্য
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য। মদ বিক্রিকরতে করতে কখন যে সে নিজেও মদে আসক্ত হয়ে গেছে
তা সে নিজেও জানে না। বন্ধুদের সাথে এমন কোন পানের আড্ডা বসে যায়। আরও অনেক কাহিনী
আছে।
এদেশে
ভাল মেয়ের অভাব বলে নিজ দেশে যায় পাত্রীর সন্ধানে। পাত্রীর বাবা বা অভিভাবক বিলাতি
পাত্রের কথা শুনে তার কাছে মেয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। অনেক সময় পাত্রী নিজেও
আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।কিন্তু সে কোথায় আসছে তা টের পায় যখন এখানে
আসে। এমনও দেখা যায় ৩, ৪
বা ৫ দিন পর্যন্ত স্বামী ঘড়ে ফিরছে না। স্ত্রীর মলিন মুখ। কি করবে, কাকে বলবে? নিজের ভিতরেই একটা
চিতা জ্বেলে তার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে, অথচ তার শরীরে মাথা থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত দামী গহনা, হীরের গহনা জড়ান
রয়েছে! আলমারি ভরা নানা রকম দামী শাড়ি, বছরে অন্তত একবার আমেরিকা বা ফ্রান্স ঘুরে আসা সবই আছে
কিন্তু যার কাছে আসা তার কোন দেখাই নেই। এমন অনেক ঘটনা আছে। আবার সে নিজেই দেখে
শুনে অন্য কারো হাত ধরে চলে যাচ্ছে নিজের অনন্ত সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
কিন্তু সুখ কি আর শাড়ি গহনা কিংবা প্যারিসের টিকেটের মত দোকানে কিনতে পাওয়া যায়?
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।