৭৬।
এখানে
বসে আরও কয়েকটা পাব দেখা যাচ্ছে ভিতরে মৃদু বাজনার শব্দ আসছে। আজ মঙ্গল বার তাই
ভিড় নেই। হাতের সিগারেটটা শেষ হলে ফেলে দিয়ে এবারে উঠে দাঁড়ালেন। রেস্টুরেন্টে
ঢুকার পথে কিচেনের ভিতর দিয়ে ঢুকতে
হয়। তাকে দেখেই বলে উঠলো কি ভাই সাহেব কোথায়
গেছিলেন?
রাশেদ
সাহেব সারা দিনের ফিরিস্তি দিলেন। এখানে এসে ইফতার করে যেতে পারতেন, ক্ষুধা লেগেছে কিছু
খাবেন? আমতা আমতা করে বললেন-
-হ্যাঁ
দিবেন কিছু?
-কি
খাবেন?
-যা
দিবেন তাই।
-তাহলে
একটা নান খান।
মারুফ
একটা নান বানিয়ে তন্দুরির ভিতরে ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
-কি
দিয়ে খাবেন?
-যা
দিবেন তাতেই হবে ঘরের বাইরে যখন এসেছি তখন আর কোন চাহিদা নেই যা দিবেন তাই আলহামদুলিল্লাহ।
সেই
সেদ্ধ করা ভেড়ার কিমা দিয়ে তাদের এই বিলাতি কায়দায় একটু নেড়ে চেড়ে কি একটা করে বললো-----নেন খান।
-এটা
কি দিলেন?
-এটা
হলো কিমা ভুনা।
-ও
আচ্ছা তা আসেন আপনারাও আসেন!
-না
আপনে খান আমরা খাইছি
-বেয়াই
সাহেব শুনছেন কাল ঈদ!
-তাই
নাকি? বেশ তা হলে ঈদ মোবারক সবাইকে।
-কোথায়
যাবেন ঈদের দিন?
-কেন
কাল কি বন্ধ নাকি?
-হ্যাঁ
দিনের বেলা বন্ধ তবে রাতে খুলবো।
-না
ভাই আমি কোথায় যাব এখানেই ঘুরা ঘুরি করবো আজকের মত, আপনারা কি করবেন?
-আজকে
রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে আমরা সবাই লন্ডন চলে যাব, আসাদ মিয়া যাবে অক্সফোর্ড তার
ভাইয়ের কাছে শুধু কবির থাকবে।
-কেন
কবিরও কি আমার মত নাকি?
-না
ওর অনেকেই আছে তা উনি কোথাও যাবেনা, আপনের জন্যে ভালো হবে একা একা থাকার চেয়ে।
-আপনাদের
তো সবার গাড়ি আছে কিন্তু নুরুল ইসলাম আর আসাদ ভাই কেমনে যাবে এতো রাতে বাস পাবে কোথায়? বাস বন্ধ হয়ে গেছে
দেখে আসলাম!
-নুরু
যাবে আমার সাথে,
আসাদ
যাবে ওসমানের সাথে।
ওসমানের বাসাও অক্সফোর্ডে।
এমন সময়
সামনে থেকে খবর এলো রাশেদ সাহেবের ফোন।
৭৭।
রাশেদ
সাহেব উপরে এসে ফোন ধরলেন।
-হ্যালো
ওপাশ
থেকে মেঝো ভাইয়ের কণ্ঠ-
-সালামালেকুম, কেমন আছেন?
-হ্যাঁ
চলছে একরকম।
-কাজকর্ম
কেমন?
-খুব
কষ্ট, জীবনে অনেক কষ্টের কাজ
করেছি কিন্তু এই কষ্ট তার কাছে কিছুই না। এখন বয়সও হয়েছে পারছি না। যা আছে তাও যদি
একটু ধীরে সুস্থে হোত করা যেত, তাহলে চলতো কিন্তু সবাই চায় বলার আগেই যেন রেডি হয়। কিচেনের
সবাই অর্ডার করে তার মধ্যে মালিক হলো তিন জন। একজন সেফ অন্য দুজন সামনে। সামনে
থেকে এসে ওয়েটাররাও এটা ওটা করতে বলে। সবারই এক কথা ‘কুইক। তখন বিশ্রী ভাবে আজেবাজে
কথা বলে। কাজ যেমন তেমন কথাগুলিই বেশি কষ্টের। কেও সহজ করে কথা বলে না, সাধারণ কথা গুলিই
বাঁকা করে বলবে অশ্লীল ভাবে। এদিকে হাত কেটে কুটে অবস্থা খারাপ।
-হ্যাঁ, এটাই এদের স্বভাব।
ওখানে গ্লোভস নেই?
-না
গ্লোভস দেখি না।
-বলবেন
গ্লোভসের কথা।
-হ্যাঁ, ফিরোজও বলেছে বলতে, বলা হয়নি। ভয় করে
আবার কী বলে না বলে তাই আর বলিনি।
-এমনি
অন্য সময় কথাবার্তা আচার ব্যাবহার কেমন, গালাগালি করে?
-এমনি
অন্য সময় যা তা মেনে নেয়া যায় তবে শুনেছি বিজির সময় সেফ নাকি গালাগালি করে। আমি
যেদিন এসেছি সেই শুক্র শনিবার সেফ ছিলো না তাই দেখিনি কেমন, এখনও দেখছি ভালোই।
-আচ্ছা
চলুক এভাবে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে আর বিশেষ করে আপনি অনেকদিন শুধু অর্ডার
করেই এসেছেন এধরনের কাজের সাথে তো আপনার পরিচয় নেই, সামনে কাজ পেলেন না, না?
-না, পেলাম না অবশ্য
খুঁজতেও পারিনি তেমন করে। প্রথমেই যা পেয়েছি তাতেই চলে এসেছি। সামনের একটা কাজ পেয়েছিলাম
কিন্তু সেটা আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে। ফিরোজ ওখানে যেতে নিষেধ করলো বললো অত দূরে গিয়ে দরকার নেই এদিকে আসা
যাওয়াতে অসুবিধা হবে তুমি মেইন ল্যান্ডেই থাকো। তাই আর গেলাম না। ও হ্যাঁ, ব্রিস্টলেও একটা
পেয়েছিলাম কিন্তু বেতন কম। এখন মনে হচ্ছে ওখানে গেলেই ভালো হোত। বেতন কম বলে ফিরোজ
ওখানেও নিষেধ করেছে।
-আচ্ছা
যাই হোক, আপাতত একটা দাঁড়াবার জায়গা তো হয়েছে পরে সুযোগ মত খুঁজে
নিতে হবে। কিচেনের কাজ আপনি পারবেন না। আমি জানি এখানকার এসব কাজ হলো অল্প বয়সীদের
জন্যে। দেখা যাক কিছু দিন থাকেন এভাবে। কাল ঈদ জানেন?
-হ্যাঁ, এইমাত্র শুনলাম।
-নামাজ
কোথায় পড়বেন, কিছু শুনেছেন?
-না
তেমন আলাপ হয়নি শুধু জানলাম যে সবাই লন্ডন অক্সফোর্ড চলে যাবে, মাত্র একজন থাকবে
এখানে। কোথায় মসজিদ কিছু জানি না, শুনিনি এখনও।
-আমরা
লন্ডন যাবো।
-কোথায়, কখন?
-ওর
বোনের বাসায়,
সকালেই
যাব। সাথে কাজলও যাবে।
-ও
আচ্ছা।
ভাইয়ের কথা শুনে রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবছিলেন হয়ত বলবে যাবার সময় আপনাকে নিয়ে যাব। এই
কথা বলার জন্যেই হয়তো ফোন করেছে কিন্তু সেরকম কিছু শোনার আগেই ওপাশ থেকে বললো -
-তো
ঠিক আছে তাহলে রাখি, কি
আর করবেন কষ্ট করতে এসেছেন আর একটু করেন। সামনের কাজে এতো কষ্ট না। পেলে চলে যাবেন, আচ্ছা সালামালেকুম।
খট করে
লাইন কাটার শব্দ পেয়েও রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন আরও কিছু শোনার আশায়। না, ওপাশ থেকে আর কোন কথা
এলো না। রিসিভার নামিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিনের সেই কথা মনে হলো। মনি বলে
গেছে দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে। ভুলতে চেয়েছিলো আবার কেন এই আঘাত? ওরা লন্ডন যেয়ে ঈদ
করবে এই খবর শোনার জন্যে কি সে অস্থির হয়েছিলো, না কি এটা ওর জানা খুব জরুরি? তাহলে কেন, কেন আবার মনে করিয়ে
দেয়া? ওখানে যা হয়েছে তা কি
যথেষ্ট নয়?
সেই ক্ষত
সেরে উঠার মত সময় কি সে সারা জীবনে পাবে? তার পরেও আবার কেন? এ কি শুরু হলো তার জীবনে, কোন খেলা এটা? সেতো কখনো কারো সাথে
এমন করেনি! কারো মনে আঘাত দেয়া তো দুরের কথা কারো সাথে উঁচু স্বরে
কথাও বলেনি। কারো অমঙ্গল চিন্তা করতে পারে না সে, তার মনই সে ধাঁচে গড়া নয়, এসব তার ভাবনায়ই আসে
না। এ কোন পরীক্ষায় পড়েছে, কি ভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসবে?
মনে আছে
ছোট বেলায় তার এক মামা তার এই নরম স্বভাব আর কোমল মন দেখে আফসোস করে বলেছিলো তোকে
তো বড় কঠিন ভাবে জীবন পাড় করতে হবেরে ব্যাটা। এই কঠিন দুনিয়াতে এতো নরম হলে কি চলে? এদিকে আয় তোকে শক্ত
হবার ট্রেনিং দেই আয়। এক কাজ কর ওই যে একটা ছেলে দেখছিস ওকে একটা ধমক দিতে পারবি? যদি তোর ধমক শুনে ও ভয়
পায় তাহলে এক আনা পাবি।
-না
মামা আমি পারব না।
-আরে
যা না দিয়েই দেখ পারবি, পারবি যা।
ধমক
দিয়েছিলো কিন্তু ওই এক আনা পাবার মত হয়নি। কোথাও মারামারি দেখলেই তার বুকের ভিতর
ঢিপ ঢিপ করত। দৌড়ে বাসায় এসে মায়ের আঁচলের তলায় লুকাতো। তার হাঁপানি দেখে মা
বুঝতেন কোথাও কিছু হয়েছে আর বকতেন এমন ছেলে কি করে চলবে এই দুনিয়াতে! সেই রাশেদ সাহেবের
জীবনে এসব কি ঘটছে, কী, হচ্ছে কি এসব? আমি কী করেছি? কী করেছি? ভাবতে ভাবতে রুমে এসে
জ্যাকেটটা খুলে হুকে ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় বসলেন। কতক্ষণ বসে ছিলেন মনে নেই। ভিড় কম
বলে আজ একটু তাড়াতাড়িই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে সবাই যার যার উৎসবে মেতে উঠার আনন্দে
বাড়ির দিকে ছুটে যাবার পথে বের হয়ে গেলো। নুরু এলো রুমে।
-কি
ভাই, কি ব্যাপার মন খারাপ
নাকি?
-কাছে
এসে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার বললো ।
-আরে
কাল ঈদ আর আপনি এখন মন খারাপ করে অন্ধকারে এভাবে বসে আছেন কেন? ও! বাড়ির কথা মনে পরছে? না না ভাববেন না এতো
ভাবার কি আছে?
বিদেশে
এতো মন খারাপ করে থাকবেন না এখানে তো আর কেও নেই যে এসে দেখবে। উঠেন যান খেয়ে দেয়ে
এসে নিচে কবিরের সাথে টিভি দেখেন বসে। আমি চললাম, ঈদ মোবারক।
নুরু
চলে গেলো। রাশেদ সাহেব একটা সিগারেট বানালেন। হাত দুইটাই টেবিলের উপরে এক হাতে
সিগারেটটা ধরা। কবির এলো রুমে।
-কি
খবর নয়া ভাইসাব একলা কি করেন খাবেন না আজতো সেহেরি নাই আসেন খেয়ে আসি।
রাশেদ
সাহেবের মুখে কথা নেই। কবির পাশে বসলো। মুখের দিকে তাকিয়ে বললো
-
-কি
ব্যাপার ভাই মন খারাপ?
-না
এমনিই।
নিজেকে
সামলে নিয়ে বললো -
-তামাক
খাবেন?
-আমি
বানাতে পারি না।
-নেন
আমি দেখিয়ে দেই।
-কি
তামাক এটা?
-এরিনমোর।
-বেশ
ভালো, একটু কড়া তবে গন্ধটা
সুন্দর, এটা কি এখান থেকে
নিয়েছেন?
-না
দেশ থেকে এনেছি,
এখনও
এখান থেকে কেনার দরকার হয়নি, আরও কিছুদিন চলবে।
তামাকের
সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নিচে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে উপরে এসে কবির বললো -
-চলেন
টিভি দেখি
-না
ভাই আমার ভালো লাগছে না আমি শুয়ে পরবো আপনি দেখেন। আচ্ছা ভালো কথা কাল ঈদের নামাজ, কোথায়, কখন যাবেন?
-হ্যাঁ, যাবো। সকালে নয়টায় বের
হয়ে অক্সফোর্ডে যেতে হবে, জামাত হবে দশটায়।
-তাহলে
আমাকে নিয়ে যাবেন।
-হ্যাঁ, আমি আর আপনেই যাব।
তাহলে এই কথাই রইলো আমি চলি এখন।
৭৮।
রাশেদ
সাহেব উপরে এসে এবারে কাপর বদলিয়ে বিছানায় বসে একটা সিগারেট জ্বালালেন। আবার
টেলিফোনের কথা মনে হলো। এখানে কাল ঈদ আমাদের দেশে পরশু ঈদ। মেয়েদের কথা মনে হলো।
ভাগ্যের অন্বেষণে অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বাবাকে ছাড়া কি ভাবে ওরা ঈদ
করবে? ওরা বড় হয়েছে সবই বুঝে। ওদের
মা কিভাবে ওদের নিয়ে বাড়ি ভরা আর সবার সাথে একটা বিরূপ পরিবেশে দিনটা কাটাবে? কেওতো ওদের মানসিক
অবস্থা বুঝবে না, বুঝতে
চাইবে না। ওদের মনে যে কি ঝড় বইবে তা কি কেও বোঝার চেষ্টা করবে? এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে
একটা জটিল রকমের ছন্নছাড়া বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো মন। ঘুমের কোন ভাব নেই চোখে মনে। আবার
আর একটা সিগারেট বানালেন। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পায়ের উপর লেপটা টেনে নিলেন, ঠাণ্ডা লাগছে একটু।
কেন এমন হলো?
গণ্ডগোলটা
কোথায় খোঁজার চেষ্টা করছেন। ফেলে আসা জীবনসাগর মন্থন করেও কোন কূল
কিনারা পেলেন না। বার বার মনে হচ্ছিল ভাই হয়তো বলেনি কাল লন্ডন যাবার পথে আপনাকে
নিয়ে যাব। কিন্তু যাবার পথে সে ঠিকই আসবে, না এসে পারবেনা। সে এখানে থাকবে
আর বিদেশে এই প্রথম ভাই একা ঈদ করবে, তাই কি হয়?
ছোট
বেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে মায়ের দেয়া টিফিন বাবদ দুই পয়সা দিয়ে দুইটা কমলা কিনে
একটা নিজে খেয়ে আর একটা পকেটে করে নিয়ে আসত। ছোট্ট পকেটের মধ্যে এতো বড় কমলা ধরত
না, কোন রকমে ঠেলে
একটুখানি ঢুকিয়ে এক হাতে বইয়ের ব্যাগ আর অন্য হাতে কমলা চেপে ধরে রাখতে হোত। বাগানে
ঘেরা ঝোপের আড়াল থেকে গেট দিয়ে ঢুকেই দেখত ছোট ভাই দরজার সামনে ঘরে উঠার
সিঁড়িতে বসে আছে। তার হাতে কমলাটা দিতেই কি যে খুশী! মনে হোত পূর্ণিমার
সমস্ত জ্যোৎস্না যেন তার মুখে এসে পড়েছে। আজও মনে পরে সে দৃশ্য, আম্মা আম্মা ভাইজান
আছছে বলেই উঠে ভাইজানকে জড়িয়ে ধরত। দুই ভাই এক সাথে ঘরে ঢুকত, এ যে সেই ভাই!
৭৯।
ভাইয়ের
পেটে ব্যথা হয়েছিলো। একদিন রাতে খাবার পরেই হঠাৎ করে ভীষণ ব্যথা। কিছুতেই ভালো
হচ্ছে না। অনেক ডাক্তার, কাছের থেকে দূরের বড় ডাক্তার, না কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দু’তিন
দিন হয়ে গেছে যে যা বলছে এটা সেটা সহ মসজিদের ইমামের পানি পড়া। নাহ কিছুই হচ্ছে
না। বাবা মা চোখ মুছেন। রাশেদের স্কুল বন্ধ, বাবার অফিস বন্ধ। মায়ের
রান্নাবান্না বন্ধ। প্রতিবেশীরা খাবার এনে জোর করে খাইয়ে যাচ্ছে। কত চেষ্টা করেছে
ভাইকে জিজ্ঞেস করার জন্যে কেমন লাগছে, পারেনি। পাশে বসে থেকেছে। কেমন যেন একটা গোঙ্গানির মত শব্দ, চোখ বন্ধ করে কেমন যেন
ঘোরের মধ্যে রয়েছে, চোখ
মেলে তাকায় না। কিছুক্ষণ পরপর যখন দুই হাতে পেট ধরে মুখ চোখ বিকৃত করে যন্ত্রণায়
চিৎকার দিয়ে উঠত বুকের ভিতর ধক করে উঠত, মনে হোত ইসস কি যে কষ্ট ভাইয়ের! ছোট্ট
বুদ্ধিতে কিছু কুলিয়ে উঠতে না পেরে বলেছিল-
-আম্মা
আমি কি করলে ওর অসুখ ভালো হবে আমাকে বলে দেন আমি তাই করবো।
-না
বাবা তুমি পারবে না। তোমার কিছু করার নেই শুধু আল্লাকে ডাকো আল্লাকে বল আমার ভাইকে
ভালো করে দাও।
-হ্যাঁ, আমি বলছি তো তবুও
আল্লা শুনছে না।
-ওকথা
বলে না বাবা তুমি আল্লাকে বলতে থাকো।
প্রতিবেশীরা আসছে সবাই। খলিল চাচা হাসপাতালে চাকরি করেন, বাবাকে বললেন কাল সকালে হাসপাতালে নিয়ে আসেন আমি
গেটে থাকবো। রাতে পাউরুটি এনে রাখা হয়েছিলো সকালে বাবা নামাজ পড়েই মাকে বললেন
কাপড়টা বদলে নাও। মা রেডি হয়ে আসতেই তিনি উঠে প্যান্ট পরে বেরিয়ে গেলেন স্কুটার
ডাকতে। যাবার সময় বলে গেলেন তুমি ওকে কিছু খাইয়ে দাও। মা রাশেদকে দুধ দিয়ে ভিজিয়ে
রুটি খেতে বললেন ভাইকেও একটু খাওয়াবার চেষ্টা করলেন পারলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে
স্কুটার নিয়ে এসে বাবা ভাইকে কোলে নিয়ে বের হলেন। মা ঘরে তালা দিয়ে চাবিটা নিয়ে
পাশের বাড়ির খালাম্মাকে ডেকে বললেন ভাবী হাসপাতালে যাচ্ছি চাবিটা রাখেন। চাবি দিয়ে
স্কুটারে বসলেন। কথামত হাসপাতালের গেটে খলিল চাচা দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্কুটার থামতেই
উনি এগিয়ে এলেন। স্কুটারের ভিতরে বাবার কোল থেকে ভাইকে নামিয়ে কোলে নিয়ে হেঁটে
ভিতরের দিকে এগিয়ে গেলেন। পিছনে বাবা মা। এতো বড় হাসপাতাল কখনো দেখেনি
ছোট্ট
রাশেদ। তার কাছে হাসপাতাল বলতে বাড়ির কাছের ডিসপেনসারি। বিশাল
এলাকা জুড়ে এই
হাসপাতাল
দেখেই রাশেদ ভয় পেয়ে মার হাত চেপে ধরে হাঁটছিলো। খলিল চাচা ভাইকে কোলে নিয়ে আগে
আগে হাঁটছিলেন। পিছনে বাবা। একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
পিছনে তাকিয়ে মাকে বললেন আপনি রাশেদকে নিয়ে এখানে বসেন আমরা আসছি। বলেই
রুমের ভিতরে ঢুকে গেলেন, সাথে বাবা। মা রাশেদকে নিয়ে বাইরের একটা বেঞ্চে বসলেন।
আম্মা
তোমাকে যেতে দিবে না কেন, আমি যাব না কেন, ভাইকে কি করবে?
অনেকক্ষণ
অনেকক্ষণ হয়ে যায় মাঝে মাঝে একজন করে দুই তিনজন ডাক্তার নার্স এসে ঢুকল তারাও বের
হয়না ভাইও বের হয়না। ভিতর থেকে কয়েকবার চিৎকারের শব্দ শুনেছে। উৎকণ্ঠায়
দুশ্চিন্তায় রাশেদ কেঁদে ফেলল। আমার ভাইকে কি করছে ওরা? আসছে না কেন? মার ঠোট শুকনো, চোখ ভেজা। মাঝে মাঝে
আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। মা
সান্ত্বনা দেন,
-এইতো
আসবে এখনি আসবে,
ডাক্তার
দেখছে তাই দেরি হচ্ছে।
-এতো
দেরি হয় কেন?
-ভালো
করে দেখছে তাই সময় লাগছে তুমি চিন্তা করনা আসবে।
তারও
বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবা বের হয়ে মাকে বললেন-
-ওরা
ভর্তি করে রাখতে চায় কি বলবো? চলো তোমাকে ভিতরে যেতে বলেছে চলো দেখ কি বলে।
মা এক হাতে
রাশেদের হাত ধরে ভিতরে এলেন। কয়েকজন ডাক্তার বসে। পাশে দাঁড়ানো একজন নার্স বিছানায়
শোয়া গায়ের জামা খোলা চোখ বন্ধ পেটে একটা হাত রাখা ভাইকে ধরে রেখেছে। ডাক্তার মাকে
বসতে বললেন।
-আপনার
ছেলের কি হয়েছে আমরা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এজন্যে তাকে এখানে
ভর্তি করে রাখতে হবে।
-অতটুক
বাচ্চা কি করে থাকবে?
-না
না আপনিও সাথে থাকবেন।
-ও
মা
একবার বাবার আর খলিল চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-ঠিক
আছে করেন তাহলে যা করতে হয়। আপনারা কি কিছুই বুঝতে পারছেন না?
-হ্যাঁ, মনে হয় কৃমি, যদিও ব্যাপারটা
সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নই, আশা করি আজ বিকেলের মধ্যেই জানতে পারবো তবে আপনারা আরও আগে
আসলে ভাল হোত।
মা
ভাইকে নিয়ে রয়ে গেলেন। বাবা রাশেদের হাত ধরে বললেন চলো রাশেদ। ভাইয়ের মাথা থেকে পা
পর্যন্ত দেখে নিয়ে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বাবার পিছনে বের হয়ে এলো। সাথে খলিল
চাচা। গেটের কাছে এসে চাচা বললেন আপনি বাসায় যেয়ে খেয়েদেয়ে ওদের কাপড়চোপড় আর দরকারি জিনিষ পত্র
নিয়ে বিকেলে চলে আসেন আমি আছি এখানে। আমি দেখছি, চিন্তা করবেন না। আপনি আসলে এক
সাথে বের হব। যাবার সময় আমার বাসায় একটু বলে যাবেন। বাবা রাশেদকে নিয়ে বাসে করে
চলে এলেন। বাসায় ঢোকার আগে পাশের খালাম্মার কাছে চাবি আনতে গেলে খালাম্মা ব্যস্ত
হয়ে খবর জানতে চাইলেন। সব শুনে খালাম্মা বললেন-
-আপনি
বাসায় যান হাতমুখ ধুয়ে আসেন খেয়ে নেন, আমি রান্না করি ভাবীর জন্যে নিয়ে যাবেন ভাবীর দুপুরে খাওয়া
হয়নি।
-না
কিছু বিস্কুট দিয়ে এসেছি ওতেই হবে খাওয়ার মত ইচ্ছা নেই।
-মজিবরের
আব্বা এখনও আসেনি। দেখি সে আসুক আমরাও হয়ত যেতে পারি।
খেয়ে
দেয়ে বাসায় এসে বাবা একটা বড় ধরনের ব্যাগে মা আর ভাইয়ের জন্যে কাপড়, স্যান্ডেল, আয়না চিরুনি, টুথ পেস্ট, ব্রাশ তোয়ালে এইসব
টুকিটাকি গুছিয়ে একটু বিশ্রামের জন্যে বিছানায় কাত হলেন। রাশেদকেও টেনে তার সাথে
শোয়ালেন। রাশেদ ঘুমিয়ে পড়েছিলো। একটু পরে বাবার ডাকে চোখ মেলে তাকাল।
-চলো
রেডি হও তাড়াতাড়ি, হাসপাতালে
যাবেনা ওঠ।
বের হয়ে
মজিবরদের বাসায় ঢুকলেন। খালাম্মা রেডি হয়েই ছিলেন একটা
টিফিন ক্যারিয়ারে মার জন্যে খাবার নিয়ে বেরিয়ে এলেন সাথে মজিবরের বাবা। হাসপাতালে
এসে দেখে ভাইয়ের চোখ খোলা। কতদিন পরে চোখ খোলা দেখে রাশেদের মনে হলো এইতো ভাই ভালো
হয়ে গেছে। এগিয়ে এসে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। রাশেদের হাতটা চেপে ধরল,
-ভাইজান
তুমি আছছ।
-তুমি
ভালো হয়ে গেছ ভাইয়া! পেটে ব্যথা নেই আর?
-আমি
বাসায় যাবো না?
আমাকে
এখানে এনেছে কেন।
হাত না
সরিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মা বললেন এর মধ্যে দুইবার ওষুধ
দিয়ে গেছে এখনও কিছু খাওয়াতে পারিনি, স্যালাইন দিয়েছে, বলেছে কিছু খাওয়াতে হবেনা ভয় নেই। রাতে আবার ওষুধ আছে
নার্সরাই খাইয়ে দেয়। খেতে চায়না দুইজনে মিলে জোড় করে খাওয়াতে হয়। ব্যথাটা মনে হয়
কমেছে। দুপুরের পর থেকে ওই রকম চিৎকার করেনি। মজিবরের মা টিফিন ক্যারিয়ার থেকে
খাবার বের করে মাকে খেতে দিলেন। বাবা বাইরে গেলেন। পাউরুটি কলা কিনে দিয়ে এলেন
মায়ের সকালের নাস্তার জন্যে। আবার কাল বিকেলে আসবে বললেন। আমি ভাইয়ের সাথে খাবার
পাঠিয়ে দিবো।
বেরিয়ে
আসার সময় ভাই আর রাশেদকে ছাড়তে চায়না। কান্না, না আমি এখানে থাকব না। নিয়ে চলো
আমাকে। পরদিন দুপুরে খলিল চাচা অফিস থেকে ফেরার পথে বাসায় এলেন। বাবাও এর মধ্যে
চলে এসেছিলেন।
-কি
খবর খলিল সাহেব?
-হ্যাঁ, খবর আছে। ভালো খবর।
-উদগ্রীব
হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি খবর?
-কাল
রাতে ওষুধ দেয়ার পর আবার পেটের ব্যথাটা বেড়েছিল, কিছু খাওয়াতে পারেনি
শুধু পানি ছাড়া আর কিছু খায়নি। আজ সকালে হঠাৎ বমি আর বমির সাথে বিরাট এক ক্রিমি।
বিকট চেহারা, প্রায় ছয় ইঞ্চির মত হবে লম্বা।
জীবিত, নাড়াচাড়া করছিলো সাপের
মত। বমি হবার পরে ও তো নেতিয়ে পড়ে সাথে সাথেই ঘুম। আমি আসার সময়ও ঘুমে দেখে এলাম ।
ডাক্তার বললো বিপদ শেষ। ওরা ওটা
রেখে দিয়েছে। এমন নাকি হয় না। অস্বাভাবিক ব্যাপার, এই জন্যেই এরকম হয়েছিলো। ওটা যখন
কামড়াত তখন যন্ত্রণায় চিৎকার করতো। ডাক্তার বলেছে যদিও বিপদ শেষ তবুও কয়েকদিন ওরা
ওকে রেখে দিবে। পেটে কোন ক্ষত হয়েছে কিনা দেখবে। ভাবী বলেছে আজ যাবার সময় একটা
শাড়ি নিয়ে যাবেন।
সারাদিনে
রাশেদ ঘুরে ঘুরে তার ভাইয়ের পছন্দ মত খেলনা সংগ্রহ করেছে। ওপাশের লইলিদের বাসার
সামনের গাছ থেকে ফুল পেড়ে এনেছে, আর তার জমানো এক আনা দিয়ে মারবেল কিনে এনেছে। আজ হাসপাতালে
যেতে নিয়ে যাবে। ভাইকে দিয়ে আসবে খেলার জন্য। বিছানায় বসেই মারবেল খেলবে। দুপুরে
একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে আজ বেরিয়ে গেলেন। হাসপাতালে গিয়ে দেখে এখনও ঘুমে, মা পাশে বসে। অস্থির
হয়ে ঘুরা ঘুরি করছে কখন ভাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে। মাকে বললো ওকে ডাক আমি এগুলি নিয়ে
এসেছি ও দেখবে খেলবে।
ডাকতে
হলো না। একটু পরেই কথার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে উঠে চোখ খুলে ভাই আর বাবাকে দেখে মনে
হচ্ছিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রাশেদ এগিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো কি ভাই
কেমন আছ?
এই যে
দেখ তোমার জন্যে কি এনেছি!
বলেই
ওকে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে হাতের ব্যাগটা বের করে খুলে বিছানায় ঢেলে দিতেই তা দেখে
ভাইয়ের মুখের যে হাসি সেদিন দেখেছিলো সে হাসি তার জীবনে কারো মুখে দেখেনি। সেই ভাই
আজ কি ভাবে তাকে এখানে রেখে তার বাসা থেকে যে জায়গা মাত্র এক ঘণ্টার ড্রাইভ সে ঈদ
করবে? নিশ্চয় তাকে নিয়ে যেতে
আসবে। যদিও আসলেই যে রাশেদ সাহেব তার সাথে যাবে তা নয়। তার সমস্ত অন্তর মন হৃদয়
জুড়ে যে মনি সেই মনির যেখানে জায়গা হয়নি সেখানে সে কিভাবে যেতে পারে? তবুও ভাবছে হয়ত এমন
হতেও পারে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে বুঝতে পারেনি। তবে পৌনে এগারটার দিকে একবার ঘড়ি
দেখেছিলো মনে আছে। ঘুম ভাঙল দুপুর প্রায় একটার পরে। শরীরের ক্লান্তি, মনের ভার বিষণ্ণতায়
নির্জীবের মত অনেকক্ষণ শুয়ে রইলো। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। না আর না, চারটা বেজে গেছে। কবির
এসে ডাকছে। উঠে পরল।
-কি
ব্যাপার ভাই নামাজে গিয়েছিলেন আমাকে ডাকলেন না?
-না
নামাজে যাইতে পারি নাই ঘুম ভাংছে বারোটায়, এসে দেখি আপনেও ঘুমে তাই আর ডাকি
নাই। আমি আবার শুইলাম এইতো এখন উঠলাম।
-তাই
নাকি? খাবার মত কিছু আছে? ক্ষুধা লেগেছে চলেন
খেয়ে আসি।
-কি
খাবেন কিছু নেই শুধু রাইস আছে।
-কেন
ডিম আছে না ডিম ভেজে নিলেই তো হয়। চলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।