১৮৬।
আস্তে
আস্তে মর্জিনা একটু স্থির হচ্ছে। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার ভার কি আর এত সহজে কাটিয়ে
উঠতে পারে?
সারাক্ষণ
মেয়েকে বুকে নিয়েই কাটাচ্ছে তবে এখন অন্তত কিছু খাওয়া দাওয়া করছে। রাশেদ সাহেবের
সাথেই তার যত কথা
বার্তা। কি করবে? এখানে আর কোন মহিলা নেই। রাশেদ সাহেব সবসময় খোজ খবর নেন। খাবার
সময় হলে ডেকে নিয়ে যায়। আস্তে আস্তে কোলের অবুঝ বাচ্চাটাও নতুন মামাকে চিনতে
পারে। মামা কাছে এসে শিমু বলে ডাকলেই হাত বাড়িয়ে দেয়। বসে টিভি দেখার মত মনের
অবস্থা মর্জিনার এখনও হয়নি আর কীইবা দেখবে? সবই ইংলিশ চ্যানেল! ওদিকে
মালিকেরা তাদের সব পরিচিতদের কাছে ফোন করে খবর নিচ্ছে কেও নাদিরুজ্জামান নামে
কাওকে চিনে কিনা। প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে আসিয়াদ ভাই এক দিন রেস্টুরেন্টে আসার আগে
আবারক্যানফিগের সনি ফ্যাক্টরিতে খবর নিয়ে এসেছে। নাদিরের সংবাদ জানা গেল। এখন
সবাই বলাবলি করছে আমাদের ভুল হয়ে গেছে, এখানে আগেই খবর নেয়া দরকার ছিল তা না করে আমরা এদিক ওদিক
খুঁজেছি। যাক,
সন্ধান
পাওয়া গেছে যখন এখন খুঁজেও পাওয়া যাবে।
-হ্যাঁ
হ্যাঁ নাদিরুজ্জামান আমাদের এমপ্লয়ি। লন্ডন থেকে কয়েকদিন আগে এখানে এসে জয়েন করেছে
-ও
কোথায় জান?
ওর
এড্রেস বলতে পার?
-কয়েকদিন
আগে বাংলাদেশ থেকে ওর ওয়াইফ আসবে বলে তাকে রিসিভ করার জন্যে ছুটি নিয়ে লন্ডন যাবার
কথা বলেছিল। গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে ও
ছুটিতে আছে,
২৬
তারিখে আসার কথা ছিল কিন্তু এখনও আসেনি। আমরা ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও
পাচ্ছি না।
-তোমরা
কি পুলিশে জানিয়েছ?
-আচ্ছা
তুমি কে?
এত কিছু
জানতে চাইছ কেন?
-আসলে
ওর স্ত্রীর যেদিন আসার কথা ছিল সেদিন সে এসে পৌঁছেছে কিন্তু হিথরোতে তাকে না পেয়ে
একা একা ব্রীজেন্ড চলে এসেছে। আমাদের একজন সেদিন লন্ডন থেকে একই কোচে এসেছে সে ওকে
সাথে নিয়ে নাদিরের বাসায় গিয়ে তালা দেখে ফিরে এসেছে এখন ওর স্ত্রী আমাদের
রেস্টুরেন্টে আছে।
-বল
কি? তাহলেতো ভীষণ চিন্তার
কথা! গেল কোথায়?
-তোমাদের
কোম্পানিতে ও অনেকদিন যাবত আছে তা এমনিতে ওর রেকর্ড কেমন?
-আসলে
ও এতদিন লন্ডনে ছিল এখানে এসেছে মাত্র কয়েক দিন আগে কাজেই আমরা তেমন কিছু বলতে
পারছি না। কিন্তু এখন কি করা যায় বলতো!
-আমার
মনে হয় পুলিশকে জানালে ভাল হবে, কি বল?
-হ্যাঁ
তাই করতে হবে।
এর পরেই
ওরা ব্রীজেন্ড পুলিশকে ঘটনাটা জানাল। ব্রীজেন্ড পুলিশ মটর ওয়ের কন্ট্রোল
স্টেশন ব্রিস্টল এবং লন্ডন পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে।
আসিয়াদ
ভাই রেস্টুরেন্টে এসে রাশেদ সাহেবের সাথে আলাপ করল।
-দাদা
আপনি মর্জিনাকে জানিয়ে দিবেন। ওর সংবাদ যখন পেয়েছি এখন ওকেও পাব, কান্নাকাটি করতে নিষেধ
করবেন। আসলে ও এখানে নতুন এসেছে বলে কারও সাথে আলাপ পরিচয় হয়নি তাই এই
হেস্তনেস্ত।
কেও চিনতে পারেনি।
-কি
যে বলেন ভাই আমি সারাক্ষণ নিষেধ করছি, কাঁদবে না, কিন্তু কে শোনে কার কথা? এমন অবস্থায় ওর কান্না ছাড়া আর কী করার আছে! দেখি আজকের
খবরটা বলে দেখি যদি একটু কান্না থামাতে পারি বলে রাশেদ সাহেব উপরে চলে গেলেন।
-মর্জিনা
শোন, তোমার একটা ভাল খবর
আছে।
-ওর
খবর পেয়েছেন ভাইয়া?
-হ্যাঁ, ওর সন্ধান পাওয়া গেছে
তবে আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই ওকেও পাব। লন্ডন এবং আমাদের এই ব্রীজেন্ড
পুলিশকে জানান হয়েছে। ও যেখানে কাজ করত তুমি বলেছিলে সনি কোম্পানিতে এখনও ও ওই
কোম্পানিতেই আছে। তোমাকে আনার জন্য ও ছুটি নিয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে ওর কোন সংবাদ নেই। সংবাদ যখন পেয়েছি এখন তুমি কান্না
বন্ধ কর। আর যেন কাঁদতে দেখি না, বুঝেছ?
-ভাইয়া!
বলে রাশেদ সাহেবের হাতটা চেপে ধরে বললো -আপনিই বলেন আমি কি করতাম?
-আহ!
কত বার বলেছি তুমি কোন চিন্তা করবে না এদেশে মানুষ ইচ্ছে করলেও হারিয়ে যেতে পারে
না। ওকে আমরা খুঁজে পাবই! দেখলে? চল এখন নিচে চল, বার থেকে কিছু জুস টুস খেয়ে ওখানে সবাই আছে ওদের সাথে একটু
কথা বল দেখবে ভাল লাগবে। চল।
রাশেদ
সাহেব শিমুকে কোলে নিয়ে আগে আগে নিচে নেমে এলেন।
১৮৭।
মর্জিনা
আসার কয়েক দিন পরে মনির সাথে ফোনে আলাপ হয়েছে। মর্জিনার ব্যাপারেও আলাপ করেছে। মনি
অবাক হয়েছে,
বল কি? মেয়েটা এখন কি করছে? রাশেদ সাহেব সব খুলে
বললেন। ওদিকে খুকু মা বোনদের কাছে একটু একটু সুস্থ হচ্ছে কিন্তু এতদিনের পুঞ্জিভূত
ক্ষত কি আর এত সহজে মুছে ফেলতে পারে? তবুও মা আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সুস্থ করে
আবার ফিরিয়ে দিতে। হাতে সময় বেশি নেই, মাত্র চার সপ্তাহ। এর মধ্যেই এক সপ্তাহ চলে গেছে।
দুই দিন
পরে সনি কোম্পানি থেকে আসিয়াদ ভাইকে ওদের অফিসে যেতে বললো ।
নাদিরুজ্জামানের
সন্ধান পেয়েছি। ব্রিস্টল এবং লন্ডন পুলিশ জানিয়েছে। গত ২৪ তারিখে লন্ডন যাবার পথে
মটর ওয়েতে এক্সিডেন্ট করেছিল। সম্ভবত স্পিড কন্ট্রোল করতে না পেরে সামনের একটা
লরিকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল এতে ওর গাড়ি সাংঘাতিক ভাবে ড্যামেজ হয়েছে এবং ওকে
মুমূর্ষু অবস্থায় ব্রিস্টল হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে, এখনও সেন্স আসেনি।
একটা হাত ভেঙ্গে গেছে। প্লাস্টার করা হয়েছে।
ওই
দিনেই বিকেলে সমসু ভাই তার গাড়িতে মর্জিনা এবং রাশেদ সাহেবকে নিয়ে ব্রিস্টল গেল। হাসপাতালেকাঁচের
জানালার বাইরে থেকে স্বামীকে দেখে মর্জিনার বাধ ভাঙ্গা কান্না শুরু হলো। কিছুতেই
থামতে চায় না। সেদিনের মত হাসপাতালে সমসু ভাইয়ের ফোন নম্বর এবং ঠিকানা দিয়ে ওরা
মর্জিনাকে অনেক কষ্টে ফিরিয়ে নিয়ে এলো।
দুই এক দিন পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাল ওর সেন্স এসেছে, এখন ওকে সাধারণ বেডে
নেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে সেই দিনই আবার মর্জিনাকে নিয়ে ব্রিস্টল গেল। নাদিরুজ্জামান
এবং মর্জিনার সাক্ষাত হলো। উভয়ে উভয়কে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! সমসু ভাই এবং রাশেদ
সাহেব হতভম্বের মত পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাকে
কি বলবে?
কেও ওদের
কোন কথা শোনার অবস্থায় নেই।
মিলনের
এই ক্ষণ হাসপাতালের কক্ষে অস্বাভাবিক এক দৃশ্য তৈরি করেছে। এক অসহায় স্ত্রী তার হারানো অসুস্থ স্বামীকে
কাছে পাবার,
ফিরে
পাবার যে কি আকুতি তা নিজের চোখে না দেখলে অনুভব করা কঠিন। সব হারিয়ে সে আবার তার
স্বামীকে ফিরে পেয়েছে। বাস্তব বড়ই কঠিন। কেমন করে কি হয়ে গেল! ঢাকা থেকে ফ্লাই
করার আগের মুহূর্তেও যার সাথে কথা হয়েছে তাকে এখানে এসে খুঁজে না পাওয়া, আবার যাও বা খুঁজে পেল
তাও এত দিন ছিল অচৈতন্য অবস্থায় আবার চৈতন্য ফিরে এলেও এক হাতে প্লাস্টার দেখে
আনন্দ, এত দিন খুঁজে না পাবার
বেদনা এবং বর্তমানে তার অসুস্থতা সব মিলিয়ে মর্জিনা ভিন্ন জগতে চলে গিয়েছে। সমসু
ভাই এবং রাশেদ সাহেবের মনে গভীর ভাবে দাগ কেটে চলছে, উভয়েই নির্বাক। শান্ত হবার কোন
অনুরোধ করতে পারছে না, ভাষা
খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে রাশেদ সাহেবের কোলে মেয়েটা এক বার মায়ের দিকে আর একবার
বাবার দিকে দেখছে আর কাঁদছে। জীবনে এই প্রথম বাবাকে দেখল মেয়েটা। ওদের কান্না একটু
থেমে এলে নাদির মেয়েকে কাছে টেনে বুকে চেপে ধরল। মর্জিনাকে জিজ্ঞেস করল এরা কারা?
সংক্ষেপে
মর্জিনা সব জানাল। সেদিনের মত ভিজিটিং সময় শেষ হয়ে এলো। সমসু ভাই হাসপাতালের
ডাক্তারের সাথে আলাপ করলে জানাল দুই এক দিনের মধ্যেই ওকে রিলিজ করা হবে। আচ্ছা
আমাকে ফোনে জানাবে আমি এসে নিয়ে যাব। আবার নাদিরের বেডে গিয়ে ওকে এ কথা জানাল।
আপনি চিন্তা করবেন না এখান থেকে রিলিজ দিলেই আমি এসে নিয়ে যাব। সেদিনের মত
মর্জিনাকে নিয়ে ফিরে এলো। এত দিনে মর্জিনার কান্নার ভার কিছুটা কমেছে। রাস্তায়
গাড়িতে বসে নানা কথা। আমাদের দেশে হাসপাতালে রুগীর সাথে থাকতে দেয় এখানে দেয় না
কেন? আমি থাকতে পারব না কেন? ওকে কে দেখবে?
তুমি এ
নিয়ে চিন্তা করবে না এখানে দেখার জন্য নার্স আছে ওরাই দেখবে, ডাক্তার তো আছেই। তুমি
থেকে কি করবে?
-ভাইয়া
ঢাকায় একটা ফোন করেন না!
-বাসায়
কথা বলবে?
-হ্যাঁ
ওর কথা একটু জানাতাম
আচ্ছা
বল, বলেই পকেট থেকে মোবাইল
বের করে মর্জিনার বাবার বাড়ির লাইন ধরে ওর হাতে মোবাইলটা দিয়ে দিলেন।রাশেদ সাহেব নিশ্চিন্ত।তার খুব ভাল লাগছে।
মর্জিনা কথা বলছে, কিছু
বলছে, ওর মুখে কথা ফিরে
এসেছে। মন থেকে অন্ধকার দূর হয়েছে। অনিশ্চয়তার কাল আঁধার কেটে আলোর দেখা পেয়েছে।
বাকিটা নাদির বাসায় ফিরে এলেই ঠিক হয়ে যাবে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।