১৭৭।
১২
তারিখে খুকু কনফার্ম করল সে ১৪ তারিখে
আসতে পারছে। সেদিন থেকেই রাশেদ সাহেবের প্রস্তুতি শুরু হলো। মেয়ে আসলে
কোথায় কোথায় যাবে কি খাবে। ১৪ তারিখে সকাল আটটায় মোবাইল বেজে উঠল।
-হ্যালো।
-আব্বু
আমি যেতে পারছি না, লন্ডনের
টিউবে বোমা বার্স্ট হয়েছে।
-রাশেদ
সাহেব চমকে উঠলেন। বল কি?
-হ্যাঁ
তুমি টিভি খুলে দেখ, কিং
ক্রস সহ এক সাথে পাঁচটা স্টেশনে। আমি স্টেপনি গ্রিন স্টেশনে ডিসট্রিক্ট লাইনের
অপেক্ষা করছিলাম এমন সময় ফিরোজ চাচা ফোন করে বললো এই অবস্থা, তুমি আজকের জার্নি
হোল্ড করে বাবাকে জানিয়ে দাও পরে যেও। বাসায় এসে টিভি খুলে দেখি লন্ডনের সমস্ত
আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব, ট্রেন
বন্ধ করে দিয়েছে, কি
ভয়ংকর অবস্থা! কত মানুষ পড়ে রয়েছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে! ডিসট্রিক্ট লাইনের একটা ট্রেনেও হয়েছে ওই সময়।
ভাগ্য ভাল চাচা আগেই নিউজ দেখে আমাকে জানিয়েছে। আমার ভীষণ ভয় করছে আব্বু!
-এদেশেও
এই অবস্থা! আমি ভাবতেও পারছি না। এদেশে এমন ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। কারা করেছে
কিছু বলছে?
-আবার
কারা? মুসলিম জঙ্গিদের কথা
বলছে, প্রত্যেকটা স্টেশনের
সিসি টিভিতে যা দেখা গেছে সবই দেখাচ্ছে।
-আচ্ছা, থাক ভয়ের কিছু নেই।
সাবধানে চলাফেরা করবে। এখন এখানে কড়া সিকিউরিটি থাকবে কাজেই তোমার আইডি কার্ড
সবসময় সাথে রাখবে।
-আচ্ছা
আব্বু।
রাশেদ
সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কতদিন থেকে অপেক্ষায় আছে মেয়ে আসবে। কিন্তু এ কি হলো?
যাক, হাজার শোকর, খুকু ওই ট্রেনে যেতে
পারেনি, যদি ও ওই ট্রেনে থাকত!
১৭৮।
দুইদিন
পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে খুকু জানাল সে সতের তারিখে পেডিংটন থেকে সকাল সাতটার
ট্রেনে আসবে। সেদিন নয়টায় তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে ব্রীজেন্ড রেল স্টেশনে
ছুটলেন। মিনিট
দশেক হেঁটে স্টেশনে এসে বসে রইলেন। ট্রেন আসতে আরও আধা ঘণ্টা দেরি আছে।
এদিক ওদিক পায়চারী করছেন। সময় যেন কাটতেই চায় না। একসময় ওয়েটিং
লাউঞ্জের মনিটরে দেখা গেল লন্ডনের ট্রেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছে। একটু
পরে হুইস্যাল শোনা
গেল। ট্রেন এগিয়ে আসছে। ট্রেন এসে থামল। রাশেদ সাহেব টিকেট চেক করার গেটের
কাঁচের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এক এক করে সবাই নেমে গেটের মেশিনে
টিকেট চেক করে বের হচ্ছে। ছোট স্টেশনে বেশি যাত্রী ওঠা নামা করে না। মেয়েকে নামতে দেখে
রাশেদ সাহেবের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক
দেখা গেল। বের হতেই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পাশে
দাঁড়ান চেনা এক রেলওয়ে কর্মী ডেভিড তাকিয়ে দেখল।
-ইয়োর
ডটার?
-হ্যাঁ
মেয়ে, কিন্তু তুমি কেমনে
বুঝলে?
-চেহারা
দেখেই বুঝেছি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো গুড লাক।
বের হয়ে
রেস্টুরেন্টে এসে দেখে নাসির নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করছে। মেয়ের থাকার জন্য আগে থেকেই
একটা খাট নিয়ে রেখেছে। নাসির সহ মালিকেরা সবাই দাদার মেয়ে আসছে বলে যার পক্ষে যা
করার তা কেও কম করেনি। সমসু ভাই জিজ্ঞেস করে মেয়ের জন্য ইলিশ মাছ এনে রেখেছে। মেয়ে
এলে ঢাকার মোগলাই বিরিয়ানি রান্না হবে সে ব্যবস্থাও করে রেখেছে। সোয়ান সি থেকে
ছাগলের মাংস এনে রেখেছে। গফুর ভাইকে আগে থেকেই বলে রেখেছে মেয়ে আসলে বিরিয়ানি
রান্না করবে সেদিন আমাদের এখানে খাবেন। মালিকেরা জানে মেয়ে এলে দাদা মেয়েকে নিয়ে
বেড়াবে তাই তার জন্য আগাম ছুটির ব্যবস্থা করে রেখেছে।
বিকেলে
ট্রেনে করে সোয়ান সি হয়ে পন্টারডুলাসে মনা ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে বেড়াতে গেল। রাতে
খাওয়া দাওয়া সেরে মনা ভাই তার গাড়িতে করে পৌঁছে দিল আর পোর্টাল বোটে তার বাসায়
যেয়ে চাচীর
সাথে দেখা করতে বলে গেল। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পোর্তকল সি বিচে গেল।
আটলান্টিকের পাড়ে বাপ মেয়ে ঘুরে বেড়াল, ছবি তুলল। দুপুরে একটা ক্যারিবিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে
আবার সাগর পাড়ে গিয়ে দেখল ভাটার টানে সাগরের পানি অনেক দূরে চলে গেছে আর পানির
নিচের প্রবাল মেশান পাথুরি সমুদ্রতল সুন্দর দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব এর আগেও
এখানে এসেছিলেন কিন্তু তখন জোয়ার ছিল বলে এই চমৎকার দৃশ্য দেখতে পারেনি। আজ মেয়েকে
নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরলেন। সন্ধ্যার আগে ফিরে এসেদেখেনাসির বারে কাজ
করছে। মেয়ের জন্য ফ্রুট
জুসের ককটেল বানিয়ে দিল। কোথায় কোথায় বেড়াল সব কথা হলো। সমসু ভাই বিরিয়ানি রান্না
করবে কিনা জিজ্ঞেস করে কিচেনে জানিয়ে দিল তারা যেন সব রেডি করে রাখে। খুকু জুসের
গ্লাস নিয়ে কিচেনে যেয়ে কি করতে হবে কুককে বুঝিয়ে দিয়ে বলে আসল আপনি রেডি করে রাখুন আমি একটু ফ্রেশ হয়ে
আসছি।
গফুর
ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয়া হলো তার টেক এওয়ে বন্ধ হলে যেন এখানে চলে আসে। সমসু
ভাই আরও কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করেছিল, মনা ভাইও বাদ পড়েনি।
রাতে সবাই মিলে একসাথে বসে আনন্দ করে বিরিয়ানি খাওয়া হলো। সবাই প্রশংসা
করল। খুব ভাল হয়েছে মা, খুব ভাল রেঁধেছ।
কয়দিন
পোর্তকল,
কার্ডিফে
বেড়াল। খুকুর ছুটি ফুরিয়ে এলে তিন দিন থেকে চলে গেল। বাবার জন্য রেখে গেল কিছু
মধুর স্মৃতি যা নিয়ে আবার কিছুদিন একঘেয়েমি থেকে দূরে থাকার, বেঁচে থাকার একটা উপায়
হবে।
১৭৯।
রাশেদ
সাহেবের এখন আর বিষণ্ণ মনে হয় না। কোন কিছুতে বিরক্তি আসে না। মাস খানিক পরে একদিন
ফোনে ফিরোজ বললো-
-রাশেদ, তুমি এত দিন ধরে এসেছ, লন্ডনের কিছু দেখলে না, এবার এখানে এলে তোমাকে
আর তিথিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াব। কোথায় কোথায়
যাবে মনে মনে ভেবে রেখো। কবে আসতে পারবে?
-দেখি
সামনের সপ্তাহে যদি পারি তাহলে আসব।
-এবার
আসলে মেয়ে সহ আমার এখানে থাকবে।
আচ্ছা।
এক মাস
এক নাগারে কাজ করে ছুটি জমিয়েছে, সাপ্তাহিক ছুটি কাটায়নি। পরের সপ্তাহে পাঁচ দিন ছুটি নিয়ে
রাতের ট্রেনে রাশেদ সাহেব লন্ডনে গেলেন। খুকুকে আগেই বলে রেখেছে কয়েকদিন থাকার
মত কাপড় চোপর নিয়ে তুমি সকালে চাচার বাসায় চলে এসো। ফিরোজ নিজেও কয়েকদিন ছুটি নিল।
পাঁচদিন ভরে লন্ডনের নানা জায়গায় বেড়াল। মাঝে মাঝে ভাবীও ছিল সাথে। একদিন ব্রাইটন
গেল সেখান থেকে ফিরোজ জিজ্ঞেস করল-
-আর
কোথাও যাবার ইচ্ছে আছে?
-এখান
থেকে ক্যামব্রিজ কত দূর?
-যত
দূরেই হোক যেতে চাও?
-যদি
পার তাহলে চল,
দেখে
যাই। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রিজ দেখার। এর মধ্যে
অক্সফোর্ডে কাজ করার সময় দেখে নিয়েছি ক্যামব্রিজটা বাকি রয়ে গেছে।
-চল
তাহলে।
সামনের
রাউন্ড এবাউটে গাড়ি ঘুড়িয়ে ফিরোজ ক্যামব্রিজের দিকে চলল।ঘণ্টা দুয়েক ড্রাইভ করে
ক্যামব্রিজ এসে একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে রাতের ডিনার খেয়ে গাড়িতে বসে এদিক ওদিক
একটু ঘোরা ঘুরি করে চলে এলো লন্ডনে। এ কয়দিন ভাবী অনেক কিছু রান্না করেছিল, প্রায় সবই ছিল দেশি
খাবার। আজ রাতে বাইরে খেয়ে এসেছে শুনে ভাবীমহা রেগে গেল।
-কেন
বাইরে খেয়ে এসেছেন বলেন? আমি রান্না করে রেখেছি সেগুলি কি হবে?
-আপনি
এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন ভাবী? ফ্রিজে রেখে দেন কাল সকালে খেয়ে যাব!
তবুও কি
আর ভাবী শান্ত হয়? কোন
ভাবে ক্ষমা চেয়ে সেদিনের মত উদ্ধার পেল। আগামী কাল রাশেদ সাহেব চলে যাবে। তিথি
বাবার সাথে বের হয়ে বাবার সাথে একটন থেকে সেন্ট্রাল লাইনে লিভারপুল স্ট্রিট
পর্যন্ত এসে গাড়ি বদলে ডিসট্রিক্ট লাইনে চিজ উইক নেমে ওর কাজে ম্যাকডোনালে চলে
যাবে আর রাশেদ সাহেব ভিক্টোরিয়া টিউব স্টেশনে নেমে সোয়ান সির কোচ ধরবেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।