১৭২।
সকাল
আটটায় ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে রাশেদ সাহেবের কোচ। কর্ণ ফ্ল্যাক্স আর দুধ দিয়ে
নাশতা খেয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে বের হল। স্টেপনি গ্রিন থেকে টিউবে
ডিসট্রিক্ট লাইন ধরে যেতে হবে। আগের রাতে
তানিম ফোনে বলেছিল ভাইয়া, আপনাকে এগিয়ে দেয়ার
জন্য ওকে নিয়ে যাবার দরকার নেই। একা ফিরতে না পারলে আবার আর এক সমস্যা হবে। কিন্তু
রাশেদ সাহেব জানে তার মেয়ে যে পথে এক বার যাবে সে ঠিক পথ চিনে আবার ফিরে আসতে
পারবে। সাহস করে মেয়ের উপর আস্থা রেখে ওকে নিয়েই বের হল। পথে ট্রেনে বসে আরও
বোঝাল। এক এক করে কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া টিউব স্টেশনে এসে
গাড়ি থামল। উপরে উঠে আসতেই খুকু বললো -আব্বু এই এত বড় স্টেশন?
-হ্যাঁ বাবা এটা লন্ডনের
সব চেয়ে ব্যস্ত স্টেশন। কোন দিক দিয়ে বের হতে হবে ওকে দেখাল। সাথে জানাল যে আমি
এখান থেকে কোচ স্টেশনে যেতে প্রতিবারেই পথ হারিয়ে ফেলি। শুনে খুকু হাসল।
-আব্বু
তুমিও হারিয়ে যাও?
-হ্যাঁ
দেখছ না কত্ত বড় আর ব্যস্ত স্টেশন! আমি সব সময়ই উলটা পথে বের হয়ে আর যেতে পারি না।
শেষ পর্যন্ত কাওকে জিজ্ঞেস করে তারপরে যাই। কাজেই তুমি ভাল করে দেখে নাও। এখান
থেকে কোন পথে বের কতে হয়।
বের হয়ে
মিনিট দশেক হেঁটে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের ডিপার্চার টার্মিনালে পৌঁছে দেখল আরও প্রায়
আধা ঘণ্টা বাকী আছে সোয়ান সির কোচ ছাড়তে।
-ওই যে
ও পাশে এরাইভ্যাল টার্মিনাল। এখানে দুইটা টার্মিনাল একটা এরাইভ্যাল আর একটা
ডিপার্চার। কোথা থেকে টিকেট করতে হয় দেখিয়ে দিল। বলে দিল তোমার কোথাও যেতে হলে এত
দূরে এসে টিকেট করতে যেও না। বাসা থেকে বা কাছের সাইবার ক্যাফে থেকে অনলাইনে
ন্যাশনাল এক্সপ্রেস বা মেগা বাসের টিকেট করে নিও। আরও একটু এদিক ওদিক ঘোরা ঘুরি
করল। খুকু স্টেশনের ভিতরের এক ইন্ডিয়ান দোকান থেকে রাস্তায়
খাবার জন্য কয়েকটা সিঙ্গারা আর স্যান্ডউইচ কিনে ব্যাগে ভরে দিয়ে বললো মনে করে খেও।
কোথা দিয়ে কোচ যাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে বললো-তাহলে কার্ডিফে যখন
থামবে তখন এগুলি খেয়ে নিও মনে করে।
-আচ্ছা
আব্বু তুমি এ জন্যে ভেবো না।
দেয়ালে
লাগানো মনিটরে সময় দেখে বললো
-আব্বু, আমি তাহলে গাড়িতে উঠি?
-আচ্ছা, সাবধানে থেকো।
রাশেদ
সাহেব হাতে ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে কোচে উঠে বসলেন। কয়েক
মিনিটের মধ্যে কোচ ছেড়ে টার্মিনাল থেকে বের হয়ে বাকিংহাম প্যালেস রোডের ডানে
টার্ন নিয়েই ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়াল। জানালার পর্দা সরানো ছিল, দেখল খুকু একটা চায়ের
গ্লাস হাতে রাস্তা পার হচ্ছে।
১৭৩।
সারাটা
পথে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে যখন কার্ডিফ এসে পৌঁছল তখন রাশেদ সাহেবের কত স্বপ্ন, কত আশার চিন্তা স্রোত
থেমে গেল। খুকুর দেয়া খাবারের কথা মনে হলো। নিচে নেমে এক ক্যান ডায়েট কোক এনে
সাথের ব্যাগ খুলে খুকুর দেয়া প্যাকেট খুলে খেয়ে নিলেন। মনে
হলো কতদিন পরে আপনজনের পরম যত্নে দেয়া খাবার খাচ্ছে। যদিও দোকান থেকেই কিনে দিয়েছে কিন্তু নিজের
মেয়ের হাতের স্পর্শ মাখা এত যত্ন এখানে কতদিন পায়নি! দুপুরের পরে পরেই ব্রীজেন্ড
পৌঁছে গেল। রেস্টুরেন্টে এসে দেখে নাসির দুপুরের ডিউটি শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে
উপরে যাচ্ছে। রাশেদ সাহেবকে দেখে আবার নিচে নেমে এলো।
-কি
খবর রাশেদ ভাই,
মেয়েকে
নিয়ে এ কয়দিন কেমন কি করলেন? কেমন লাগল? আমি এর মধ্যে ফোন করে ডিস্টার্ব করিনি। ভাবলাম আপনি এলেই
সব জানতে পারব।
-হ্যাঁ
নাসির আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কেন ফোন করনি। এ অনুভূতির কথা কি আর বলব বল! এ কী বলে বোঝান যায়? এ শুধু অনুভবের। আমিতো
কোনদিন ভাবতেই পারিনি আমার মেয়ে আসবে আমি এখানে তাকে বুকে নিয়ে আদর করতে পারব!
সত্যিই নাসির আমার যে কেমন লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না।
-সত্যিই
তাই রাশেদ ভাই।
-তারপর
বল এখানে তোমরা কেমন ছিলে?
-ওইতো
সারাক্ষণ আপনার কথাই আলাপ হয়েছে। সমসু ভাই আসিয়াদ ভাই শুধু বলছিল দাদা আজ কত খুশী
কত আনন্দ!
-ওহ!
নাসির ভাল কথা,
বাহাদুরকে
জানান হয়নি!
-বলেন
কি?
-শিগগীর
ফোন দেন।
-হ্যাঁ
হ্যাঁ দিচ্ছি এখনই বলছি, আসলে আনন্দের আতিশয্যে সবকিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে
গিয়েছিল
-খুবই
স্বাভাবিক রাশেদ ভাই।
বাহাদুরের
সাথে কথা বলে খাবার খেয়ে উপরে গিয়ে গোসল করে বিকেলের ডিউটির জন্য রেডি হচ্ছে।
১৭৪।
রেস্টুরেন্টে
আসার পরে প্রতিদিনই দিনে কয়েকবার করে খুকুর সাথে ফোনে কথা হচ্ছে। খুকু কোথায়
যাচ্ছে কি করছে কি দেখছে সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে পারছে। কয়েকদিন পরে একদিন
খুকু জানাল
-মেঝ
কাকু আজ সকালে ফোন করেছিল বললো দুই একদিনের মধ্যে ওদের ওখানে যেতে। কি করব?
রাশেদ
সাহেব ভাবনায় পড়ে গেলেন। ওর মায়ের সাথে যা করেছে তাতে ওকে ওখানে যেতে দিতে মন
চাইছে না কিন্তু ওই বিভীষিকাময় ঘটনার প্রতিফলন কি সন্তানদের উপর বর্তানো যায়? না, তা কী করে হয়? এই বিষবৃক্ষ ওদের
মধ্যেও সংক্রমিত হোক এমনটা হতে দেয়া যায় না। সময়ের আবর্তনে একদিন যা হয় হবে এখন
অন্তত ওকে নিষেধ করা যায় না।
-তুমি
চিনে যেতে পারবে?
-মনে
হচ্ছে পারব। ভিক্টোরিয়া থেকে গ্লস্টারের কোচ যায় দেখেছি আবার সেদিন প্যাডিংটন
গিয়েছিলাম ওখানে দেখেছি বারমিংহামের ট্রেন গ্লস্টার স্টেশন ধরে।
স্টেশনে নামলেই কাকু নিয়ে যাবে।
-তাহলে
কাকুকে তোমার এরাইভ্যাল শিডিউল জানিয়ে দিও। কবে যেতে চাও?
-কালই
যাই!
-বাসায়
বর্ণা আর ওর মাকে বলে যেও
-হ্যাঁ
তাতো বলবই
-আর
ফিরোজ চাচা বা চাচীকেও বলে যেও
-আচ্ছা।
ফিরোজকে
বলার পরে ফিরোজও অবাক হয়েছিল। তুমি গ্লস্টারে চাচার বাসায় যাচ্ছ? তোমার বাবা যেতে বলেছে?
ফিরোজের
অবাক হওয়া দেখে খুকুও অবাক হয়েছিল। চাচা এমন অবাক হলো কেন? কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে বাবাকে
জিজ্ঞেস করেছিল। নতুন বলে এত দূরে একা যেতে পারবে কিনা রাশেদ সাহেব এই সব বলে
কোনভাবে এড়িয়ে গেছে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।