২৫৫।
যূথী যাবার আগে থেকেই রাশেদ সাহেবের সব ভাই ফাইনাল সিদ্ধান্ত
নিয়েছে তারা নিজেরা এ বাড়ির আর কোন উন্নয়ন করবে না। কে করবে? রাশেদ
সাহেবের সামর্থ্য নেই আর ওরা সবাই ইংল্যান্ড কানাডার নাগরিক, ওদের
ছেলেমেয়েরা
ওখানেই পড়াশুনা করছে। ওরা কি আর এ দেশে বসবাসের জন্য আসবে? বাবাও
ওদের প্রস্তাবে মত দিয়েছে। শুধু একা রাশেদ সাহেব বাড়িটা ভিন্ন মালিকানায় চলে যাবে
আর তাদের নিজেদের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না বলে মত দিতে পারছিলেন না। এই বাড়ি তার ছোট বেলায় হয়েছে। গ্রামের এজমালি
জমিজমা বিক্রি করে, মায়ের গয়না বিক্রি করে এই জমি কেনা থেকে
শুরু করে বাবার গ্রাচুইটির টাকা দিয়ে ছয় তলার ফাউন্ডেশন সহ একতলা করার সমস্ত
ইতিহাস তার হাতেই হয়েছে সবই তার জানা। তাই মায়ের ছোঁয়া, বাবার
সারা জীবনের সঞ্চয় মিলে এই বাড়ি হয়েছে বলে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
কিন্তু ওদের চাপাচাপিতে এক সময় বুঝতে পারলেন এইতো আমি মরে গেলেই আমার তিন মেয়ে এই
বাড়ির কতটা পাবে? ওদের মধ্যেই তিন ভাগ হয়ে যাবে তখন কাউকে হয়ত
তার অংশ বিক্রি করে দিতে হবে। তখন ওই এক কথাই দাঁড়াবে। তার চেয়ে ওদের সাথে সায়
দিলেই ভাল হয়। সে অন্তত একটা ফ্ল্যাট পাবে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন থাকবে তারপরে
তার মৃত্যুর পর মেয়েরা বিক্রি করে যার যার মত অন্যত্র চলে যাবে। পৃথিবীতে একমাত্র
আল্লাহর বিধান আর আদেশ নির্দেশ ছাড়া চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই। আজ যেটা একজনের কালই
সেটা আর একজনের হয়ে যাচ্ছে। তার জীবন দিয়ে, পৃথিবীর
আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে সে এই সত্য কঠিন ভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। মনির সাথে রাজীবের সাথে
পরামর্শ করে সে সম্মতি দেয়ার পর থেকেই ডেভেলপার খোঁজাখুঁজি শুরু করে একজনের সাথে
চুক্তি হলো। এ বাড়ি
ডেভেলপারের হাতে ছেড়ে দিয়ে তারা পাশের এক ভাড়া করা বাড়িতে গিয়ে উঠল। বাড়ির
কন্সট্রাকশনের কাজ চলাকালিন ভাড়া বাড়ি থেকেই যূথী চলে গেছে।
২৫৬।
দিন তার নিজের নিয়মেই গড়িয়ে যায়। কে সুখে আছে আর কে কষ্টে আছে সে
দেখার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই তার নেই। তেমনি করে রাশেদ সাহেবদের পরিবারের দিনগুলিও
চলে যাচ্ছে। একদিন বাড়ির
কাজ শেষ হলো। এখন নিয়ম অনুযায়ী বাবা তাদের ভাই বোনদের মাঝে ফ্ল্যাট ভাগ করে দেয়ার
কথা। রাশেদ সাহেব তার বাবাকে বললেন আমি যেহেতু দেশেই থাকব আর ওরা তো দেশে আসবে
শুধু বেড়াতে কাজেই আমাকে দোতলার একটা ফ্ল্যাট দিবেন। শুনে রাশেদ সাহেবের বাবা
বললেন-
-তুমি তো এখান থেকে কিছু পাবে না, তোমার অংশ জাহিদকে দেয়া হবে।
রাশেদ সাহেব চমকে উঠলেন, বাবা কি বলছে?
-কেন, আবার কি হলো?
-তুমি ব্যবসা করার নামে জাহিদের সাভারের জমিতে লোণ নিয়েছিলে সেটা
ওখান থেকে জমি বিক্রি করে শোধ করতে হয়েছে কাজেই ওই হিসাব থেকে তোমার এই হিসাব
সমন্বয় করা হয়েছে।
বাবা বলে কি? রাশেদ সাহেব কিছু
বুঝতে পারলেন না।
-আমি কি শুধু আমার জন্য ওই ব্যবসা করেছিলাম? তখন যদি
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ওইরকম না হোত আর আজ যদি ওই ব্যবসা টিকে থাকত যদি সফল হোত
তাহলে কি ওটা আমার একার হোত? সব ভাইবোনেরা কি
ওটার শরীক হোত না?
-আমি তোমার এত কথার জবাব দিতে পারব না।
-আচ্ছা, ওদেরও কি একই কথা?
-হ্যাঁ মেঝ কর্তাই এমন করে বলে দিয়েছে।
-কে জাহিদ?
-হ্যা।
তখন রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন, তাহলে বিলাতে জাহিদের বাসায় ওদের
উঠতে না দেয়ার পিছনে এই কারণ? যে ক্ষত সে আর মনি
আজও ভুলতে পারছে না। এই দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পরে সে তার অপরাধ জানতে পারল।
-জাহিদ বললো আর আপনি তাই মেনে নিলেন, আপনি না
বাবা, সংসারের কর্তা, তাহলে আপনার কোন মতামত
নেই? সাভারের ওই জমিতো একান্নবর্তী সংসারে থাকা অবস্থায় কেনা
হয়েছিল এবং প্রথমে সেটা আপনার নামে করতে চেয়েছিলেন আমিই সেটা ওর নামে করিয়েছিলাম
এমনকি আমাদের পরিবারে কি এখনও কোন ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছেন যে ওটা একান্তই ওর!
ওখানে সবাই শরীক। এভাবে আমার রোজগারের টাকা দিয়ে যা করেছেন সেগুলি কেন শুধু আমার
একার না? সেগুলিতে যদি ওরা সবাই মালিক হতে পারে তাহলে এখন কেন এই
কথা উঠছে?
-না তা হয় না।
-কেন হবে না, যদি ওটা আপনার নামে
হোত তাহলে কি হোত?
-তা যেহেতু হয় নাই কাজেই এখন যা বলছি তাই হবে আমি আর কিছু বলতে
পারব না।
রাশেদ সাহেব কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলে এসেছিলেন। কি হবে আর কিছু
বলে? রক্তের সম্পর্ক মুছে ফেলার ইতিহাস রাশেদ সাহেব অনেক আগেই জানতে
পেরেছিলেন। তবে ফিরে আসার আগে বাবাকে
বলেছিলেন জাহিদ একটা ভুল করেছে আর সেটা প্রশ্রয় দিয়ে আপনি নিজেও একটা মস্ত ভুল
করলেন।
মনটা বিষণ্ণ। তাই দেখে মনি জিজ্ঞেস করল-
-কি হয়েছে, আব্বা কি বললো?
সব শুনে মনি বললো-
-তাতে কি হয়েছে তুমি এ নিয়ে মোটেই ভেবো না। আজ তোমার সবই আছে।
ছেলের মত জামাই পেয়েছ। মেয়েরা বড় হয়েছে যোগ্য হয়েছে তোমার অভাব কিসে?
-না মনি, সে কথা ভাবছি না।
-তাহলে?
-ভাবছি মেয়েদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারব না, তাই
ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছি।
ওই দিনেই রাতের মধ্যে সব জামাই মেয়ে একথা জেনে রাশেদ সাহেবকে
বোঝাল। আব্বা আপনি মোটেই ভাববেন না, আমাদের কিছুই দরকার
নেই। আমাদের দরকার শুধু আপনাদের দোয়া। আপনারা আমাদের জন্য নামাজ কালাম করে দোয়া
করবেন এতেই আমাদের সব পাওয়া হবে। আল্লাহতালা আমাদের অনেক দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। একবার স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে চলে গেলে কি আর
কেও এদেশে ফিরে আসে? যুথীআরফিরেআসবেনা, বরং
বাবা মা সবাইকে নিয়েই যেতে চেষ্টা করবে। যূথী পাশ করলে দেখবেন আপনার মত সুখী কেও হবে না তখন কিছুদিন অস্ট্রেলিয়া আবার
কিছুদিন কানাডা আবার কিছুদিন ঢাকায় বীথীর কাছে থাকবেন। এইতো আর মাত্র কয়েকদিন।
একটু অপেক্ষা করেন।
রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-অস্ট্রেলিয়া মানে?
রাজীব বলল- আমরা ওখানে মাইগ্রেট করার জন্য এপ্লাই করেছি তাতে ওরা
যে পয়েন্ট চায় আমার তার চেয়ে বেশিই আছে আশা করি খুব শিগগিরই হয়ে যাবে।
সবাই বোঝালেও রাশেদ সাহেব আর মনি কিছুতেই এ কথা মেনে নিতে পারছে
না। তাদের কিছুই থাকবে না এটা কি করে মেনে নিতে পারে? এই
সংসারের জন্য নিজের পড়ালেখা বিষর্জন দিয়েসেই কবে এতটুক বয়সে বাড়ি থেকে বের হয়ে
সারাটা জীবন দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে ঘুরে আজ এই পরিণতি? তার
নিজের সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারবে না? মনকে
নানা ভাবে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করেও কিছু হচ্ছে না। কিছুতেই মন মেনে নিতে পারছে
না। বাবার উপরে ভাই বোনদের উপরে তার দাবী রেখেই দিলেন, ছেড়ে দিতে মন সায় দিল না।
এই প্রায় বৃদ্ধ বয়সে এসে আগের মত উদার থাকতে পারলেন না।
মনে মনে সেই যেবার প্রথম ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে প্রথম বিদায়
নিয়েছিলেন সেই রাত থেকে এ পর্যন্ত ঘুরে এলেন। সবার শেষের বিলাতের দিনগুলার কথা মনে
হতে চোখ ভিজে আসল। কি ভাবে মানবেতর জীবন কাটিয়েছে ওখানে! ওই ভাবে একটানা দশটা বছর
তার জীবন থেকে চলে গেছে। কেও পারবে সেদিনগুলা ফিরিয়ে দিতে? কার জন্য যেতে হয়েছে?
এই বাবা এই ভাইবোনদের জন্যেই তাকে দেশ ছেড়ে তার স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে যেতে হয়েছে।
তারা যদি একটু বাস্তবতার নিরীখে ভেবে দেখত তাহলে তার জীবন থেকে এই দশটা বছর হারিয়ে
যেতে পারত না। সেই বিভিষীকাময়
দিনগুলার কথা মনে হলে এখনও রাশেদ সাহেব চমকে উঠেন। রাতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনিকে
ছুয়ে দেখে সে সত্যিই কোথায়, মেয়েদের ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। ওদের
ছুয়ে দেখেন সত্যিই ওরা তার পাশে আছে কি না। মেয়েরা বুঝতে পেরে বাবার সাথে কেদে
ফেলে আবার একটু শান্ত হয়ে বাবাকে বোঝায়, আব্বু যা হবার হয়ে গেছে ওই সব দিনের কথা
তুমি ভুলে যাবার চেষ্টা কর। মেয়েরাও প্রায়ই কোন দরকার নেই তবুও আব্বু বলে ডেকে
কাছে এসে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে মিশে থাকে। আর মনি! সে তো প্রায়ই রাশেদ সাহেবের
ঘুমের মধ্যে তার দিকে অপলক চেয়ে থাকে। কতদিন মেয়েরা এসে দেখে মা বাবার দিকে চেয়ে
আছে আর চোখ মুছছে। তাকেও প্রবোধ দেয়, আম্মু আর কেন? বাবাতো এসেছে! এইতো বাবা তোমার
হাতের মধ্যেই রয়েছে। রাশেদ সাহেব আধো ঘুম আধো জাগরনের মধ্যে কতদিন এ কথা শুনেছে।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছে, কি হচ্ছে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।