২১১।
রাশেদ
সাহেব নিউ ক্যাসেল ফিরে আসলেন। আবার সেই আগের মত গতানুগতিক ধারাবাহিক জীবন। এর
মধ্যে ফিরোজ একটা দুঃসংবাদ জানাল। ওর মায়ের ক্যানসার ধরা পরেছে, ডাক্তাররা আর মাত্র ছয়
মাস সময় দিয়েছে।
মনটা বেশ খারাপ। রাশেদ
সাহেবও বোঝালেন।
দেখ
আমার মায়েরও ঠিক একই সমস্যা হয়েছিল তার জন্য কি আমরা কম চেষ্টা করেছি? তবে তুমি বিলাতে আছ আর
এর মধ্যে চকিৎসাও কিছু এগিয়েছে তাই হয়ত মাকে কিছুদিন বেশি পাবে কিন্তু তোমাকে
বাস্তবের সত্যিটা মেনে নেয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
হ্যাঁ
আমি বুঝতে পেরেছি রাশেদ।
২১২।
ওদিকে
মনির দিনগুলি কি ভাবে যাচ্ছে সে একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেও বুঝতে বা জানতে পারছে
না। স্বামীকেও কিছু খুলে বলতে পারে না
যদি তার মন ভেঙ্গে যায় তাহলে দেশে ফিরে আসার জন্য উতলা হয়ে উঠবে। তখন কি উপায় হবে? নানা সাত পাঁচ ভেবে
সমস্ত যাতনা ভাবনা নিজের মধ্যেই চেপে রাখে। কোন কাজে মন বসাতে পারে না। মেয়েদের
চোখে মায়ের অন্যমনস্কতা, উদাসীনতা ধরা পড়ে কিন্তু তারাও নীরবে মেনে নেয়া ছাড়া আর
কোন পথ খুঁজে পায় না। রান্না বান্না আগের মত হয় না। কোথায় কি রাখে তা মনে করতে
পারে না। কতগুলি দিন চলে গেল! ভাবতেও অবাক লাগে! তারপ্রাণ
পাখি আজ কোথায় কি করছে? যখন যা হয় সব ফোনে আলাপ হয় কিন্তু সব কি আর খুলে বলে? মনি বুঝতে পারে ওর দিন
কিভাবে কাটছে। যে মানুষটা বাইরের কাজ সেরে এক মুহূর্তও দেরি না করে বাড়িতে ফিরে
আসার জন্য অস্থির হয়ে যেত সে কি করে এতগুলি দিন কাটাচ্ছে? মনিকে ছেড়ে সেও যেমন থাকতে পারে
না সে নিজেও কি তেমন করে পারে? তাই কি হয়? ঘরের ভিতরেই আসতে যেতে সবসময় শুধু ওর কথাই মনে আসে ওর ছায়া
মনে ভেসে বেড়ায়। মাস গড়িয়ে কতগুলি বছর কেটে গেছে! মেঝ মেয়ে কলেজ ছেড়ে
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, ছোটন স্কুল ছেড়ে কলেজে গেছে। মেয়েরাও জানে মা বাবা ভিন্ন
দেহ হলে কি হবে তারা এক প্রাণ এক আত্মা। কেও কাওকে ছাড়া থাকতে পারে না। ওরাও
আপ্রাণ চেষ্টা করে মাকে বাবার অভাব বুঝতে না দেয়ার কিন্তু শত চেষ্টাতেও কি আর তাই
হয়? তবুও ছোটন কলেজ থেকে
ফেরার পথে কোনদিন এক গোছা ফুল নিয়ে আসে কোন দিন আইসক্রিম। মাঝুও তার সাধ্যমত মায়ের
কাছে কাছে মাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে।
যা হবার
তাই হচ্ছে,
তাদের
নিয়তি যেভাবে লিখেছে তাই হচ্ছে। বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ভাঙ্গা তরী ঘাটে
ভেড়াবার,
কিন্তু
পেরে উঠেনি। পরিবেশ এবং পরিস্থিতি বাবার অনুকূলে ছিল না। শুধু তাই না বাবা সবার
কাছ থেকে সহযোগিতা তো দূরের কথা কেবল বিরোধিতাই পেয়েছে। ওরা বুঝতে শিখেছে। বাবার
অবর্তমানে ওদের মন তাড়াতাড়িই অস্বাভাবিক ভাবে পরিণীত হয়েছে। পৃথিবীর কাঠিন্য
অল্পতেই বুঝতে শিখেছে। ওরাও কি আর বাবার কথা মন থেকে দূরে রাখতে পারে? পারে না! কি করে
পারবে! বাড়িতে চলতে ফিরতে শুধু বাবার স্মৃতি যে দিকেই তাকায় শুধু বাবা। রান্না ঘরে
বাবা তাক বানিয়ে দিয়েছে, হুক বানিয়ে দিয়েছে এটা সেটা ঝুলিয়ে রাখার জন্য। জুতার
ব্রাশ কালি সব জায়গা মত যেমন রেখে গিয়েছিল তেমন করেই সাজিয়ে রেখেছে। খেতে বসলেও
বাবার কথা মনে আসে খাবার টেবিলে বাবার কেনা সব বাসন পেয়ালা, আবার বাড়ি থেকে বের
হতেও বাবার কথা। বাবা তো আর না ফেরার দেশে যায়নি প্রায় দিনই কথা হচ্ছে। রোজার
ইফতারির সময়েও মা এখনও ভুল করে বলে ফেলে মাঝু দুইটা পিয়াজু একটু কম ভাজবে তোমার
বাবা- এই পর্যন্ত বলেই মা থেমে যায়! বাবা কড়া ভাজা পিয়াজু খেতে পারে না সে কি আর
ওদের মনে নেই?
বাবার
জন্য কম ভাজা পিয়াজু থেকে যা যা বাবার পছন্দ সবই যে ওদের মুখস্থ! এই কি আর ভুলে
থাকা যায়?
বড় খালা
প্রায়ই বলে রাশেদ না থাকাতে মেয়েদের মনে একটা জেদ কাজ করছে। ওরা পড়া লেখায় মনোযোগী
হয়েছে নিজেদের বুঝ বুঝতে শিখেছে। মনি তুই মেয়েদের নিয়ে কোন চিন্তা করবি না। দেখবি
ওরা একদিন ওদের সঠিক অবস্থানে উঠে যাবে। আমরা সবসময়েই ওদের জন্য দোয়া করি। তোর
দুলাভাই সবসময় রাশেদের কথা মেয়েদের কথা বলে। তোর দুলাভাই তো রাশেদকে খুবই স্নেহ
করে, সব সময় ওকে নিয়ে আলাপ
করে, ভাবে। দেখবি একদিন এই
অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই আসবে। এমন থাকবে না। তোর মেয়েরা বড় হলে তোর দিন আবার ফিরে
আসবে।
২১৩।
অক্টোবরের
প্রথম দিকে রাজীবের মা, চাচা, মামা মামিরা সহ ১০/১২ জন প্রস্তাব নিয়ে আসার কথা হলো।
কিভাবে কি আয়োজন করবে এই নিয়ে রাশেদ সাহেব মনির সাথে পরামর্শ করল। মনি জানাল ওর
ছোট খালা বেণুর সাথে আলাপ করেছি মাসুদ সব ব্যবস্থা করবে। তুমি কোন চিন্তা করবে না, ও পুরনো ঢাকা থেকে
ওদের চেনা বাবুর্চি নিয়ে আসবে সেই রান্না বান্না করবে। বাড়িতেই বসার ব্যবস্থা করব।
আব্বাকে বলেছি,
ওর ফুফু
ফুফারা আসবে। নয়া মামাকে বলেছি কিন্তু সে ওইদিন দেশে থাকবে না বলে আসতে পারবে না
বলেছে তবে তার ছেলেকায়েস আসবে। বড় দুলাভাই
আপা এরা আসবে।
ঠিক আছে, দেখবে কোন ত্রুটি যেন
থাকে না!
নির্দিষ্ট
দিনে অতিথিরা সবাই এলো। মাসুদ আগেই মেঝ আপার সাথে আলাপ করে সব ব্যবস্থা করেছে। হবু
বেয়াইন বেয়াইরা সবাই আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছে। রাজীবের পরীক্ষার পরেই এ মাসের শেষ
দিকে লন্ডনে বিয়ে হবে। পরে দুইজনে একসাথে দেশে ফিরে এলে বৌ ভাতের ব্যবস্থা করবে।
এই সব আলাপ আলোচনা করে সেদিনের মত তারা তাদের বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে খুশি
মনে বিদায় নিয়েছে।
ফিরোজ
এবং তানিমের সাথে টেলিফোনে আবার আর এক বৈঠক। ফিরোজ আর ভাবী প্রস্তাব জানাল
তার বাড়িতে বিয়ে হবে কিন্তু ফুফু আম্মার অসুস্থতার কথা ভেবে তানিম আপত্তি জানাল।
শেষ পর্যন্ত তানিমের বাড়িতে যেখানে খুকু থাকে ওখানেই বিয়ে হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। ভাবী
বরের জন্যে যা যা রান্না করা দরকার সেগুলি তার বাড়িতে রান্না করে নিয়ে যাবে আর
অতিথিদের জন্য কেয়া এবং খুকুর বান্ধবী শিখা রান্না করবে। তানিম বাজারের লিস্ট থেকে
শুরু করে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ জানাতে হবে ঠিক করে রাখবে আবার সেই সাথে বিয়ে পড়াবার
জন্য ওদের কাছের স্টেপনি গ্রিন মসজিদের ইমামের সাথে আলাপ করে রাখবে। রাশেদ সাহেব
হবু বেয়াইনের সাথে ফোনে এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করলেন।
দেখেন
বেয়াই সাহেব আপনি ওখানে আছেন কাজেই আপনারা যা ভাল মনে করেন সে ভাবেই ব্যবস্থা
নিবেন। ছেলে তো এখন আপনাকেই দিয়ে দিলাম, আপনি যা ভাল বুঝবেন তাই করবেন।
রাশেদ
সাহেব ছুটি নিয়ে বিয়ের দুইদিন আগেই লন্ডন এসেছেন। আসার
আগে মিজান
এবং রাসেলকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে্ন। আবার সমসু
ভাই, মর্জিনা, গফুর ভাই, মনা ভাই এদেরকেও
জানিয়েছেন ২৫ তারিখে তিথির বিয়ে হচ্ছে আপনারা আসবেন। মনির সাথে আলাপ
হলো, -মেঝ ভাইকে কি জানাবে
নাকি?
-হ্যাঁ
অবশ্যই জানাবে,
তোমার
আমার সাথে যাই হয়েছে যাই করেছে মেয়েদের উপরে কেন তার প্রভাব ফেলতে দিবে?
-হ্যাঁ
আমিও তাই ভেবেছি কিন্তু আমি যে মনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না! তুমি জান, ওরা যেদিন খুকুকে
রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিল সেদিনও আমি ওদেরকে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি, শুধু মেয়ের কথা ভেবে
মেনে নেয়ার চেষ্টা করেছি।
-যে
ভাবেই হোক যা হয়েছে সে সব কথা মনের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া কিছুই করার নেই। আমি
এখনও বুঝতে পারছি না সেদিন ওরা ওই আচরণ কেন করেছিল।
-হ্যাঁ
আমার মনেও সেই ক্ষত তেমনই রয়ে গেছে, আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
-যাক
ওসব আপাতত বাদ দিয়ে ওদের জানিয়ে দাও।
-আচ্ছা
ঠিক আছে,
জানাচ্ছি।
মনির
সাথে কথা রেখে জাহিদকে ফোন করলেন। জাহিদ সব
কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল।
-তোরা
কি আসতে পারবি?
-আসতে
হবে। শাহেদও তো ২৩ তারিখে আসছে!
-হ্যাঁ
ও এসে আগে লন্ডনে বিয়ের কাজ সেরে পরে ব্রিস্টল যাবে। তোরা কবে আসতে পারবি?
-বিয়ের
দিনেই আসি?
আমরা
কিন্তু থাকতে পারব না, রাতেই
চলে আসতে হবে।
-পারবি
এক দিনে এত ড্রাইভ করতে?
-হ্যাঁ, ওতে কোন অসুবিধা হবে
না
-আচ্ছা
ঠিক আছে তাহলে,
সময়মত
চলে আসবি।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।