২০৯।
এই
বাসায় আর যাই হোক একা একা হলেও রান্না বান্না করা এবং থাকার বেশ সুবিধা। হিটিং
সিস্টেম খুবই ভাল। বাথরুমে এবং কিচেনে সবসময় গরম পানি থাকে, ওয়াশিং মেশিনও আছে।
কাছেই বাসস্ট্যান্ড। রাশেদ সাহেব সকালে
ডিউটি সেরে এসে কোনদিন কর্ণ ফ্ল্যাক্স আর
দুধ আবার কোনদিন ডিম পোঁচ বা অমলেট করে টোস্টারে কয়েকটা ব্রেড গরম করে খেয়ে শুয়ে
পরেন। সারা রাত জেগে ডিউটি করে বলে একেবারে
বিকেলে ঘুম ভাঙ্গে। উঠে খাবার আর ল্যাপটপের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে যান। ছুটির
দিনে কাপর ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিনে টাইম সেট করে দিয়ে শুয়ে পরেন। এদিন
একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে বাজার করে এনে সাড়া সপ্তাহের রান্না করে একটা একটা করে
প্যাকেটে ভরে ঠাণ্ডা হলে ফ্রিজে রেখে দেন। সপ্তাহ জুরে মাইক্রোওয়েভে গরম
করে খেতে হয়। এখানে এই হচ্ছে তার নৈমিত্তিক রুটিন।
এবার
বেশ শীত পড়েছে। এমনিতেও নিউ ক্যাসেলের আবহাওয়ার দুর্নাম আছে। হয়ত স্নো কিংবা
বৃষ্টি লেগেই থাকে। প্রতি দিন বরফের উপর দিয়ে প্রায় দুই মাইল হেঁটে যেতে হয়। বরফের
উপরে হাটা বেশ কঠিন ব্যাপার। উপযুক্ত জুতা না হলে যে কোন সময় পা পিছলে অনেক
দুর্ঘটনা ঘটে যেমন এর আগে হয়েছে, ল্যাপটপের মনিটর ভেঙ্গে গিয়েছিল।
এবারের
মত শীত চলে যাচ্ছে। শীত চলে যাচ্ছে মানে কি? মানে হচ্ছে গায়ের কাপড়ের বোঝা
একটু হালকা হয়েছে মাত্র। গরম পোষাক ছাড়া বাইরে যাওয়াই যায় না। সেই জুলাই আগস্ট
আসলে তখন মোটামুটি হাফ সার্ট গায়ে চলাফেরা করা যায় তবুও রাতে লেপ গায়ে
দিতে হয়। এ দেশে গত এত গুলা বছর ধরে এমনটাই দেখে আসছে।
এমনি
করে রাশেদ সাহেব তার দিন কাটাচ্ছেন। মনের মধ্যে
অনেক কিছুই আসে যায় কিন্তু সে কিছুতেই তার অতীত ভুলতে পারে না। তার মত একজন অতি
সাধারণ মানুষের আজ এই অবস্থা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শুধু সংসারের কথা
ভেবে, স্ত্রী সন্তানদের কথা
ভেবে সব কিছু মেনে নিচ্ছেন। মেনে নিতে
হচ্ছে তাই। হাসি
খুশি মানুষটা বলতে গেলে একেবারে যান্ত্রিক হয়ে গেছে। আসা যাওয়ার পথে নিতান্ত চোখের
সামনে যা পড়ে এ ছাড়া আর কোন দিকে মন দিতে পারে না। বিলাতের মত দেশে থেকে কোন দিন
হলে গিয়ে একটা সিনেমা দেখা বা আশেপাশে এত পাব সেই পাবে গিয়েও কোনদিন এক গ্লাস কোক
বা জুস খেয়ে দেখেনি, দেখেনি
এদেশের চালচলন রীতিনিতি। এ দেশে আমোদ প্রমোদের কত কি রয়েছে কিন্তু রাশেদ সাহেব সে
দিকে কোন দিন ফিরেও তাকায়নি। লন্ডনে গেলে মেয়ে কত বলেছে চল না আব্বু মাদাম তোশো
দেখে আসি,
হাইড
পার্কে যাই কিংবা রিজেন্ট পার্কে বা আর্ট গ্যালারি বা কোন মিউজিয়ামে বা অন্য কোথাও
কিন্তু রাশেদ সাহেব শুধু বলেছেন তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়ে যেও বাবা আমাকে যেতে বোল না। এখানে এসে
তোমাকে দখলেই আমার সব দেখা হয়ে যায়। জীবনে অনেক দেখেছি, আর কি দেখব? কেবল ফিরোজ তার সাথে
যেখানে নিয়ে গেছে সেখানেই গেছেন।এর বেশি আর
কোথাও না। এমনকি লেস্টারে যেখানে ছিল সে রাস্তার ও পাশে এবে পার্ক, আসতে যেতে দেখেছে ১৮৮৯
সালের প্রতিষ্ঠিত পার্ক তবুও সেখানে গিয়েও কোন দিন একটু বসেনি। তার মনে শুধু এক
মনি। মনি ছাড়া সে কোথায় যাবে? মনিকে না নিয়ে গেলে কি কিছু দেখা যায়? তার সামনে বা তার পাশে
মনি আছে তো সব আছে, মনিকে
ছাড়া একা একা কিছু দেখা যায় না।
২১০।
আগস্টের
মাঝামাঝি সময়ে একদিন ফিরোজ ফোনে জানাল ২৯ তারিখে রাজীবের ভাই আসছে। সপ্তাহ খানিক
থাকবে।
-তুমি
ওদের আসার দুই একদিন পরে চলে আস, আগেই ছুটির ব্যবস্থা
করে রাখবে।
-আচ্ছা
আসব।
ফিরোজের
সাথে কথা বলে মিজানের সাথে ছুটির ব্যাপারে জানিয়ে রাখল। ঠিক আছে চাচা আপনি আমাকে
দুই দিন আগে মনে করিয়ে দিবেন।
কয়েকদিন
পরে লন্ডন যাবার জন্য মোটামুটি গুছিয়ে নিচ্ছে। আগে ব্রীজেন্ড থেকে কাছেই ছিল মাত্র
৩/৪ ঘণ্টার পথ ছিল এখন অনেক দূরে প্রায় ৮/১০ ঘণ্টা লেগে যায়। দেখতে দেখতে লন্ডন
যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। ৩০ তারিখ রাতের কোচে যাবেন। একটা
ব্যাগে পানি আর কিছু শুকনা খাবার নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে নেভিল স্ট্রিটে
রেলস্টেশনের সামনে যেখানে মেগা বাস দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে এসে দেখে বাস দাঁড়িয়ে
রয়েছে। বাসে উঠে একটা সিট খুঁজে বসে খুকুকে জানিয়ে দিলেন।
ফিরোজের
সাথেও কথা হলো। ফিরোজ বললো রাজীবের ভাই ভাবীকে আমার এখানেই রাতে খাবার জন্য দাওয়াত দিয়েছি তখন
একসাথে সব হবে তিথির বাসায় যাবার দরকার নেই।
-ভালই
করেছে।
সকালে
ভিক্টোরিয়া ন্যাশনাল এক্সপ্রেসের স্টেশনের পাশে মেগা বাস থেকে নেমে একটু হেঁটে
টিউব স্টেশন থেকে ডিসট্রিক্ট লাইন ধরে স্টেপনি গ্রিনে নেমে কয়েক মিনিট হেঁটেই
খুকুর বাসা। পৌঁছে নাশতা করেই এক ঘুম। বিকেলে ফিরোজ ফোন করে ঘুম ভাঙ্গাল।
-তুমি
এসেছ?
-হ্যাঁ
সকালে এসেই ঘুম দিয়েছি, আমরা আসছি এখনই বের হব। আমাদের সাথে কিন্তু তানিম আর কেয়াও
আসবে, ওরাও দেখতে চাইছে
-ঠিক
আছে আস।
-ওরা
কখন আসবে?
-বলেছি
সাতটায় আসতে। এসে পড়বে। তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আস।
রাশেদ
সাহেব তাড়াতাড়ি উঠে কেয়াকে বললেনখুকুকে নিয়ে তোমরা রেডি হও বের হব, ফিরোজ ফোন করেছিল।
-আমরা
রেডি হচ্ছি কিন্তু ও তো বাসায় নেই, কাজে আছে ওখান থেকে চলে যাবে।
এদেশে
সামারে রাত নয়টায়ও বেলা ডুবে না। অন্ধকার হয় না, মায়েরা ঘরের মোটা পর্দা টেনে ঘর
অন্ধকার করে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায়। না হলে কাল স্কুলে গিয়ে ঘুমবে। এমনি দিনে
সন্ধ্যা ছয়টায় ওরা এসে পৌঁছল। নানা কথা বার্তা চলছিল। এক পর্ব চা হলো। ঘণ্টা খানিক
পরে রাজীবরা এলো। তার একটু পরেই তানিমও এলো। এদের সাথে আর এক পর্ব চা হলো।
দেখাশোনা এবং নানা ধরনের কথাবার্তা আলাপ আলোচনা চলছে। রাজীবের বড়ভাই ভাবীও বেশ
অমায়িক। এবার খাবার পালা। খাওয়া দাওয়া সেরে ভাবী তিথিকে উপরে পাঠিয়ে দিল। ড্রইং রুমে এসে ফিরোজ
আসল কথা তুলল। রাজীবের ভাই জানাল,
-মেয়ে
তাদের ভাল লেগেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো বাংলাদেশে এখন অনেক রাত সবাই ঘুমে কাজেই
এখন আর মার সাথে কথা বলতে পারছি না, কাল কথা বলে আপনার সাথে আলাপ করব।
পরদিন
বিকেলে ফিরোজ আবার ফোন করে রাশেদ সাহেবকে যেতে বললো।
-তুমি
আস রাজীবের ভাই আসছে একসাথে কথাবার্তা বলি।
-আচ্ছা
আমি আসছি।
-মা বললো
ওরা যখন দেশে আসবে তখন বিয়ে হবে। এর মধ্যে মা আর আমাদের চাচা মামারা একদিন ঢাকা
তিথিদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবে।
ফিরোজ-
সে তো অনেক দেরি! রাজীবের পরীক্ষা সামনের অক্টোবরে হয়ে যাবে ও যেতে পারবে কিন্তু
তিথির যেতে অনেক দেরি হবে,
-তাহলে
কি করা যায়?
-আচ্ছা
বিয়েটা এখানেই সেরে ফেলা যায় না? তুমি কি বল রাশেদ?
-আমি
কি বলব! আমার কোন অসুবিধা নেই কিন্তু, এই পর্যন্ত বলে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
রাজীবের
ভাই রিয়াজ- এখানে হলে আত্মীয়রা কেও থাকতে পারবে না।
-এখানেও
কিন্তু কয়েকটা বিয়ে আমি দেখেছি তারা প্রায় সবাই স্টুডেন্ট। অবস্থার প্রেক্ষিতে এমন
দুই একটা ঘটনা হয়েই যায়। সব কিছু কি আর গতানুগতিক ভাবে চলতে পারে?
এই নিয়ে
বেশ অনেকক্ষণ কথা বার্তা বলে সিদ্ধান্ত হলো রাজীবের পরীক্ষার পর এখানেই বিয়ে হবে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এক সময় রাজীবের মা ঢাকায় আসবে। রিয়াজ চলে যাবার পর ফিরোজ আর
রাশেদ সাহেব কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে সেদিনের মত মেয়ের বাসায় চলে এলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।