২০৬।
একটু
পরে সিলভার রঙের ছোট্ট একটা ফিয়াত গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ড্রাইভিং সিট থেকে সত্যিই ২২
বা ২৩ বছর বয়সী এক অপরূপা সুন্দরী মেয়ে নেমে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে,
-হাই
রাশেদ! সরি আমার একটু দেরি হয়ে গেল!
বুঝতে
পারলেন এই হল এলিজাবেথ।
-না
না, তাতে এমন কি আসলো গেল?
ও এসেই হাত
বাড়িয়ে দিল। পরে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে গাড়ির কাছে যেয়ে পেছনটা খুলে ব্যাগ রেখে দিল। রাশেদ সাহেব ওর পিছনে
যেয়ে আর একটা সুটকেস রাখলেন।
-এবার
চল।
-কোথায়
যাবে?
-তোমার
বাসায়।
-না
শোন, আমার ভীষণ ক্ষুধা
লেগেছে নতুন বাসায় খাবার ব্যবস্থা নেই এতো রাতে একমাত্র সুপার স্টোর
ছাড়া আর কোথাও কিছু পাবো না আর তোমারও খাওয়া হয়নি চল এক সাথে খেয়ে নিই তারপর বাসায়
যাই।
-হ্যাঁ
তা করা যায়।
-কি
খাবে বল,
ইটালিয়ান
নাকি তোমার ইংলিশ নাকি মেক্সিকান?
-তুমি
কি খাবে?
-আমি
উপমহাদেশীয় হলেই বেঁচে যাই।
-তাহলে
চল তোমার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে যাই।
-সরি
এলিজাবেথ,
আমার
পূর্বপুরুষ ইন্ডিয়ান ছিল কিন্তু আমি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি তোমাদের
পূর্বপুরুষদের কারণেই।
-ও
হ্যাঁ তুমি বাংলাদেশি তবে আমি ও কথা মিন করে বলিনি, আমি তোমার উপমহাদেশীয় হিসেবে
বলেছি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের কথা।
-আসলে
কি জান এলিজাবেথ, এই
যে তোমরা যাকে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বল এর শতকরা নব্বই ভাগই কিন্তু বাংলাদেশি।
-তাই
নাকি?
-হ্যাঁ।
-আচ্ছা
ঠিক আছে,
এখন বল
কোথায় যাবে?
-আমি
তো সেই কবে ছিলাম এখানে, কিছু মনে নেই তার চেয়ে তুমি যেখানে চেন সে রকম কোথাও চল।
গাড়ি
স্টার্ট দিয়ে ঘুড়িয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে নেভিল রোডে একটা
পাঞ্জাবী রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।
-জান
রাশেদ, আমি তোমাদের বাংলাদেশে
গেছি।
-তাই
নাকি?
-হ্যাঁ, তবে ছোট বেলায়, আমার মার সাথে। ড্যাড তোমাদের
ওখানে অনেক বড় একটা নদীর উপর কি একটা বড় ব্রিজ হয়েছে না সেখানকার ইঞ্জিনিয়ার ছিল।
-বাহ!
বেশ খুশি হলাম তোমার কথা শুনে, ওটা যমুনা ব্রিজ। কেমন লেগেছে ওখানে?
-খুব
গরম আর খুব বৃষ্টি হয় এই টুকু মনে আছে।
-তোমার
যাওয়া হয়েছিলো অসময়ে সম্ভবত জুন বা জুলাই মাসে তাই না?
-হ্যাঁ
হবে হয়ত,
বললাম না
ছোট বেলায় গেছি তো বিশেষ কিছু মনে নেই।
-যাক
সময় হলে আবার যেয়ো। এবার গেলে ডিসেম্বর মাসে যাবে এক ভিন্ন রূপ দেখবে।
-কি
রকম?
-ডিসেম্বর
মাসে ওখানে শীত থাকে তবে সে শীত যদিও তোমাদের এখানকার মত না, সহনীয়। তোমরা কোন রকম একটা
সোয়েটার গায়েই চালাতে পারবে।
-দেখি
যদি কখনো সুযোগ হয় বাবার তৈরি ব্রিজটা দেখতে যাব।তুমি স্কটল্যান্ড গেছ?
-গেছি
মানে, বলে কি এই মেয়ে?
-গ্লাসগো
থেকে আবারডিন পর্যন্ত কোন শহরের কথা জিজ্ঞেস করবে করে দেখ।
-তাই
নাকি?
-হ্যাঁ
আসলে ওখানে যাবার আমার একটা বিশেষ ইচ্ছেও ছিল কারণ আমার এক প্রিয় শিক্ষকের বাড়ি
কোন এলাকায় তা দেখতে চেয়েছিলাম। সেও তোমার মত ক্যাম্পবেল, তার নাম ছিল অলসটার ক্যাম্পবেল।
সে স্কটিশ এটুকুই জানতাম কিন্তু কোন শহরের তা জানতাম না তবে আমার ধারনা মতে ডান্ডি
হতে পারে। তবুও হ্যামিলটন, গ্লাসগো, পার্থ, স্টার্লিং, ডান্ডি, স্টোন হ্যাভেন, ওবান সব জাগায় অর্থাৎ আমি যেখানে যেখানে গেছি সেখানেই যে
বয়স্ক ক্যাম্পবেল পেয়েছি তাকেই জিজ্ঞেস করেছি।
-পেয়েছ?
-না! এত বড় স্কটল্যান্ডে
কি আর এই ভাবে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়? পাইনি, তবে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পেরেছি যে আমি খুঁজেছি।
-তোমার
একজন শিক্ষকের প্রতি এই শ্রদ্ধা দেখে আমি অবাক হলাম!
-তোমার
বাড়ি কোথায় বললে না?
-আমার
বাড়ি পার্থে।
-আমি
দেখেছি, খুব সুন্দর জায়গা আমার
কাছে ছবির মত মনে হয়।
-ওখানেই
আমি বড় হয়েছি তবে এখন নিউ ক্যাসেলে থাকি।
-ওখানে
কে থাকে?
-কেও
না
-কেন?
-কে
থাকবে, বাবা মা কেও নেই।
-ওহ, সরি
খেয়ে
দেয়ে এসে গাড়িতে উঠল। এলিজাবেথ ড্রাইভ করছে, হঠাৎ আজদা সুপারমার্কেটের সামনে
এসে থামল। এদেশে সাধারণত বেশি রাতে কোন দোকান পাট খোলা থাকে না সন্ধ্যার পরে সবাই
যার যার ঘরে ফিরে যায়। দোকান খোলা থাকবে কার জন্য? তবে বিশেষ কিছু সুপার মার্কেট ২৪
ঘণ্টা খোলা থাকে।
জিজ্ঞেস
করল-
-কি
হলো এখানে থামলে কেন?
-আজ
তো হলো, কাল সকালে ব্রেকফাস্ট
করবে কি দিয়ে?
তাই এখান
থেকে কিছু নিয়ে যাও।
-সত্যিই
এলিজাবেথ তুমি শুধু দেখতেই সুন্দর নও তুমি খুব ভালো মেয়ে।
গাড়ি
থেকে নেমে দুইজনেই এক সাথে ভিতরে গেল। দুধ, চা, ব্রেড, মার্জারিন, চা পাতা এই রকম কিছু
ওই তুলে দিল ঝুড়িতে। দাম টাম দিয়ে এসে আবার গাড়িতে। সাত আট মিনিটের মধ্যে
ল্যাংকেস্টার স্ট্রিটের একটা বাসার সামনে এসে থেমে বললো-
-নাও
এই হচ্ছে তোমার বাসা আর হাতের ব্যাগটা খুলে ডেভিডের কাছ থেকে আনা চাবিটা বের করে হাতে
দিয়ে বললো এই হলো চাবি। চল মাল নামিয়ে গৃহে প্রবেশ কর এখন।
গাড়ির
পেছনটা খুলে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে এসে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো-
-তাহলে
এখন আমি আসি?
কাল দেখা
হবে।
-ওকে
এলিজাবেথ,
অনেক
কষ্ট করেছ আমার জন্য, অনেক
অনেক ধন্যবাদ,
শুভ
রাত্রি।
২০৭।
এলিজাবেথ
গাড়ি নিয়ে চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত ওর গাড়ির পিছনের লাল বাতির দিকে তাকিয়ে খুকুর
কথা মনে এলো। গাড়ির পিছনের লাল বাতি বাম দিকে ঘুরে আড়াল হলে পর তালা খুলে ঘরে ঢুকে
লাইট জ্বালিয়ে দেখে নিলেন। নিচে বড়
একটা কিচেন,
বড়
বাথরুম। উপরে যাবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখলেন এখানে শুধুই একটা
শোবার ঘর। অনেক দিনের পুরনো বাড়ি ভিক্টোরিয়া আমলেরও হতে পারে। স্টুডিও টাইপের
বাড়ি। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমের বয়লার কিচেনেই, ওটা অন করে দিলেন। সারা
বাড়ি ঠাণ্ডা বরফ হয়ে রয়েছে। অন্তত এক ঘণ্টার আগে গরম হবে না। জিনিষ পত্র উঠিয়ে কোন
রকম রেখে
আর কোন হিটার আছে কিনা দেখছিলেন। হ্যাঁ ওইতো
ওয়ারড্রবের পাশেই, এটাও
অন করে দি্লেন। ঘড়টা গরম হোক পরে শোবার আগে অফ করলেই হবে। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত
মুখ ধোয়া যাবে না তাই পানি গরম হওয়া পর্যন্ত কাপর চোপর বদলে জিনিশ পত্র একটু
গুছিয়ে রাখলেন। এতক্ষণে মনে হয় পানি গরম হয়েছে, বাথরুমে গিয়ে দেখে
হ্যাঁ গরম পানি আসছে। হাতমুখ ধুয়ে এসেই শুয়ে পড়লেন আর টমি সাহেবের হাত থেকে
নিষ্কৃতি পাবার আনন্দে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে বুঝতেই পারেনি।
২০৮।
পরদিন
সকালে জন বিউ ফোন করে নতুন কাজের বিবরণ জানিয়ে দিল। একটু পরে আবার মিজান ফোন করে ওখানে
কেমন করে যেতে হবে বলে দিল। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি। রাতে আজদা
থেকে আনা কর্ণ ফ্ল্যাক্স আর দুধ দিয়ে নাশতা খেয়ে বের হলেন। রান্নার
আয়োজন করতে হবে। জিজ্ঞেস করে ওয়েস্ট গেট রোড ধরে সামনে একটু এগিয়ে হাতের বায়ে একটা
বাংলাদেশি দোকান পেলেন। কয়েক পদের মাছ, ভেড়ার মাংস, শাক সবজি, মশলা, চাল ডাল কিনে এনে
রান্না শুরু করলেন। রাতের খাবার সাথে নিয়ে যেতে হবে।
সামনেই ক্রিস্টমাস আসছে। সমস্ত নিউ ক্যাসেল সাজান হয়েছে। আরও হবে। দোকানে
দোকানে ক্লিয়ারেন্স সেল দিবে তখন একটা ল্যাপটপ কিনতে হবে।
ডিউটির
সময় হয়ে আসছে। রাতের খাবার প্যাকেটে নিয়ে বের হয়ে বাসার কাছেই বাসস্ট্যান্ডে এসে
দাঁড়ালেন। ৩২ নম্বর বাসে নিউ ক্যাসেল স্টেশনের
কাছে নেমে আবার একটু হেঁটে ১০০ নম্বর মেট্রো সাটল বাস ধরে নিউ
ক্যাসেল মেট্রো শপিং মলে আসলেন। এখান থেকে
আবার ৭
নম্বর বাসে এর পরের স্ট্যান্ডে যেতে হবে। ৭ নম্বর বাস আসতে দেরি হবে বলে হেঁটেই
চললেন। কাছেই, বেশি দূরে নয়। বেশ শীত পড়েছে।
মিজানের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী মিনিট পনেরর মধ্যে আজদা সুপার স্টোরের কাছে কাজের
জায়গায় পৌঁছে ওখানে যে এখন ডিউটি করছে তাকে ফোন করে গেট খোলার জন্য বললেন। একটু
পরেই আশরাফ এসে গেট খুলে ভিতরে নিয়ে গেল। আলাপ পরিচয় সেরে কাজ কর্ম বুঝিয়ে দিয়ে
আশরাফ চলে গেল।
এভাবেই
বেশ কয়েকদিন পরে ক্রিস্টমাস এসে গেল। ক্রিস্টমাসের আগের দিন সকালে ডিউটি সেরে
ফেরার পথে স্নো শুরু হলো। বাসায় ফিরে নাশতা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলে উঠে এলডন
স্কয়ারে পিসি ওয়ার্ল্ড থেকে একটা ল্যাপটপ কিনতে হবে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল।
উঠে কিছু খেয়ে বের হলেন। আবার ৩২ নম্বর বাসে করে এলডন স্কয়ারে
নেমে কয়েকটা দোকান দেখে শেষ পর্যন্ত পিসি ওয়ার্ল্ড থেকে একটা ল্যাপটপ নিয়ে বাসায়
এসে আবার ডিউটিতে যাবার জন্য বের হলেন। নতুন কেনা ল্যাপটপটাও
সাথে নিয়ে গেলেন। একা একা রাতে ডিউটি করতে একজন সঙ্গীর
দরকার। একটা ল্যাপটপ থাকলে অনেক সুবিধা। মেইল দেখা যায়, সবার সাথে যোগাযোগ করা যায়।দেশের
খবর বিদেশের খবরাখবর জানা যায়। বাড়ির সাথে যোগাযোগও সহজে কম খরচেই হয়ে যায়। অনেক
সুবিধা। একটা প্যাপটপ অত্যন্ত বিশ্বস্ত একজন সঙ্গী।
খুকু, ফিরোজ, বাহাদুর, গফুর ভাই এবং
মর্জিনাদের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। খুকু ফোন করলেই বলে-
-আব্বু
ওখানে ঠাণ্ডা কেমন?
-ঠাণ্ডা
মানে আব্বু আমি প্রায় প্রতিদিনই বরফের উপর দিয়ে হেঁটে যাইতোমরা লন্ডনে থাক ওখানে
এমন স্নো পড়ে না তাই বুঝবে না।
-বল
কি আব্বু! ঠাণ্ডা লাগে না?
-না
ঠাণ্ডা লাগবে কেন? ওভাবেই
পোষাক পরে বের হই।
-দেখবে
আব্বু সাবধানে চলাফেরা করবে।
-মনি, বীথি, যূথী সবারই এক কথা
সাবধানে চলাফেরা করবে।
একদিন
ফিরোজ ফোনে জানাল রাজীবের মা মাঝে মাঝেই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করে। কবে দেশে যাবে, কেমন আছে এই সব নিয়ে
আলোচনা হয়। আরও কয়েকটা ছবি চেয়ে নিয়েছে। দেশে যেতে দেরি হবে জেনে একটু চিন্তিত মনে
হয়েছে। নেক্সট সামারে রাজীবের বড় ভাই ভাবী ইংল্যান্ডে আসবে তখন ওকে দেখে মতামত
জানাবে বলেছে।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।