২০৪।
রাশেদ
সাহেব ভাবল মেয়েটাকে বড্ড ঝামেলায় ফেলেছে, এই সময় তার বয় ফ্রেন্ডের সাথে
পাবে বিয়ারের গ্লাস নিয়ে বসে থাকার কথা নয়তো বাড়িতে বসে রাতের খাবার আগে ওয়াইনের
গ্লাস হাতে টিভি দেখার কথা তা না করে এই
শীতের মধ্যে চল্লিশ দ্বিগুণে আশি মাইল
গাড়ি চালিয়ে ডার্লিংটন থেকে ডঙ্কেস্টার যাবে আসবে আবার সেখান থেকে নিউ ক্যাসেল, তারপর সহকর্মীকে তার
বাসায় নামিয়ে দেয়া। পিছনে ঘুরেই দেখে যাত্রীরা আর ড্রাইভার এগিয়ে আসছে। রাশেদ
সাহেবও ঠাণ্ডা কফির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিনে ফেলে দিয়ে কোচে এসে বসলেন। কোচ
ছেড়ে দিল।
বসে বসে ভাবছিলেন এর আগের বারে যখন লেস্টারে ছিলেন তখন পাশের
সোমালিয়ানদের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন ওই সময়েই রিটায়ার্ড গুজরাটি ডাঃ
সাত্তার সাহেবের সাথে আলাপ পরিচয় থেকে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সাত্তার সাহেব কলকাতায়
পড়াশুনা করেছে বলে ভাল বাংলা বলে। রাশেদ সাহেবের সাথে বাংলায়ই কথা বলত। মাঝে
মাঝে সাত্তার সাহেব তার গাড়িতে নিয়ে বেড়াতে যেত। প্রায়ই এসে রাশেদ সাহেবের সাথে
গল্প করত রাশেদ সাহেবকে একটা সুন্দর কোরআন শরিফ গিফট করেছিল। তারও সময় কাটতে চাইত
না একা রিটায়ার্ড মানুষ। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে তারা ভিন্ন
ভিন্ন শহরে থাকে। এবার ভেবেছিল তার সাথে আবার আড্ডা জমবে কিন্তু তা আর হলো না। আগেই চলে
আসতে হলো।
২০৫।
জানালা
দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য আছে আর তার সাথে যদি মটর ওয়ের
সোডিয়াম আলোর মাখামাখি হয় তাহলে সে সৌন্দর্যে ভিন্ন একটা মাত্রা যুক্ত হয়। এপাশের
ওপাশের ৮টা লেন দিয়ে অসংখ্য গাড়ি আসছে যাচ্ছে। কেও যাচ্ছে দিনের কাজের শেষে বাড়িতে
আবার কেও যাচ্ছে বাড়ি থেকে কাজে একই সময়ে কত জনের কত বিচিত্র প্রয়োজন। রাস্তার দু
পাশে কখনো ঘন ঝোপ আবার কখনো খোলা মাঠ আবার তা ছাড়িয়ে কিছু দূরে ছায়া ছায়া বনের মত
মনে হচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে লাইট পোস্ট গুলি ফুড়ুত করে একটা একটা করে পিছনে চলে
যাচ্ছে।
গত এক
মাসের ফিরিস্তি মনে আসছে কি কি করেছে, কোথায় কি ভাবে থেকেছে নানা কিছু। বাড়ির কথা মেয়েদের কথা
মনে হলো। খুকুকে ফোন করা দরকার ও জানে বাবা লেস্টারে আছে, সে যে নিউ ক্যাসেল যাচ্ছে তা ওকে
জানান হয়নি। পকেট খুঁজে ফোন পাচ্ছে না। এই হচ্ছে ইদানীং এক নতুন সমস্যা কোথায় কি
রাখে তা মনে রাখতে পারে না। ভাগ্য ভালো দুই জনের সিটে একাই বসেছিলেন গাড়িতে যাত্রী
বেশি নেই,
লীডস
থেকে চার/ পাঁচ জন উঠেছে আর লেস্টার থেকে মনে হলো দশ বার জন উঠেছিল তার আবার তিন
জন লীডসে নেমে গেছে।
গাড়িতে
উঠেই জ্যাকেটটা খুলে সিটের পাশে হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, গাড়িতে হিটার চলছে বেশ গরম। শীতের
দিনে অনেক গুলি পকেট থাকে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো ও হ্যাঁ জ্যাকেটের
পকেটে। জ্যাকেটের পকেট খুঁজে পেয়ে খুকুর নাম্বারে কল করলেন, যাচ্ছে না। নেট ওয়ার্ক
নেই। ফোনটা হাতে নিয়ে বসে খুকুর কথা ভাবছেন। বিলাতের জীবন। শুনতে কি মধুর
শোনায়, ইংল্যান্ডে থাকে! অথচ এই বিলাতে যে কি যান্ত্রিক জীবন সে ভুক্ত
ভোগী ছাড়া আর কতজনে জানে। এরা সবাই মানুষ না হয়ে যদি রোবট বা অন্য কোন মেশিন হতো
তাহলে মানাত। বাবা মা সন্তান কেও কারো নয়। কি ভয়ঙ্কর জীবনে এরা অভ্যস্ত! আমরা এমন
ভাবতেও পারি না অথচ তাও মেনে নিতে হচ্ছে। প্রয়োজন এমন এক দায় যার টানেই সব ছিঁড়ে
কেটে টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙ্গেচুরে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। মায়া মমতা স্নেহ দাবী আবদার, কিছুরই মূল্য নেই।
ভাবতে ভাবতে কখন যে মিডল বোরো এসে পড়েছে লক্ষ করেনি, এখানে একজন যাত্রী নামার জন্য কোচ
থামলে দেখলেন। এইতো এর পর ডার্লিংটন,
ডারহ্যাম
তারপরেই নিউ ক্যাসেল।
আবার
খুকুকে কল দিলেন, ওপাশ থেকে খুকুর কণ্ঠ শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো, এতো দূরে চলে এসেছে
শুনেই তো ও আঁতকে উঠবে!
-আব্বু
কেমন আছ?
-হ্যাঁ
আব্বু আমি নিউ ক্যাসেলের পথে আছি। যা ভেবেছে তাই।
-শুনেই
খুকু চিৎকার করে উঠলো, নিউ
ক্যাসেল! এতো দূরে? তাও
আবার এই শীতের মধ্যে? নিষেধ
করতে পারলে না?
-না
আব্বু, নিষেধ করি কি করে বল!
সব খুলে বললেন। তোমার ছুটি হলে ন্যাশনাল এক্সপ্রেসে বা মেগা বাসের ফান
ফেয়ারে কম দামে যে প্রমোশনাল টিকেট পাওয়া যায় তাই করে তুমি এসো, একা ভালো না লাগলে
শিখা বা
ঝুমুর বা বর্ণা কাওকে নিয়েই এসো।
আরও
কিছু কথা বলে রেখে দিলেন। এইতো টাইন নদী পাড় হচ্ছে আর পাঁচ সাত
মিনিট লাগবে। হুক
থেকে জ্যাকেট নামিয়ে গায়ে দিলেন, গ্লোভস আর মাথায় টুপি পরে নামার জন্য রেডি হলেন।
হঠাৎ
মনে হলো এলিজাবেথ আমার জন্য এতো কষ্ট করছে ওর জন্য কি করা যায়? ভাবতে ভাবতেই
নিউক্যাসেলের ছোট্ট কোচ স্টেশনে এসে কোচ দাঁড়ালো। সমাধান পাবার সময় পেলেন না। গাড়ি
থেকে নেমে মালামাল বের করে এদিক ওদিক খুঁজলেন। না, কোন সুন্দরী বা জল
হস্তীর দেখা নেই। এতো রাত বলে স্টেশনের ভেতরটা বন্ধ, বাইরেই দাঁড়িয়ে একটা
বিড়ি বানিয়ে জ্বালালেন। শেষ হলে ফেলে দিয়ে ডঙ্কেস্টারের
পথের দিকে
তাকিয়ে রইলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।