মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৭
দুপুরে খাবার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে, বিশ্রাম আর কি হল রুমে বসে টিভি দেখার পর নিশাত বলল চলেন বাইরে থেকে
ঘুরে আসি। আমার একটা ক্যামেরা কেনার শখ অনেক দিনের দেখি যদি পাই নিয়ে আসব।
চলেন ঘরে বসে থেকে কি করবো তার চেয়ে
ঘুরে আসি, আমরাও কখনো এই দেশে আসিনি।
আপনারা এর আগে কোথায় কোথায় গেছেন?
আমি বেশি গেছি ইস্টে, অনেক জায়গায় গেছি, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং।
ওদিকে কেমন দেখেছেন?
ওদিকে এরকম শীত নেই, গাছপালা আছে, সবুজ আছে, বিদেশে সব জায়গাই ভালো, মানে আমাদের দেশের মত এত চোর বাটপার পকেট মার নেই
তবে দেখতে আমাদের দেশ সুন্দর যদি এই সব না থাকত তাহলে আমাদের দেশই সবচেয়ে ভাল দেশ
হতো।
জাহাজে চাকরী করলে এই একটা সুবিধা তাই
না? বিভিন্ন দেশ দেখা যায়। এইযে দেখেন এই
আমি এখনও জাহাজি উঠিনি অথচ এর মধ্যে দুইটা দেশ দেখা হয়ে গেল!
৯।
ওরে বাব্বা যা ঠাণ্ডা, একটু চা হলে ভালো হতো।
চলেন দেখি হোটেলে যাই ওখানে চা বা কফি
পাই কি না।
হ্যাঁ চলেন
তিন জনেই হোটেলে এসে দেখে দুপুরের খাবার
খাচ্ছে কেউ কেউ।
তা হলে আমরাও খেয়ে যাই?
হ্যাঁ তা খারাপ হয় না আমি তখন তেমন খেতে
পারিনি
ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল এখানে কি মেনু আছে?
ওয়েটার মেনু এনে দিল।
মেনুতে দেখে সব ইংলিশ খাবার।
তাহলে আমাদের খাবার কি হবে?
নিশাত ভাই এক কাজ করেন ওয়েটারকে জিজ্ঞেস
করেন এশিয়ান খাবার আছে কি না!
আচ্ছা!
নিশাত ওয়েটারকে ডেকে বলল, তখন ওয়েটার বলল
দুঃখিত তেমন কিছু এখানে নেই তবে তোমরা
ফিস অথবা চিকেন এন্ড চিপস বা রাইস খেতে পারবে
ওদের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ে বলে দিল
এখন ফিস এন্ড চিপস দাও রাতে চিকেন এন্ড রাইস খাব
হ্যাঁ আমিও
আমিও
আচ্ছা তা হলে সবার জন্য একই আইটেম
ওয়েটার চলে গেল। একটু পড়ে খাবার নিয়ে
আসল তিনটা ডিশ ভরে, বিশাল এক টুকরা ভাজা মাছ, বেশ অনেক গুলো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, অনেক সালাদ।
খেয়ে বেশ ভালই পেট ভরল। তবে নিশাত ভাবল
এই শুরু হলো বিদেশের খাবার। এখন আর ইচ্ছে করলেই মায়ের রান্না খাবার পাওয়া যাবে না
কিংবা মাকে জ্বালাতনের জন্য বলাও যাবে না যে এটা খাব না ওটা খাব না। এখানে যা
পাওয়া যাবে তাই খেতে হবে।
খেয়ে দেয়ে ম্যানেজারের সাথে আলাপ করল
কোথা থেকে কি কিনতে হবে। ম্যানেজার বলে দিল এখান থেকে পপলার টিউব স্টেশনে গিয়ে
একটা করে রিটার্ন টিকেট নিয়ে হোয়াইট চ্যাপেল চলে যাও ওখানে যেয়ে ব্রিকলেন বা
হোয়াইট চ্যেপেল থেকে তোমার যা খুশি কিনে আন।
ওরা হাঁটছে আর কথা বলছে। জিজ্ঞেস করে
করে পপলার টিউব স্টেশনে এসে ম্যানেজারের কথা মত তিনটা অল্ডগেট ইস্ট রিটার্ন টিকেট
নিয়ে সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেনে উঠে পরল। অল্ডগেট ইস্ট নেমে টিউব থেকে বের হয়ে আবার
জিজ্ঞেস করে করে ব্রিকলেনে চলে এলো। কথায়
কথায় মার্কেটের নাম দেখার সুযোগ পায়নি। প্রায় সব দোকান সুন্দর ছিম ছাম সাজানো
গুছানো। লন্ডন শহরের দোকান পাট! এগুলি কি আর আমাদের ঢাকা শহরের দোকানের সাথে তুলনা
করা চলে? কিছু কিছু রাস্তার নাম বাংলায় লেখা, ব্রিকলেন এমনি আরও কিছু। রাস্তায়ও প্রচুর এশিয়ান
এবং বাঙালি বলেই মনে হলো যদিও কারো সাথে কথা বলেনি এমনিই চেহারা দেখে যা মনে
হয়েছে। দোকান পাট সব বাইরে থেকে দেখছে। বিচিত্র সব মানুষ গিজ গিজ করছে। বিভিন্ন
রকমের পোশাক, বিভিন্ন চেহারা। ইংরেজ দেশ বলে যে সবাই ইংরেজ
তা নয় অনেক বিদেশী দেখে একটু বিস্মিত হলো। এটা একটা আন্তর্জাতিক শহর বলে নানান
জাতের নানান রঙের মানুষ থাকবেই। সবাই পায়ে হেঁটে এসেছে। মার্কেট এলাকায় কোন গাড়ি
নেই, সম্ভবত গাড়ি পার্কিং এলাকায় রেখে এসেছে
নয়ত টিউবে এসেছে।
নিশাতরা বাইরে থেকে কাচের দেয়াল দিয়ে
দেখল একটা দোকানে কিছু ঘড়ি ক্যামেরা সাজানো রয়েছে এই দোকানে ঢুকে পরল। বিভিন্ন
ডিজাইনের বিভিন্ন সাইজের সেলফে নানা রকম জিনিস সাজিয়ে রেখেছে। প্রতিটা জিনিসের
সাথে কাগজের একটা কার্ডের মত আছে যাতে ওই জিনিসের বিবরণের সাথে দাম লেখা রয়েছে।
যেখানে ক্যামেরা রয়েছে ওখানে গেল,
ইয়াশিকা, অলিম্পাস, ক্যানন, পেনটেক্স নানা কোম্পানির তৈরি নানা মডেলের
ক্যামেরা। এর মধ্যে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা দেখল তাতে যে দাম লেখা রয়েছে তাতে আজ
সকালে স্টেনলি যে টাকা দিয়েছে তার চার ভাগের এক ভাগেই হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকে একটা
ইয়াশিকা ক্যামেরার খুব শখ।
মেঝ মামাকে দেখেছে ইয়াশিকা
ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে। ভাবনায় পরে গেল এতো টাকা দিয়েছে! কিনব না কি? থাক দেখি আগে জাহাজে যাই আরও কিছু দিন যাক পরে
কেনার অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে,
কোথায় কত টাকা লাগে না
লাগে তা না জেনে খরচ করা উচিত হবে না। হঠাৎ কোন প্রয়োজন হলে কে তাকে টাকা দিবে? এখানে তাকে কে চিনে? কার কাছেই বা হাত পাতবে নানা রকম সাত পাঁচ ভেবে কেনার ইচ্ছা বাদ দিল।
দেখতে এসেছি দেখি কালই তো আর চলে যাচ্ছি না। দেখতে দেখতে এক জায়গায় দেখে নানা
ধরনের অলংকার সুন্দর করে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আঙ্গিকে নানা ধরনের। দেশে
অলংকারের দোকান দেখেছে কিন্তু সে তো এর কাছে কিছুই নয়। এখানে হিরা বসানো, সাদা এবং গোলাপি মুক্তা বসানো কত রকমের ডিজাইনের। আবার একটা দেখল সাদা স্বর্ণ, এটা আবার কি? স্বর্ণ কি সাদা হয় নাকি? আগে তো কখন
দেখিনি! এর দাম হলুদ স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশী। প্রতিটির সাথেই স্বর্ণের পরিমাণ, কি পাথর বা কত ক্যারেটের হিরা আছে দাম কত সব লেখা।
নিরুর কথা মনে হলো। নিরু কি আমার হবে? আমি কি নিরুর
জন্য এসব কিনতে পারব? আমার যদি এগুলি কেনার মত অত টাকা হয় তা
হলে সব কিনে এক দিন নিরুকে অবাক করে দিবো, একটা একটা করে পড়িয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখব। এগুলি পড়লে ওকে কেমন দেখাবে? হঠাৎ করে এক বিদেশীর সাথে ধাক্কা লেগে নিশাতের নিরু
স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, সরি বলে সরে এলো।
কোথায় কেন যেন এসেছে, ও হ্যাঁ এই তো দোকানে। এর পরে গেল ঘড়ির কাছে। ওরে
বাব্বা এতো দাম! অবাক হয়ে গেল,
এই দাম দিয়ে কারা কিনে
এগুলি? তার হাতে আগে কখন ঘড়ি ছিল না যে ঘড়ি
রয়েছে সেটা মামা যে টাকা দিয়েছিল সে টাকা দিয়ে চিটাগাং থেকে একশ বিশ টাকায় কিনেছে।
কত রঙ বেরঙ্গের ঘড়ি, কোনটা স্বর্ণের সংখ্যা, স্বর্ণের ডায়াল, স্বর্ণের চেইন স্টেনলি যা দিয়েছে তাতে কুলায় না এমন সব দাম আবার ওই
টাকা দিয়ে বিশটাও কেনা যায় এমনও আছে। হবেই তো এদের পকেটে আর ব্যাঙ্কে কত টাকা। না
বাবা আমার হাতে যা আছে এই যথেষ্ট শুধু সময় দেখা এই তো, আর কি হবে? আমাকে যে নিরুকে পেতেই হবে ওর জন্য আমার
অনেক টাকার দরকার হবে। বাড়িতে মা বাবা, ভাই বোন এরা
তো আমার পাঠান টাকার পথ চেয়ে রয়েছে। নিরুকে আনতে হলে অনেক টাকা জমাতে হবে, অনেক ত্যাগ করতে হবে, অনেক সহ্য করতে হবে। কাজেই এসব দেখে মন বিভ্রান্ত করা যাবে না। কিছু না
বলে চলে যাওয়া নিরুর মুখ কিছুতেই ভুলতে পারছে না। নোমানের কথার খেই ধরে নিরু শুধু
মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া একটা কথাও বলেনি। পরে এখানে আসার আগে বীণা আপার
বাড়িতে শুধু অপেক্ষা করবে বলে বলেছে, কিন্তু এর
মধ্যে নিশাত যাবার আগে যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে? অন্য কিছু মানে নিরুর বাবা যদি অন্য কোথাও বিয়ে
দিয়ে দেয়! তাহলে কি নিরু পারবে তাকে সত্য কথাটা বলতে? না না এ হতে পারে না। নিরু ঢাকা লালমাটিয়া কলেজে যখন ভর্তি হয়েছে তাহলে
আর সহসা বিয়ের পরিকল্পনা মাথায় নেই বলেই মনে হয়। তবুও মনে একটা কিন্তু জেগেই রইল।
ভুল করেছে মস্ত ভুল! অন্তত বীণা আপাকে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে এলে পারত। এখানেও কিন্তু!
কি ইঙ্গিত দিত? কি বলত? ওর এখন কি সঙ্গতি আছে?
চলেন এনাম ভাই, সালেক ভাই চলেন দেখার কোন শেষ নেই, এর চেয়ে বাইরে দেখি। কেনাকাটা যা করার পরে করব!
চলেন, তাই ভাল
চলেন, সিঙ্গাপুরে দেখেছি এখানের চেয়ে অনেক কম দাম
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সিঙ্গাপুর ডিউটি ফ্রি দেশ। কেনাকাটা করলে ওখান থেকেই করবেন কিংবা দুবাই
থেকেও করতে পারেন এই দুই দেশে কোন ডিউটি নেই একেবারে ট্যাক্স ফ্রি দেশ
ও আচ্ছা, বুঝেছি মানে ওখানে কোন কাস্টম ডিউটি নেই, তাই না?
হ্যাঁ, নিশাত ভাই কিছু খাবেন?
কি খাব, চলেন একটা করে কোক নেই, সবাই হাঁটছে
প্রায় সবার হাতেই দেখছি কিসের ক্যান একটা। আমরা আর বাদ থাকি কেন, চলেন ওইতো ওই দোকান ওই যে সামনে বাম দিকে।
কোক কিনে সবাই হাঁটছে আর একটু একটু করে
চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ সালেক বলল
দেখছেন ওই যে সিনেমা হল!
হ্যাঁ তাই তো, হিন্দি সিনেমা চলছে মনে হয়, চলেন তো দেখি, যদি হিন্দি সিনেমা হয় তা হলে দেখবেন?
হ্যাঁ দেখব না মানে, জানেন সিঙ্গাপুরে শোর পাস পেলেই হিন্দি সিনেমা
দেখতাম, চলেন।
চলেন, আমি উর্দু হিন্দি সব জানি, আমার কোন
অসুবিধা নেই!
একটু এগিয়ে হলের সামনে দেখে হেমা মালিনি
আর ধর্মেন্দ্রের ছবি চলছে। টিকেটের দাম খুবই কম, মাত্র এক পাউন্ড। ওরা তিন জনে তিনটা টিকেট নিয়ে দেখে আরও কিছুক্ষণ পরে
শো শুরু হবে। এই ফাঁকে বাইরে বের হয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। সময় মত ফিরে এসে
হলের ভিতর যেয়ে বসল। একে বারে আমাদের দেশের মত ব্যবস্থা। নিশাত কখনো ভারতের হিন্দি
সিনেমা দেখেনি। করাচীতে থাকা সময়ে উর্দু সিনেমা দেখেছে। রাত নয়টায় সিনেমা শেষ হলে
হল থেকে বের হয়ে আবার টিউবে করে পপলার এসে বাকি পথে হেটে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে
শুয়ে পরল। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা!
পরদিন আবার সারা দিন হেঁটে যত দূর যেতে
পারে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে নিলো।
১০।
পরদিন সকালে সাড়ে আটটার দিকে রুম
সার্ভিস ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, হ্যাঁ গুড
মর্নিং।
ওপাশ থেকে স্টেনলির কণ্ঠে গুড মর্নিং
ভেসে এলো। নিশাত, কি খবর তোমাদের, কেমন আছ?
হ্যাঁ ভালো আছি সেদিন সিনেমা দেখলাম
এদিক ওদিক বেড়ালাম ভালোই কাটছে।
বেশ ভালো করেছ, জায়গা চিনে নিয়েছ। আচ্ছা শোন তোমাদের জাহাজ চলে এসেছে আজ দুপুর দুইটায়
তোমরা রেডি হয়ে থেক এন্ড্রু গিয়ে তোমাদের জাহাজে পৌঁছে দিয়ে আসবে, মনে থাকবে?
হ্যাঁ মনে থাকবে না কেন?
তা হলে এখন রাখি, সময় মত রেডি হয়ে থেক।
ঠিক কাটায় কাটায় দুপুর আড়াইটায় সে দিনের
সেই ড্রাইভার এসে হোটেলের গেটে গাড়ি রেখে ভিতরে ওদের দেখে বলল,
ও, তোমরা রেডি হয়ে বসে আছ, বেশ! চল
গাড়িতে ওঠ।
সবাই যার যার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠার পর
গাড়ি ছেড়ে দিল। টেমস নদীর পাড় ঘেঁসে যে রাস্তা গেছে ওই রাস্তায় মিনিট পাঁচেকের
মধ্যে জেটির পাড়ে একটা ছোট অফিসের মত ঘরের পাশে গাড়ি রেখে ওদের সিডিসি গুলি চেয়ে
নিয়ে বলল আমার সাথে মালামাল নিয়ে আস।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।