বেলা শেষের গান-২
৩।
এবার একটু পিছন ফিরে দেখি কে এই হাসান
সাহেব, কি তার পরিচয়। হাসান
সাহেবের বাবা এক জন ছোট খাট স্বর্ণের ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বর্ণের ব্যবসায়ী বলতে যা
বোঝায় আসলে ঠিক তা না। কর্মকারেরা যেখানে নানা গহনা তৈরি করে সেখানে দিনের শেষে ঘর
ঝাড়ু দিয়ে আবর্জনার স্তূপ জমা করে রাখে এতে দিনের স্বর্ণ কাটা ছেড়া, ঘসা মাজা
করতে বা হাতে নারা চারা করতে স্বর্ণের যে অণু পরমাণু বা ছোট সামান্য ক্ষুদ্র
কণা যা ছিটে পরে সে গুলি জমে থাকে। ওই গদি ঝারা আবর্জনা কিনে সেগুলি থেকে নানা
প্রক্রিয়া করে তা থেকে স্বর্ণ আলাদা করে নিয়ে কুমিল্লার নিজের একটা দোকানে কিছু
সামান্য অলঙ্কার বানাতেন এ ছারা কিছু জমি জমা ছিল ওতেই মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই চলে
যেত।
ঢাকার অদূরে ধামরাই থানার কাছেই এক
বর্ধিষ্ণু গ্রামের পাঠশালা শেষ করে একটা বৃত্তি পেয়ে মানিকগঞ্জে এসেছিলেন হাই
স্কুলে পড়ার জন্য। এখানেও ভাল ফল পেয়ে ভর্তি হলেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে।
বাড়ি থেকে বাইরে এসে ছোট এই মফস্বল শহরে পড়া লেখার ফাকে ফাকে এতো দিনে তিনি বেশ
স্বপ্ন দেখতে শিখে ফেলেছেন অনেক উঁচু স্বপ্ন। চলনে বলনে আচরণে ছিলেন অসম্ভব
মার্জিত। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতা, গায়ের
রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায়
সামান্য কুঞ্চিত চুল, গলার
কণ্ঠ এবং কথা বলার ভাব ভঙ্গি ছিল । যে কেউ তার সাথে এক মুহূর্ত আলাপ করলে তাকে
পছন্দের তালিকার শীর্ষে বসিয়ে দেয়ার মত। শিক্ষার পাশা পাশী কিছু কিছু সামাজিক
নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। এমন কি স্কুল কলেজ ছুটির সময়
যখন গ্রামে যেতেন তখন থেকেই নিজ গ্রামে গড়ে তুলেন একটা তরুণ সঙ্ঘ যেখানে গ্রামীণ
নানাবিধ উন্নয়ন এবং গ্রামের অন্যান্য ছেলে মেয়েদেরকে তার মত করে উন্মুক্ত ভাবনা
ভাবতে এবং স্বপ্ন দেখতে শেখাবার একটা পথ বের করেছেন। ছোট শহর, বড় শহরে কোথায় কোন কলেজ,
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কি পড়ান হয়,
কি নিয়ে পড়াশুনা করলে ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, নিজের ভাগ্য কি ভাবে নিজে গড়ে নিতে হয় এই সব
ধ্যান ধারনা সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে একটা আত্ম তৃপ্তি পেতেন।
সবচেয়ে বড় কথা গ্রামের উঠতি বয়সের
ছেলেদের স্বপ্ন দেখতে শেখাতেন। ইচ্ছে করলেই কি আর স্বপ্ন দেখা যায়? স্বপ্ন দেখতে হলে যে সাধের সীমানাটা ছড়িয়ে দিতে
হয় অনেক দূরে আকাশের ওই দূর প্রান্তে যেখানে দৃষ্টিসীমা পৌছাতে পারে না সেখানে। কে
কতদূর যাবে সে কথা তার স্বপ্ন দেখার আকাঙ্ক্ষা দেখেই কিছুটা অনুমান করা যায়।
হাসান সাহেব স্থানীয় সুয়াপুর
হাইস্কুলেই তার উচ্চ মাধ্যমিক শুরু করলেও বোর্ডে নাম রেজিস্ট্রি করার আগে তার
সুদূরের স্বপ্ন সফলের আশায় অজ গ্রামের পরিবেশ ছাড়িয়ে তখনকার মহকুমা সদর মানিকগঞ্জে
মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মেধা,
মিষ্টি স্বভাব আর পড়াশুনার প্রতি একাগ্রতা সবার দৃষ্টিতে
এলেও সবচেয়ে যিনি কাছে টেনে নিলেন তিনি এই স্কুলেরই হেড স্যার মীর
আক্কাস আলি। আক্কাস সাহেব অনেকদিন ধরেই এই স্কুলের হেড মাস্টারের
দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রতি বছরেই তার বেশ কয়েকজন ছাত্র বৃত্তিও পায় আবার যারা
স্কুল ফাইনাল দেয় তাদের শতকরা ৯০ জনই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে জেলা সদর ঢাকা শহরের
নামি দামি কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়। এক এক করে প্রায় প্রতিটি
ছাত্র ছাত্রীর উপরেই তার সজাগ দৃষ্টি। কে কি করছে,
কোথা থেকে এসেছে, কার বাবা কি করে সবই তার মুখস্থ।
হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী কেউই তার চোখের আড়াল হতে পারে না। তার একটাই স্বপ্ন, মানিকগঞ্জের ছোট্ট মহকুমা সদরের স্কুলটাকে ঢাকা,
না না শুধু ঢাকা নয় সারা বাংলার সেরা স্কুল হিসেবে দাড়
করানো। মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে স্কুল ছুটির পর নিজেই আলাদা করে ক্লাস নিয়ে
যার যেখানে দুর্বলতা সেগুলি পূরণ করে দেয়া তার ব্রত। বাড়িতে ফিরে গিয়েও ক্লান্তি
নেই। নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে বসে। দীপা আর নিপা দুই বোন,
আক্কাস সাহেবের দুই মেয়ে। মাত্র এক বছরের ছোট বড় হলেও পড়ে
একই ক্লাসে আর দুইজনেই ক্লাস ফাইভ থেকে বৃত্তি পেয়েছে সামনে এইট থেকেও পাবে এমনই
তাদের দুই বোনের মেধা। হবে নাই বা কেন? যারা এমন চৌকস বাবার মেয়ে আর শুধু বাবার কথাই-বা বলছি কেন মাও কি কম? সেও একই স্কুলের শিক্ষিকা, খাদিজা বেগম।
হাসান সাহেব সুয়াপুর স্কুল থেকে এখানে
আসার আগে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলেন। বৃত্তি পাবে জেনে ওই স্কুলের শিক্ষকেরা
কেওই তাকে সার্টিফিকেট দিতে সম্মত ছিল না কিন্তু ছেলের জেদের কাছে তারা তাদের মতে
স্থির থাকতে পারেনি। সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উপরে ওঠার স্বপ্নে বিভোর ছেলে নাওয়া
খাওয়া ছেড়ে এমন জেদ ধরল যে শেষ পর্যন্ত তাদের বাধ্য হয়েই বিদায় দিতে হলো।
সার্টিফিকেটটা হাতে দেবার সময় হেড স্যার মাখন বাবু বলেছিলেন দেখ বাবা আমরা তোমাকে
ছাড়তে চাইনা কিন্তু শুধু তোমার জন্যেই টিসি দিতে বাধ্য হলাম তবে যেখানেই যাওনা কেন
ঈশ্বর যেন তোমার মঙ্গল করেন আর বাড়ি এলে আমাদের সাথে এসে দেখা করে যেও। আচ্ছা
স্যার, আসব, আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন। বলে বের হয়ে বাড়ি এসে
নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখেছিল। মা বারবার করে বলছিল অত দূরে যেয়ে কি এমন লেখাপড়া
করবি যে এখানে হবে না! এখানে কি কেও লেখা পড়া করে না?
ওখানে যেয়ে থাকবি কোথায়,
খাবি কি? কে
তোর রান্না করে দিবে?
অতশত তোমার বুঝে কাজ নেই মা, আমাকে খুশি মনে যেতে দাও আর আমার জন্য দোয়া কর।
৪।
মডেল স্কুলে ভর্তি হবার কিছুদিন পরে
যখন তার বৃত্তি পাবার সংবাদ জানতে পারল তখন আক্কাস সাহেব খুশি মনে নিজে চেয়ার চেড়ে
এসে হাসানের ক্লাসে ঢুকে টিচারের অনুমতি নিয়ে সংবাদটা জানাল। এর মধ্যে তার নিজের
স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্র বৃত্তি পেয়েছে এবং তা এরা খুব ধুমধাম করে উদযাপন
করেছে। তবে হাসানের স্কুল দূরে থাকায় এ সংবাদ একটু দেরিতে পৌঁছেছে। হাসানকে তার
ক্লাস শেষ হলে তার রুমে গিয়ে দেখা করার কথা বলে বের হয়ে গেলেন।
স্যার আসতে পারি? –কে? স্যার আপনি আসতে বলেছিলেন। ও আচ্ছা তুমি! আস আস। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বুকে
জড়িয়ে ধরলেন। তোমার মত ছেলেই আমার চাই। তুমি প্রতিদিন সকালে আমার বাসায় যাবে, এখন থেকে আমি তোমাকে পড়াব। আচ্ছা স্যার। আমার
বাসা চেন? ঐযে পুকুর পাড়ে বড় টিনের
ঘর..................আমি চিনি স্যার! চেন?
বেশ, তাহলে
এসো।
পরদিন সকালে বই খাতা নিয়ে হোস্টেল থেকে
বের হয়ে পায়ে পায়ে পুকুর পাড় দিয়ে এসে কাঠের গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকেই দেখে কি
সুন্দর ফুলের বাগান, পার
হয়ে বড় ডাক বাংলো ধরনের বাড়ির বাইরের বারান্দায় একটা টেবিলে হেড স্যার আর তার সাথে
দুই পাশে দুই মেয়ে বসে পড়ছে। আস্তে আস্তে হাসান দরজার পাশে এসে দাড়াতেই পায়ের শব্দ
শুনে ঘুরে তাকিয়ে হাসানকে দেখে আরে আস আস! এত দেরি করলে কেন? বস বস এইযে এখানে বস। টেবিলের ওপাশের খালি
চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন। সংকোচ ভরা ভীরু পায়ে হাসান আস্তে আস্তে স্যারের দেখান
চেয়ারে বসল। বস। এরা আমার মেয়ে এ হলো দীপা
আর এ নিপা। শোন এ হচ্ছে হাসান আমাদের স্কুলে নতুন এসেছে,
জানিস এ কিন্তু বৃত্তি নিয়ে এসেছে। হাসান একটুখানি মাথা
ঘুড়িয়ে দুই পাশে দুই বোনকে দেখল। একজন ফর্সা ডান চোখের পাশে ছোট একটা তিল, লাল সাদা ছাপা ফ্রক পড়নে আর একজন তার চেয়ে একটু
চাপা গায়ের রঙ তবে সুন্দর ফ্রকে বেশ লাগছে দেখতে কিন্তু কে বড় আর কে ছোট বোঝার
উপায় নেই। এমন সময় ফর্সা মেয়েটা বলে উঠল এই আপু পেন্সিলটা একটু দে না! তাই শুনে
বুঝল তাহলে এই ফর্সা জনই ছোট আর এর নামই নিপা।
প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে ক্লাসের পড়ার
বাইরে ইংরেজি আর অংক দেখিয়ে দিলেন আক্কাস সাহেব। হাসান বের হবার জন্য উঠে দাঁড়ালো, স্যারের দিকে তাকিয়ে,
তাহলে আমি এখন আসি। ক্লাসে যেতে হবে। হ্যাঁ ক্লাসে যাবে
কিন্তু নাশতা করবে না? একটু
বস। দীপা আর নিপা ভিতরে চলে গেল। এমন সময় খাদিজা বেগম ট্রেতে করে রুটি আর হালুয়া
এনে হাসানের সামনে নামিয়ে দিল। নাও বাবা খেয়ে নাও। ও! তাহলে ইনি স্যারের স্ত্রী!
আগেই স্কুলে দেখেছে কিন্তু বুঝতে পারেনি। দীপা আর নিপাকেও দেখেছে। আজ সবার সাথে
পরিচয় হলো। সেদিনের মত নাশতা খেয়ে বের হয়ে এলো।
এর পর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল। সকালে
ঘুম থেকে উঠে এখানে আসা, পড়া
আর নাশতা খাওয়া। দুপুরে এবং রাতে হোস্টেলেই খেতে হয়। অন্যান্য যারা তার মত দূর
থেকে শিক্ষিত হবার জন্য, স্বপ্ন
পূরণের জন্য এখানে এই স্কুলে এসেছে তারা সবাই। তবে সবার ভাগ্যে হেড স্যারের বাসায়
নাশতার ব্যবস্থা হয় না। হাসানের হয়েছে। তার স্বপ্ন যে অনেক বড়, সিঁড়ি বেয়ে অনেক উপরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা, ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নেয়ার বাসনা। [চলবে]
[নওরোজ সাহিত্য সম্ভারের প্রকাশনায় আগামী ২০১৭ বই মেলায় প্রকাশের অপেক্ষায়।]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।