১০২।
পরের
দিন, তার পরের দিন এবং তার
পরেও এই ভাবে বেশ সুখেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ফাঁকে ফাঁকে ময়না ভাই আর দেলুর
সাথে গল্প। আজ ময়না ভাই আসেনি দেলু কিচেনে ব্যস্ত। জানালার পর্দা সরানো রয়েছে, বাইরে ঝুর ঝুর করে
স্নো পরছে ভিতরে ইন্ডিয়ান হিন্দি জ়োবায়দা সিনেমার গান বাজছে। রেস্টুরেন্ট খুলেই
মিউজিক বাজাতে হয়, এদেশের
এই রীতি। সাধারণত এশিয়ান রেস্টুরেন্ট গুলিতে নিজ নিজ দেশের মিউজিক বাজায়। রাশেদ
সাহেব বসে বসে স্নো দেখছেন। কখন শুরু হয়েছে দেখেনি। জীবনের প্রথম স্নো দেখছে। দেখতে
দেখতে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছেন। অপূর্ব দৃশ্য, চারিদিকে সাদা, সাদা, আর সাদা, শুধু সাদা। দালান
কোঠার লাল কালো টালির চাল সাদা, গাছপালার ডাল সাদা, দূরে ওই দুই দালানের ফাঁকে
ক্রিকের ওপাশের পাহাড় সাদা, পাহাড়ের চূড়া সাদা, ক্রিকের পানি সাদা, বাসের যাত্রী ছাউনির
চাল সাদা,
দালান
কোঠার জানালার কার্নিশ সাদা, রাস্তা সাদা, রাস্তা দিয়ে দুই একটা গাড়ি যা যাচ্ছে তার সারা দেহ সাদা, আকাশ সাদা, সমস্ত পৃথিবী সাদা।
ঝির ঝির স্নো জানালার কাচে এসে লাগছে আবার নিমেষেই গলে যাচ্ছে দেখে দেখে দেশের কথা
মনে হয়েছে। ওখানে এই ভাবে জানালায় বসে বৃষ্টি দেখেছি, সাথে চানাচুর, মুড়ি কিংবা ছোলা ভাজা, চা। আর এখানে দেখছি
স্নো। উঠে গিয়ে কিচেন থেকে এক কাপ চা এনে বসলেন।
রাস্তায়
মানুষজন নেই বললেই চলে। এখানে প্রায়ই স্নো পরে। শিমুল গাছে শিমুল তুলা যেমন পেকে
ফেটে গেলে বাতাসে উড়ে ঝিরঝির করে মাটিতে নেমে আসে তেমনি ঝির ঝির করে সারা দিন স্নো
পরছে। প্রায় দুপুরে কাজ শেষ করে তিনজনে একসাথে বাইরে হাঁটতে বের হোত। যেদিন
স্নো হয়
কিন্তু রাস্তায় বরফ জমেনি সেদিন ছাতা নিয়ে বের হতেন। রাস্তায় বরফ জমে গেলে আর হাঁটা
যায়না। দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখতেন। রাস্তার পাড়ে একটা বিল্ডিং দেখলেন প্রায়
দুইশ চৌত্রিশ বৎসর আগের তৈরি। রাশেদ সাহেব যা ভেবেছিলেন তাই, তবে রাশেদ সাহেব যত
পুরনো শহর ভেবেছিলেন তার চেয়ে এটা অনেক বেশী পুরনো। সেদিন টেসকোতে যাবার
সময় একটা স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছে প্রায় চারশো বছর আগের তৈরি, তাহলে এই শহরের বয়স
তার চেয়েও অনেক বেশি। এটা একটা টুরিস্ট শহর এখানে যত মানুষ দেখা যায় তার চার ভাগের
তিন ভাগই টুরিস্ট এবং অধিকাংশই আমেরিকান। সঙ্গত কারণেই দোকান গুলি পৃথিবীর বিভিন্ন
জায়গা থেকে সংগ্রহ করা খুব সুন্দর সুন্দর সৌখিন জিনিষ পত্রে সাজানো, অনেক দোকান। তবে
দেলু বললো
এখন শীত বলে টুরিস্ট কম, টুরিস্ট বাড়বে সামারে তখন এইটুক শহর লোকে গিজ গিজ করে।
ওদের সাথেই একদিন হাঁটতে হাঁটতে লাইবেরি দেখে এসেছে, কাছেই, বেশি দূরে না। সামনের অফের দিন
যাবে। লাইবেরির সাথেই টাউন হল সেখানে মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় যদিও তা রাশেদ
সাহেবদের নাগালের বাইরে। পঞ্চাশ পাউন্ডের নিচে কোন টিকেট নেই, উপরে দুইশ পাউন্ড
পর্যন্ত।
১০৩।
রাত এবং
দিন যেমন একের পর এক আসে যায়, সুবিধা অসুবিধাও তেমনি। এখানে গ্লাসগো ছাড়া হালাল কোন মাংস
পাওয়া যায়না,
বাংলাদেশের মাছ কল্পনাই করা যায়না। এক
সপ্তাহ হয়েছে এসেছে এর মধ্যে দুপুরে এবং রাতে শুধু চিকেন, কখনো আলু দিয়ে, কখনো পাতা কফি দিয়ে।
সকালে ব্রেড,
মার্জারিন
বা মাখন,
ডিম আর
চা, এই ভাবে চলেছে এবং যত
দিন থাকবে এইভাবেই নাকি চলবে। হঠাৎ যদি কখনো মালিক লন্ডন থেকে ফেরার পথে ভেড়ার
মাংস আর কিছু মাছ যদি মনে করে এবং দয়া করে আনে তবে তা চোখে দেখা যেতে পারে নয়তো
কোন উপায় নেই। ওদিকে রুমে হিটার চলে রাত বারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত মাত্র দুই
ঘণ্টা। আবার বেসিনে বা গোসলের জন্য গরম পানি নেই, সকালে মুখ ধোয়া ওজু করা সবই বরফ
ঠাণ্ডা পানি দিয়েই করতে হচ্ছে। তবে, সেদিন ইলেকট্রিক জগে পানি গরম করে সাত দিন পর গোসল করতে
পেরেছে। রুম হিটারে টাইমার সেট করা বলে রাত দুইটায় একা একাই বন্ধ হয়ে যায়। মোটা
মুটি ঘণ্টা দুয়েক উষ্ণ থাকে তারপর থেকেই রুম ঠাণ্ডা হতে থাকে এবং ভোরের আগেই
স্কটিশ ঠাণ্ডার কামড়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রথম দুই দিন খুব কষ্টে রাত পার করেছে, কিছুক্ষণ পর পরই গা
কেঁপে কেঁপে উঠেছে। এর পর থেকে তার সাথে যা ছিলো, গরম কাপড়, পায়ের মুজা, হাতের মুজা, মাফলার সব কিছু পরে
নিয়ে দুইটা লেপ সেলাই করে গায়ে দিয়ে কাটাতে হয়েছে। রাশেদ সাহেব কখনও গায়ে লেপ
রাখতে পারেনা,
হাত পা
ছড়িয়া ফেলে দেয়। আগে মা ঠিক করে দিতেন, পরে মনি আসার পর তার মনি গায়ের লেপ ঠিক করে দিত। এখানে মনি
নেই, কে লেপ উঠিয়ে দিবে? তাই, দুইটা লেপ একত্রে
সেলাই করে এক পাশে আর পায়ের দিকে বিছানার ম্যাট্রেসের সাথে ফিতা বানিয়ে বেঁধে
নিয়েছিলেন যাতে পড়ে না যায়। মালিকের ইলেকট্রিক আর গ্যাস বিল বাঁচাবার জন্য হিটার
চালানো হয়না। তবে স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে ভালো যেটা রাশেদ সাহেব দেখেছেন তা হলো পানি, এখানকার পানি অতি
সুস্বাদু। প্রথম বারে পানি খেয়েই ভেবেছেন এই জন্যেই মনে হয় স্কটল্যান্ডের স্কচ
হুইস্কি পৃথিবীর বিখ্যাত হুইস্কি।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার মতামত জানতে আগ্রহি।
আশা করি অতি শিঘ্রই আপনার মন্তব্য বা জিজ্ঞাসার জবাব পাবেন।